Ajker Patrika

সনির বাবার অমূল্য সম্পদ

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২: ৫৬
Thumbnail image

আমার প্রকৌশলী বন্ধু মনিমুলের স্বভাবই হলো সামান্য কিছু নিয়ে হইচই শুরু করা। সেটা হোক অফিসে, বাসায়, সামনাসামনি অথবা টেলিফোনে। তার অবস্থা দেখলে মনে হয়, এখনই কোনো দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘটে যাবে।

সপ্তাহখানেক আগে সেই মনিমুলের ফোন, সঙ্গে অনুযোগ। তার কাছে বিরাট গোপন খবর আছে, আমি সাংবাদিক হয়েও সেটা কেন জানি না, ইত্যাদি ইত্যাদি…। যা হোক, তাকে কোনোমতে শান্ত করে জানতে চাইলাম, খবরটা কী। মনিমুল বলল, টগরকে সে রাস্তায় দেখেছে।

কোন টগর?
মনিমুল বলল, বুয়েটের ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি খুনের মামলার আসামি মুকি-টগরের টগর।

আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, সনি হত্যা মামলায় তাঁদের তো যাবজ্জীবন সাজা হয়েছিল। সেই টগর জেলের বাইরে আসবেন কী করে! এবার মনিমুলের গলায় উত্তেজনা। এত বড় ঘটনা আমি কেন জানি না!

মনিমুলের সঙ্গে কথা শেষ করে কয়েক জায়গায় ফোন দিলাম, কেউ কিছু বলতে পারেন না। সনির ভাই রানাকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনিও কিছু জানেন না। ফোন দিলাম আজকের পত্রিকার মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলা প্রতিনিধি মোহাম্মদ উজ্জ্বলকে। তিনি একটু খোঁজখবর নিয়ে বললেন, ঘটনা ঠিক। টগরের বড় ভাই মেজবাউদ্দিন কায়েস তাঁকে জানিয়েছেন, দুই বছর আগেই টগর জেলখানা থেকে বেরিয়ে গেছেন। এখন মাঝেমধ্যে গ্রামে আসেন, তবে কারও সঙ্গে খুব একটা মেশেন না।

সে সময় টগরের সঙ্গে জোড়া লাগানো নামটি ছিল মুকি ওরফে মুকিত। সেই মুকির খোঁজ নিতে ফোন দিলাম আজকের পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরোপ্রধান সবুর শুভকে। তিনি খোঁজখবর নিয়ে বললেন, মুকি এখন অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। সনি খুনের পর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সহায়তায় প্রথমে তিনি লন্ডনে এবং পরে সেখান থেকে যান অস্ট্রেলিয়ায়। এখন সেখানেই থিতু।

সবুর শুভর ফোন রাখতেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল ২১ বছর আগের এক হত্যাকাণ্ড। সেদিন ছিল শনিবার, ২০০২ সালের ৮ জুন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) চত্বরে ঘটে যাওয়া সেই খুনের ঘটনা নিয়ে কেঁপে উঠেছিল শিক্ষাঙ্গন। সে সময় ক্ষমতায় থাকা বিএনপি সরকারকে এর জন্য কম খেসারত দিতে হয়নি।

যত দূর মনে পড়ে, অফিসের নিয়মিত মিটিং শেষে সেদিন আমরা উঠি উঠি করছি। জনকণ্ঠের বুয়েট প্রতিনিধি রাকিবুর রহমান রূপক ফোন করে জানালেন, বুয়েটে ছাত্রদলের দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হচ্ছে। আমার সামনেই চিফ রিপোর্টার বসে ছিলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, এখনই বুয়েটে যাও। চোখের নিমেষে আমাদের গন্তব্য হয়ে গেল বুয়েট।

আমি যখন বুয়েটে পৌঁছালাম, শুনি গোলাগুলি থেমে গেছে। কিন্তু ভেতরের পরিবেশ থমথমে। ছাত্রদলের দুই পক্ষের একটি ক্যাফেটেরিয়ার দিকে, আরেক পক্ষ শহীদ মিনারের পাশে বসে আছে। প্রায় সবার হাতেই অস্ত্র। বুয়েট ক্যাম্পাসের বাইরের রাস্তায় পুলিশ দাঁড়িয়ে, কিন্তু তারা কেউ ভেতরে ঢুকছে না।

ছাত্ররাজনীতিতে মূলত বিরোধ হয় দুটি কারণে—একটি হলো প্রভাব বিস্তার, অন্যটি টাকাপয়সা-সংক্রান্ত। আমি প্রথমে বোঝার চেষ্টা করলাম, এখানে বিরোধটা কী নিয়ে। সবাই বললেন, বুয়েটে কিছু উন্নয়নকাজ শুরু হয়েছে। দুই দিন পরে তার টেন্ডার হবে।

সেই কাজ কারা দখলে নেবে, তা নিয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। এর একটি পক্ষে ছিলেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক এবং বুয়েট শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোকাম্মেল হায়াত খান মুকি, আরেক পক্ষে ছিলেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহপ্রচার সম্পাদক মুশফিক উদ্দিন টগর।

বুয়েটে তখন একটি অদ্ভুত নিয়ম ছিল, ক্যাফেটেরিয়া যাঁর দখলে, ক্যাম্পাস তাঁর দখলে থাকবে। সপ্তাহখানেক আগে মুকির দল ক্যাফেটেরিয়া দখল করে নেয় টগরের গ্রুপকে বিতাড়িত করে। সে সময় দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। এরপর থেকে দুই পক্ষের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে থাকে।

৮ জুন শনিবার কোনো ক্লাস ছিল না। হঠাৎ দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। একটু পর আবার সেটা থেমে যায়। সাবেকুন নাহার সনি সে সময় এক বান্ধবীকে নিয়ে ছাত্রী হলের দিকে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি গুলি এসে তাঁর পেটে লাগে। সনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়, কিন্তু তাতে শেষরক্ষা হয়নি। সনিকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। গুলিতে সনির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় উত্তেজনা। ছাত্রলীগ ও সাধারণ ছাত্ররা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটে হলে তল্লাশি চালিয়ে ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করে। সনির লাশ দেখতে মর্গে আসেন বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাস, লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাদেক হোসেন খোকা। বুয়েট বন্ধ হয়ে যায়।

আমরা তখন টগর আর মুকির পেছনে দৌড়াতে থাকি। মুকির বাড়ি চট্টগ্রামের জামাল খান রোডে। পড়েছেন ইস্পাহানি স্কুল ও কলেজে। ’৯৩ সালে বস্তু ও ধাতব কৌশলে পড়তে বুয়েটে ভর্তি হন। এরপর ছাত্রদলের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। এই খুনের পর তাঁর সহায়তায় গা ঢাকা দেন। একপর্যায়ে বিদেশে চলে যান।

টগর পড়তেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, দর্শনে। সনি খুন হওয়ার পরও তিনি প্রকাশ্যে চলাফেরা করতেন। সেই অবস্থায় ২৩ জুন সোনারগাঁও হোটেলের লবি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। টগরের কথা শুনে মাসুম বিল্লাহকে আটক করে পুলিশ। এ মামলায় ১৯ জন গ্রেপ্তার হন। ৯ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

২০০৩ সালের ২৯ জুন মামলার রায় হয়। নিম্ন আদালত সনি হত্যার মূল তিন আসামি মোকাম্মেল হায়াত খান মুকি, টগর এবং নুরুল ইসলাম সাগর ওরফে শুটার নুরুর মৃত্যুদণ্ড এবং এস এম মাসুম বিল্লাহ ও মাসুমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। পরে ২০০৬ সালের ১০ মার্চ মুকি, টগর ও সাগরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন হাইকোর্ট। আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া এস এম মাসুম বিল্লাহ ও মাসুমকে খালাস দেন। মুকির মতো সাগরও কখনো ধরা পড়েননি।

ঢাকা বারের আইনজীবী আলী আসগর স্বপন সেদিন বললেন, সে সময় যাবজ্জীবন সাজা ছিল ২০ বছর। জেলখানা বছরের হিসাব করে ৯ মাস করে। কাজেই সনি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কোনো আসামি যে আর কারাগারে নেই, সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ।

সনির পরিবার তখন থাকত উত্তরায়, সোনালী ব্যাংকের কোয়ার্টারে। সনির মা দিলরুবা বেগম ছিলেন সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা। আর বাবা হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া ছিলেন টিঅ্যান্ডটির কর্মকর্তা। সনির মৃত্যুর পর একটি ছাত্রী হলের নাম হয় ‘সাবেকুন নাহার সনি হল’। সনি নিহত হওয়ার দিনটি ‘সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্র প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়।

সনির মৃত্যুর পর তাঁর বাবা অদ্ভুত একটি কাজ শুরু করেন। সেটা হলো, সনি মারা যাওয়ার পর স্বাধীনতা-পরবর্তী শিক্ষাঙ্গনে যত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেছে, সেগুলোর তথ্য তিনি জোগাড় করেন। সেসব তথ্যে আছে, স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে ১৫৯ জন নিহত হয়েছেন, আর আহতের সংখ্যা কয়েক হাজার। কী কারণে এসব ঘটেছে, তা লিখে রাখতেন তিনি। দেখা গেল টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদাবাজির কারণেই এসব সংঘর্ষ হয়েছে। তাঁর এই কাজ সাংবাদিকদের বেশ কাজে লাগত। কোনো ক্যাম্পাসে মারামারি হলেই তাঁর তথ্য ছিল ‘রেডি জিনিস’।

কয়েক দিন আগে অনুজ সাংবাদিক গোলাম মর্তুজা অন্তু জানালেন, সনির বাবা হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। তাঁর চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে পরিবার। সনির ভাই মাকসুদুর রহমান রানা গতকাল বললেন, তাঁর বাবার তথ্য জোগাড়ের সব কাজও বন্ধ হয়ে গেছে। শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছে, হয়তো আর বেশি দিন বাঁচবেন না।

যে যায়, সে সবকিছু নিয়ে যেতে পারে না। কিছু না কিছু ফেলে যায়। কেউ চোখের চশমা, কেউ চাবির গোছা, কেউ হাতের ছড়ি। আর সনির বাবা হাবিবুর রহমান চলে গেলেও রেখে যাবেন ৫০ বছরের শিক্ষাঙ্গনের সন্ত্রাসের চিত্র। সংবাদকর্মীদের কাছে সেটা নিঃসন্দেহে অমূল্য সম্পদ।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত