Ajker Patrika

ববিতার মুখে শোনা কয়েকটি গল্প

খায়রুল বাসার নির্ঝর, ঢাকা 
আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২৫, ২১: ০৫
ববিতা। ছবি: সংগৃহীত
ববিতা। ছবি: সংগৃহীত

বাংলা সিনেমার একটি যুগের প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ববিতা। চিরন্তন প্রেমের গল্পে যেমন তিনি মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন পর্দায়, তেমনি ভিন্ন ধরনের সব গল্প আর চরিত্রকে সঙ্গী করে ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর নামীদামি উৎসবে। বাংলা সিনেমাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বময়। আজ ৩০ জুলাই এই অভিনেত্রীর জন্মদিন। ৭১ বছর পূর্ণ করলেন তিনি। ববিতার জন্মদিনে তাঁর মুখে শোনা যাক বর্ণাঢ্য জীবনের টুকরো কিছু গল্প।

ভালো সিনেমার পাশে সব সময়

ববিতা একদিকে বাণিজ্যিক সিনেমা যেমন করেছেন, সুযোগ পেলেই হাজির হয়েছেন ভিন্ন ধরনের গল্পেও। সেসব সিনেমার সূত্রে তাশখন্দ, মস্কো, কান, বার্লিন, কার্লোভি ভ্যারিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পা পড়েছে তাঁর। সেসব উৎসবে গিয়ে পেয়েছেন প্রশংসা-পুরস্কার-সম্মাননা। সারা বিশ্বের শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। আর অসংখ্য সিনেমা দেখেছেন। বিশ্বের নানা প্রান্তের নানা ভাষার সিনেমা। সেসব অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করেছে অভিনেত্রীকে। তিনি সব সময় চেষ্টা করেছেন ভালো গল্পের সিনেমার পাশে দাঁড়াতে। পারিশ্রমিক নিয়ে ভাবেননি কখনো। ববিতা বলেন, ‘শেখ নিয়ামত আলী একটা ছবি বানাবেন দহন নামে। আমি জানতাম, তিনি আমার পারিশ্রমিক দিতে পারবেন না। তো আমি কী করতাম, বলতাম, আপনাকে পয়সা দিতে হবে না। দত্তদা (সুভাষ দত্ত) ডুমুরের ফুল বানাবেন, বসুন্ধরা বানাবেন; এ ধরনের সিনেমার ক্ষেত্রে পুরো পারিশ্রমিক নিতাম না। এ রকম করে করে আমি কিন্তু অনেক ভালো ছবি করতে পেরেছি। তারা খুশি হয়েছে, ছবিগুলো করতে পেরেছে। সেগুলো ফেস্টিভ্যালে গেছে। পুরস্কৃত হয়েছে। আমি হাততালি পেয়েছি।’

‘অশনি সংকেত’ সিনেমার শুটিং, ববিতাকে দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন সত্যজিৎ রায়। ছবি: সংগৃহীত
‘অশনি সংকেত’ সিনেমার শুটিং, ববিতাকে দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন সত্যজিৎ রায়। ছবি: সংগৃহীত

আরেকটু হলেই সুযোগ হাতছাড়া

‘অশনি সংকেত’ সিনেমায় সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় কাজ করতে পারা ববিতার অভিনয়জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। অনঙ্গ বউ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সত্যজিৎ রায় কীভাবে তাঁকে খুঁজে নিয়েছিলেন, সে গল্প তো কমবেশি সবারই জানা! বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে নির্বাচিত হয়েছিল অশনি সংকেত। এই উৎসবে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ববিতাও গিয়েছিলেন। তবে আরেকটু হলেই উৎসবে অংশ নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল অভিনেত্রীর। ববিতা বলেন, ‘মানিকদা (সত্যজিৎ রায়) আমাকে ফোন করেন কলকাতা থেকে, আমাদের অশনি সংকেত বার্লিন ফেস্টিভ্যালে যাবে। তুই কি যাবি? আমি বললাম, অবশ্যই যাব। সব প্রস্তুতি নেওয়া হলো। আমাকে বলা হলো, আমরা দিল্লি থেকে ফ্লাই করব ফ্রাঙ্কফুর্ট। সেখান থেকে তখনকার ওয়েস্ট বার্লিন। ফ্রাঙ্কফুর্টে নেমে সবার পাসপোর্ট জমা পড়ল। সবার পাসপোর্টে স্ট্যাম্প করা হলো। কিন্তু আমারটা আর হচ্ছে না। ওরা জানাল, জার্মান গভর্নমেন্ট তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। সে কারণে আমার আর যাওয়া হবে না। এটা শুনে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। এত দূর এত বড় পরিচালকের সঙ্গে এসে আমি আবার বাংলাদেশে ফেরত চলে যাব! আমার যাওয়া হবে না! আমি খুব কান্না শুরু করলাম। তখন মানিকদাকে দেখলাম, টেলিফোনে উৎসব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছেন—সে আমার ছবির আর্টিস্ট, একটা শিল্পীর দেশ-কাল-পাত্র বলে কোনো কথা নেই। কেন তাকে অ্যালাউ করা হবে না? এ রকম অনেকক্ষণ ধরে কথাবার্তা চলল। তারপর আমাকে অনুমতি দেওয়া হলো। এটা আমার জীবনের একটা বিরাট ঘটনা।’

চুমু খেয়ে অঝোরে কান্না

১৯৭৭ সালে ববিতাকে নিয়ে রাজ্জাক বানিয়েছিলেন ‘অনন্ত প্রেম’। এর শেষে একটি চুমুর দৃশ্য ছিল। এই দৃশ্য করে খুব কেঁদেছিলেন ববিতা। তিনি বলেন, ‘গল্পে আমাদের শেষ দৃশ্যে চুম্বনের দৃশ্য ছিল। রাজ্জাক ভাই আমাকে সুন্দর করে বোঝালেন—দ্যাখো, তুমি পয়জন খেয়েছ, আমি তোমাকে কিস করছি, তারপর বিষে আমরা দুজনেই মারা যাচ্ছি—এই ধরনের ব্যাপার-স্যাপার। খুব ইমোশনাল হয়ে অভিনয় করেছি। সবাই হাততালিও দিয়েছে। কাপ্তাইতে আমরা যে কটেজে ছিলাম, রাতে সেখানে ফিরে আমি খুব কাঁদছি। রাজ্জাক ভাইয়ের কানে গেল, কী হয়েছে রে, পপ নাকি কাঁদছে! রাজ্জাক ভাই আমাকে পপ বলে ডাকতেন। উনি এসে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কাঁদছ কেন? আমি বললাম, এ দৃশ্যে অভিনয় তো করলাম, মানুষ এটা দেখবে, আমার তো বোধ হয় আর কোনো দিন বিয়ে হবে না।’ ববিতার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে রাজ্জাক তাঁকে আশ্বস্ত করেন, দৃশ্যটি সম্পাদনার পর ববিতাকে দেখানো হবে। যদি তাঁর কাছে খারাপ লাগে, তাহলে সিনেমায় এটা রাখা হবে না। শেষ পর্যন্ত এ দৃশ্য ছাড়াই মুক্তি পায় অনন্ত প্রেম।

বিয়ের দিন পালিয়ে রাজ্জাকের বাসায়

ববিতার বিয়ের দিন সে এক কাণ্ড ঘটেছিল! বিয়ের দিন সকালে কাউকে না জানিয়ে চলে গিয়েছিলেন রাজ্জাকের বাসায়। সে গল্প শোনা যাক ববিতার মুখেই, ‘তখন আমার বাবা মৃত্যুশয্যায়। তিনি বলেছিলেন, মা, আমি বেঁচে থাকতে তোমার বিয়েটা দেখে যেতে চাই। তোমার যদি কাউকে ভালো লাগে বলো, না হলে আমরা দেখি। সুচন্দা আপা, দুলাভাই উনারা অনিকের আব্বা মানে আলম সাহেবের খোঁজ নিয়ে এলেন। যেদিন আমার বিয়ে হবে, পরিকল্পনা ছিল, সকালে উনারা বাসায় আসবেন। বাসায় বিয়েটা হবে। রাতে সোনারগাঁও হোটেলে বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান। অনেককে আমন্ত্রণ জানানো হলো। কিন্তু কেন আমন্ত্রণ, সেটা গোপন রাখা হলো।’

তবে বিয়ের দিন সকাল থেকে চিন্তায় পড়ে গেলেন ববিতা। ‘ভাবলাম, আমি তো বিয়ে করছি, আমার জীবনটা যদি সুখের না হয়! সকালবেলা উনারা আসবেন ১০-১১টায়। আমি করলাম কি, ব্যাকডোর দিয়ে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে রাজ্জাক ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে হাজির।’ তখনো ইন্ডাস্ট্রিতে শুধু রাজ্জাক ও তাঁর স্ত্রী জানতেন ববিতার বিয়ের কথা। এমনই পারিবারিক সম্পর্ক ছিল তাঁদের। ববিতাকে দেখে তাঁরা অবাক! অভিনেত্রী বলেন, ‘আমি গিয়ে লক্ষ্মী ভাবির কাছে বসে পড়লাম। ভাবি, আমার ভয় লাগছে!’ তাঁরা বুঝতে পারলেন ববিতার মানসিক পরিস্থিতি। তাঁকে বুঝিয়ে শান্ত করে রাজ্জাকের স্ত্রী ববিতাকে পৌঁছে দেন বাড়িতে।

‘নায়কের পোশাকও কিনে আনতাম’

শুধু তো অভিনয় নয়, ববিতার ফ্যাশনও আলোচিত ছিল ওই সময়ের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। তাঁর পোশাক, হেয়ারস্টাইল অনুসরণ করতেন তরুণীরা। এক সাক্ষাৎকারে ববিতা বলেন, ‘এটা খুব মজার ব্যাপার। তখন আমি যে ধরনের ব্লাউজ পরতাম, তা দেখে আমার ভক্তরা টেইলরের কাছে গিয়ে বলত ববিতা ব্লাউজ বানিয়ে দিতে। শুধু তা-ই নয়, আমি যে হেয়ারকাট করতাম, পারলারে গিয়ে মেয়েরা বলত, ববিতা হেয়ারকাট করে দাও।’

‘অনন্ত প্রেম’ সিনেমার দৃশ্যে রাজ্জাক ও ববিতা। ছবি: সংগৃহীত
‘অনন্ত প্রেম’ সিনেমার দৃশ্যে রাজ্জাক ও ববিতা। ছবি: সংগৃহীত

প্রতি সিনেমায় নিজের চরিত্র অনুযায়ী পোশাক নিজেই কিনতেন ববিতা। কখনো প্রযোজকের দেওয়া পোশাক পরেননি। এমনকি কখনো কখনো সহশিল্পীর পোশাকও কিনে আনতেন তিনি। ববিতা বলেন, ‘আমি কিন্তু এত বছর অব্দি কোনো দিন প্রডিউসারদের দেওয়া পোশাক পরিনি। শুটিংয়ে সব সময় আমার নিজস্ব পোশাক, গয়না ব্যবহার করেছি। হয়তো বিদেশে কোথাও গেছি। যদি কোনো মডার্ন ছবি থাকে, এ ধরনের ড্রেস কিনতাম। আমি এ রকমও করেছি, নায়কের পোশাকও আমি কিনে নিয়ে আসতাম। আমি একা ভালো পোশাক পরব, আর নায়ককে ভালো কিছু দিল না প্রডিউসার, তাহলে তো ভালো লাগবে না।’

পর্দার জনপ্রিয় জুটি জাফর ইকবাল ও ববিতা। ছবি: সংগৃহীত
পর্দার জনপ্রিয় জুটি জাফর ইকবাল ও ববিতা। ছবি: সংগৃহীত

গান শিখিয়েছেন জাফর ইকবাল

একসময় জাফর ইকবালের সঙ্গে ববিতার সম্পর্কের গুঞ্জন ছিল ইন্ডাস্ট্রির হট টপিক। ‘ওই সময় আমাকে আর জাফরকে নিয়ে মুখরোচক কথাবার্তা হতো। তখন পত্রপত্রিকায় এগুলো লিখে বেশ মজাই পেত সবাই। ববিতা-জাফরের নাকি ভীষণ প্রেম’—হাসতে হাসতে বললেন অভিনেত্রী। দুজন একসঙ্গে ৩০টির বেশি সিনেমা করেছেন। ববিতাকে নাকি গানও শিখিয়েছেন জাফর ইকবাল। অভিনেত্রী বলেন, ‘খুব সুন্দর গান গাইতে পারত। কী অদ্ভুত গলা! গিটার বাজাত। শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে আমাকে ও গান শিখিয়েছে। কিছু ইংলিশ গানও আমাকে শিখিয়েছে। আমরা বিভিন্ন জায়গায় মঞ্চে একসঙ্গে গেয়েছি। দর্শকদের অনুরোধ আসত, ববিতা-জাফরের গান শুনতে চাই।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তামিম কি তাহলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি হবেন

নারীর ‘বগলের গন্ধ’ পুরুষের মানসিক চাপ কমায়, তবে কি মানুষেরও আছে ফেরোমোন!

বাংলাদেশি পণ্যে ভারতের চেয়ে কম শুল্কের ইঙ্গিত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

ট্রাম্প আরোপিত শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চূড়ান্ত সমঝোতার দোরগোড়ায় বাংলাদেশ

ফেসবুকে নাহিদ ইসলামের বিস্ফোরক স্ট্যাটাস

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত