Ajker Patrika

ঢাকার মীনা কুমারী

কামরুল হাসান
Thumbnail image

এক তরুণীর মুখের ওপর আমরা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছি। তিনি যা যা বলছেন, সবাই শুনছি আর একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছি। এত মানুষের উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তরুণীটির কিন্তু কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি খুব আস্থার সঙ্গে অবলীলায় বলে যাচ্ছেন।

তরুণীর কথা শুনে আমাদের দলের যাঁকে আমরা ‘জ্ঞানী’ সাংবাদিক বলে জানতাম, সে রকম এক সহকর্মী বলে উঠলেন, হেসে উড়িয়ে দিচ্ছেন কেন? এ রকম অবস্থায় সব দলেই দু-একজন সংশয়বাদী থাকেন। তেমন একজন বললেন, এমন অদ্ভুত কথা বাপের জন্মেও শুনিনি। আর আমাদের অগ্রজ সাংবাদিক ফজলুল বারী সমানে নোট নিচ্ছেন, তিনি রিপোর্ট লিখবেন।

জনকণ্ঠে আমাদের প্রতিদিনের রিপোর্টার্স মিটিং ছিল বেলা ১১টায়। সেই মিটিং শেষে নিউজ রুমে নেমেই শুনি, বলিউডের এক নায়িকা এসেছেন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। বলিউডের নায়িকা ঢাকায়, তা-ও আমাদের অফিসে! দৌড়ে গেলাম নিচের অভ্যর্থনায়। দেখি সেখানে কেউ নেই। অভ্যর্থনার এক কর্মী বললেন, তিনি লিফটে ওপরে উঠে গেছেন। আবার পড়িমরি করে এলাম ওপরে। দেখি ফজলুল বারীর সামনে এক তরুণী বসে আছেন, আর তাঁকে ঘিরে আছেন সহকর্মীরা। জ্যেষ্ঠ সহকর্মী আহমেদ নূরে আলম গম্ভীরভাবে তাঁকে দু-একটা করে প্রশ্ন করছেন। তরুণী ঝটপট সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন, এতটুকু দেরি করছেন না।
হঠাৎ আমাদের এক সিনিয়র সহকর্মী এসে ভিড়ের মধ্যে গলা বাড়িয়ে দিয়ে জানতে চাইলেন, আপনি যেন কী বললেন আপনার নাম? তরুণী বললেন, বলছি তো আমি মীনা কুমারী। হিন্দি সিনেমার অভিনেত্রী। উপস্থিত সবাই তা শুনে হেসে উঠলেন। তরুণী তাতে দমবার পাত্রী নন। তিনি জোর গলায় বললেন, আমার কথাবার্তাকে আপনারা সিরিয়াসলি নেবেন কিন্তু। ঠাট্টা-মশকরা মনে করবেন না। আমি পাগল বা মানসিক রোগী নই। কোনো গাঁজাখুরি দাবিও করছি না। সত্যি সত্যিই আমি মীনা কুমারী।

এবার শুরু হলো আমাদের প্রশ্নবাণ। তরুণীটির আবদার, তাঁর কথা পত্রিকায় ছাপা হলে তাঁকে নিতে মুম্বাই থেকে লোকজন ছুটে আসবেন ঢাকায়। বললেন, দেখবেন মুম্বাই চলে গেলে আমাকে নিয়ে কী ভীষণ হইচই-না পড়ে যায়! দিলীপ কুমার, সুনীল দত্তসহ পুরোনো বন্ধুরা ছুটে আসবেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। জানেন, রাজ কাপুরকে আমি ভালোবাসতাম। আর নার্গিস আমাকে জীবনে অনেক সাহায্য করেছেন। আমি মুম্বাই ফিরে গিয়ে রাজ কাপুরের স্মরণে একটি মিউজিয়াম করতে চাই। ক্যানসার হাসপাতাল করতে চাই নার্গিসের স্মরণে। কারণ, নার্গিস মারা গেছেন ক্যানসারে।

ফজলুল বারী বললেন, মাস তিনেক আগে একদিন ফোন করে ওই তরুণী বলেছিলেন, তিনি ট্র্যাজিক কুইন নায়িকা মীনা কুমারী। তাঁর পুনর্জন্ম হয়েছে। ধানমন্ডির বাসার ঠিকানা দিয়ে তাঁর ইন্টারভিউ করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু না যাওয়াতে তিনি নিজেই অফিসে চলে এসেছেন। জনকণ্ঠ ভবনের রিসেপশনে এসেও নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন মীনা কুমারী বলে। যদিও তাঁর নাম আসলে মৌসুমি। তাঁর বাবা একজন প্রকৌশলী। ধানমন্ডিতে নিজেদের বাড়ি আছে। লালমাটিয়া কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বাবা আর বেঁচে নেই। ভাই, বোন আর মাকে নিয়ে চারজনের সংসার। মা গৃহবধূ, ভাই-বোন দুজনই পড়াশোনা করেন।

তরুণীটি তাঁর মীনা কুমারী হিসেবে পুনর্জন্ম সম্পর্কে নিজস্ব একটি গল্প বললেন; তা হলো, টেলিপ্যাথিতে তাঁর মনে হয়েছে, তিনি বাইজি ছিলেন। খুব গরিব ঘরে তাঁর জন্ম হয়েছিল। খুব কষ্ট ও সংগ্রাম করে খ্যাতির শিখরে উঠেছেন। এবং তিনিই সেই মীনা কুমারী।

ওই তরুণী বলেন, যেদিন এটা জানতে পারেন, সেদিন রাতে মা, ভাই-বোনকে তিনি তাঁর নতুন অনুভব, অনুভূতির কথা বলেন। তাঁরা বিষয়টি প্রথমে পাত্তা দিতে চাননি; পরে বলেছেন, ঠিক আছে, তুমিই মীনা কুমারী, তোমাকে মুম্বাই নিয়ে যাওয়া হবে। তরুণীর আক্ষেপ, মুম্বাই না নিয়ে তাঁকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নেওয়া হয়েছে।

ওই তরুণী বারবার বললেন, আসলে আমার তো কোনো অসুখ হয়নি। আমি তো সত্যিকারের মীনা কুমারী। আমার পুনর্জন্ম হয়েছে। তিনি বললেন, নবম শ্রেণিতে থাকতে একবার তাঁর বাবা মীনা কুমারীর বিখ্যাত ছবি ‘পাকিজা’র ভিডিও ক্যাসেট এনেছিলেন। মীনা কুমারীর এই একটি চলচ্চিত্রই তিনি দেখেছেন। মীনা কুমারীকে নিয়ে কোনো বইও তিনি পড়েননি। বললেন, আমার তো অনেক বয়সে বিয়ে হয়েছিল। ছেলে-পুলে হয়নি। সেই বিবাহিত জীবন সুখের ছিল না। স্বামী মারধর করতেন, আমি তখন দুঃখ ভুলতে ড্রাগ নিতাম। রাজ কাপুর, মধুবালা, বৈজয়ন্তীমালা—এসব জানতেন। রাজ কাপুর আমাকে ভালোবাসতেন। নার্গিসও আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন খুব। আমি মুম্বাই ফিরে গিয়ে তাঁদের স্মৃতিরক্ষায় কিছু করতে চাই।

আমরা একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছি। একজন বললেন, সিনেমায় নতুন করে অভিনয়ের প্রস্তুতি আছে তো? সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আমার তো নতুন করে প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার নেই। আমি তো মীনা কুমারী। তারপরও এ যুগের নাচের জন্য যা প্র্যাকটিস-প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, সেসব এর মাঝে নিয়েছি। ঘণ্টা দুয়েক পর তরুণী চলে গেলেন। তারপর তাঁর আর মীনা কুমারী হওয়া হয়েছিল কি না জানি না।

ঢাকার এই ‘মীনা কুমারী’কে নিয়ে নিউজ ছাপা হয়েছিল ২০০২ সালের ১ এপ্রিল। সেই প্রতিবেদন পড়ে তখনকার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ এইচ মোহাম্মদ ফিরোজ বলেছিলেন, তরুণীটি ‘সাইকোসিস’ নামের একধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। তাঁর বর্তমান মানসিক অবস্থাকে বলে ‘ডিলুশন অব পজিশন’ (অবস্থানের বিভ্রম)। এ ধরনের রোগীর মনে সব সময় এ রকম অদ্ভুত বিশ্বাস ভর করে। আর সেটাই তাঁরা বলে বেড়ান।

মীনা কুমারীর এই গল্প লিখতে গিয়ে মনে হলো, আজকাল আমাদের চারপাশে তো অনেক মানুষই নিজেদের নিয়ে এ রকম অদ্ভুত দাবি করে বসেন। এঁরা সবাই কি মানসিক রোগে আক্রান্ত? তাহলে কি মীনা কুমারীদের সংখ্যা দেশে বেড়েই চলেছে? প্রশ্নটা হয়তো কঠিন, উত্তরটা আরও কঠিন।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত