আজকের পত্রিকা ডেস্ক
সাল ১৯৫৯। চীনা সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নে ব্যর্থ তিব্বতিদের বিদ্রোহ। সে সময় রাতের অন্ধকারে তিব্বত ছেড়ে যান এক ভিক্ষু। তিনি আর কেউই নন, মালভূমিটির ১৪তম দালাই লামা তেনজিন গিয়াৎসো। বিশের কোঠার মাঝামাঝিতে তখন তাঁর বয়স।
তিব্বতের ওপর চীনের এই আগ্রাসন দেখে চুপ ছিল বিশ্ব। তিব্বতিদের সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিকতা আর ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব এসে পড়ে এই তরুণের কাঁধে। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, কিন্তু তাঁর ভেতরে ছিল অদম্য দৃঢ়তা।
এরপর কেটে গেছে কয়েক দশক। ভারতে নির্বাসনে থেকেও দালাই লামার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে তিব্বতের গণ্ডি ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বে। তিনি কেবল তিব্বতিদের আধ্যাত্মিক গুরুই নন, বরং মাতৃভূমি ফিরে পেতে চাওয়া এক জাতির আশা-ভরসার প্রতীক।
অহিংসার পক্ষে অটল অবস্থান নেওয়ায় ১৯৮৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন দালাই লামা। তাঁর দাবি স্পষ্ট, তিব্বতের পূর্ণ স্বাধীনতা নয়, বরং স্বশাসন ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার অধিকার।
কিন্তু বেইজিং বরাবরই তাঁকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে দেখে এসেছে। চীন-তিব্বত সম্পর্কের বহু দশকের জটিলতার কেন্দ্রে থেকেও দালাই লামা কখনো তাঁর শান্তিপূর্ণ পথচলা থেকে বিচ্যুত হননি।
এ বছরের জুনে ৯০ বছরে পা রেখে তিনি ঘোষণা দেন, তাঁর মৃত্যুর পর উত্তরসূরি অবশ্যই আসবেন। ছয় শতাব্দী পুরোনো এই বৌদ্ধপ্রতিষ্ঠান যেন থেমে না যায়, সে আশ্বাসেই যেন নতুন করে প্রাণ পান তাঁর অনুসারীরা।
জীবনের শেষ অধ্যায়ে দাঁড়িয়েও তিনি ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন তাঁর উত্তরাধিকার, তাঁর জাতি এবং এক শান্তিপূর্ণ পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে।
শৈশব ও নির্বাসনের শুরু
দালাই লামা ১৯৩৫ সালের ৬ জুলাই তিব্বতের বর্তমান সীমানার ঠিক বাইরে একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
কৃষক বাবা-মা তাঁদের এই নবজাতক ছেলের নাম দেন ‘লহামো ধোন্দুব’।
মাত্র দুই বছর বয়সে একদল বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও অনুসন্ধানী কর্মকর্তা তাঁকে পূর্ববর্তী ১৩ জন দালাই লামার পুনর্জন্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং বয়স চার বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়। তখনোই তাঁর নাম দেওয়া হয় ‘তেনজিন গিয়াৎসো’।
দালাই লামার শিক্ষা শুরু হয় এক বৌদ্ধ মঠে। সেখানেই কঠোর সাধনা ও অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে তিনি অর্জন করেন গেশে লহারাম্পা ডিগ্রি—বৌদ্ধ দর্শনে সর্বোচ্চ সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি।
১৯৫০ সালে তাঁর বয়স যখন ১৫, চীনের নবগঠিত কমিউনিস্ট সরকার তাদের সেনাবাহিনী নিয়ে প্রবেশ করে তিব্বতে। এরপর ১৯৫১ সালে চীন একতরফাভাবে তৈরি করে ১৭ দফা চুক্তি; যা তিব্বতকে চীনের অন্তর্ভুক্ত করার বৈধতা দেয়।
১৯৫৯ সালের ১০ মার্চ এক চীনা জেনারেল দালাই লামাকে আমন্ত্রণ জানান একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। কিন্তু তিব্বতের জনতার মনে গভীর শঙ্কা—একি কোনো চক্রান্ত? অপহরণ বা হত্যার আশঙ্কায় হাজারো মানুষ ভিড় করেন তাঁর প্রাসাদের সামনে।
সেই জনসমাবেশ রূপ নেয় বিক্ষোভে। চীনা সেনাবাহিনী নেমে আসে দমন-পীড়নে। প্রচণ্ড সহিংসতায় প্রাণ হারান বহু তিব্বতি। ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক অধ্যায়ে রচিত হয় নির্বাসনের সূচনা।
দালাই লামা রাতে ছদ্মবেশে তিব্বত ছেড়ে যান। এক সৈনিকের পোশাকে ভিড়ে মিশে যান তিনি। তাঁর কথায়, এই সিদ্ধান্ত আসে তাঁর ব্যক্তিগত দেবদূতের দিব্য বার্তা থেকে।
১৫ দিন ধরে কঠিন হিমালয় পেরিয়ে অবশেষে তিনি পৌঁছান ভারতের সীমান্তে। ভারত সরকার তাঁকে আশ্রয় দেয়। তাঁর নতুন ঠিকানা হয় উত্তর ভারতের হিমাচল প্রদেশ অঙ্গরাজ্যের ধরমশালা শহরে; যা পরিণত হয় তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের ঘাঁটিতে।
দালাই লামার সঙ্গে প্রায় ৮০ হাজার তিব্বতি পাড়ি জমান নির্বাসনে। তাঁদের অনেকে আশ্রয় নেন ধরমশালাতেই—যেখানে গড়ে ওঠে এক নতুন তিব্বত।
শান্তিতে-বিতর্কে দালাই লামা
নির্বাসনে এসেই তিব্বতের প্রাচীন সংস্কৃতি ও পরিচয় রক্ষার পাশাপাশি বিশ্বের দরবারে তিব্বতবাসীর দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন দালাই লামা।
তিনি জাতিসংঘের দ্বারস্থ হন, বারবার আহ্বান জানান তিব্বতবাসীর সুরক্ষার জন্য। তাঁর প্রচেষ্টাতেই ১৯৫৯, ১৯৬১ ও ১৯৬৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় একাধিক প্রস্তাব; যেখানে তিব্বতিদের মানবাধিকার রক্ষার দাবি জানানো হয়।
তবে তাঁর অবস্থান সব সময় ছিল মধ্যপন্থার দিকে—স্বাধীনতা নয়, বরং চীনের আওতায় থেকেই তিব্বতের জন্য প্রকৃত স্বশাসনের দাবি। এটি ছিল এক বাস্তববাদী ও অহিংস পথ, যা তিনি নিরলসভাবে অনুসরণ করে গেছেন।
১৯৮৭ সালে তিব্বতে হান চীনাদের বড় আকারের স্থানান্তরের বিরুদ্ধে লাসা শহরে প্রতিবাদের মধ্যে দালাই লামা পাঁচ দফা পরিকল্পনা প্রস্তাব করেন, যেখানে তিনি তিব্বতকে একটি শান্তিময় অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।
দমন-পীড়ন, নির্বাসন ও অপমান সত্ত্বেও দালাই লামা কখনো সরে আসেননি অহিংস পন্থায় প্রতিরোধ থেকে। এরই স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৯ সালে তাঁকে দেওয়া হয় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার।
নোবেল কমিটির ভাষায়, ‘যে জাতি বছরের পর বছর ধরে দুঃসহ নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তাদের নেতা হয়ে তিনি যে শান্তিপূর্ণ পথে থেকেছেন, তা এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত।’
বৈশ্বিক নানা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন দালাই লামা। ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের সাবেক সর্বোচ্চ যাজক (পোপ) প্রয়াত দ্বিতীয় জন পলের সঙ্গে একাধিকবার দেখা করেন তিনি।
দক্ষিণ আফ্রিকার ডেসমন্ড টুটুর সঙ্গে যৌথভাবে লেখেন একটি বই। তাঁর যাত্রাপথে পাশে পান হলিউডের রিচার্ড গিয়ার, মার্টিন স্করসেজি বা লেডি গাগার মতো সমর্থকদের।
তবে এই শান্তিপন্থী অবস্থান, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁকে খ্যাতি এনে দিয়েছে, তা কখনো কখনো হয়ে ওঠে তিব্বতের কিছু অংশের মানুষের হতাশার কারণ। তাঁরা মনে করেন, চীনের বিরুদ্ধে খুবই নরম ছিলেন দালাই লামা।
২০০৮ সালে চীনা শাসনের বিরুদ্ধে লাসায় সহিংস দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাবে, এতে বহু তিব্বতি প্রাণ হারান।
শান্তির দূত হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেলেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি দালাই লামার।
সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি ঘটে ২০২৩ সালে, যখন এক ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি এক শিশুকে ‘জিব চুষতে’ বলছেন।
এ ঘটনার পর দালাই লামার দপ্তর জানায়, তিনি প্রায়ই খেলাচ্ছলে এমন আচরণ করেন। যদিও পরে তিনি ক্ষমা চান।
২০১৯ সালেও তিনি বিতর্কে জড়ান, যখন বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ভবিষ্যতের কোনো নারী দালাই লামা হলে তাঁকে ‘আকর্ষণীয়’ হতে হবে। সেই মন্তব্যের পরও দুঃখ প্রকাশ করে তাঁর দপ্তর।
উত্তরাধিকার প্রশ্ন
তিব্বতের ইতিহাসে দালাই লামা শুধু আধ্যাত্মিক নেতা নন, রাজনীতিরও সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব। কিন্তু ২০১১ সালের মার্চ মাসে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে দালাই লামা তাঁর রাজনৈতিক দায়িত্ব হস্তান্তর করেন নির্বাসিত তিব্বত সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে।
তাঁর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে একটি প্রশ্ন ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠে—এই দীর্ঘ পথচলার পর কে হবেন উত্তরসূরি।
দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যায়, যখন দালাই লামা ইঙ্গিত দেন, তাঁর কোনো পুনর্জন্মপ্রাপ্ত উত্তরসূরি না-ও থাকতে পারে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত তিব্বতের মানুষের হাতেই থাকবে।
তবে এ বছর ৯০ বছরে পা রেখে তিনি বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দেন।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘অনেক অনুরোধ ও মতামত বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, দালাই লামার প্রতিষ্ঠান চলমান থাকবে।’ এই ঘোষণায় যেন নতুন আশার আলো দেখেন তাঁর অনুসারীরা।
বিশ্লেষকদের মতে, দালাই লামার এ বক্তব্য কেবল অনুসারীদের জন্যই নয়, বরং বেইজিংয়ের উদ্দেশেও এক কড়া বার্তা—তাঁর নেতৃত্ব জনগণের সম্মতির ওপর প্রতিষ্ঠিত; শক্তি ও দখলের ওপর নয়।
দালাই লামা বলেছেন, ভবিষ্যৎ দালাই লামার পুনর্জন্ম চিহ্নিত করার অধিকার একমাত্র তাঁর দপ্তরের।
‘এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার অন্য কারও নেই’—এই ঘোষণা কার্যত চীনের দাবির প্রতি এক দৃঢ় প্রত্যাখ্যান।
চীন দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, দালাই লামার উত্তরসূরি নির্ধারণের চূড়ান্ত ক্ষমতা তাদেরই।
চীন ওই ঘোষণা শুনে জানায়, ভবিষ্যৎ দালাই লামার অনুমোদন দেওয়ার অধিকার কেবল বেইজিংয়ের।
এদিকে দালাই লামা আগেই বলে রেখেছেন, তাঁর উত্তরসূরি জন্ম নেবেন ‘এক মুক্ত দেশে’, চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলের বাইরে।
তবে সেই ব্যক্তি কে হবেন, তা এখনো রহস্যই থেকে গেছে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি
সাল ১৯৫৯। চীনা সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নে ব্যর্থ তিব্বতিদের বিদ্রোহ। সে সময় রাতের অন্ধকারে তিব্বত ছেড়ে যান এক ভিক্ষু। তিনি আর কেউই নন, মালভূমিটির ১৪তম দালাই লামা তেনজিন গিয়াৎসো। বিশের কোঠার মাঝামাঝিতে তখন তাঁর বয়স।
তিব্বতের ওপর চীনের এই আগ্রাসন দেখে চুপ ছিল বিশ্ব। তিব্বতিদের সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিকতা আর ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব এসে পড়ে এই তরুণের কাঁধে। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, কিন্তু তাঁর ভেতরে ছিল অদম্য দৃঢ়তা।
এরপর কেটে গেছে কয়েক দশক। ভারতে নির্বাসনে থেকেও দালাই লামার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে তিব্বতের গণ্ডি ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বে। তিনি কেবল তিব্বতিদের আধ্যাত্মিক গুরুই নন, বরং মাতৃভূমি ফিরে পেতে চাওয়া এক জাতির আশা-ভরসার প্রতীক।
অহিংসার পক্ষে অটল অবস্থান নেওয়ায় ১৯৮৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন দালাই লামা। তাঁর দাবি স্পষ্ট, তিব্বতের পূর্ণ স্বাধীনতা নয়, বরং স্বশাসন ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার অধিকার।
কিন্তু বেইজিং বরাবরই তাঁকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে দেখে এসেছে। চীন-তিব্বত সম্পর্কের বহু দশকের জটিলতার কেন্দ্রে থেকেও দালাই লামা কখনো তাঁর শান্তিপূর্ণ পথচলা থেকে বিচ্যুত হননি।
এ বছরের জুনে ৯০ বছরে পা রেখে তিনি ঘোষণা দেন, তাঁর মৃত্যুর পর উত্তরসূরি অবশ্যই আসবেন। ছয় শতাব্দী পুরোনো এই বৌদ্ধপ্রতিষ্ঠান যেন থেমে না যায়, সে আশ্বাসেই যেন নতুন করে প্রাণ পান তাঁর অনুসারীরা।
জীবনের শেষ অধ্যায়ে দাঁড়িয়েও তিনি ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন তাঁর উত্তরাধিকার, তাঁর জাতি এবং এক শান্তিপূর্ণ পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে।
শৈশব ও নির্বাসনের শুরু
দালাই লামা ১৯৩৫ সালের ৬ জুলাই তিব্বতের বর্তমান সীমানার ঠিক বাইরে একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
কৃষক বাবা-মা তাঁদের এই নবজাতক ছেলের নাম দেন ‘লহামো ধোন্দুব’।
মাত্র দুই বছর বয়সে একদল বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও অনুসন্ধানী কর্মকর্তা তাঁকে পূর্ববর্তী ১৩ জন দালাই লামার পুনর্জন্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং বয়স চার বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়। তখনোই তাঁর নাম দেওয়া হয় ‘তেনজিন গিয়াৎসো’।
দালাই লামার শিক্ষা শুরু হয় এক বৌদ্ধ মঠে। সেখানেই কঠোর সাধনা ও অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে তিনি অর্জন করেন গেশে লহারাম্পা ডিগ্রি—বৌদ্ধ দর্শনে সর্বোচ্চ সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি।
১৯৫০ সালে তাঁর বয়স যখন ১৫, চীনের নবগঠিত কমিউনিস্ট সরকার তাদের সেনাবাহিনী নিয়ে প্রবেশ করে তিব্বতে। এরপর ১৯৫১ সালে চীন একতরফাভাবে তৈরি করে ১৭ দফা চুক্তি; যা তিব্বতকে চীনের অন্তর্ভুক্ত করার বৈধতা দেয়।
১৯৫৯ সালের ১০ মার্চ এক চীনা জেনারেল দালাই লামাকে আমন্ত্রণ জানান একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। কিন্তু তিব্বতের জনতার মনে গভীর শঙ্কা—একি কোনো চক্রান্ত? অপহরণ বা হত্যার আশঙ্কায় হাজারো মানুষ ভিড় করেন তাঁর প্রাসাদের সামনে।
সেই জনসমাবেশ রূপ নেয় বিক্ষোভে। চীনা সেনাবাহিনী নেমে আসে দমন-পীড়নে। প্রচণ্ড সহিংসতায় প্রাণ হারান বহু তিব্বতি। ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক অধ্যায়ে রচিত হয় নির্বাসনের সূচনা।
দালাই লামা রাতে ছদ্মবেশে তিব্বত ছেড়ে যান। এক সৈনিকের পোশাকে ভিড়ে মিশে যান তিনি। তাঁর কথায়, এই সিদ্ধান্ত আসে তাঁর ব্যক্তিগত দেবদূতের দিব্য বার্তা থেকে।
১৫ দিন ধরে কঠিন হিমালয় পেরিয়ে অবশেষে তিনি পৌঁছান ভারতের সীমান্তে। ভারত সরকার তাঁকে আশ্রয় দেয়। তাঁর নতুন ঠিকানা হয় উত্তর ভারতের হিমাচল প্রদেশ অঙ্গরাজ্যের ধরমশালা শহরে; যা পরিণত হয় তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের ঘাঁটিতে।
দালাই লামার সঙ্গে প্রায় ৮০ হাজার তিব্বতি পাড়ি জমান নির্বাসনে। তাঁদের অনেকে আশ্রয় নেন ধরমশালাতেই—যেখানে গড়ে ওঠে এক নতুন তিব্বত।
শান্তিতে-বিতর্কে দালাই লামা
নির্বাসনে এসেই তিব্বতের প্রাচীন সংস্কৃতি ও পরিচয় রক্ষার পাশাপাশি বিশ্বের দরবারে তিব্বতবাসীর দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন দালাই লামা।
তিনি জাতিসংঘের দ্বারস্থ হন, বারবার আহ্বান জানান তিব্বতবাসীর সুরক্ষার জন্য। তাঁর প্রচেষ্টাতেই ১৯৫৯, ১৯৬১ ও ১৯৬৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় একাধিক প্রস্তাব; যেখানে তিব্বতিদের মানবাধিকার রক্ষার দাবি জানানো হয়।
তবে তাঁর অবস্থান সব সময় ছিল মধ্যপন্থার দিকে—স্বাধীনতা নয়, বরং চীনের আওতায় থেকেই তিব্বতের জন্য প্রকৃত স্বশাসনের দাবি। এটি ছিল এক বাস্তববাদী ও অহিংস পথ, যা তিনি নিরলসভাবে অনুসরণ করে গেছেন।
১৯৮৭ সালে তিব্বতে হান চীনাদের বড় আকারের স্থানান্তরের বিরুদ্ধে লাসা শহরে প্রতিবাদের মধ্যে দালাই লামা পাঁচ দফা পরিকল্পনা প্রস্তাব করেন, যেখানে তিনি তিব্বতকে একটি শান্তিময় অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।
দমন-পীড়ন, নির্বাসন ও অপমান সত্ত্বেও দালাই লামা কখনো সরে আসেননি অহিংস পন্থায় প্রতিরোধ থেকে। এরই স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৯ সালে তাঁকে দেওয়া হয় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার।
নোবেল কমিটির ভাষায়, ‘যে জাতি বছরের পর বছর ধরে দুঃসহ নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তাদের নেতা হয়ে তিনি যে শান্তিপূর্ণ পথে থেকেছেন, তা এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত।’
বৈশ্বিক নানা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন দালাই লামা। ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের সাবেক সর্বোচ্চ যাজক (পোপ) প্রয়াত দ্বিতীয় জন পলের সঙ্গে একাধিকবার দেখা করেন তিনি।
দক্ষিণ আফ্রিকার ডেসমন্ড টুটুর সঙ্গে যৌথভাবে লেখেন একটি বই। তাঁর যাত্রাপথে পাশে পান হলিউডের রিচার্ড গিয়ার, মার্টিন স্করসেজি বা লেডি গাগার মতো সমর্থকদের।
তবে এই শান্তিপন্থী অবস্থান, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁকে খ্যাতি এনে দিয়েছে, তা কখনো কখনো হয়ে ওঠে তিব্বতের কিছু অংশের মানুষের হতাশার কারণ। তাঁরা মনে করেন, চীনের বিরুদ্ধে খুবই নরম ছিলেন দালাই লামা।
২০০৮ সালে চীনা শাসনের বিরুদ্ধে লাসায় সহিংস দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাবে, এতে বহু তিব্বতি প্রাণ হারান।
শান্তির দূত হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেলেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি দালাই লামার।
সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি ঘটে ২০২৩ সালে, যখন এক ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি এক শিশুকে ‘জিব চুষতে’ বলছেন।
এ ঘটনার পর দালাই লামার দপ্তর জানায়, তিনি প্রায়ই খেলাচ্ছলে এমন আচরণ করেন। যদিও পরে তিনি ক্ষমা চান।
২০১৯ সালেও তিনি বিতর্কে জড়ান, যখন বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ভবিষ্যতের কোনো নারী দালাই লামা হলে তাঁকে ‘আকর্ষণীয়’ হতে হবে। সেই মন্তব্যের পরও দুঃখ প্রকাশ করে তাঁর দপ্তর।
উত্তরাধিকার প্রশ্ন
তিব্বতের ইতিহাসে দালাই লামা শুধু আধ্যাত্মিক নেতা নন, রাজনীতিরও সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব। কিন্তু ২০১১ সালের মার্চ মাসে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে দালাই লামা তাঁর রাজনৈতিক দায়িত্ব হস্তান্তর করেন নির্বাসিত তিব্বত সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে।
তাঁর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে একটি প্রশ্ন ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠে—এই দীর্ঘ পথচলার পর কে হবেন উত্তরসূরি।
দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যায়, যখন দালাই লামা ইঙ্গিত দেন, তাঁর কোনো পুনর্জন্মপ্রাপ্ত উত্তরসূরি না-ও থাকতে পারে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত তিব্বতের মানুষের হাতেই থাকবে।
তবে এ বছর ৯০ বছরে পা রেখে তিনি বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দেন।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘অনেক অনুরোধ ও মতামত বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, দালাই লামার প্রতিষ্ঠান চলমান থাকবে।’ এই ঘোষণায় যেন নতুন আশার আলো দেখেন তাঁর অনুসারীরা।
বিশ্লেষকদের মতে, দালাই লামার এ বক্তব্য কেবল অনুসারীদের জন্যই নয়, বরং বেইজিংয়ের উদ্দেশেও এক কড়া বার্তা—তাঁর নেতৃত্ব জনগণের সম্মতির ওপর প্রতিষ্ঠিত; শক্তি ও দখলের ওপর নয়।
দালাই লামা বলেছেন, ভবিষ্যৎ দালাই লামার পুনর্জন্ম চিহ্নিত করার অধিকার একমাত্র তাঁর দপ্তরের।
‘এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার অন্য কারও নেই’—এই ঘোষণা কার্যত চীনের দাবির প্রতি এক দৃঢ় প্রত্যাখ্যান।
চীন দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, দালাই লামার উত্তরসূরি নির্ধারণের চূড়ান্ত ক্ষমতা তাদেরই।
চীন ওই ঘোষণা শুনে জানায়, ভবিষ্যৎ দালাই লামার অনুমোদন দেওয়ার অধিকার কেবল বেইজিংয়ের।
এদিকে দালাই লামা আগেই বলে রেখেছেন, তাঁর উত্তরসূরি জন্ম নেবেন ‘এক মুক্ত দেশে’, চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলের বাইরে।
তবে সেই ব্যক্তি কে হবেন, তা এখনো রহস্যই থেকে গেছে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির জানিয়েছেন, বেলুচিস্তানের রেকো ডিক খনি থেকে দেশের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি নির্ভর করছে। তিনি বিশ্বাস করেন, চীন যদি পাশে থাকে, তাহলে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সোনা ও তামার খনিকে ঘিরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক চেহারা পাল্টে যেতে পারে।
১ ঘণ্টা আগেগত সপ্তাহেই কেনিয়ার আদালতের এক ম্যাজিস্ট্রেট আশা প্রকাশ করেছেন, ব্রিটিশ সম্পদশালী ব্যবসায়ী হ্যারি রয় ভিভার্সের আত্মা এবার হয়তো শান্তি পাবে। কিন্তু মৃত্যুর ১২ বছর পরও তাঁর মরদেহ কোথায় শায়িত হবে, সে প্রশ্ন এখনো অনির্ধারিতই রয়ে গেছে।
৪ ঘণ্টা আগেউপহারটি যখন দেওয়া হয়, তখন আফসারের দোকান বন্ধ ছিল। গত শুক্রবার তিনি দোকানে পৌঁছে উপহারটি খোলেন এবং দেখেন যে স্পিকারগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি ভারী।
৪ ঘণ্টা আগেতানজানিয়ার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত নর্থ মারা সোনার খনি একদিকে যেমন দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করছে, অন্যদিকে স্থানীয় মানুষের জন্য নিয়ে এসেছে ভয়াবহ দুর্দশা, নির্যাতন আর মৃত্যু। আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম হু হু করে বাড়ায় এ খনিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, পুলিশি সহিংসতা ও অপহরণের মতো ঘটনা বাড়ছে।
৫ ঘণ্টা আগে