Ajker Patrika

জুয়ার টাকা জোগাতে মা-ছেলেকে গলা কেটে হত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ১১ জুলাই ২০২২, ১৫: ৫১
জুয়ার টাকা জোগাতে মা-ছেলেকে গলা কেটে হত্যা

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার বাহ্মণনদী এলাকায় মা-ছেলেকে গলা কেটে হত্যার ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন ও জড়িত ঘাতককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) নারায়ণগঞ্জ। গত শনিবার (২ জুলাই) রাতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। এই ঘটনায় নিহতের মা খন্দকার তাসলিমা বেগম বাদী হয়ে আড়াইহাজার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে একটি সুপারি গাছের গায়ে লাগা কাদা মাটির সূত্র ধরে হত্যাকাণ্ডে জড়িতকে শনাক্ত করা হয়। 

পিবিআই বলছে, ভারতীয় টি-টোয়েন্টি লিগ আইপিএলের ম্যাচে জুয়া খেলে ৭০ হাজার টাকা ঋণী হয়ে যান গার্মেন্টস শ্রমিক সাদিকুর রহমান সাদিক। আর এই টাকার জন্য পাওনাদারদের মানসিক চাপের কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি। নিহতের চাচাতো দেবর সাদিকুর রহমান সাদিক। 

আজ সোমবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার। 

পিবিআই প্রধান বনজ কুমার বলেন, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের ব্রাহ্মনদী ইউনিয়নের উজান গোবিন্দি এলাকার বাসিন্দা রাজিয়া সুলতানা ওরফে কাকুলি ও তার শিশু সন্তান তালহা (০৮) হত্যায় জড়িত সাদিককে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় হত্যার পরে বাসা থেকে লুট করা স্বর্ণালংকার ও হত্যায ব্যবহৃত ধারালো বটি উদ্ধার করা হয়েছে। এলাকায় নম্রভদ্র ও নামাজি ছেলে হিসেবে পরিচিত গার্মেন্টস কর্মী সাদিকুর রহমান ওরফে সাদিক জুয়ার টাকা পরিশোধ করতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে জানা গেছে। 

যেভাবে হত্যা করা হয়
গত ২ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে নিহত কাকুলির বাড়ির গেটে গিয়ে ‘ভাবি ভাবি’ বলে ডেকে গেট খুলতে বলে সাদিকুর। কিছু সময় পর কাকুলি দরজা খুললে সাদিক জানান তাঁর মা ইলেকট্রিক ব্লেন্ডার ধার নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছে। পরে কাকুলির ঘরে প্রবেশ করে সাদিকুর। এ সময় নিহতের ছেলে তালহাকে (৮) ভাত খাওয়াচ্ছিলেন। তালহা ঘুম ঘুম চোখে ভাত খাচ্ছিল। কাকুলীকে পাশের রুমে আসার অনুরোধ করেন সাদিকুর। পাশের রুমে গেলে সাদিকুর কাকুলীর হাতে পায়ে ধরে দশ হাজার টাকা ধার চান। টাকা চাইলে কাকুলি জানায় তাঁর কাছে কোনও টাকা নেই। সাদিকুর অনেক জোরাজুরি করার পর কাকুলি ঘরের আলমারি খুলে দেখিয়ে বলে ‘দেখ আলমারিতে শুধু ১০০ টাকা আছে। আর কোন টাকা নাই।’ তখন আলমারির ভেতরে একটি বাক্সে কিছু স্বর্ণের গয়না দেখতে পায় সাদিকুর। আর এগুলো নেওয়ার জন্য লোভ করেন তিনি। কাকুলি আলমারি বন্ধ করে চাবি রাখার পরে তাঁকে চেয়ারে বসিয়ে প্রথমে ওড়না দিয়া গলায় ফাঁস দেয় সাদিক। কাকুলি নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেলে বিছানার পাশেই রাখা ইস্ত্রি দিয়ে কাকুলির মাথায় সজোরে আঘাত করে সাদিকুর। এতে পুরোপুরি অজ্ঞান হয়ে যায় কাকুলি। পরে সাদিকুর দ্রুত রান্না ঘর থেকে সবজি কাটার বটি এনে অজ্ঞান অবস্থায় পরে থাকা কাকুলির গলায় পোচ দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরে পাশের রুমে ঘুমন্ত তালহাকেও বটি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে সাদিক। এ সময় তালহা একটি চিৎকার দিয়েছিল। এরপর আলমারিতে থাকা স্বর্ণালংকার নিয়ে পালিয়ে যায় ঘাতক সাদিকুর। 

পিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সাদিকহত্যাকারী চিহ্নিত হলো যেভাবে
রাতের অন্ধকারে মা ও ঘুমন্ত শিশু ছেলেকে হত্যার ঘটনায় এলাকায় বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এই ঘটনায় নিহতের মা খন্দকার তাসলিমা বেগম বাদী হয়ে আড়াইহাজার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে নিহতের বসত ঘরের পেছনে দেয়ালের সঙ্গে লাগানো সুপারি গাছের গোড়া থেকে আনুমানিক দুই ফিট ওপরে এক জায়গায় সদ্য কাদামাটি লাগানো দেখতে পান পিবিআই সদস্যরা। তদন্তকারী কর্মকর্তারা দেখতে পান সুপারি গাছে কোনো ফল নেই। বিষয়টি সন্দেহের সৃষ্টি করে। পরে তদন্তকারী কর্মকর্তারা স্থানীয় সোর্সের মাধ্যমে জানতে পারে এই বাড়িটির ওয়াইফাই সংযোগ থাকায় নিহতের ভাশুরের ছেলে অজিদ কাজীসহ (১৬) স্থানীয় কয়েকটি ছেলে এখানে বসে অনলাইন গেমস খেলে। 

এমন তথ্যের পর জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে কাকুলির ভাশুরের ছেলে অজিদ কাজী জানান, ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাড়ির পেছনে দেয়াল ঘেঁষে বসে অনলাইনে মোবাইলে গেমস খেলছিল তারা। হঠাৎ তালহার একটি চিৎকার শুনতে পায় তারা। এরপর বাথরুমে কারও হাত ধোয়ার শব্দ শুনতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে অজিদ বিল্ডিংয়ের পেছনে দেয়ালের সঙ্গে লাগানো সুপারি গাছ বেয়ে বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে পান সাদিকুর ওরফে সাদিক পানির কলে হাত ধুচ্ছেন। এরপর সাদিকুরকে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে যেতে দেখে সে। এসময় সাদিকুর বের হয়ে যাবার সময় ঘরের পেছনে অজিদ কাজীকে বসে থাকতে দেখে। 

পরের দিন সকাল বেলা হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই আসামি সাদিকুর অজিদ কাজীর সঙ্গে দেখা করে বলে ‘আমার কথা কাউকে বললে তোরে জানে মেরে ফেলব।’ এই ভয়ে অজিদ কাজী ঘটনা চেপে যায়। 

নামাজি ও নম্র ভদ্র ছেলেটি যে কারণে ঘাতক বনে গেলো
বনজ কুমার বলেন, হত্যাকাণ্ডের পরের দিন ঘাতক সাদিক নিহতদের মরদেহ দেখতে আসলেও তাঁকে কেউ সন্দেহ করেনি। গার্মেন্টস শ্রমিক সাদিকুর এলাকায় নম্র ভদ্র ও নামাজি ছেলে হিসেবে পরিচিত। কিন্তু জুয়ার ফাঁদে পড়ে ঋণের জালে জড়িয়ে যায়। এই টাকা পরিশোধের জন্য অনবরত তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করে পাওনাদাররা। ফলে মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটান সাদিকুর। তদন্তের তাঁর নাম বের হওয়ার আগ পর্যন্ত কারও সন্দেহের তালিকায় ছিলেন না তিনি। এমনকি হত্যার পরেও বাড়িতেই ছিলেন ঘাতক সাদিকুর। 

ঘাতকের ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা
পিবিআই কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নিহত কাকুলির মা, ছোটবোনসহ আত্মীয়স্বজনরা। নিহত কাকুলির মা ও মামলার বাদী খন্দকার তাসলিমা বেগম বলেন, আমার মেয়েকে যারা হত্যা করেছে তাদের ফাঁসি চাই। যেভাবে আমার মেয়েকে হত্যা করেছে সেভাবেই তাঁদের হত্যা করা হোক। 

তিনি আরও বলেন, আমার ৬ ছেলে মেয়ের মধ্যে কাকুলি তৃতীয়। আড়াই বছর আগে তাঁর স্বামী মারা যায়। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে স্বামীর বাড়িতেই থাকত। 

এদিকে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার ঘাতক সাদিকুর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। দায়েরকৃত মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। এরপর তিনি আদালতে দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে বলে জানান পিবিআই প্রধান। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত