Ajker Patrika

ধুলোয় ঢাকা কেস ডকেট

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ০১
Thumbnail image

বেনাপোল মোড় থেকে উত্তর দিকে যে গ্রামটিতে আমরা যাচ্ছি, সেটি কাশীপুর। অর্ধেক বাংলাদেশে, অর্ধেক ভারতে। সীমান্তের উঁচু কাঁটাতার গ্রামটিকে এফোঁড়-ওফোঁড় করেছে। সেই পথ ধরে মিনিট বিশেক চলার পর গাড়ি এসে থামল ধবধবে সমাধিসৌধের সামনে। কিছুক্ষণ আগে তুমুল বৃষ্টি হয়েছে। সেই পানিতে ধুয়ে সমাধির পাথর আরও শুভ্র হয়েছে। সমাধির গায়ে খোদাই করা নামটি দেখে বুক ভরে গেল–বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের সমাধি।

যশোর বিমানবন্দর থেকে এযাত্রায় আমার সঙ্গী হয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম। সমাধির দিকে তাকিয়ে তিনি বেশ বিজ্ঞর মতো বললেন, যে গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠর সমাধি থাকে, সেখানকার মানুষও মাদকের কারবার করে! আমি তাঁকে অনিমেষ বৈশ্যর চরণ শুনিয়ে বললাম, যেখানে রবীন্দ্রনাথের গান বাজে, সেখানেও মানুষ খুন হয়।

মনিরুল হেসে বললেন, কিন্তু এটাও সত্যি যে আমরা এখানে খুনের ঘটনা জানতে এসেছি। মনিরুলের কথা ঠিক, সীমান্তের এই গ্রামে আমরা এসেছি এক গ্রামীণ সাংবাদিকের খোঁজ নিতে, মাদক ও চোরাচালান বিষয়ে প্রতিবেদন করে যিনি খুন হয়েছেন।

যাঁর খোঁজ নিতে এসেছি, তিনি বিখ্যাত কেউ নন, খুব সাধারণ একজন। নাম জামাল উদ্দিন। কাজ করতেন যশোর থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক গ্রামের কাগজ’-এ, কাশীপুর প্রতিনিধি হিসেবে। তাঁর খুনের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল দায়সারাভাবে, ভেতরের পাতায় খুব ছোট করে। সাধারণ একজন গ্রামীণ সাংবাদিককে নিয়ে এত ভাবার সময় কার আছে?

জামাল উদ্দিন খুন হন ২০১২ সালের ১৫ জুন, রাতে। এর মাস তিনেক পর বেনামি একটি চিঠি আসে আমার কাছে। খামের ভেতরে শুধু একটি পেনড্রাইভ। সেটাতে থাকা অডিও ফাইল কম্পিউটারে চালাতেই দেখি একটি ফোনালাপ।

‘–ও যখন মা মা কয়ে চিৎকার করে, আমি তখন লাথি দিয়া রেলিংটা ভাইঙ্গা ওর গলা চেপে ধরি। চিৎকার দিবি না, খবরদার! তারপর ভুঁড়িটা নিয়ে নিছি।
 -প্রথম কী করিছিলি?
 -প্রথম ভুঁড়ি, তারপর চোখ, তারপর তিনটা রগ।
 -রক্ত তো পড়ে নাই বেশি?
 -চেপে ধরেছিলাম না। চিৎকার যাতে না পাড়ে। রক্ত যাতে না পড়ে সেভাবেই মারছি। 
 -দূরে থাক, সাবধানে থাক; ধরা পড়িস না।’

পেনড্রাইভের ভেতরে একটি ওয়ার্ড ফাইলে ছিল সেই খুনের বিবরণ। সেটা পড়ে বুঝলাম, এই ফোনালাপ একজন খুনি এবং এক পুলিশ সদস্যের। এই খুনের সঙ্গে তারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পড়ে-শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। যশোরের মনিরুলকে ফোন করে বললাম, কাল আসছি। এটা ২০১২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর।

উড়োজাহাজ থেকে যশোর বিমানবন্দরে নামতেই তুমুল বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির পথ মাড়িয়ে বেনাপোল হয়ে কাশীপুর গ্রামে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। জামাল উদ্দিনের বাড়িও খুঁজে পেলাম সহজে। বাড়ি না বলে একে কুঁড়েঘর বলাই ভালো। একটিমাত্র মাটির ঘর, তাতে আসবাব বলতে শুধু একটি কাঠের চৌকি। দুই মেয়ে রিয়া ও নেহা আর ছেলে চঞ্চলকে নিয়ে জামাল উদ্দিনের সংসার। স্থায়ী পেশা বলতে বেনাপোলের বাসমালিক সমিতিতে চাকরি, বাসের সময় নিয়ন্ত্রণের কাজ (স্টার্টার)। আর মাঝেমধ্যে এলাকার খবর পাঠাতেন গ্রামের কাগজে।

সেই জামাল উদ্দিনকে এক রাতে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যান তাঁর পরিচিত কয়েকজন। তাঁরা কাশীপুর বাজারে একটি চায়ের দোকানে বসে গল্প জুড়ে দেন। গল্পের ফাঁকে চেতনানাশক মেশানো কোমল পানীয় খাওয়ান জামালকে। এতে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর তাঁকে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। এ ঘটনার ৫-৬ মিনিটের মধ্যে সেখানে কয়েকজন পুলিশ সদস্য এসে হাজির হন।

অত রাতে মফস্বলের ওই বাজারে লোকজন বেশি ছিল না। তারপরও লোকজন খুনিদের চিনিয়ে দিয়ে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশকে অনুরোধ করে। কিন্তু পুলিশ খুনিদের গ্রেপ্তার না করে উল্টো পালিয়ে যেতে সহায়তা করে।

জামালের ভাই লিটন আমাকে বললেন, ‘কিলারদের দেইখে লোকজন পুলিশকে বলল, ভাই, ওই দ্যাখেন, খুনিরা যাইতেছে। পুলিশ বলল, তোমাদের কিছু করতি হবি না, আমরা দেকছি।’
এরপর খুনিরা চলে গেল। কিন্তু লোকজন পুলিশের এ কর্মকাণ্ড মেনে নিতে পারেনি। প্রতিবাদে পুলিশের সামনেই তারা সন্দেহভাজন দুই খুনির বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

আমি কথা বলে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, খুনটা হলো কী করে। জামালের বাবা আবদুল আলিম আমাকে বললেন, দেড় মাস আগে কাশীপুর ঘাট দিয়ে গ্যাস সিলিন্ডার (গাড়ির এসিতে ব্যবহারের উপযোগী) পাচারে বাধা দিয়েছিলেন জামাল। সেখানকার চোরাচালানি শরিফুল ও তোতা এটা পাচার করছিল। পরে জামাল থানায় খবর দিয়ে এসব ধরিয়ে দেন। এতে পুলিশ ফাঁড়ির তখনকার ইনচার্জ ও চোরাচালানিরা ক্ষুব্ধ হয়। এ ঘটনার পরই তারা জামালকে খুনের পরিকল্পনা করে।

কাশীপুর বাজারের এক দোকানি আমাকে বললেন, এই গ্রামের আশপাশে ৬-৭টি চোরাচালানের ঘাট আছে। প্রতি মাসে এসব ঘাট থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ৩-৪ লাখ টাকা আদায় করেন। কাশীপুর গ্রাম থেকে একটু দূরের শার্শা থানা-পুলিশের গৌরপাড়া ফাঁড়ি। চোরাচালানের ঘাট থেকে আয়ের সব টাকা সেই ফাঁড়ির প্রধানের হাত ঘুরে কর্তাদের পকেটে যায়।

সব শুনে মনে হলো, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চোরাচালান ও মাদক ব্যবসার স্বার্থ। জামাল উদ্দিন এলাকার মাদক কারবার নিয়ে নিয়মিত রিপোর্ট করতেন। স্থানীয় পত্রিকাটিতে সেসব খবর ছাপাও হতো। এসব কারণেই মাদক ব্যবসায়ীরা তাঁকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

খুনের পর গ্রেপ্তার হওয়া দুই আসামি আদালতে বলেছিলেন, তাঁদের পরিকল্পনা ছিল, জামাল উদ্দিনের হাত ও পা কেটে নেবেন, চোখ তুলে ফেলবেন—কিন্তু প্রাণে মারবেন না। স্বাভাবিকভাবেই এই খুনের সঙ্গে ফাঁড়ির সেই পুলিশ সদস্যের হাত ছিল। কুরিয়ারে আসা ফোনালাপ তারই প্রমাণ।

জামালের বাবা আমাকে বললেন, ফাঁড়ির সেই সদস্য শুধু খুনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি এখন এ নিয়ে ‘বাড়াবাড়ি’ না করার জন্য তাঁদেরকে চাপে রেখেছেন। হত্যা মামলার প্রধান আসামির সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে তাঁকে নানাভাবে সহায়তাও করছেন।

এলাকার আরও কয়েকজনের সঙ্গে আমার কথা হলো। তাঁরা বললেন, জামালকে যারা খুন করেছে, তাদের সঙ্গে ফাঁড়ির সেই সদস্যের অনেক দহরম-মহরম। রাত বাড়লেই তাদের একসঙ্গে দেখা যায়।

শার্শা থানায় তখন ওসি ছিলেন এ কে এম ফারুক হোসেন। তিনি আমার সব কথা শুনে বললেন, ‘আপনার মাথা খারাপ, পুলিশ কি মার্ডার করে?’ তখন যশোরের এসপি ছিলেন কামরুল আহসান। তিনি বলেছিলেন, ‘এই ফোনালাপ সাজানো হতে পারে।’

জামালের এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমার রিপোর্ট ছাপা হওয়ার পর একটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ১৭ মে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। তাতে সাতজনের নাম উল্লেখ ছিল। কিন্তু অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য ছাড়াও লোকজন সেদিন যাদের ঘটনাস্থলে দেখেছিল, তাদের অনেকের নাম বাদ দেওয়া হয়েছিল। জামালের অসহায় বাবা এ নিয়ে অনেক চেষ্টা-তদবির করেছিলেন, কিন্তু কে শোনে তাঁর কথা।

‘আষাঢ়ে নয়’ লেখার আগে গতকাল আবার মনিরুলকে ফোন করেছিলাম এই মামলার শেষটা জানতে। মনিরুল বললেন, আদালতে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত জামালের বাবা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। এখন এ মামলা নিয়ে কেউ আর ঘাঁটাঘাঁটি করে না।

মনিরুলের কথায় মনে হলো, এ মামলার কোনো সাক্ষী আর আদালতে যান না। সে কারণে বিচারও আটকে গেছে। পড়ে থাকতে থাকতে ধুলোর আস্তরণে ঢেকে গেছে হতভাগ্য এক গ্রামীণ সাংবাদিক খুনের ‘কেস ডকেট’।

এখানে বিচারের বাণী আর কাঁদে না, পাথর হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত