Ajker Patrika

রাসেল ও’নীল:...ফের দেখা হবে?

গুঞ্জন রহমান
আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২১, ১৮: ৩৪
রাসেল ও’নীল:...ফের দেখা হবে?

ডিজিটাল খাতা খুলে বসে আছি, প্রতি শুক্রবারের মতো নিজের কলাম লিখব বলে। লিখতে পারছি না। একটা শব্দও টাইপ করতে পারিনি। ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে একটা সুইসাইড নোট। খানিক পরে ছেড়ে যাবেন যে দেহটাকে, তাকে কাটাছেঁড়া না করতে অনুরোধ করেছেন একজন গীতিকবি। এক জীবনের শেষ অনুরোধ। কবি কি আসলে দেহে থাকেন? রক্তমাংসের দেহকে কেটে-ছিঁড়ে জানা যায় কি কবিকে? জানা যায় মৃত্যুর কারণ? কবির কি মৃত্যু হয়? কবি বরাবর সত্য বলেন। কিন্তু কবি রাসেল ও’নীল শেষ কথাটা মিথ্যা লিখে গেলেন। লিখে গেলেন, ‘কেউ দায়ী নয়’।

বললেই হলো কেউ দায়ী নয়? মৃত্যু কোনো আনন্দভ্রমণ নয় যে স্বপ্রণোদিত হয়ে কেউ খুশিমনে টিকিট কেটে হাসতে হাসতে চেপে বসবে মৃত্যু-শকটে। অনন্যোপায় শেষযাত্রায় পা বাড়ানোর কঠোরতম সিদ্ধান্তটা নেওয়ার পেছনে কেউ তো নিশ্চয়ই দায়ী। কে সেটা? কিংবা, কে কে? জানা যাবে না। কোনো দিন আর জানা যাবে না। কারণ, কবি নিজেই চাননি জানাতে। আমরা তাঁর কে, যাকে উজাড় করে জানাবেন অন্তর-বাহির? আমরা কতটাই-বা জানতে চেয়েছি? জানতে চাই? একজন কবিকে? বিশেষ করে, গীতিকবিকে? তিনি যা জানান, তাও তো আমরা ‘তাঁর কথা’ বলে জানি না। জেনে নিই, কিংবা ধরে নিই এবং মেনে নিই অন্য কারও কথা বলে। যাঁর কণ্ঠে শুনি সেই গীতিকাব্য, তাঁর কথাই ভাবি সবচেয়ে বেশি। আর তারপর, নিজের কথা। আমার জন্যই গেয়েছেন আমার প্রিয় শিল্পী। কে লিখে দিলেন সেই গান–তিনি তখন অনেক তফাতে। তাই রাসেল ও’নীলের গান শোনেননি এমন শ্রোতা এই প্রজন্মে বিরল হলেও রাসেলেরই যে গান এগুলো—এই কথা তাদের কজন জানতেন? কজন জানেন! 

মৃত্যু অনেক কারণেই হতে পারে। তার মধ্যে সবচেয়ে তুচ্ছ কারণ আত্মহত্যা। যার কোনো মানে নেই। যার কোনো ব্যাখ্যা নেই, যার কোনো কারণও নেই বলে দাবি করি আমরা সবাই। আমিও করি। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে—যখন এটা ঘটে, মানে এই হৃদয়বিদারক, প্রায় অসম্ভব অঘটনটা...ঠিক ওই মুহূর্তে, ওই ব্যক্তিটির স্থানে নিজেকে স্থাপন করতে চেষ্টা করে দেখুন না! দেখবেন, তখন পৃথিবীতে আর কোনো কারণ নেই, নেই কোনো আশা, কোনো সম্ভাবনা, কোনো একটা হেল্পলাইন। নচেত তিনি সফল হন কী করে আত্মহননে? আমি নিজে একাধিকবার চেষ্টা করে দেখেছি, পারিনি এবং মেনে নিয়েছি—এই পৃথিবীতে আত্মহননের চেয়ে কঠিন কাজ আর নেই, আমার পক্ষে যা করা হয়তো সম্ভব হবে না কোনো দিন। 

তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল একবারই। সেটা সম্ভবত ২০০৫ কিংবা ২০০৬ সালে। খুবই সাধারণ একটা সাক্ষাৎ। পুরানা পল্টনে সংবাদ পত্রিকার অফিসে। তিনি তখন চাকরি করতেন সেখানে। সম্ভবত বিনোদন বিভাগে। আমাকে তাঁর অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন আমার বন্ধু সুজন আরিফ। মাত্র কিছুদিন আগে আরিফের একটা নতুন গান তৈরি হয়েছিল আমার লিরিকে। সেই গান শুনে প্রশংসা করেছিলেন রাসেল ভাই। ‘ভালোবাসিরে’ শিরোনামের সেই গানটা আসলে পুরোটা আমার লেখা নয়। আরিফ নিজেই গানের মুখটুকু তৈরি করেছিল নিজের কথা ও সুরে। পরে অন্তরার সুর করে হৃদয় খান, আমি সেই সুরের ওপরে কথা সাজাই। রাসেল ভাই তখন পর্যন্ত মানতেন যে, সুর অনুসরণ করে ভালো লিরিক লেখা যায় না। আমি সুরের ওপরে লিরিক লিখি শুনে বকা দিয়েছিলেন। কিন্তু আরিফের সেই গানটা শুনে, সেটা ওভাবেই লেখা জেনে তিনি নিজের কথা ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এইটা আমার ভালো লেগেছে। মেনে নিচ্ছি, পরে লিরিক লিখেও, মানে বাঁধা মিটারে কথা সাজিয়েও ভালো লিরিক লেখা যায়।’ কিন্তু আবার এটাও বলেছিলেন, ‘আপনাকে কবিতার মতো করে, অর্থাৎ সুরের আগে লিরিক লিখার প্র্যাকটিস ছেড়ে দিলে হবে না। কারণ, আপনি লিরিকে যা বলতে চান, তা পুরোপুরি বলতে পারবেন তখনই, যখন আপনার সামনে কোনো প্যারামিটার থাকবে না।’ 

রাসেল ভাই, আপনি লিরিকে যা বলতে চেয়েছিলেন, তা কি পুরোপুরি বলতে পেরেছিলেন? অন্তত যে লিরিকে লিখেছিলেন সেই কথাগুলো, একদম ভেতরের কথা, গহিনের কথা, সেই লিরিকগুলো কি শোনাতে পেরেছেন কোনো শ্রোতাকে? কোনো সুরকার কি সুর দিয়েছেন তাতে? গেয়েছেন কোনো গায়ক? ‘রাসেলের গান’ বা ‘রাসেল ও’নীলের গান হয়ে উঠতে পেরেছিল কি কোনো গান? এখনকার বাংলাদেশে কোনো গীতিকারই কি শেষ পর্যন্ত লিখতে পারে সেই কথাগুলো? প্যারামিটার ছাড়া একটা ধবধবে শাদা-শুভ্র গানের খাতা কেউ কি দিয়েছে কোনো গীতিকারকে? দেয় কেউ! 

আপনার মৃত্যু অন্য কোনো রোগে হলে বা কোনো রোগ ছাড়াই...হয়তো দুর্ঘটনায়, কিংবা ঘুমের মধ্যে স্বাভাবিক মৃত্যু, অথবা...ওই যে ডাক্তারেরা বলেন না, হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে...দেখুন, মানুষের শরীরে কতই না অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আমরা বলি না মস্তিষ্কযন্ত্র, বলি না ফুসফুসযন্ত্র, বলি না বৃক্কযন্ত্র বা যকৃৎযন্ত্র; কিন্তু আমরা বলি হৃদ্‌যন্ত্র! হৃদয় ব্যাপারটা জড়িত যার সঙ্গে, তাকেই আমরা যন্ত্র বানিয়ে দিলাম! যন্ত্রের মতো চলতে থাকাই যার কাজ। কোনো মানবিক আবেগ স্পর্শ করবে না, কোনো ভাবালুতায় আক্রান্ত হওয়া যাবে না, সিঁড়ির নিচের কোনায় লুকানো পানির পাম্পের মতো একঘেয়ে চলতে থাকতে হবে আর রক্ত পাম্প করতে থাকতে হবে সারা শরীরে—এই হলো কাজ আমাদের হৃদয়ের। সেই যন্ত্র—কঠিন হৃদয়টা যদি সেইভাবে চালিয়ে যেতে দিতে পারতেন, যদি তাকে থামতে দিতেন নিজের নিয়মে, নিজের নির্ধারিত সময়ে, তার আগে আপনিই তাকে আগবাড়িয়ে থামিয়ে না দিতেন; এত কথা হয়তো উঠত না। মানুষ তো কতভাবেই নিজেকে ধ্বংস করে। নিজের অমিত সম্ভাবনা নষ্ট করে, প্রতিভার প্রতি অন্যায় করে, সৃজনশীলতা নষ্ট করে, নিজের স্বাধীনতা ধ্বংস করে, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার গলা টিপে মারে, নিজের কণ্ঠস্বরকে বাজেয়াপ্ত হতে দেয়...আপনি নিজের জীবনটাকেই শেষ করে দিলেন।...আপনার সাথে আমার ওই একটা দিনের পরিচয়, একদিনের আলাপ। তারপর আর কোনো দিন দেখা হয়নি, কথাও হয়নি। আমরা ফেসবুকেও ছিলাম না পরস্পরের ফ্রেন্ড লিস্টে। কিন্তু আপনার লেখা গান আমি শুনতাম। জানি না, আপনিও শুনতেন কিনা আমার লেখা গান। আমার শোনার উপযোগী গান আপনি লিখতেন নিয়মিত, আপনার শোনার উপযোগী গান আমি লিখতে পেরেছি কিনা জানি না, ওই একটা ছাড়া। একটা গোটাও নয়, অর্ধেকের একটু বেশি। সেই গানটা আপনার ভালো লেগেছিল। আর আমার ভালো লেগেছিল আপনার আন্তরিক ব্যবহার। অন্য অনেকের মতো কপট গাম্ভীর্য ধরে রেখে, কিংবা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ভদ্রতা দেখিয়ে ‘জি ভাই, ভালো আছেন’—টাইপ ফর্মালিটির ধার না ধেরে আপনি সরাসরি বলেছিলেন আপনার পছন্দ-অপছন্দের কথা। বয়সে এবং কাজের অভিজ্ঞতায় অল্প কয়েক বছরের অগ্রজ হলেও সুপরামর্শ দিতে আপনি কার্পণ্য করেননি, এবং তা করেছেন আন্তরিকতা নিয়েই। ভান-ভণিতা আমি দেখিনি আপনার আচরণে। 

আর ‘যদি না হয় কথা/জমে নীরবতা’, তাহলে কী হবে? আপনি বলেছিলেন, ‘ফের দেখা হবে।’ বলেছিলেন ‘চোখে রাখতে চোখ’, বলেছিলেন, ‘চোখে চোখে কথা হোক’। হায়, চোখই বুঁজে ফেললেন এত তাড়াতাড়ি? এই অবেলায়! বলে গেলেন, ‘যত দূরেই যাই/জানি না তো কবে/জেনে রেখো শুধু/ফের দেখা হবে।’ অথচ, এত দূরে চলে গেলেন, আর কবে দেখা হবে?...কিংবা, কে জানে, হতো বেশি দূরেও নয়, খুব দেরিও নেই! আমিই কি জানি, আমি কতটা দূরে আছি সেই শেষ গন্তব্যের?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ৪ বিচারকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল যুক্তরাষ্ট্র

প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার পর যা বলল ইইউ

আপনাদের সঙ্গে হাত মেলাব না, বিস্ফোরক তামিম

কাগজে-কলমে মেয়র হওয়ায় দায়িত্ব পালন করলাম: জাতীয় ঈদগাহ পরিদর্শন শেষে ইশরাক

এপ্রিলে নির্বাচন ঘোষণায় বিএনপি ও জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি: সালাহউদ্দিন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত