Ajker Patrika

ভুটানের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকেও বিতাড়ন, জীর্ণ শরণার্থীশিবিরই তাদের শেষ আশ্রয়

অনলাইন ডেস্ক
শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত লোতশাম্পা জনগোষ্ঠী। ছবি: উইকিপিয়া
শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত লোতশাম্পা জনগোষ্ঠী। ছবি: উইকিপিয়া

আবারও অনিশ্চয়তায় নেপালিভাষী ভুটানি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় লোতশাম্পার একাংশ। ভুটান থেকে এক সময় যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই ভুটানেই আবার ফেরত পাঠানো হয়েছে। তবে, ভুটান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে—তারা এই শরণার্থীদের গ্রহণ করবে না। ফলে, আবারও তাঁদের ঠাঁই হয়েছে নেপালের এক জীর্ণ শরণার্থীশিবিরে। শৈশবে এই শরণার্থীশিবিরে বসেই আশায় বুক বেঁধেছিলেন, একদিন কোনো এক উন্নত দেশে পাড়ি জমাবেন, বদলে যাবে জীবন। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! আবার সেই জীর্ণ কুটিরেই ফিরতে হলো!

১৯৯০-এর দশকে এই সম্প্রদায়কে ভুটান ছাড়তে বাধ্য করা হয়। দীর্ঘদিন নেপালে শরণার্থী ছিলেন। পরে, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ২০০৭ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে পুনর্বাসন শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও আরও কিছু দেশে আইনি প্রক্রিয়ায় পুনর্বাসিত হন ১ লাখের বেশি লোতশাম্পা।

মার্কিন ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই)-এর তথ্য অনুযায়ী, ভুটান এত দিন এসব শরণার্থীকে ফেরত নিতে অনিচ্ছুক ছিল বলেই যুক্তরাষ্ট্র কাউকে ফেরত পাঠায়নি। তবে চলতি বছরের মার্চ থেকে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। এরই মধ্যে দুই ডজনের বেশি লোতশাম্পাকে ভুটানে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ভুটান সরকার তাঁদের গ্রহণ করেনি। ফলে আবার ফিরে যেতে হয়েছে নেপালে পুরোনো শরণার্থীশিবিরগুলোতে।

২৪ বছর বয়সী রমেশ সন্ন্যাসী এমনই একজন ভুক্তভোগী। নেপালের একটি শরণার্থীশিবিরেই তাঁর জন্ম। ১০ বছর বয়সে বাবা-মা ও বোনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। পেনসিলভানিয়ায় আমাজনের একটি ওয়্যারহাউস কাজ করছিলেন। গত বছর অনুমতি ছাড়া গাড়ি চালানোর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন রমেশ। ভুয়া পরিচয়পত্র বহনের অভিযোগও আনা হয়। আট মাস কারাবাসের পর, গত এপ্রিলে তাঁকে প্রথমে নয়াদিল্লি, এরপর ভুটানের পাঠানো হয়।

ভুটানে পৌঁছানোর পর তাঁকে ও আরও দু’জন শরণার্থীকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ভারতের সীমান্তে নিয়ে যায়। এরপর হাতে ৩০ হাজার রুপি ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়, ভারতের পানিটাঙ্কি সীমান্ত পার হয়ে যেন নেপালে ফিরে যান তাঁরা। রমেশ বলেন, ‘দালালের মাধ্যমে মেচি নদী পাড়ি দিয়ে নেপালে ঢুকতে হয়। এখন বেলডাঙ্গি শরণার্থীশিবিরে আছি, কিন্তু কোনো পরিচয়পত্র না থাকায় বাইরে চলাফেরা করা কঠিন। আত্মীয়রা টাকা পাঠালেও তোলা সম্ভব নয়। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।’

এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রফেরত শরণার্থীরা আইনি ও মানবিক দিক থেকে গভীর সংকটে পড়েছেন। অথচ তাঁদের প্রায় সবাই বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মাত্রার অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত হন। সাজা শেষ হওয়ার পর তাঁদের ভিসা বাতিল করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আইন অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কিছু অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে ভিসা বাতিল হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

১৯৯০-এর দশকে ভুটান থেকে বিতাড়িত নেপালি ভাষাভাষী হাজারো লোতশাম্পার অস্থায়ী আশ্রয় নেপালের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বেলডাঙ্গি শরণার্থী শিবির। ছবি: সিএনএন
১৯৯০-এর দশকে ভুটান থেকে বিতাড়িত নেপালি ভাষাভাষী হাজারো লোতশাম্পার অস্থায়ী আশ্রয় নেপালের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বেলডাঙ্গি শরণার্থী শিবির। ছবি: সিএনএন

এই অবস্থায় এসব শরণার্থী এখন একটি ‘ডিপ্লোম্যাটিক গ্রে জোন’ এ অবস্থান করছেন। যুক্তরাষ্ট্র, ভুটান ও নেপাল এক সময়ের আশ্রয়স্থল হলেও এখন কোনো দেশেরই নাগরিক নন তাঁরা।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও পরিবেশ সংক্রান্ত সংস্থা আইআইআরএইচইডির নেপালভিত্তিক সভাপতি গোপালকৃষ্ণ সিওয়াকোটি জানান, এখন পর্যন্ত মোট ৩০ জন শরণার্থীকে ভুটানে ফেরত পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আরও দুই ডজন ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায়। সিওয়াকোটি বলেন, ‘ভুটানে পৌঁছানোর পর সবাইকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। কেউ কেউ সেখানেই আছেন, বাকিরা নেপালে ফিরেছেন। অনেকে আত্মগোপনে। এমনকি চারজন শরণার্থীকে নেপালের সীমান্তে অবৈধভাবে প্রবেশের অভিযোগে আটক করে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

এদিকে, নেপালের ইমিগ্রেশন বিভাগের মহাপরিচালক টিকারাম ঢাকাল সিএনএনকে বলেন, ‘আমরা গভীর দোটানায় পড়েছি। যুক্তরাষ্ট্র তাঁদের ফিরিয়ে নেবে না, ভুটানও গ্রহণ করছে না। আমাদের পক্ষেও তাঁদের রাখা সম্ভব নয়।’

হিমালয়ের কোলে অবস্থিত ৮ লাখ জনসংখ্যার ছোট্ট বৌদ্ধ রাজ্য ভুটান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ‘ন্যাশনাল হ্যাপিনেস ইনডেক্স’ আর পরিবেশবান্ধব পর্যটননীতির জন্য প্রশংসিত। কিন্তু দেশটির ইতিহাসে রয়েছে জাতিগত সংখ্যালঘু দমনের এক অন্ধকার অধ্যায়। উনিশ শতকে দক্ষিণ ভুটানে বসবাস শুরু করে নেপালি বংশোদ্ভূত লোতশাম্পা জনগোষ্ঠী। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিক থেকে ভুটান সরকার এই জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে। ১৯৮৯ সালে ‘ভুটানিকরণ’ নীতির আওতায় বাধ্যতামূলক পোশাকবিধি আরোপ করা হয়, নিষিদ্ধ করা হয় নেপালি ভাষা। প্রতিবাদ করলেই সহ্য করতে হতো দমনপীড়ন। নিপীড়ন, হুমকি আর বাধ্যবাধকতার মুখে হাজার হাজার লোতশাম্পা ভুটান ছাড়তে বাধ্য হয়।

যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক আইনে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো, নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকলে কোনো ব্যক্তিকে সে দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এমন সব দেশে অভিবাসীদের ফেরত পাঠাচ্ছে, যাদের মানবাধিকার রেকর্ড গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। যেমন লিবিয়া বা দক্ষিণ সুদান, এল সালভাদরও এর মধ্যে পড়ে।

নেপালভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও পরিবেশ সংস্থার সভাপতি গোপাল কৃষ্ণ সিওয়াকোটি বলেন, ‘ভুটানের রাজতান্ত্রিক সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ও আইনগতভাবে এই মানুষগুলোর নাগরিকত্ব বাতিল করেছে। তারা একেবারে রাষ্ট্রহীন হয়ে গেছে। এই মানুষগুলোর কোনো দেশ নেই। তাদের ভুটানে ফেরত পাঠানো ভুলই।’

যেসব দেশ নিজ নাগরিকদের ফেরত নিতে নিমরাজি, তাদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত শুল্কারোপের মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ধারণা করা হয়, এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি রাখতে ফেরত পাঠানো শরণার্থীদের প্রথমে গ্রহণের ভান করেছিল ভুটান।

যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা গত মার্চে এক খসড়া ‘লা তালিকায়’ ভুটানের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ওই তালিকায় ১১টি দেশের নাম ছিল, যেগুলোর নাগরিকদের মার্কিন ভিসা নিষিদ্ধ করা হবে। তবে জুনে চূড়ান্ত ১৯ দেশের যে তালিকা প্রকাশিত হয়, সেখানে ভুটান নেই। প্রথম ফেরত পাঠানো ফ্লাইটটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভুটানে পৌঁছায় মার্চের শেষ দিকে।

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ও শুল্ক প্রয়োগ সংস্থা (আইসিই) এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে সিএনএন। তবে, সাড়া মেলেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ আইন ও আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার আলোকে ফেরত পাঠানো ব্যক্তিদের অভিবাসন পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রত্যেক দেশ নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেবে।’

সিএনএন নিউইয়র্কে অবস্থিত ভুটানের কনস্যুলেটে ই-মেইল করলেও কোনো জবাব পায়নি। নেপালের অভিবাসন দপ্তরের মহাপরিচালক টিকরাম ধাকাল বলেন, ‘আমরা এক সংকটে আছি। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত এদের আর ফেরত নেবে না। আর ভুটানে ফেরত পাঠানোও সহজ নয়।’ তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজা হচ্ছে।

এদিকে শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর খবরে যুক্তরাষ্ট্রে ভুটানি কমিউনিটির মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। পেনসিলভানিয়ার হ্যারিসবার্গে বসবাসকারী শরণার্থী নেতা তিলক নিরৌলা বলেন, ‘আমাদের ভুটান থেকে উৎখাত করা হয়েছে, আমরা নিজের দেশ বলতে কিছুই পাইনি—এই দেশ, যুক্তরাষ্ট্রকেই আমরা আমাদের বাড়ি বলে মনে করি। যদি কেউ অপরাধ করে, তাহলে তাকে অবশ্যই বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তাকে দেশ থেকে বের করে দিতে হবে। একটি পরিবারকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে কোনো সমাধান আসতে পারে না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত