Ajker Patrika

আমি অপার হয়ে বসে আছি...

ফরিদা পারভীন। ছবি: সংগৃহীত
ফরিদা পারভীন। ছবি: সংগৃহীত

ফরিদা পারভীন অসুস্থ। খবরটা শুনে একটু বিষণ্ন বোধ করছি। তিনি শারীরিকভাবে ভালো নেই, এটা আগে শুনলেও গণমাধ্যমে অসুস্থতার খবর দেখে বিচলিত না হয়ে পারিনি। ফরিদা আপার সুস্থতা কামনা করে দু-চারটা কথা না লিখে পারছি না।

ফরিদা পারভীনের গান কবে প্রথম শুনেছি, তাঁর সঙ্গে কীভাবে আমার পরিচয় হয়েছিল—এসব এখন আর তেমন জরুরি নয়। তবে এটা ঠিক, আমার কণ্ঠে গান আসে না, কিন্তু আমার কান ঠিকই সুরের কণ্ঠ চিনে নিতে পারে। সেই কানেই একদিন ধরা দিয়েছিল এক বিস্ময়কর কণ্ঠস্বর ফরিদা পারভীন। তাঁর কণ্ঠে সুর যেন বয়ে আনে কোনো আদিগন্ত ধ্যান, কোনো অদৃশ্য নদীর স্রোত। প্রথমবার শুনেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম এই কণ্ঠ হারিয়ে যাওয়ার নয়, বারবার ফিরে ফিরে বাজবে মনে।

ফরিদা পারভীনের জন্ম ১৯৫৪ সালে, শুনে একরকম আত্মিক আনন্দ হয়েছিল এ কারণে যে তিনি আর আমি একই বয়সী। একই বছরে পৃথিবীর আলো দেখেছি। জীবনের পথচলায় দূরে কোথাও এক শিল্পী-বোন আছেন, যিনি নিজের কণ্ঠে সুর ধারণ করে আমার সুরহীনতার বেদনা দূর করছেন!

ফরিদা আপার কণ্ঠে লালনের গান জাদুকরি প্রভাব ছড়ালেও ‘এই পদ্মা, এই মেঘনা’, ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম’, কিংবা ‘তুমি রাত, আমি রাতজাগা পাখি’—এসব গানও কম টানেনি শ্রোতাদের। আজও আমার কানে এগুলো বাজে। যেন নিছক গান নয়, একেকটি সময়ের দলিল।

ফরিদা পারভীনের প্রথম স্বামী আবু জাফরের লেখা এ গানগুলো একসময় আমার খুব ভালো লাগত। মনে হতো, ফরিদা পারভীনই এসব গানে প্রাণ দিয়েছেন। গানের কথা আর সুর একাকার হয়ে গিয়েছিল তাঁর কণ্ঠে। মনে হতো, তাঁর গলার ভেতরে যেন খাঁচার ভিতর এক অচিন পাখি গুনগুন করে যায়, যে পাখির ডাক শুনে মানুষ থমকে দাঁড়ায়, মনের আয়না দেখে।

পরে ফরিদা পারভীনের জীবনে এলেন বংশীবাদক গাজী আবদুল হাকিম। তাঁর দ্বিতীয় জীবনসঙ্গী, আর বাংলা বাঁশির ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাম। গাজী ভাইয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। এই শিল্পী দম্পতির বাসায় আমি একাধিকবার গিয়েছি। একসঙ্গে অনেক কথা হয়েছে, অনেক স্মৃতি জমেছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই মানুষ দুজনের কাছে বসে আমি শুধু গান শুনিনি, শুনেছি জীবন, সুর, সংবেদন আর সাঁইয়ের লীলাখেলার এক অপার রূপ। আমি অপার হয়ে বসে থাকি, আর সেই কণ্ঠে লালনের দর্শন ঢেউ তোলে আমার অনুভবের গহিনে।

২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আয়োজন করেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তিন দিনব্যাপী এক সাংস্কৃতিক উৎসব—‘উৎসবে পার্বণে’। সেই উৎসবে যখন ফরিদা আপা মঞ্চে উঠলেন, তখন হাজার হাজার মানুষ যেন এক নিমেষে নীরব হয়ে গেল। তিনি গাইলেন ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে’, ‘জাত গেল জাত গেল বলে’, ‘বাড়ির কাছে আরশীনগর’, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’সহ আরও কত গান! আর গাজী ভাই বাঁশি বাজালেন—হাওয়ার মধ্যেও যেন শব্দের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ সেদিন শুধু শোনেনি, ভেতরে-ভেতরে কেঁদেছিল।

রাজনীতিবিদ ও লেখক মোনায়েম সরকারের চামেলীবাগের বাসায় বহু অনুষ্ঠানে এই শিল্পী দম্পতির সঙ্গে দেখা হয়েছে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন দেশের নামকরা রাজনীতিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরও যাঁরা চুপচাপ বসে থাকতেন, তাঁরা ছিলেন ফরিদা পারভীনের শ্রোতা। তাঁর গানের পরিমিত মরমিয়া মাধুর্য যেন হৃদয়ের গায়ে হাত রেখে বলত—‘কে বোঝে সাঁইয়ের লীলাখেলা’?

ফরিদা আপা অসুস্থ। হৃদয় ভার হয়ে আসে। এই মানুষটি শুধু গান করেন না, তিনি এক ধারা, এক শুদ্ধ ধারা। যাঁকে একবার ছুঁয়ে গেলে ভোলা যায় না। তিনি আমাদের সংগীতের এক প্রজ্ঞাময় অধ্যায়। তাঁর গলায় লালন শুধু গান হয়ে ওঠেননি, হয়ে উঠেছেন একপ্রকার আত্মশুদ্ধির আহ্বান।

ফরিদা পারভীনকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর সুস্থতা কামনায় ভরে দিলাম আমার এই লেখা। সময় যেন তাঁকে একটু অবকাশ দেয়, যেন আবার কোনো এক ভোরে তাঁর কণ্ঠে শুনি—

‘বাড়ির কাছে আরশীনগর, সেথা এক পড়শি বসত করে...’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত