Ajker Patrika

ফ্যাক্টচেক /ট্রেনের নিচে পড়া ভাইরাল ভিডিওর ব্যক্তিটি বেঁচে আছেন

ফ্যাক্টচেক  ডেস্ক
আপডেট : ১৯ মে ২০২৫, ১৭: ২৮
চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে ফোন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে পালানোর সময় চাকায় পিষ্ট হয়ে এক ব্যক্তি মারা গেছেন দাবিতে ফেসবুক পোস্ট। ছবি: স্ক্রিনশট
চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে ফোন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে পালানোর সময় চাকায় পিষ্ট হয়ে এক ব্যক্তি মারা গেছেন দাবিতে ফেসবুক পোস্ট। ছবি: স্ক্রিনশট

চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে মোবাইল ফোন চুরি করতে গিয়ে যাত্রীদের হাতে ধরা পড়েন এক ব্যক্তি। পালাতে গিয়ে একপর্যায়ে ট্রেনের চাকায় নিচে পড়ে তিনি মারা গেছেন।—এমন দাবিতে একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। একই ক্যাপশনে ভিডিওটি বিভিন্ন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, পেজ ও গ্রুপ থেকে ছড়ানো হয়েছে।

ভিডিওতে একটি চলন্ত ট্রেনের দরজায় এক যুবককে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। পরক্ষণেই তাঁর পা মাটি স্পর্শ করতে দেখা যায়। দ্রুত গতিতে চলমান ট্রেনের গতির সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু না পেরে আবার ঝুলে যান। ট্রেনটি একপর্যায়ে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করে। দরজায় ঝুলন্ত অবস্থায়ই প্ল্যাটফর্মে নামার চেষ্টা করেন। কিন্তু একপর্যায়ে ট্রেনের নিচে পড়ে যান। ওই সময় দেখা যায়, দরজার ভেতর থেকে কেউ তাঁর হাত ধরে রেখেছে। ট্রেনটি প্লাটফর্মে প্রবেশ করার পরপরই স্টেশনের নামফলকে ‘নশরৎপুর’ লেখা দেখা যায়।

হৃদয়ে বাংলাদেশ’ নামের ফেসবুক পেজ থেকে ভিডিওটি গতকাল রোববার (১৮ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৭টা ৫৩ মিনিটে পোস্ট করা হয়। ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘আহ্, চুরি করতে গিয়ে নিজের প্রাণটা বিলিয়ে দিল। চোর হলেও তার পরিবারের কথা ভেবে মায়া লাগছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে চুরি করতে গিয়ে যাত্রীদের হাতে ধরা পড়ে যায় যুবক, অতঃপর পালানোর জন্য চেষ্টা করতে গেলে একপর্যায়ে ট্রেনের চাকায় পিষ্ট হয়ে যায়।’ (বানান অপরিবর্তিত)

Khan Saddam নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে গতকাল রোববার (১৮ এপ্রিল) রাত ৮টা ২০ মিনিটে পোস্ট করা ভিডিওটি সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে। এর ক্যাপশনে লেখা, ‘মোবাইল ফোন চুরি করতে গিয়ে মৃত্যু!’ (বানান অপরিবর্তিত)

আজ সোমবার বেলা ১১টা পর্যন্ত ভিডিওটি ২০ হাজার বার দেখা হয়েছে এবং ২৮৯টি রিঅ্যাকশন পড়েছে। এতে ৪৫টি কমেন্ট পড়েছে এবং শেয়ার হয়েছে ৬২।

Md Eamin HossanH M Jonayed Ahmad নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একই ক্যাপশনে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়েছে।

ভিডিওটির কিছু কি-ফ্রেম রিভার্স ইমেজ সার্চ করা হলে একই ভিডিও একাধিক সোশ্যাল মিডিয়াতে পাওয়া যায়। তবে এসব পোস্ট থেকে ঘটনাটির বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ ট্রেনের প্ল্যাটফর্মের নামফলকে ‘নশরৎপুর’ লেখার সূত্র ধরে ঘটনাস্থল সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নশরতপুর (নশরৎপুর) রাজশাহী বিভাগের বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার একটি ইউনিয়ন। নশরৎপুর রেল স্টেশন সেখানেই অবস্থিত।

এর সূত্র ধরে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ আদমদীঘি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তাঁকে ঘটনার বিবরণ দিলে বলেন, ঘটনার বিষয়ে জানেন।

তিনি বলেন, ‘ট্রেনের নিচে পড়ে যাওয়া ব্যক্তি মারা যাননি। গতকাল তিনি আমাদের থানায় অভিযোগ দিতে এসেছিলেন। কিন্তু যেহেতু ঘটনাটি রেলস্টেশনে ঘটেছে তাই এটি আমাদের আওতাধীন নয়। তাই আমরা তাঁকে জিআরপির (রেলওয়ে পুলিশ) কাছে অভিযোগ করতে বলি। পরবর্তীতে তিনি সান্তাহার রেলওয়ে পুলিশের কাছে যান।’

তবে ওই ব্যক্তির নাম-পরিচয় জানাতে পারেননি ওসি মোস্তাফিজুর রহমান।

আজককের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ আদমদীঘি থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের কাছ থেকে সান্তাহার রেলওয়ে থানার ওসি মো. হাবিবুর রহমানের ফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করে। এ বিষয়ে ওসি হাবিবুর রহমানের কাছে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘ওই ব্যক্তি বেঁচে আছেন। তিনি প্রথমে আদমদীঘি থানায় গিয়েছিলেন। আদমদীঘি থানা যখন বলেছে এটা রেলওয়ে পুলিশের বিষয় তখন এখানে আসেন। এসে এখানে শুধু প্রহরীর (সেন্ট্রি) সঙ্গে দেখা হয়। পরে ওনাকে আদমদীঘি থেকে ফোন করলে উনি আবার চলে যান।’

পরে আদমদীঘি থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমানকে আবার ফোন কল করে সেই ব্যক্তি তাঁর থানায় দ্বিতীয়বার এসেছিলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি ‘না’ সূচক জবাব দেন।

প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে MD Rana Islam নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গতকাল রোববার (১৮ এপ্রিল) রাত ৯টা ০২ মিনিটে প্রকাশিত একটি পোস্ট পাওয়া যায়। এই পোস্টে একটি ভিডিও ও একটি ছবি যুক্ত করা হয়েছে। ভিডিওটির সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর মিল রয়েছে। তবে এটি ভিন্ন দিক থেকে ধারণ করা। এর সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর ট্রেনে ঝুলে থাকা ব্যক্তি, তাঁর পোশাক, ট্রেন, রেললাইন, প্ল্যাটফর্ম, প্ল্যাটফর্মের নাম ফলক— এসবের মিল পাওয়া যায়।

MD Rana Islam নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পোস্ট। ছবি: স্ক্রিনশট
MD Rana Islam নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পোস্ট। ছবি: স্ক্রিনশট

এই পোস্টে মো. রানা ইসলাম ভিডিওতে থাকা ব্যক্তিকে নিজের বাবা দাবি করে লিখেছেন, ‘আমার বাবা চোর না। তিনি আদম বাপারীর ব্যাবসা করতো। যাকে বিদেশ পাটাইছে তার শালা ও তার বন্ধু রা মিলে তাকে মারার চেষ্টা করে ছিল। আপনারা দয়া করে আমার বাবা কে চোর মনে করবেন বা।’ (বানান অপরিবর্তিত)

এ বিষয়ে জানতে রানা ইসলামকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগের পক্ষ থেকে নক দেওয়া হয়। তবে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।

এই পোস্টের কমেন্টের সূত্র ধরে Tarek Rahman গতকাল রাত ৮টা ৪৪ মিনিটে একই ভিডিও প্রকাশ করে দাবি করেন, ভিডিওর ব্যক্তিটি তাঁর ফুপা। তিনি বেঁচে আছেন।

Tarek Rahman নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পোস্ট। ছবি: স্ক্রিনশট
Tarek Rahman নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পোস্ট। ছবি: স্ক্রিনশট

ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা, ‘আমরা কোন কিছু না বুঝে সবকিছু শেয়ার দেই এটা ঠিক না সম্পর্কে উনি আমার ফুপা উনি একজন আদম বেপারী কিছু ঝামেলার কারণে কয়দিন ধরে সমস্যা ছিল আজকে তাকে পেয়ে ট্রেনের মধ্যে মারধর করা শুরু করে পরে তিনি জীবন রক্ষাতে ট্রেন থেকে পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু তাকে জানে মারার চেষ্টা করে তার কাছে টাকা ছিল অনেক সেই টাকা তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় তারা_ আর ফেসবুকে তাকে চোর বানানো হয়েছে হায়রে সমাজ। বর্তমানে উনি বেঁচে আছেন কিন্তু এর পিছনে যাদের হাত আছে তাদের কঠোরতম শাস্তি দাবী জানাচ্ছি।’ (বানান অপরিবর্তিত)

এই ফেসবুক অ্যাকাউন্টে উল্লেখিত ফোন নম্বরে কল করা হলে অপর প্রান্ত থেকে তারেক রহমান পরিচয়ে একজন কথা বলেন। ঘটনার ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাইরাল ভিডিওর ব্যক্তির নাম মতিউর রহমান। তিনি সম্পর্কে তাঁর ফুপা। তিনি বেঁচে আছেন।

ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইলে তারেক রহমান বলেন, ‘ওনার বাড়ি নওগাঁ জেলার রাণীনগর থানার পারইল গ্রামে। ওনার বাবা পারইল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। গতকাল (রোববার) উনি বগুড়া থেকে আসার সময় কিছু লোক ওনাকে ফলো করে। পূর্ব শত্রুতার জেরে পরিকল্পিতভাবে তাঁকে মোবাইল চুরির অপবাদ দেয় এবং মব সৃষ্টির চেষ্টা করে। একপর্যায়ে হত্যার উদ্দেশ্যে ট্রেন থেকে ফেলে দেয়।’

তারেক রহমানের কাছ থেকে মতিউর রহমানের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তাঁকে কল করলে অপর প্রান্ত থেকে একজন নারী রিসিভ করেন। তিনি মতিউর রহমানের স্ত্রী পরিচয়ে আজকের পত্রিকার সঙ্গে কথা বলেন। মতিউর রহমান আছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি ফোনটি মতিউর রহমানের কাছে দেন।

ঘটনার বিবরণ শুনে মতিউর রহমান আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগকে বলেন, ‘আমিই সেই ব্যক্তি।’

ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গতকাল আমি বগুড়া থেকে ট্রেনে করে আসছিলাম। আমার সঙ্গে ৩০ হাজার টাকা ছিল। সেই সময় ৭ জন আমাকে ফলো করছিল। তা আমি জানতাম না। যখন ট্রেন আলতাফনগর পার হয় তখন তারা আমাকে অ্যাটাক করে। আমাকে কিল ঘুষি দেয়। তারা সবাই মাস্ক পরা ছিল। একপর্যায়ে তারা চাকু বের করে মেরে ফেলার প্ল্যান করে। তখন তারা আমার হাতে চাকু দিয়ে আঘাত করে। তবে তাদের একজন বলে যে তারা ফেঁসে যাবে। তাই তারা ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার কথা বলছিল। তারা আমার হাত ছেড়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। আমি আবার ধরার চেষ্টা করি। একপর্যায়ে আমি বাইরে পড়ে যাই এবং ট্রেনের নিচে চলে যাই। সেসময় তারা আমাকে মোবাইল চোর হিসেবে সম্বোধন করেছিল।’

মতিউর রহমান আরও বলেন, ‘আমার পরিবারকে নিয়ে এই ঘটনায় আদমদীঘি থানা অভিযোগ দিতে গেলে থানা থকে জানানো হয় এটি রেল স্টেশনের ঘটনা, তাই অভিযোগ জিআরপিতে করতে হবে। পরে সান্তাহার রেলওয়ে থানায় গেলে সেখান থেকে জানান হয় আদমদীঘি থানায় যেতে। এখন পর্যন্ত কোনো থানাতেই অভিযোগ করতে পারিনি।’

ট্রেনে বিবাদের বিষয়ে জানতে চাইলে মতিউর রহমান বলেন, ‘আমি একজন আদম ব্যবসায়ী। আক্রমণকারীদের আত্মীয়ের একজন আমার মাধ্যমে বিদেশ গিয়েছিল। যিনি বিদেশ গেছেন, তিনি সেখানে গিয়ে চাকরি করেছেন। সেটা তারা না জেনেই আমার ওপর হামলা করেছে।’

তাঁর বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে আমি বেঁচে গেছি। তবে পায়ে কিছুটা ব্যথা পেয়েছি। একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। আজকে ছুটি হয়ে যাবে।’

সুতরাং, চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে ফোন চুরি করার সময় যাত্রীদের কাছে ধরা পড়ে পালানোর সময় ট্রেনের চাকার নিচে পড়ে একজনের মৃত্যুর খবরটি সঠিক নয়। ওই ব্যক্তি বেঁচে আছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘আমরা প্রজাতন্ত্রের এমন চাকর যে মালিককে জেলে ভরে দিতে পারি’

জামায়াতের অফিসে আগুন নেভাতে গিয়ে কোরআন শরিফ দেখেননি, দাবি ফায়ার সার্ভিসের

দিনাজপুরে নিহত মাইক্রোবাস-আরোহীদের সবাই সরকারি কর্মকর্তা

ফরিদপুরে গাড়ির চাকায় ছিন্নভিন্ন অজ্ঞাত ব্যক্তি, অক্ষত শুধু পায়ের জুতা

নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তারে বিব্রত ফারুকী, যা বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত