Ajker Patrika

ডেঙ্গু মোকাবিলায় সংকট: রোগী দেশজুড়ে, নজর নগরে

  • ৭৩ শতাংশ রোগীই প্রধান শহরগুলোর বাইরের।
  • ডেঙ্গু মোকাবিলা কৌশলে ত্রুটি: বিশেষজ্ঞ
  • এলাকা চিহ্নিত করে কাজ করার পরামর্শ।
  • ‘ঢাকার ব্যয়েই সারা দেশের কাজ সম্ভব।’
সৈয়দ ঋয়াদ ও জয়নাল আবেদীন
বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। শয্যা পেতে সমস্যা হচ্ছে হাসপাতালে। গতকাল রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ছবি: আজকের পত্রিকা
বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। শয্যা পেতে সমস্যা হচ্ছে হাসপাতালে। গতকাল রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ছবি: আজকের পত্রিকা

মুগদার ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের সিঁড়িতেই গা ছেড়ে দিয়েছিলেন ডেঙ্গু আক্রান্ত অশীতিপর নবারুণ দাস। সঙ্গে থাকা পুত্রবধূ রমা দাসকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, তাঁরা এসেছেন মুন্সিগঞ্জ থেকে। সেখানকার চিকিৎসক পাঠিয়েছেন ঢাকায়। সিট খালি না থাকায় তাঁদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

গত কয়েক দিনে নবারুণ দাসের মতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আসা কয়েকজন রোগীকে ভর্তির অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে মুগদা হাসপাতালে। সেখানে গতকাল বুধবার পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি ছিল ১৫২ জন, যা ধারণক্ষমতার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৭৫৮ জন। এর মধ্যে ৫৫২ জন, অর্থাৎ বেশির ভাগই ঢাকার বাইরের জেলাগুলোয়। এ সময়ের মধ্যে সারা দেশে মারা গেছে ৪ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, চলতি মাসের প্রথম ১১ দিনে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৭ হাজার ২১৭ জন। গত সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ১৫ হাজার ৮৬৬ জন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া মোট ডেঙ্গু রোগী ৫৪ হাজার ৫৫৯ জন। এ সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে প্রায় আড়াই শ জন।

রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২ হাজার ৩৬৮ জন ভর্তি হয়েছে। চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র নিয়েছে ২ হাজার ১৮৩ রোগী। গতকাল সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ভর্তি হয়েছে ৩০ জন। সারা দেশের রোগীর মোট সংখ্যা থেকে সাদা চোখেই বোঝা যায়, রাজধানী ও আশপাশে আক্রান্তের তুলনায় বাইরের জেলাগুলোর মোট রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। অথচ এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু কয়েক বছর আগেও পরিচিত ছিল মূলত ঢাকার রোগ হিসেবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, গত পাঁচ বছরে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে প্রায় ৩ হাজার মানুষ। এর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ঢাকার মতো মহানগরের বাইরের জেলা, উপজেলা ও গ্রাম থেকে আসা রোগী। একসময় ঢাকার রোগ হিসেবে পরিচিত ডেঙ্গু এখন ছড়িয়েছে গ্রামাঞ্চলসহ সারা দেশে। সবচেয়ে প্রত্যন্ত জেলাগুলোর একটি বরগুনা কিছুদিন আগে হয়ে উঠেছিল শীর্ষ ডেঙ্গু সংক্রমণের জেলা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এর একটি কারণ হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলে বিচরণ করা মশার ভিন্ন প্রজাতিটিও এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর বাহক হয়ে উঠেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরে মোট আক্রান্ত রোগীর মধ্যে সিটি করপোরেশনের বাইরের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, পৌর এলাকা ও গ্রামের মানুষই বেশি। তাদের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন এলাকায় আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার। এ হিসাবে আক্রান্ত রোগীর প্রায় ৭৩ শতাংশই মহানগরগুলোর বাইরের।

কৌশলে ত্রুটি, বলছেন বিশেষজ্ঞ

ডেঙ্গুর প্রকোপ এভাবে বেড়ে যাওয়া তথা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারাকে বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, ডেঙ্গু মোকাবিলায় এখনো স্বীকৃত কোনো বিশেষ কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠান না গড়ে তোলা এবং এ বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণ গবেষণা না থাকার কারণে রোগটি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ডেঙ্গুর মতো মশাবাহিত রোগের বিষয়ে দ্রুত সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে না পারলে জনস্বাস্থ্যের জন্য এটি বড় ধরনের বিপদ হয়ে উঠতে পারে।

ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়া বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ জি এম সাইফুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ভুল পথে হাঁটছে। ক্রমেই রোগটির বিস্তার বাড়লেও তা নিয়ন্ত্রণে স্বীকৃত কোনো বিশেষ কর্তৃপক্ষ নেই। এটা বিশেষজ্ঞ নিয়ে কাজ করার বিষয়, কিন্তু তা ঠিকঠাকমতো করা হচ্ছে না।’

মশকনিধন কর্মসূচির লক্ষ্য ও প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, নজর নেই জেলা-উপজেলায়। ডেঙ্গু পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব না। এলোপাতাড়ি মশার ওষুধ প্রয়োগ না করে জেনেবুঝে অ্যাকটিভ ক্লাস্টার (যেসব এলাকায় বেশি রোগী) চিহ্নিত করে কাজ করতে হবে। এটা করলে শুধু ঢাকার জন্য যে বরাদ্দ, তা দিয়ে সারা দেশে ডেঙ্গু থেকে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।

চেষ্টা চলছে: দুই সিটি কর্তৃপক্ষ

নির্বাচিত কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতিতে দীর্ঘ সময় মশকনিধনসহ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অচলাবস্থার কথা অনেকবার বলা হয়েছে। তবে মশকনিধন কর্মসূচির কার্যকারিতা নিয়েও অভিযোগ আছে। ডিএনসিসির অন্তর্ভুক্ত ভাটারা এলাকার বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘দেখি মাঝেমধ্যে মশার ওষুধ দিতে আসে। কী যেন ধোঁয়ার মতো দেয় আর স্প্রে করে। কিন্তু কাজ তো হয় না। মশা কমে না।’

একই রকমের অভিযোগ ডিএসসিসির আওতাধীন মানিকনগরের বাসিন্দা মো. রওশন আলীর। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মশা মারার ওষুধ যতটুকু দেওয়া দরকার, তা মনে হয় না দেওয়া হয়। এ জন্য মশা না কমে আরও বাড়ছে। যাদের দায়িত্ব এসব দেখার, তারা মনে হয় ঠিকমতো কাজ করে না।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন বলেন, ‘আমরা কাজ করছি। পুরোপুরি ডেঙ্গু নির্মূল করা সম্ভব না, তবে প্রতিকার বা প্রতিরোধ তো করা সম্ভব। অনেকের ধারণা, সিটি করপোরেশন চাইলেই ডেঙ্গু নির্মূল সম্ভব, কিন্তু ডেঙ্গুর জন্য সবার সমন্বিতভাবে কাজ করা জরুরি। সবাই সচেতন না হলে এটা থেকে প্রতিকার পাওয়া কঠিন।’

ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী মশকনিধন কার্যক্রম নিয়ে বলেন, ‘আমরা পরিচ্ছন্নতার কাজ অব্যাহত রেখেছি। বাড়িঘরের পরিচ্ছন্নতায় উৎসাহিত করা, কুইক রেসপন্স টিমসহ নানান কর্মসূচি আমরা গ্রহণ করেছি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আসামি গ্রেপ্তারে র‍্যাবকে ভুল তথ্য, বগুড়া ডিবির ওসিসহ ৩ কর্মকর্তা প্রত্যাহার

গাজায় ৮ জনকে প্রকাশ্যে গুলি করে মারল হামাস

সব ‘নোট অব ডিসেন্ট’ স্পষ্ট থাকবে জুলাই সনদে, সেটাই যাবে গণভোটে: সালাহউদ্দিন আহমদ

দয়া করে বিভাজন সৃষ্টি করবেন না, দেশকে বাঁচান: মির্জা ফখরুল

স্কুলছাত্রীর মৃত্যুতে স্তব্ধ মালয়েশিয়া, কাঠগড়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত