Ajker Patrika

আশ্রয়কেন্দ্রে স্থান নেই আরবদের, ইসরায়েলে অ-ইহুদিরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৮ জুন ২০২৫, ১১: ২৩
আশ্রয়কেন্দ্র অবস্থান করছেন ইসরায়েলিরা। ছবি: এএফপি
আশ্রয়কেন্দ্র অবস্থান করছেন ইসরায়েলিরা। ছবি: এএফপি

সামার আল রাশেদ, ইসরায়েলে বসবাসরত এক ফিলিস্তিনি। গত শুক্রবার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে জিহানকে নিয়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টেই ছিলেন তিনি। হঠাৎ শুনতে পান সাইরেন। তড়িঘড়ি মেয়েটিকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটে যান তিনি। মেয়েটা যাতে ভয় না পায় তাই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। আর এতেই বাধে বিপত্তি। আরবি ভাষা শুনে মুখের ওপর আশ্রয়কেন্দ্রের দরজা বন্ধ করে দেন তাঁরই প্রতিবেশী এক ইসরায়েলি।

২৯ বছর বয়সী সামার বলেন, ওই ইসরায়েলির আচরণে তিনি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কাতারি সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘আমি হিব্রু ভাষায় তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সে ঘৃণাভরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল—এই আশ্রয়কেন্দ্র তোমাদের জন্য নয়।’

আরেক ফিলিস্তিনি মোহাম্মাদ দাবদুব বাস করেন ইসরায়েলের হাইফায়। ৩৩ বছর বয়সী দাবদুস কাজ করেন একটি মোবাইল ফোন মেরামতের দোকানে। তিনি জানান, অন্যান্য দিনের মতো গত শনিবারও দোকানে মোবাইল ফোন মেরামত করছিলেন। হঠাৎ একযোগে সব ফোনে সতর্কবার্তা বাজতে শুরু করে। হাতে যে কাজটি ছিল সেটি শেষ করে দ্রুত দোকানের পেছনে থাকা একটি আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যান। কিন্তু ততক্ষণে একটু দেরি হয়ে গেছে। আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে দেখতে পান দরজায় তালা ঝুলছে।

তিনি বলেন, ‘আমি কোড দিয়ে চেষ্টা করলাম কিন্তু কাজ হলো না। অনেকক্ষণ দরজায় কড়া নাড়লাম। হিব্রু ভাষায় ডাকাডাকি করলাম, কোনো সাড়া পেলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যে কাছেই কোথাও একটি ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরণ হলো। রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল ভাঙা কাচ। ধরেই নিয়েছিলাম আমি মারা যাব।’ একটু থেমে তিনি আবার বলেন, ‘কালো ধোঁয়ায় চারপাশ ছেয়ে গেল। চিৎকার-চেঁচামেচি-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। ১৫ মিনিট পর পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনতে পেলাম। আমার মনে হলো যেন ২০২০ সালে বৈরুতে বিস্ফোরণের অভিজ্ঞতা আবার জ্যান্ত হয়ে গেল আমার চোখের সামনে।’

শুধু সামার বা দাবদুব নয়, ইসরায়েলে বসবাসরত প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনির অভিজ্ঞতা একই রকম। ইসরায়েলের জনসংখ্যার প্রায় ২১ শতাংশই ফিলিস্তিনি নাগরিক। কাগজে-কলমে তাঁদের অধিকারের ব্যাপারে ইসরায়েল সরকার নিজেকে সচেতন বলে দাবি করে। তবে, বরাবরই প্রায় সব ক্ষেত্রেই বৈষম্যের স্বীকার হতে হয় এই ফিলিস্তিনিদের। আর এ ধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তা আরও প্রকট হয়ে ওঠে।

বাসস্থান, শিক্ষা, কর্মসংস্থা ও রাষ্ট্রীয় সেবাসহ নানা ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে কাঠামোগত বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন ইসরায়েলে বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা। ইসরায়েলের নাগরিকত্ব থাকা সত্ত্বেও তাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয়। ‘আদালাহ—দ্য লিগ্যাল সেন্টার ফর অ্যারাব মাইনরিটি রাইটস ইন ইসরায়েল’-এর তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলে ৬৫টিরও বেশি আইন সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক। ২০১৮ সালে পাস হওয়া ‘জাতি-রাষ্ট্র আইন’ (নেশন স্টেট ল) এই বৈষম্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। এই আইনে ইসরায়েলকে ‘ইহুদি জাতি-রাষ্ট্র’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সমালোচকদের মতে, এই আইন ইসরায়েলে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদকে বৈধতা দেয়।

সংঘাতের সময় ফিলিস্তিনি নাগরিকেরা প্রায়ই বৈষম্যমূলক পুলিশি নজরদারি ও বিধিনিষেধের শিকার হন। সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হতে হয় তাঁদের, বঞ্চিত করা হয় আশ্রয়কেন্দ্রে প্রবেশাধিকার থেকে। এ ছাড়া, যেসব শহরে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি জাতি-গোষ্ঠীর বসবাস প্রায় সমান, সেসব মিশ্র শহরে মৌখিক হয়রানির মতো ঘটনা ঘটে হরহামেশাই।

ইসরায়েলের সব নাগরিকেরই জননিরাপত্তামূলক সুবিধা—যেমন বোমা আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবহারের সমান অধিকার থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি শহর ও গ্রামগুলোতে ইহুদি জনপদের তুলনায় নিরাপদ আশ্রয়স্থলের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজে প্রকাশিত ২০২২ সালের স্টেট কম্পট্রোলারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর বসতিগুলোর ৭০ শতাংশেরও বেশি বাড়িতে নিরাপদ ঘর বা আশ্রয়কেন্দ্র নেই। যেখানে ইহুদি বসতির ক্ষেত্রে এই অনুপাত কেবল ২৫ শতাংশ। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসামরিক প্রতিরক্ষার জন্য ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত অঞ্চলের পৌরসভাগুলো তুলনামূলকভাবে কম বাজেট পায়। নতুন ভবন তো নির্মাণ করা হয়ই না, পুরোনো ভবনগুলোতেও প্রয়োজনীয় উন্নয়নকাজ করা হয় না।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হামলার পর বলেছিলেন, ‘ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের সব মানুষকে লক্ষ্য করে—ইহুদি এবং আরব উভয়কেই।’ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি মূলত ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন কিংবা বহির্বিশ্বে নিজেকে নিরপেক্ষ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। যুদ্ধ শুরুর আগেও রাজনৈতিক মত প্রকাশের কারণে ইসরায়েলি নাগরিকদের তুলনায় ফিলিস্তিনিদের বেশি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো পোস্টে শুধু রিয়্যাক্ট করার কারণেও কারও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অথচ অনলাইনে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে পাল্টা সহিংসতার ডাক দেওয়া অনেক পোস্টই সরকারি নজরদারিতে থাকে না।

এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের কাছে স্পষ্ট যে, কাগজে-কলমে তারা ইসরায়েলের নাগরিক, কিন্তু বাস্তবে এই রাষ্ট্রে বহিরাগত!

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সকালে পরীক্ষা, রাতেই ফল: সেই নিয়োগের তদন্তে কমিটি

চোখের সামনে খামেনির অন্তরঙ্গ মহল ফাঁকা করে দিচ্ছে ইসরায়েল

এপ্রিলে নির্বাচিত সরকার পাবে দেশ, এরপর চুপচাপ সরে যাব: প্রধান উপদেষ্টা

আমাদের হয়ে ‘নোংরা কাজটা’ করে দিচ্ছে ইসরায়েল: জার্মান চ্যান্সেলর

গোমস্তাপুরে পুলিশের লাঠিপেটায় আহত ১১ নারী: ওসি ও এসআই প্রত্যাহার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত