Ajker Patrika

গ্যাস-সংকট বাড়ছে, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প উৎপাদন

সাজ্জাদ হোসেন, ঢাকা
আপডেট : ০২ আগস্ট ২০২২, ০৮: ৫৬
গ্যাস-সংকট  বাড়ছে, ক্ষতিগ্রস্ত  শিল্প উৎপাদন

আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের অতিরিক্ত দামের কারণে স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই সিদ্ধান্তের ফলে বাতিল করা হয়েছে আগস্ট মাসের তিন কার্গো স্পট এলএনজি আমদানি। বাতিল করা হতে পারে সেপ্টেম্বর মাসের কার্গোও। এর ফলে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ কমবে।

গ্যাস খাতের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তে দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে। একই সঙ্গে উৎপাদনমুখী শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ব্যাহত হবে কৃষির জন্য ব্যবহৃত সারের উৎপাদনও। পেট্রোবাংলার সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) জুলাই মাসের তিনটি স্পট কার্গো ক্রয় করার জন্য এপ্রিলের মাঝামাঝি প্রক্রিয়া শুরু করলেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অনুমোদন দেয় জুনের মাঝামাঝি সময়ে। পরে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি থাকার কারণে সেই ক্রয় প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। আরপিজিসিএলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট ২০ মার্কিন ডলারে না নামা পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ থাকবে।

বাংলাদেশ সর্বশেষ স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কার্গো কেনে গত জুন মাসে। তখন প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট এলএনজির দাম পড়ে ২৪ দশমিক ৭৫ মার্কিন ডলার। গত ১৮ জুলাই এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্পট মার্কেটে প্রতি এমএমবিটিউ এলএনজির দাম ৩৬ দশমিক ৫৯৪ মার্কিন ডলারের আশপাশে আছে।

পেট্রোবাংলার স্পট এলএনজি পরিকল্পনা ভন্ডুল
পেট্রোবাংলার ২০২১-২২ সালের এলএনজি ক্রয় পরিকল্পনা হোঁচট খেয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি লং টার্ম থেকে এলএনজি ক্রয় করবে ৬৪টি কার্গো। তার মধ্যে কাতারের রাসগ্যাস ৪০টি কার্গো ও ওমানের প্রতিষ্ঠান ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল ২৪টি কার্গো সরবরাহ করবে।

তবে পেট্রোবাংলা সমস্যায় পড়েছে স্পট মার্কেট থেকে ৩০টি কার্গো কেনা নিয়ে। স্পট মার্কেট পরিকল্পনা অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১২টি কার্গো ক্রয় করা হয়েছে। বাংলাদেশে শীতকাল থাকায় বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা কম থাকে। তাই জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাসের জন্য ১৮টি স্পট কার্গোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

কিন্তু সেই পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে স্পট এলএনজির আকাশচুম্বী দামের কারণে। করোনা-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতি একযোগে খুলে যাওয়ায় এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রতি এমএমবিটিউ স্পট এলএনজির দাম ৪০ মার্কিন ডলারে ঠেকেছে।

পেট্রোবাংলার একটি সূত্র জানায়, অতিরিক্ত দামের কারণে জুলাই মাসের জন্য নির্ধারিত তিনটি কার্গো ক্রয় বাতিল করা হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসের কার্গো ক্রয়ও অনিশ্চিত। দাম সহনীয় পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত সরকার এখন স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি ক্রয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতি কার্গো এলএনজির ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৩৮ হাজার কিউবিক মিটার।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইজাজ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা নিজস্ব উৎসে গ্যাস অনুসন্ধান না করে এলএনজিনির্ভর হওয়ার কারণেই বর্তমান সংকট। সরকারের উচিত ছিল এলএনজির পাশাপাশি নিজস্ব উৎসে গ্যাস অনুসন্ধান করা। এলএনজির আমদানিতে লং টার্ম ও স্পটের প্রায় ৫০: ৫০ রেশিও আমাদের এখন ভোগাচ্ছে। আমাদের উচিত ছিল লং টার্মে ৭০ শতাংশ রেখে বাকিটা বিশেষ প্রয়োজনে স্পট থেকে কেনা।’

ডলার সাশ্রয়ে এই পদক্ষেপ
পেট্রোবাংলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, লং টার্ম চুক্তি থেকে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম পড়ছে গড়ে ১৫ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি ক্রয় করলে প্রতি এমএমবিটিউতে খরচ পড়বে প্রায় ৩৭ ডলার।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, স্পট মার্কেট থেকে আগে তাঁরা যে কার্গো সাত-আট শ কোটি টাকায় কিনতেন, এখন তা কিনতে লাগছে ২১-২২ শ কোটি টাকা। বর্তমান বাজারদরে এলএনজি কেনার জন্য পর্যাপ্ত টাকা পেট্রোবাংলার নেই।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা আরও বলেন, একদিকে এলএনজির দাম বেশি অন্যদিকে ডলার সংকট। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে টাকার অবমূল্যায়ন। এই সব কারণে সরকার বেশি দামে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করতে চাইছে না।

এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘বর্তমানে স্পট মার্কেটে এলএনজির যে দাম, তা আমাদের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। এলএনজির দাম সহনীয় পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ থাকবে।’

গ্যাসের চাহিদা ও জোগান
গ্যাস খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন, কলকারখানার ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে, সার উৎপাদনে এবং আবাসিকে চাহিদা মেটাতে দৈনিক ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। এই চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ আছে ২ হাজার ৮৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।

বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে গ্যাসের চাহিদা
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২২৫২ এমএমসিএফডি গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ আছে ১০২০.১ এমএমসিএফডি। অন্যদিকে সার কারখানায় ৩১৬ এমএমসিএফডি গ্যাসের বিপরীতে গ্যাসের জোগান আছে ১৬৬.৪ এমএমসিএফডি। গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংকটের কারণে দেশের বৃহত্তম ইউরিয়া উৎপাদনকারী যমুনা সার কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে বন্ধ রয়েছে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের উৎপাদনও। এই দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রয়োজনের তুলনায় গ্যাসের চাপ কম থাকায় উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা।

শিল্প উৎপাদন ও ব্যাহত
গ্যাস-সংকটের কারণে রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গ্যাসের চাপ কম থাকার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় অনেক রপ্তানিকারককে নৌপথের পরিবর্তে আকাশপথে পণ্য পাঠাতে হচ্ছে। বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন ‘গ্যাস-সংকটের কারণে আমাদের উৎপাদন ৫০ ভাগ কম হচ্ছে। আমাদের ফেব্রিক, স্পিনিং এবং কম্পোজিট কারখানাগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা দিনের বেলায় কোনো গ্যাস পাচ্ছি না। আমার কারখানার জন্য গ্যাসের চাপ হচ্ছে ১৫ পিএসআই, কিন্তু পাচ্ছি ১.৫-৫ পিএসআই।’ তিনি আরও বলেন, ‘গ্যাসের চাপ কম থাকায় কম্পোজিট কারখানাগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আমরা তাই বাধ্য হয়ে বিদেশ থেকে ফেব্রিকস আমদানি করছি। এতে ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ডিএনসিসির পদ ছাড়লেন এস্তোনিয়ার নাগরিক আমিনুল ইসলাম

ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল নিয়ে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা, চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ

এনআইডির নাম ও জন্মতারিখ সংশোধনের দায়িত্বে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা

পদত্যাগ করব না, আলোচনা করে সমাধান করব: কুয়েট উপাচার্য

কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর অতর্কিত গুলি, নিহত ২৬

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত