Ajker Patrika

এবার সহজে পার পাওয়া যাবে না

ড. মইনুল ইসলাম
এবার সহজে পার পাওয়া যাবে না

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তিনবার ক্ষমতায় থাকার পর চতুর্থবারের জন্য ক্ষমতায় ফেরা আওয়ামী লীগের জন্য সহজ না-ও হতে পারে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে কিংবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচনে অনেক ক্ষেত্রে দিনের ভোট রাতে হওয়ার অভিযোগের কারণে গত সাড়ে চার বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দেশের বিরোধী দলগুলোর পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশেরও কূটনৈতিক আক্রমণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করত বলে সাধারণ ধারণা থাকলেও নির্বাচনের আগের রাতে পুলিশি প্রহরায় এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় ব্যালট বাক্সগুলো ভরে ফেলার যে ন্যক্কারজনক ঘটনাটি দেশের অধিকাংশ এলাকায় ঘটানো হয়েছিল, তার সত্যতা সম্পর্কে সিংহভাগ জনগণের মনে বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে গেড়ে বসেছে।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশে জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি এবং বাংলাদেশ সফরে আসা মার্কিন কূটনীতিক ডোনাল্ড লু ভবিষ্যতে জালিয়াতিমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাঁদের দেশের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করায় ২০১৮ সালের নির্বাচনের অগ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারটি আবারও সামনে চলে এসেছে। এ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ যতই গলাবাজি করুক, ওয়াকিবহাল মহল ঠিকই বুঝতে পারার কথা যে ব্যাপারটা আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় বিরাট ধস নামিয়েছে। তার কিছুটা আলামত আমরা দেখলাম রংপুর ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি এসব ফলাফলকে ব্যতিক্রমী বাস্তবতা মনে করেন, তাহলে চরম ভুল করবেন, এটাই সারা দেশের আসল বাস্তবতা। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দুর্নীতিবাজ, পুঁজি-লুটেরা ও পুঁজি পাচারকারীদের দল হিসেবে মনে করছে। অতএব, আগামী সংসদ নির্বাচন যদি রংপুর ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো সুষ্ঠু হয়, তাহলে সারা দেশেই একই রকম বিপর্যয় আওয়ামী লীগের ঘটবে না, সেই নিশ্চয়তা কোথায়? সময় থাকতে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ না করলে আগামী নির্বাচনেও জালিয়াতি করা ছাড়া তাদের জয়ের কোনো পথ খোলা থাকবে না। কারণ, এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ এ রকম জালিয়াতি কোনোমতেই মেনে নেবে না। এ রকম আলামত দেখলে তাদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেওয়াও হতে পারে।

২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু গত সাড়ে চার বছরে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম একেবারেই ‘বাত কা বাতে’ পর্যবসিত হয়েছে। আমাদের স্মরণে আছে, ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পরপর পাঁচ বছর বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতি গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের বিশ্ব-র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা অর্জন করেছিল। ওই পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম বছর ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ, পরের চার বছর ক্ষমতাসীন ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট।

এরপর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের শাসনামলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচণ্ড দমননীতি বাস্তবায়নের কারণে বাংলাদেশ ওই ‘ন্যক্কারজনক চ্যাম্পিয়নশিপ’ থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হয়ে পরিকল্পিতভাবে ওই দুর্নীতি দমন অভিযানকে গলা টিপে মেরে ফেলার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে ‘নখদন্তহীন ব্যাঘ্রে’ পরিণত করেছেন। ফলে আবার দেশে দুর্নীতির তাণ্ডব পুরোদমে চালু হয়ে গেছে। ২০১৪ সাল থেকে সাড়ে ৯ বছর ধরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা অর্জন করে চলেছে, সর্বশেষ বিশ্ব-র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ১২ নম্বর দেশ হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদিও দাবি করে থাকেন যে তাঁকে কেনা যায় না, তবু সাধারণ জনগণের মনে বিশ্বাস গেড়ে বসেছে যে দুর্নীতির ব্যাপকতায় বর্তমান সরকারের আমল বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আমলকে ছাড়িয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অধিকাংশই গত সাড়ে ১৪ বছরে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়ার ব্যাপারটা তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের কাছে পুরোপুরি দৃশ্যমান। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের আত্মীয়স্বজন এবং উদার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী 
ও আমলারা ‘ক্ষমতার আলাদিনের 
চেরাগ’ পেয়ে কোটিপতির কাতারে উত্তীর্ণ হওয়ার ব্যাপারটা লুকোনোর কোনো উপায় আছে কি?

অন্যদিকে, দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার এখন অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকটে পরিণত হয়েছে। ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে সরকারের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) বরাত দিয়ে দেশের পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল যে শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আমদানির ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে প্রতিবছর এখন কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে (অথবা বিদেশে হুন্ডিওয়ালাদের কাছে বিক্রীত ডলার ও অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না, কিন্তু তার সমপরিমাণ টাকা হুন্ডিওয়ালাদের প্রদানের মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে), যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডি প্রক্রিয়ার বেলাগাম বিস্তারের মাধ্যমে।

আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে টালমাটাল অবস্থায় পৌঁছে গেছে, সেটার জন্য প্রধানত দায়ী পুঁজি পাচার। পুঁজি পাচারের চাহিদার প্রধান গ্রাহক হলো দুর্নীতিবাজ আমলা, প্রকৌশলী, লুটেরা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকঋণ গ্রহীতারা। হুন্ডি প্রক্রিয়ায় যে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার দাবি করছে সিআইডি, তার সমপরিমাণ ডলার বা অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ চাহিদাকারী ওপরে উল্লিখিত গোষ্ঠীগুলো। এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের আত্মীয়স্বজন এবং উদার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী ও আমলারা যে উল্লেখযোগ্য অংশ হিসেবে পুঁজি পাচার করে দেশে-বিদেশে আরাম-আয়েশে দিন গুজরান করছেন, সেটাও বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের ফসল সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দেশে-বিদেশে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। টরন্টোর বেগমপাড়া, সিডনির ফ্রেটারনিটি কিংবা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম এখন দেশে আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করছে।

অতএব, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে ‘বাত কা বাত’ বানিয়ে রেখে পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচার সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না। জনগণ যে এ জন্য আওয়ামী লীগকে পরিত্যাগ করেছে, তারই আলামত আমরা দেখলাম রংপুর ও গাজীপুর মেয়র নির্বাচনে এবং এটাই সারা দেশের বাস্তবতা। আগামী সংসদ নির্বাচন যদি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অবাধ হয়, তাহলে একই রকম বিপর্যয় আওয়ামী লীগের জন্য সারা দেশে অপেক্ষা করছে। অবশ্য, এটাও বলা প্রয়োজন, এখন থেকে যদি সত্যিকারভাবে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্যভাবে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা হয়, তাহলে আগামী কয়েক মাসে আওয়ামী লীগের হারানো জনপ্রিয়তা কিছুটা পুনরুদ্ধার হতেও পারে। ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, তার জন্য একক কারণ ছিল ওই সরকারের সফল দুর্নীতি দমন অভিযান।

মানুষের কাছে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের জন্য চিহ্নিত হোমরাচোমরাদের ওই সময় যেভাবে নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছিল, সেটা এখনো আমরা ভুলে যাইনি, আওয়ামী লীগের নেতাদেরও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ওই ধরনের আরেকটি অভিযান যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবিলম্বে শুরু করেন, তাহলে তাঁর নেতৃত্বে অর্জিত দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, মাথাপিছু জিডিপির প্রসার এবং ২০২২ ও ২০২৩ সালে বাস্তবায়িত মেগা প্রজেক্টগুলোর সুফল তিনি আগামী নির্বাচনে ঘরে তুলতে সক্ষম হবেন বলে আমার বিশ্বাস। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব যদি ভেবে থাকেন যে ২০১৮ সালের মতো আবারও ব্যালট-জালিয়াতি বা ভোটকেন্দ্র দখল করে তাঁরা বাজিমাত করবেন, তাহলে চরম ভুল হবে। ব্যাপারটা দেশে-বিদেশে ‘আনচ্যালেঞ্জড্’ যাবে না।

ইতিমধ্যে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের পালে কিছুটা হলেও যে হাওয়া লেগেছে, তা কি অস্বীকার করা যাবে? আমার আশঙ্কা, এফবিসিসিআই নেতাদের সমর্থন সত্ত্বেও এবার আওয়ামী লীগের খবর আছে। ভারতের কৃপাধন্য হলেও এবার সহজে পার পাওয়া যাবে না। নির্বাচনের আগের চার-পাঁচ মাস দেশে রাজনৈতিক সংঘাত মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। সাধু সাবধান! 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ডিএনসিসির পদ ছাড়লেন এস্তোনিয়ার নাগরিক আমিনুল ইসলাম

ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল নিয়ে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা, চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ

এনআইডির নাম ও জন্মতারিখ সংশোধনের দায়িত্বে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা

পদত্যাগ করব না, আলোচনা করে সমাধান করব: কুয়েট উপাচার্য

কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর অতর্কিত গুলি, নিহত ২৬

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত