Ajker Patrika

আগুনে পোড়া ক্ষতস্থানে ডিম, টুথপেস্ট ব্যবহার কি নিরাপদ

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৮: ৪২
Thumbnail image

শরীরের কোনো স্থান পুড়ে গেলে তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে কাঁচা ডিম বা টুথপেস্ট লাগিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন অনেকে। এতে পোড়ার ক্ষতি অনেকখানি কমানো সম্ভব বলে বিশ্বাস করা হয়। এই ধরনের জিনিস পোড়া স্থানের জ্বালাপোড়ার তাৎক্ষণিক উপশম করে এটি সত্যি। কিন্তু টুথপেস্ট বা ডিমের ব্যবহার আগুনে পোড়ার প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে কতোটা উপকারী? এর কি কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে?

আগুনে পোড়া স্থানে ডিম বা টুথপেস্ট লাগানোর এই ঘরোয়া পদ্ধতির কার্যকারিতা সম্পর্কে অনুসন্ধান করে দেখেছে আজকের পত্রিকা ফ্যাক্টচেক বিভাগ।

আগুনে পোড়ার প্রাথমিক চিকিৎসায় টুথপেস্ট বা ডিম কতটুকু কার্যকরী তা নিয়ে আলোচনার আগে জেনে নেওয়া যাক, আগুনে পোড়ার মাত্রা নিয়ে। আগুনে  পোড়ার মাত্রাকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়।

প্রথম মাত্রার পোড়া: খুবই কম পোড়া। এই ধরনের পোড়ার ক্ষেত্রে কেবল ত্বকের বাইরের স্তরের (এপিডার্মিস) ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দ্বিতীয় মাত্রার পোড়া: এটি প্রথম মাত্রার পোড়ার চেয়ে বেশি গুরুতর। এ ধরনের পোড়ার ক্ষেত্রে ত্বকের গভীর স্তর পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তৃতীয় মাত্রার পোড়া: এই ধরনের পোড়ার ক্ষেত্রে ত্বকের সব স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
চতুর্থ মাত্রার পোড়া: এটি আগুনে পোড়ার সবচেয়ে গুরুতর স্তর। এ ক্ষেত্রে শরীরের হাড় এবং হাড়ের সংযোগস্থল পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রথম ও দ্বিতীয় মাত্রার পোড়ার ক্ষেত্রে বাড়িতেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সেরে ওঠা যায়। তবে প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আমাদের দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় মাত্রার পোড়ার ক্ষেত্রে টুথপেস্ট ও ডিমের সাদা অংশ ব্যবহার করতে দেখা যায়।

পোড়ার চিকিৎসায় এ দুটি উপকরণের ব্যবহার প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন মেডিকেল নিউজ টুডে জানায়, পোড়ার চিকিৎসায় বিভিন্ন ঘরোয়া পদ্ধতি ব্যবহার করতে দেখা যায়। তবে এসব উপায়ের কার্যকারিতার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। বরং এসব পদ্ধতি আগুনে পোড়ার ক্ষতকে আরও গুরতর করে তুলতে পারে। তাই আগুনে পোড়া ক্ষতের চিকিৎসায় ম্যাগাজিনটি যেসব উপায় এড়িয়ে চলতে বলেছে তার মধ্যে আছে— টুথপেস্ট, ডিমের সাদা অংশ, বরফ ও বাটার বা মাখন। কারণ ডিমের সাদা অংশ, টুথপেস্ট থেকে ক্ষত স্থানে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে। আবার বাটার ক্ষতস্থানটিতে তাপ আটকে রাখে। অনুরূপভাবে পোড়া স্থানে বরফের ব্যবহার ভালোর চেয়ে ক্ষতি করে বেশি।

আগুনে পোড়া ক্ষততে ডিমের ব্যবহারে কোনো উপকার পাওয়া যায়?পোড়া স্থানে ডিমের সাদা অংশ ব্যবহার করা নিয়ে জনস হপকিন্স চিলড্রেন সেন্টারের পেডিয়াট্রিক বার্ন প্রোগ্রামের পরিচালক এবং জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. আলেজান্দ্রো গার্সিয়া বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, আগুনে পোড়া ক্ষততে ডিমের সাদা অংশ ব্যবহারে উপকার পাওয়ার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। বরং এটি অনেক বেশি বিপজ্জনক। কাঁচা ডিমে সালমোনেলা (ব্যাকটেরিয়া) থাকতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়া মারাত্মক সংক্রমণ ঘটাতে পারে; এতে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা রেড ক্রস কানাডার ওয়েবসাইটে পোড়া স্থানে টুথপেস্ট ও বাটার ব্যবহারের পরামর্শকে ‘দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ভুল পরামর্শ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি পোড়া জায়গায় টুথপেস্ট লাগানোর পরিবর্তে পানি ঢালার পরামর্শ দিয়ে জানায়, ক্ষতস্থানে টুথপেস্টের ব্যবহার সেখানে তাপ আটকে রাখে। এতে পোড়ার ক্ষত আরও গভীর হতে পারে। তাই সেখানে টুথপেস্ট না লাগিয়ে পানি ঢেলে ঠান্ডা করা দরকার।

রেড ক্রস যুক্তরাজ্যের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বাটার এবং ক্রিমে থাকা তেল তাপ ধরে রাখে। অপরদিকে টুথপেস্টে থাকা মেন্থল সাময়িক শীতল অনুভূতি দিলেও প্রকৃতপক্ষে পোড়ার চিকিৎসায় এটি কোনো উপকার করে না। অনুরূপভাবে বরফও পোড়া ত্বকের ক্ষতি করে। এসব পদ্ধতির বিপরীতে বরং পোড়া স্থানে স্বাভাবিক পানি ব্যবহার করতে হবে। যদি পানি পাওয়া না যায়, তাহলে যেকোনো ঠান্ডা তরল যেমন: দুধ, কোমল পানীয় ব্যবহার করা যেতে পারে।

আগুনে পোড়া স্থানে টুথপেস্ট ব্যবহার করার উপকারিতা প্রসঙ্গে কোনো পরীক্ষিত প্রমাণ নেই উল্লেখ করে যুক্তরাজ্যের চিকিৎসা বিষয়ক দাতব্য প্রতিষ্ঠান এনসিটি জানায়, মানুষ পোড়া স্থানে টুথপেস্ট লাগায় মূলত এর মধ্যে থাকা মেন্থল থাকার কারণে। এই মেন্থলের কারণে পোড়া স্থানে সাময়িক শীতল অনুভব করে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, পোড়াস্থানের ত্বক ঠান্ডা করা।

টুথপেস্টে থাকা উপাদান আগুনে পোড়া স্থানে সাময়িক ঠান্ডা দেয়। কিন্তু এর ব্যবহার কি নিরাপদ?স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট হেলথ লাইন থেকে জানা যায়, প্রথম মাত্রার পোড়ার জন্য ঘরোয়া বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা হয়। এসব উপায়ের মধ্যে টুথপেস্ট একটি। কিন্তু টুথপেস্ট পোড়ার চিকিৎসায় কার্যকর উপায় না। কারণ, টুথপেস্টে থাকা সোডিয়াম ফ্লুরাইড মূলত দাঁতের অ্যানামেলের ওপর আবরণ তৈরি করে ক্ষয়রোধ করে। টুথপেস্ট যখন পোড়া ত্বকে ব্যবহার করা হয় তখন সেখানে তাপ আটকে যায়, সেই সঙ্গে ব্যাকটেরিয়ার মতো জীবাণুও আটকে ফেলে। এমনকি ফ্লুরাইড–মুক্ত টুথপেস্ট, যা বেকিং সোডা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি, সেসব টুথপেস্ট ব্যবহারেও কোনো উপকার পাওয়া যায় না। 

ওয়েবসাইটটি থেকে আরও জানা যায়, কেবল টুথপেস্ট নয়, বরফ, বাটার, ডিমের সাদা অংশের মতো উপকরণগুলোও পোড়ার চিকিৎসায় ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা উচিত।

স্বাস্থ্যবিষয়ক সংবাদ ও তথ্য প্রকাশকারী আমেরিকান করপোরেশন ওয়েব এমডি জানায়, কাঁচা ডিমে সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। পোড়া স্থানে কাঁচা ডিম বা ডিমের সাদা অংশ প্রয়োগের মাধ্যমে ওই স্থান ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত হতে পারে। বরং পোড়া স্থানে ১০ থেকে ১৫ মিনিট পানি ঢেলে অ্যালোভেরা পেস্ট (ঘৃতকুমারী) ব্যবহার করা যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের বার্ন অ্যান্ড রিকনস্ট্রাকটিভ সেন্টারস অব আমেরিকা পোড়া স্থানে কেন টুথপেস্ট ব্যবহার করা উচিত নয় সে সম্পর্কে বলে, কোনো স্থান পুড়ে গেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে আক্রান্ত স্থান পরিষ্কার এবং ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ামুক্ত রাখা। আক্রান্ত স্থানে টুথপেস্টের ব্যবহার ওই স্থানকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। কারণ, টুথপেস্টের উপাদানগুলো জ্বালাপোড়া বাড়িয়ে দিতে পারে বা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। কোনো স্থান পুড়ে গেলে মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে ওই স্থানকে দ্রুত ঠান্ডা করা। তবে অনেক টুথপেস্টে থাকা মিন্ট ফ্লেভার মুখে সতেজ অনুভূতি দিলেও আগুনে পোড়া ক্ষতের কোনো উপকার করে না। বরং ওই স্থানের জ্বালাপোড়া বাড়িয়ে দিতে পারে।

সুতরাং পোড়া স্থানে কাঁচা ডিম বা টুথপেস্ট ব্যবহার তাৎক্ষণিক আরাম দিলেও এতে ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে। বরং পোড়া স্থানে বেশি করে পানি ঢেলে ঠান্ডা করার চেষ্টা করা উচিত। এরপর প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত