Ajker Patrika

‘সোনালি’ বাঘ কেন দুশ্চিন্তায় ফেলল বন্য প্রাণী গবেষকদের

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৬: ৩০
Thumbnail image

বন্য প্রাণীবিষয়ক আলোকচিত্রী ও সাফারি গাইড গৌরব রামনারায়ণ ভারতের কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানে একটি ‘সোনালি’ বাঘের ছবি তোলেন। এটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী ও প্রকৃতিপ্রেমীদের মধ্যে বিপুল সাড়া ফেলে। তবে এই সোনালি বাঘ বন্য প্রাণী গবেষক ও সংরক্ষকদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন? 

গৌরব রামনারায়ণ গত ২৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় যখন একটি সাফারিতে বের হন, তখন বাঘের খোঁজ করছিলেন না তিনি। ২৫ বছরের এই তরুণ কিছু পর্যটককে নিয়ে জঙ্গলে ঘুরছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল অন্য প্রাণী দেখা।

এখানে জানিয়ে রাখা ভালো, ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য আসামের ৪৩০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যান ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য। আসামের জঙ্গলগুলোর মধ্যে এই অরণ্যেই সবচেয়ে বেশি বাঘ আছে। তবে দেখা মেলে কম। বরং অন্য বন্য প্রাণীর জন্য বেশি পরিচিতি জাতীয় উদ্যানটির। এর মধ্যে আছে এক শৃঙ্গ গন্ডার ও বিভিন্ন প্রজাতির বর্ণিল পাখি। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি এক শৃঙ্গ গন্ডারের বাস এই বনেই। তো সেদিন এগুলোরই খোঁজ করছিলেন তাঁরা। 

সাফারি জিপে বসে দলটির সদস্যরা হঠাৎ একটি হরিণের সতর্ক গলায় ডাক শুনলেন। শিকারি কোনো প্রাণীর উপস্থিতি টের পেলেই কেবল এরা এমন সতর্ক সংকেত দেয় বলে জানান রামনারায়ণ। তিনি গাড়ি চালানো শুরু করেন। গাড়িটি একটি বাঁক নিয়ে এক জায়গায় দাঁড় করালেন। তখনই প্রায় ৭০০ মিটার দূরে, রাস্তায় একটি বাঘ দেখতে পেলেন। 

 ‘প্রথম যখন ওটাকে দেখলাম, একেবারে সাদা দেখাচ্ছিল। সাধারণ একটি বাঘ মনে হচ্ছিল না একে মোটেই।’ বলেন, ২০১৬ সাল থেকে ট্যুর গাইডের কাজ করা এবং বন্য প্রাণীর ছবি তোলা রামনারায়ণ, ‘এটা যে অন্য সব বাঘের মতো নয়, তা বোঝার মতো যথেষ্ট বাঘ আমি জীবনে দেখেছি।’ 

ক্যামেরা লেন্সের ভেতর দিয়ে যখন বাঘটির দিকে তাকালেন, সন্দেহ সত্যি বলে প্রমাণিত হলো। স্ট্রবেরি-সোনালি ডোরাসহ প্রাণীটি নিঃসন্দেহে একটি বিরল সোনালি বাঘ। 

রামনারায়ণন বলেন, ‘বাঘটি আমাদের দিকে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে আক্রমণের বা আমাদের ক্ষতি করার কোনো ইচ্ছায় নয়, বরং সম্পূর্ণরূপে তার পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া এবং নিজের এলাকা চিহ্নিত করাটাই ছিল উদ্দেশ্য।’ 

বাঘটি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় জিপের ১০০ মিটারের মধ্যে চলে এল। এ সময় ওটার দুর্দান্ত কয়েকটি ছবি তুলতে সক্ষম হন রামনারায়ণ। তিনি অনলাইনে একটি ছবি পোস্ট করলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা অসাধারণ ছবি এবং বাঘের অস্বাভাবিক রঙের জন্য প্রশংসায় ভাসিয়ে দেন। 

কিন্তু সোনালি বাঘ, যেটি সোনালি পশমি বাঘ বা স্ট্রবেরি বাঘ নামেও পরিচিত, মোটেই বাঘের কোনো উপপ্রজাতি নয়। একটি জিনগত মিউটেশনের ফলাফল হিসেবে এদের লোমের রং পরিবর্তিত হয়। দেখতে সুন্দর হলেও এদের উপস্থিতির একটি অন্ধকার দিকও আছে। 

এসব তথ্য জানা যায়, মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে।

ভারতের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেসের ইকোলজির অধ্যাপক উমা রামকৃষ্ণান বলেন, সাদা এবং তুষারসাদা বাঘের মতো সোনালি বাঘগুলো হলো এমন একটি অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের ফল, যা রং সৃষ্টিকারী জিনের মিউটেশন হিসেবে উপস্থিত হয়।

সাদা বাঘে মিউটেশন রং সৃষ্টিতে বাধা দেয়। এদিকে সোনালি বাঘে জিনের এমন একটি মিউটেশন, যা লোম বা চুলের বৃদ্ধির সময় লাল-হলুদ রঞ্জক উৎপাদন সময়কে প্রসারিত করে। সাদা বাঘগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে অপ্রত্যাশিত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়, তাদের একটি সাদা কোটের মতো থাকে, যেখানে খুব সামান্য দৃশ্যমান স্বর্ণকেশী ডোরা থাকে। তাই তাদের কেউ কেউ ডোরাবিহীন বাঘও বলেন। 

বুনো পরিবেশে প্রতি ১০ হাজার বাঘের বাচ্চার মধ্যে একটির এমন সাদা লোম নিয়ে জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা, এদিকে সোনালি লোমের বাঘের শাবক জন্মানোর সম্ভাবনা আরও বেশি বিরল। এ কারণেই সংরক্ষণবাদীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এই বাঘের উপস্থিতি বিচ্ছিন্ন বাঘের জনসংখ্যায় প্রজননের লক্ষণ হতে পারে।

এ রকম অস্বাভাবিক লোমের বিষয়টি বন্দী বাঘের বেলায় তুলনামূলকভাবে কম বিরল। এগুলো প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে জানান রামকৃষ্ণান। সাদা বাঘ এই জিনগুলোর জন্য বেছে বেছে প্রজনন করা হয়। এমনকি তাদের বংশধরদের সঙ্গেও। বর্তমানে বন্য অবস্থায় কোনো সাদা বাঘ থাকার কথা জানা যায় না। এ ধরনের শেষ বাঘটিকে ১৯৫০-এর দশকে গুলি করে মারা হয় বলে ধারণা করা হয়। গোটা বিশ্বে এ ধরনের বন্দী বাঘ আছে দুই শতাধিক।কাজিরাঙ্গা ন্যাশনাল পার্ক কর্তৃপক্ষের দাবি অরণ্যটিতে এমন চারটি সোনালি বাঘ আছে। ছবি: গৌরব রামনারায়ণ অনিয়মিত রঙের পশমের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এ ধরনের প্রজনন বাঘের বাচ্চার অন্তত চ্যাপ্টা মুখ বা ট্যারা চোখর কারণ হতে পারে। তেমনি অন্যান্য জেনেটিক মিউটেশন রোগের বিরুদ্ধে বাঘের প্রতিরক্ষাকে দুর্বল করতে পারে বলে জানান রামকৃষ্ণান। 

কিছু সূত্র অনুসারে বিশ্বজুড়ে আনুমানিক ৩০টি সোনালি বাঘ রয়েছে। কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যান দাবি করেছে, সেখানে এমন চারটি বন্য বাঘ রয়েছে। এমন বুনো সোনালি বাঘ অবশ্য পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যাওয়ার খবর মেলেনি। 

২০১৪ সাল থেকেই কাজিরাঙ্গায় সোনালি বাঘ দেখা যাওয়ার খবর মিলছে। রামনারায়ণই একমাত্র ব্যক্তি নন, যিনি এদের ক্যামেরায় বন্দী করলেন। ২০২০ সালে মুম্বাইয়ের আলোকচিত্রী ময়ুরেশ হেনদ্রে কাজিরাঙ্গায় সাফারির সময় এমন একটি বাঘের ছবি তুলে অনলাইনে পোস্ট করেন। এটি সে সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোড়ন তোলে। 

বিষয়টি পর্যটক টানার কথা বিবেচনা করলে ইতিবাচক হলেও পার্ক কর্তৃপক্ষ এটি উদ্‌যাপন করেনি। ২০২০ সালে পার্কের এক্স অ্যাকাউন্টে (আগের টুইটার) ন্যাশনাল পার্কের গবেষণা কর্মকর্তা রবীন্দ্র শর্মা বলেন, একটি খণ্ডিত জনসংখ্যার মধ্যে প্রজননের কারণে এমন জিনগুলো প্রদর্শিত হয়।

আসামের বুনো ১৯০টি বাঘের মধ্যে ৭০ শতাংশের বাস কাজিরাঙ্গায়। কিন্তু এই অঞ্চলে দ্রুত উন্নয়নের অর্থ বন্য প্রাণীগুলো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার ঐতিহাসিক পথগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। ২০২০ সালের একটি গবেষণায় পার্কের চারপাশের এলাকার বনাঞ্চল ক্রমবর্ধমান হারে বিভক্ত হচ্ছে এবং বনের আশপাশের করিডর বা এক জঙ্গল থেকে অন্যটিতে চলাচলের পথ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানানো হয়। যদি কাজিরাঙ্গার বাঘের জনসংখ্যা আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে অন্তত প্রজননের মতো সমস্যাগুলো এর জনসংখ্যাকে হুমকির মুখে ফেলবে। শর্মা এক্সে তাঁর পোস্টে বলেন। 

‘বাঘ আছে এমন অঞ্চলের মধ্যে উন্নত সংযোগ, বাঘের দূরপাল্লার চলাচলকে উৎসাহিত করে—এমন জমির ব্যবহার জিনগতভাবে বৈচিত্র্যময় বাঘের জনসংখ্যা গড়ে তোলার মূল নিয়ামক বলে মন্তব্য করেন সংরক্ষণবাদী এবং ভারতের সেন্টার ফর ওয়াইল্ডলাইফ স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা কতা উল্লাস কারান্থ। তিনি বলেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে, ঝুঁকিপূর্ণ বা অতিক্রম করা কঠিন—এমন আবাসস্থলের মধ্যে সেতু এবং সুড়ঙ্গের মতো কাঠামো দিয়ে সংযোগ তৈরি করা যেতে পারে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত