Ajker Patrika

সুখের সুরের বেহালা

আসাদ সরকার
Thumbnail image

বেহালার আরেক নাম নাকি বেদনা। এর সুর দুঃখ জাগানিয়া। হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা ক্ষত জাগ্রত করে আবার ক্ষতবিক্ষত করে বেহালার সুর। গোয়ালগাড়ি বিলের বিস্তীর্ণ জলরাশির মাঝে নৌকার পাটাতনে বসে ঠিক তেমন সুর শুনতে প্রস্তুত আমরা। শিল্পী দেওয়ান বিলকিস বানু বেহালা বাজিয়ে শোনাবেন। সঙ্গে গাইবেন গলা ছেড়ে। তাঁর গান জলভরা বিলে ভেসে ভেসে মিশে যাবে বিস্তীর্ণে। কিন্তু ঘটনা ঘটল একেবারে উল্টো। বিলকিস দেওয়ানের বেহালায় বেজে উঠল সুখের সুর। যে সুর বেদনার বদলে আনন্দিত করে।

বিলকিস বানু মনেপ্রাণে একজন সুখী মা। মাত্র পনেরো বছর বয়সে প্রখ্যাত বাউল সাধক রহিম চাঁদ দেওয়ানের ঘরে বউ হয়ে আসেন। তখন রহিম চাঁদের ঘরে অন্য স্ত্রীর পাঁচ সন্তান। স্ত্রী-পরিচয়ের প্রথম দিনেই পাঁচ সন্তানের মা হয়ে যান বিলকিস বানু। তারপর নিজের কোলেও আসে আরও পাঁচ সন্তান। বিয়ের আগেই বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। ফলে সংগীতে ছিল অন্য রকম দখল। যত দিন রহিম চাঁদ বেঁচে ছিলেন, তত দিন দুজন মিলে ১০ সন্তানকে সংগীতের তালিম দিতেন। রহিম চাঁদের মৃত্যুর পর পুরো দায়িত্ব পড়ে বিলকিস বানুর কাঁধে। ‘মা’ বা ‘ছোট মা’ থেকে হয়ে ওঠেন ‘গুরুমা’, যা আজও বিদ্যমান। ১০ সন্তানের একজন মৃত্যুবরণ করেছেন কিছুদিন আগে। বাংলাদেশ বেতারের বিশেষ শ্রেণির একজন শিল্পী ছিলেন তিনি। বাকি নয়জনের মধ্যে চার মেয়ে শ্বশুরবাড়ি। তাঁরাও শিল্পী। তবে বিয়ের পর সংগীতটা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারেননি তাঁরা। বাকি পাঁচ ছেলেই সংগীতের সাধনায় নিমগ্ন। প্রত্যেকেরই রয়েছে শিল্পী হিসেবে স্বতন্ত্র পরিচয়। বাঁশিবাদক জালাল এই মায়েরই সন্তান।

 পঁচাত্তর বছর বয়সী বিলকিস বানুর সুখের কারণ, আজও সব সন্তান তাঁর ছায়াতলে রয়েছেন। একটি মাত্র ডাক দ্ব্যর্থহীনভাবে সব সন্তানকে একত্রিত করে। বিলকিস বানুর একেকটি নির্দেশ যেন অখণ্ড বাণী। দুই মায়ের দুই সন্তান বাউল হাবিবুর ও বাঁশিবাদক জালাল ‘গুরুমা’ হিসেবে বিলকিস বানুর অবদানের গল্প শোনালেন একইভাবে। চারপাশে যখন আপন ভাইয়ে ভাইয়ে কিংবা পিতা-পুত্রের মতো বন্ধনেও সংঘাত, তখন এমন বন্ধনে আমরাও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। তাঁরা যেন বেহালার সুরের মায়ার মতোই মায়ের মায়ায় বাঁধা। আর তাই বিলকিস বানুর কাছে সুখের গল্পই শুনতে থাকি।

তিনি শোনান তাঁর শিল্পীজীবনের গল্প। করলেন ফোক সম্রাজ্ঞী মমতাজের সঙ্গে একমঞ্চে গান গাওয়ার স্মৃতিচারণা, দেশব্যাপী করা ‘কবিগানের লড়াই’-এর গল্প। শোনালেন তাঁর লেখা সাড়ে তিন শ গানের কথা। যার সব কটিই তাঁর সুর করা। বাজিয়ে শোনালেন হারমোনিয়াম, বেহালা, দোতারা ও একতারা।

নওগাঁ সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়নের রামরায়পুর দিঘির পাড়ের গোয়ালগাড়ি বিলে নৌকা যখন কিনারে ভিড়ল, তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বিদায় বেলায় আলো-আঁধারির ওই সময়েও আমরা লক্ষ করলাম প্রশান্তিমাখা এক মায়ের মুখ। কোনো বেদনার গল্প নয়, আমরা ফিরলাম সংস্কৃতির নিবেদিতপ্রাণ এক আদর্শ পরিবারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে।

বিষয়:

বিনোদন
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত