Ajker Patrika

ইভি ব্যাটারির উপাদান খুঁজতে গিয়ে উজাড় সমুদ্রের আমাজন

অনলাইন ডেস্ক
ছোট ছোট সবুজে ঘেরা দ্বীপের সমারোহ নিয়ে রাজা আমপাট দ্বীপপুঞ্জ। ছবি: গ্লোবাল উইটনেস।
ছোট ছোট সবুজে ঘেরা দ্বীপের সমারোহ নিয়ে রাজা আমপাট দ্বীপপুঞ্জ। ছবি: গ্লোবাল উইটনেস।

রাজা আমপাট দ্বীপপুঞ্জ, ইন্দোনেশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম পাপুয়া প্রদেশের এক সবুজে ভরা সৌন্দর্যের আধার। যাকে ‘সমুদ্রের আমাজন’ নামে অভিহিত করা হয়। ছোট ছোট সবুজে ঘেরা দ্বীপের সমারোহ নিয়ে এই রাজা আমপাটের ওপর নজর পড়েছে ‘শিল্পায়ন’-এর। নিকেলের খোঁজে খননের কারণে এই সবুজের আধার নিঃস্ব হতে চলেছে।

পরিবেশকর্মীদের ড্রোনে ধারণ করে বিবিসিকে পাঠানো ছবিতে দেখা যায়, নিকেলসহ বিভিন্ন ধরনের খনিজের সন্ধানে খননের কারণে রাজা আমপাটের বনাঞ্চল উজাড় হয়ে গেছে। পৃথিবীর অন্যতম জীববৈচিত্র্যপূর্ণ সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের এই এলাকায় পানি দূষিত হয়ে পড়েছে।

গত বছর ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ)-এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্বের মোট নিকেল খনন উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি এখন ইন্দোনেশিয়ায় হচ্ছে।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থা গ্লোবাল উইটনেসের অনুসন্ধানে উঠে আসে ওই এলাকার পরিবেশগত ক্ষতির মাত্রা। সেখানে দেখা যায়, বনভূমি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ভূমিক্ষয় থেকে সৃষ্ট পলি পানিতে গিয়ে মিশেছে, যেখানে রয়েছে জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ প্রবাল প্রাচীর। এই পলির কারণে ধ্বংস হচ্ছে সমুদ্রের তলদেশের বাস্তুসংস্থান।

গ্লোবাল উইটনেস জানায়, ২০২০ থেকে ২০২৪—এই চার বছরে রাজা আমপাট দ্বীপপুঞ্জের একাধিক ছোট দ্বীপে প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে খননকাজ চলেছে, যা ৭০০টি ফুটবল মাঠের সমান।

গ্লোবাল উইটনেসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই অঞ্চলে নিকেল খননের মাত্রা ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছে। বৈদ্যুতিক যানবাহনের (ইভি) ব্যাটারি এবং স্টেইনলেস স্টিলে নিকেল প্রয়োজন হয়।

২০২৪ সালে ফরেস্ট ওয়াচ ইন্দোনেশিয়ার এক গবেষণায় দেখা গেছে, ওই এলাকায় খননের কারণে বনভূমি বিলীন হচ্ছে আর এর সঙ্গে বন্যা ও ভূমিধস বাড়ছে।

একই বছর ইন্দোনেশিয়ার বৃহৎ দ্বীপ সুলাওয়েসিতে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন যুক্তরাজ্যের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মিকায়েলা গুও ইয়িং লো। দেশটির অধিকাংশ নিকেল মজুদ এই দ্বীপেই অবস্থিত। স্থানীয় সম্প্রদায়ের ওপর খননের প্রভাব নিয়ে করা ওই গবেষণায় দেখা যায়, খনন কার্যক্রম দারিদ্র্য কিছুটা কমালেও পরিবেশগত অবস্থা দৃশ্যমান পর্যায়ে খারাপ হয়েছে। বিশেষ করে ওই এলাকায় পানি ও বায়ুদূষণ বেড়েছে।

ড. লো বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়া নিজেকে বৈশ্বিক নিকেল বাজারে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এতে স্থানীয়ভাবে যা ঘটছে, তা ভুলে গেলে চলবে না।’

জাকার্তাভিত্তিক সংগঠন জাটাম-এর পরিবেশ আন্দোলনকর্মী ইমাম শোফওয়ান বলেন, ‘ওরা বলছে নিকেল জলবায়ু সংকটের সমাধান। অথচ এটা বন উজাড় করছে, চাষের জমি নষ্ট করছে।’

তিনি আরও উল্লেখ করেন, নিকেল যেখানে পাওয়া যায়, সেসব উপকূলীয় নিচু অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।

তবে বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার সরকার এই দূষণের বিষয়ে কিছুটা সতর্ক হয়েছে। এই সপ্তাহে সরকার রাজা আমপাট দ্বীপপুঞ্জে খনন চালাচ্ছে এমন পাঁচটি কোম্পানির মধ্যে চারটির লাইসেন্স বাতিল করেছে। এক বিবৃতিতে ইন্দোনেশিয়ার পরিবেশ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘রাজা আমপাটের জীববৈচিত্র্য বিশ্ব ঐতিহ্য, যা আমাদের রক্ষা করতেই হবে। এই অঞ্চলে খনন কার্যক্রমের প্রতি আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে নজর রাখছি।’

খননে বিলীন হয়ে যাচ্ছে রাজা আমপাটের অপরূপ সৌন্দর্য। ছবি: গ্লোবাল উইটনেস।
খননে বিলীন হয়ে যাচ্ছে রাজা আমপাটের অপরূপ সৌন্দর্য। ছবি: গ্লোবাল উইটনেস।

পরিবেশ কর্মীরা সরকারের এক সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে গ্রিনপিসসহ পরিবেশ নিয়ে কাজ করছে এমন কয়েকটি সংস্থা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে খনন কোম্পানিগুলোর আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যেতে পারে।

এর মধ্যে গ্যাগ দ্বীপে যে কোম্পানিটি কার্যক্রম পরিচালনা করছে, সেটিকে এখনো খনন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কারণ সেখানে নিকেলের অত্যন্ত সমৃদ্ধ ভান্ডার রয়েছে। তবে সরকার জানিয়েছে, ওই এলাকায় পরিবেশগত যে ক্ষতি হয়েছে তা পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দেওয়া হবে।

কোরাল রিফ সংরক্ষণবিদ ও পরিবেশবিজ্ঞানী ড. মার্ক আরডম্যান গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজা আমপাটে কাজ করছেন। সেখানে একটি হাঙর পুনর্বাসন প্রকল্প ‘রিশার্ক’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি।

খননে বিলীন হয়ে যাচ্ছে রাজা আমপাটের অপরূপ সৌন্দর্য। ছবি: গ্লোবাল উইটনেস।
খননে বিলীন হয়ে যাচ্ছে রাজা আমপাটের অপরূপ সৌন্দর্য। ছবি: গ্লোবাল উইটনেস।

আরডম্যান বলেন, এটি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের বৈশ্বিক কেন্দ্রবিন্দু। খননের অনুমতি বাতিলের সরকারের সিদ্ধান্তে তিনি অভিভূত এবং দারুণ খুশি হয়েছেন। তাঁর মতে, ইন্দোনেশিয়ার সাধারণ মানুষের ক্ষোভের কণ্ঠস্বরই সরকারকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বাধ্য করেছে।

আরডম্যান আরও বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়ার জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও পরিবেশ সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ইন্দোনেশিয়ায় প্রচুর পরিমাণে নিকেল রয়েছে—যেভাবেই হোক, এর কিছু তো মাটির নিচ থেকে উঠবেই।’

ড. মার্ক আরডম্যান মন্তব্য করেন, ‘খনন কার্যক্রম সব সময়ই পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলে। কতটুকু ক্ষয়ক্ষতি আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত?’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত