Ajker Patrika

বাবার ডায়েরিতে অনাগত সন্তান

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৯: ৫৭
Thumbnail image

সমাজে অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা নিয়ে খুবই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। সেটা সবচেয়ে বেশি বোঝা যায় কারও সাক্ষাৎকার নিতে গেলে। আবার এর উল্টো দিকের মানুষও আছেন, যাঁরা মনে করেন গণমাধ্যম হলো মানুষের শেষ ভরসাস্থল।

এত বছর কাজ করতে গিয়ে জীবনে অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তাতে যেমন ভালো লাগা জমেছে, তেমনি বিব্রতও কম হতে হয়নি। তার পরও কিছু কিছু ঘটনা আছে, যার রেশ থেকে গেছে অনেক বছর। আজকের ‘আষাঢ়ে নয়’-এ তেমন একটি সাক্ষাৎকারের গল্প বলি।

সেনানিবাসের ভেতর থেকে কোনো সংবাদ সংগ্রহ করতে হলে আগাম অনুমতি নিতে হয়। সেই অনুমতি নিতে নিতে দেরি হয়ে গেল। অ্যাসাইনমেন্টের সঙ্গী ছিলেন এবিসি রেডিওর সাংবাদিক শাহনাজ শারমীন (বর্তমানে নাগরিক টিভির প্রধান প্রতিবেদক)। তাঁর হাতে সময় কম, সে কারণে তিনি খুবই অস্থির। এটা ছিল বিডিআর বিদ্রোহের পরের বছর, ২০১০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি।

আমাদের লক্ষ্য ছিল নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্ত্রী বা পরিবারের নিকটজনের সঙ্গে একান্তে কথা বলে সেদিনের ঘটনাটা ভেতর থেকে বোঝা। কথা বলার অনুমতি চেয়ে নানা চেষ্টা-তদবির হলো। শুরুতে কেউ কথা বলতে রাজি হচ্ছিলেন না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দুজন কথা বলতে রাজি হলেন, যাঁরা দুজনই নিহত সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী।

আমরা প্রথমে গেলাম ঢাকা সেনানিবাসের রজনীগন্ধা কোয়ার্টারের একটি বাসায়। সেই বাসায় ছিলেন বিডিআর বিদ্রোহে নিহত মেজর মমিনুল ইসলাম সরকারের স্ত্রী সানজানা সোনিয়া। বাসার দরজায় কলবেল বাজাতেই এক কিশোরী এসে দরজা খুলে বসতে বলল। একটু পরে এলেন সোনিয়া। কাছের কেউ হারিয়ে গেলে মানুষ যে কীভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, সোনিয়াকে দেখে তা বোঝা যাচ্ছিল। স্বামী মারা যাওয়ার এক বছর পরেও তিনি শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আমরা টুকটাক প্রশ্ন করে ভেতর থেকে তাঁকে জানার চেষ্টা করছিলাম। সোনিয়াও নিজের মতো করে আামাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন।

বলছিলেন, মমিনুলের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়েছিল ’৯৫ সালে। আর বিয়ে হয় ২০০২ সালে। সাত বছরের সংসারে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে কাটিয়েছেন খুব কম দিন। দুজনের চাকরির কারণে তাঁদের থাকতে হয়েছে বাইরে বাইরে। পিলখানার ঘটনার মাত্র তিন মাস আগে তাঁরা ঢাকায় পুরোপুরি সংসারজীবন শুরু করেন। মমিনের সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল চট্টগ্রামে। পিলখানায় বদলি হয়ে আসেন ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে।

বিডিআর বিদ্রোহের দিনের কথা মনে করে বললেন, বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে মমিন ভেতরের অফিসার্স মেসে ছিলেন। বিদ্রোহের আগের দিন বিকেলে একবার বাসায় এসেছিলেন। বিডিআর সপ্তাহের কাজের তাড়াহুড়োর কারণে বিকেলে আবার চলে যান। মমিনের সঙ্গে শেষ কথা কী ছিল? সোনিয়া বললেন, বিদ্রোহের দিন সকাল সোয়া ১০টার দিকে খবর পেলাম পিলখানার ভেতরে গন্ডগোল হচ্ছে।

মমিনকে অনেকবার ফোন করলাম, কিন্তু পেলাম না। শেষ পর্যন্ত বিডিআর সিগন্যাল রুমে ফোন করতেই একজন ফোন ধরে জানতে চাইলেন, আপনি কোথায় আছেন সেটা আগে বলুন। সোনিয়া নিজের অবস্থানের কথা জানাতেই অপর প্রান্ত থেকে বিডিআরের এক জওয়ান বললেন, ভেতরে এসে লাভ হবে না, যেখানে আছেন সেখানেই থাকেন।

এরপর অনেকবার তিনি ফোন করেছেন, কেউ আর ফোন ধরেনি। সোনিয়া বললেন, তখন তিনি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা, তার ওপর স্বামীর খোঁজ নেই। সে অবস্থা কাউকে বলা যায় না, বোঝানো যায় না। কী করবেন, তা-ও বুঝতে পারছিলেন না। এভাবে দুই দিন কেটে যায়। ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় জানতে পারেন, অন্য সব কর্মকর্তার সঙ্গে মমিনও নিহত হয়েছেন। মমিনুল সেনাবাহিনীর কমান্ডো ছিলেন। সোনিয়া আশা করেছিলেন, এত কিছুর মধ্যেও মমিন বেঁচে যাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও বাঁচতে পারেনি।

সোনিয়া আমাদের বললেন, তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার ১১ দিন পরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) জন্ম হয় তাঁদের প্রথম সন্তানের। এই সন্তানকে নিয়ে মেজর মমিনের বুকভরা স্বপ্ন ছিল। দীর্ঘ সাত বছর পর প্রথম সন্তানের আগমনে তাঁর বাবা অনেক আগেই সব প্রস্তুতি শেষ করে রেখেছিলেন। শুধু সন্তানকে দেখে যেতে পারেননি। এক বছরের শিশুর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে সোনিয়া বললেন, এই সন্তানের কাছে বাবার কোনো স্মৃতি নেই।

আমাদের অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, কথাও প্রায় শেষ। এবার উঠি উঠি করতে করতে সোনিয়ার কাছে জানতে চাইলাম কী নাম রেখেছেন সন্তানের। সোনিয়া একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, আমি একটা জিনিস খুঁজছি। সেটা পেলে তবেই সন্তানের আসল নাম রাখব। এখন ছোট বাচ্চাদের সবাই যেভাবে ডাকে, আমরা তা-ই ডাকছি।

একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, কী জিনিস সেটা? তিনি বললেন, আমি হন্যে হয়ে একটি ডায়েরি খুঁজছি। যাকে পেয়েছি জানতে চেয়েছি। পিলখানা থেকে আনা সব মালপত্রও ঘেঁটেছি, কিন্তু ডায়েরিটা আর পাইনি। বিদ্রোহের সময় বিডিআর জওয়ানরা সব কর্মকর্তার বাসা ও মেসের কক্ষ লুটপাট করে। কিন্তু মমিনুলের কক্ষ স্বাভাবিক ছিল। প্রথম কয়েক দিন সেই কক্ষে গিয়ে সব জিনিসপত্র খোঁজ করেছি। সেই সঙ্গে খুঁজেছি মমিনুলের ডায়েরিটা। হয়তো ডায়েরিটা মোমিনের কাছেই ছিল, ঘাতকেরা সেটি ফেলে দিয়েছে।

আমি আরও অবাক হয়ে বললাম, ডায়েরি? কী ছিল তাতে? সোনিয়ার কণ্ঠস্বর খুব নিচু। বললেন, ডায়েরিতে ছিল আমার অনাগত সন্তানের নাম। ও আমাকে বলে গেছে, ‘কয়েকটি নাম ঠিক করে রেখেছি। আমি আগে থেকে নামগুলো বলব না। বলে দিলে তোমার কাছে সব নাম পুরোনো হয়ে যাবে।’ ওর বাবা সেই নামগুলো গোপনে লিখে রেখেছিল। ছেলের বাবার সঙ্গে সেই ডায়েরিটাও হারিয়ে গেছে। বলতে বলতে সোনিয়ার চোখ ভারী হয়ে আসে, আমাদেরও। আমি কিছু বলতে পারি না। শারমীন হাতের আঙুলে চোখ মোছেন।

এরপর ২৫ ফেব্রুয়ারি অনেকবার বনানীর সামরিক কবরস্থানে গিয়েছি, যেখানে মমিনুলকে দাফন করা হয়েছে। সোনিয়ার সঙ্গে কয়েকবার দেখাও হয়েছে, কিন্তু কিছু বলতে পারিনি। তাঁকে দেখলেই আমার চোখের সামনে অনেকগুলো ডায়েরি ভেসে ওঠে, যার পাতায় পাতায় একটি করে শিশু নাম লেখা। যে নামটি আমরা কেউই পড়তে পারি না।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত