গান অন্তঃপ্রাণ, গানেই গেল প্রাণ

কামরুল হাসান
আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০২২, ১০: ৩৮
Thumbnail image

তারাগঞ্জ থেকে খালি রিকশা নিয়ে চালক ঝন্টু আসছিলেন সৈয়দপুরের দিকে। কাছাকাছি আসার পর লাল রঙের একটি প্রাইভেট কার আচমকা রিকশাটির সামনে এসে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে দুজন নেমে বড় আকারের একটি স্যুটকেস রিকশায় তুলে দিয়ে রিকশাওয়ালাকে বলেন, ‘এটা নিয়ে রেলস্টেশনে অপেক্ষা করো, আমরা আসছি।’ তাঁরা রিকশাওয়ালার হাতে কিছু টাকাও গুঁজে দেন। এরপর মুখ উল্টো দিকে ঘুরিয়ে গাড়িটা হাইওয়ে ধরে চলে যায়।

রিকশাওয়ালা ঝন্টু সৈয়দপুর রেলস্টেশনে এসে অপেক্ষা করতে থাকেন, গাড়ি আর আসে না। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। ঝন্টু কিছুটা চিন্তিত হয়ে রিকশা সমিতির এক নেতার কাছে বিষয়টি জানান। তিনি বিপদের ভয় দেখিয়ে ঝন্টুকে পাঠিয়ে দেন আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের কাছে। চেয়ারম্যান পদের বেশির ভাগ লোকই সাধারণত খুব বুদ্ধিমান হন। আলমপুর ইউপি চেয়ারম্যান স্যুটকেসটি দেখেই সন্দেহ করেন। তিনি লক্ষ করেন, এই স্যুটকেসে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ট্যাগ লাগানো আছে। তার মানে, স্যুটকেসটি বিমানে করেই ঢাকা থেকে সৈয়দপুরে এসেছে। এরপর তিনি আর কোনো ঝুঁকি না নিয়ে সোজা চলে যান তারাগঞ্জ থানায়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) উপস্থিতিতে স্যুটকেস খোলা হয়। দেখা যায়, ভেতরে কম উচ্চতার একজনের মৃতদেহ। পরদিন সব কাগজে সেই খবর ছাপা হয়। কয়েকটি কাগজে মৃতদেহের ছবিও ছাপা হয়। এটা ছিল ২০০১ সালের ৯ আগস্ট।

এই খবর যেদিন ছাপা হলো, সেদিন সকালে ডিএমপির পূর্ব বিভাগের ডিসি মোখলেসুর রহমান (অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে অবসরে) আমাকে ফোন দিলেন। বললেন, ‘আমাদের মিলন খুন হয়েছে। সৈয়দপুরে স্যুটকেসে যে লাশ পাওয়া গেছে, সেটা মিলনের।’ আমি বললাম, সেই লাশ শনাক্ত করল কে? তিনি বললেন, ‘মিলনের বউ ফোন করে কান্নাকাটি করছিল। রাজশাহী থেকে তাঁর এক ভাই সৈয়দপুরে গিয়ে মৃতদেহ শনাক্ত করেছে।’ মোখলেসুর রহমানের খুব মন খারাপ, আমারও। পরিচিত মানুষের এমন মৃত্যু খুবই কষ্টের।

মিলনের পুরো নাম সাইদুল হক মিলন। তিনি ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে ‘বঙ্গবন্ধু সম্প্রচার সেল’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন সেই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ভাষণ, তাঁকে নিয়ে গান, কবিতা—এসব তিনি সংগ্রহ করে বেড়াতেন। পূর্ব বিভাগের ডিসি মোখলেসুর রহমানের টিকাটুলীর অফিসেই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। কথায় কথায় বেরিয়ে এল, আমার জেলাতেই তিনি বিয়ে করেছেন। আর তাঁকে পায় কে! এক মিনিটেই আত্মীয় বানিয়ে ছাড়লেন।

একদিন মোহাম্মদপুরে আমার বন্ধু লিটন হায়দারের বাসা থেকে বেরিয়ে শের শাহ সুরি রোডের মুখে এসেছি, দেখি মিলন দাঁড়িয়ে। মোটরসাইকেলে আমাকে দেখেই বরিশালের আঞ্চলিক উচ্চারণে এক চিৎকার। এরপর টানতে টানতে বাসায় নিয়ে গেলেন। তাঁর স্ত্রী সিরাজুম মুনিরা সরকারি চাকরি করেন। ছেলে সৌরভ (৮) আর মেয়ে সৃষ্টিকে (৬) নিয়ে তাঁদের সুখের সংসার। সেদিন স্বামী-স্ত্রী মিলে অতিথিকে আপ্যায়ন করেই ছাড়লেন।

সপ্তাহ দুয়েক পর মিলন আমার অফিসে হাজির। টেলিভিশনের জন্য তিনি একটি গানের প্যাকেজ অনুষ্ঠান করবেন, আমাকে এর স্ক্রিপ্ট লিখে দিতে হবে। সাবিনা ইয়াসমীন, রথীন্দ্রনাথ রায়, শেফালী ঘোষসহ নামকরা শিল্পীরা তাতে গান গাইবেন।

অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করবেন অভিনেত্রী শমী কায়সার। এ রকম অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না, পরে বন্ধু আশীষ-উর-রহমান শুভর সহযোগিতা নিয়ে একটা স্ক্রিপ্ট তৈরি করে দিলাম। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একদিন সেই অনুষ্ঠানের শুটিং হলো। পল্টন লাইনের একটি ভবনে ম হামিদের প্যানেলে অনুষ্ঠানটির এডিটিং করলেন ফিরোজ মাহমুদ। সম্ভবত এটাই বিটিভির প্রথম গানের প্যাকেজ অনুষ্ঠান। এই গানগুলো নিয়ে পরে তিনি একটি অডিও ক্যাসেট বাজারে ছেড়েছিলেন।

এ রকম একজন পরিচিত মানুষ খুন হওয়ার কারণ নিয়ে আমারও খুব আগ্রহ ছিল। সে কারণে সাধ্যমতো খোঁজখবর শুরু করলাম। কিন্তু এসব করতে গিয়ে গানের সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষের এমন সব তথ্য পেলাম, যার সবকিছু প্রকাশ্যে বলা সম্ভব নয়। শুধু এটুকু বলি, এই খুনের পর সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছিলেন এই সময়ের জনপ্রিয় মিউজিক কম্পোজার প্রতীক হাসান ও প্রীতম হাসানের বাবা খালিদ হাসান মিলু ও তাঁর পরিবার।

মিলন কীভাবে খুন হলেন, তা বলার আগে খালিদ হাসান মিলুর গল্পটা বলি। মিলুর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। একের পর এক গান আসছে আর বাজার মাত করছে। তরুণদের কাছে মিলু হার্টথ্রব। ছেলে প্রতীক, প্রীতম আর স্ত্রী ফাতেমা পারভিন পলাশকে নিয়ে মিলুর সুখের সংসার। একদিন সেই সংসারে ঝড়ের মতো ঢুকে পড়লেন এক বিমানবালা। অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় ইসমাত আরা তারা নামের ওই বিমানবালার সঙ্গে মিলুর পরিচয় হয় উড়োজাহাজে। কিছুদিনের মধ্যে তিনি সেই বিমানবালার প্রেমে পড়ে যান। এরপর যা হওয়ার তা-ই হয়; প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের ফেলে বিমানবালাকে বিয়ে করে সিদ্ধেশ্বরীর হোপ টাওয়ারে ইসমাত আরার ফ্ল্যাটে ওঠেন মিলু। তাঁর প্রথম স্ত্রী ফাতেমা পারভিন পলাশ এ নিয়ে টঙ্গী থানায় মামলা করেন। মিলু ও তাঁর বিমানবালা স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাঁরা জামিনে বেরিয়ে আসেন। দুই পরিবারের মধ্যে এ নিয়ে বিরোধ বাড়তে থাকে। মিলুর গানে ভাটা পড়ে। এ অবস্থায় এগিয়ে আসেন মিলন। তিনি দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা করার উদ্যোগ নেন। একটি বৈঠকে সমঝোতা হয় বটে, তবে বিমানবালার ভেতরে ক্ষোভ থেকেই যায়।

কিছুদিন পর এই বিমানবালার বাসায় মিলু অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর চিকিৎসায় বিপুল অর্থ খরচ হয়। বিমানবালা আর কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। মিলুর বন্ধুরা তাঁর চিকিৎসার জন্য কনসার্ট করে অর্থ সংগ্রহের আয়োজন করেন। এ রকম একটি কনসার্ট হয় পিরোজপুরে। কিন্তু সেই কনসার্টের টাকা আর মিলু পাননি। পিরোজপুর সমিতির কিছু লোক আর মিলুর সহযোগীরা সব টাকা মেরে দেন। এ নিয়ে আবার গন্ডগোল শুরু হয়। এই সালিসেও মিলন ঢুকে পড়েন। এবার তাঁর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন মিলুর গানের কম্পোজার গায়িকা আঁখি আলমগীরের প্রথম স্বামী সাইরাস আলতাফ শাশা, মিলুর ড্রামবাদক পলাশ সাউ, বাবু, ফারুক, পিরোজপুর সমিতির জিয়াসহ অনেকে। ইসমাত আরার সঙ্গে মিলনের পুরোনো বিরোধ তো আছেই; সেই সঙ্গে যুক্ত হয় পিরোজপুরের ঘটনা। এরই প্রেক্ষাপটে ২০০১ সালের ৪ আগস্ট রাতে বেইলি রোড থেকে নিখোঁজ হন মিলন।

মিলনের স্ত্রী মুনিরা আমাকে বলেছিলেন, ঘটনার দিন রাতে মিলন বেইলি রোডে আযম বাবুর ‘ডিজিটন’ স্টুডিওতে গিয়েছিলেন গান রেকর্ডের কাজে। রাত ১০টার দিকে তাঁকে ফোন করে বলেন, ফিরতে দেরি হবে। এরপর মিলনকে আর ফোনে পাননি। বেইলি রোডে এখন যেখানে ক্যাপিটাল টাওয়ার, তার ঠিক পাশের ভবনেই ছিল স্টুডিওটি। টাওয়ারের সামনে ‘চমচম’ নামে একটি মিষ্টির দোকান ছিল। ঘটনার দিন রাতে স্টুডিওর এক কর্মচারী মিলনকে হেঁটে সিদ্ধেশ্বরীর ভেতরে ঢুকতে দেখেছিলেন।

মিলন খুন হওয়ার ঘটনায় মুনিরা কয়েকজনের নাম দিয়ে ৮ আগস্ট (২০০১) রমনা থানায় অপহরণ ও হত্যা মামলা করেন। মোজাম্মেল হোসেন তখন রমনা থানার ওসি। তিনি আমার উপস্থিতিতে ডিএমপির কমিশনার আনোয়ারুল ইকবালকে বলেছিলেন, প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ মনে করছে, বিমানবালা ইসমাত আরার বাসাতেই মিলন খুন হন। লাশ উদ্ধারের সময় স্যুটকেসে বিমানের সিল থাকা একটি বালিশ ও ব্যাগ পাওয়া যায়। তা ছাড়া লাশ উদ্ধারের পরপরই ওই বিমানবালা গা ঢাকা দেন। কমিশনারের কাছে দেওয়া ওসির সেই বক্তব্য পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল।

এই বক্তব্য যেদিন ছাপা হয়, সেদিন বিমানবালা ইসমাত আরা অজ্ঞাত স্থান থেকে আমাকে ফোন করে বলেন, তিনি মিলনকে খুন করেননি, খুন করেছেন আঁখি আলমগীরের স্বামী শাশা। তিনি বললেন, পিরোজপুর কনসার্টের টাকা মেরে দেওয়ার পর মিলনের সঙ্গে শাশার অনেক তর্কাতর্কি হয়। মিলন তাঁকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। শাশাও তাঁকে হুমকি দিয়েছিলেন।

কিন্তু মিলুর প্রথম স্ত্রী পলাশ আমাকে ফোনে বলেন, মিলু তাঁর মায়ের কাছে বলেছেন, মিলনকে গোপনে আটকে রেখেছিলেন বিমানবালা ইসমাত আরা। 

অনেক দিন ধরে মিলন খুনের মামলার তদন্ত করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। কিন্তু তারা কখনোই ইসমাত আরাকে ধরতে পারেনি। লাশ উদ্ধারের পর থেকে তিনি আর প্রকাশ্যে আসেননি। ইসমাত আরার বাসায় দুই দফা তল্লাশিও করেছিল ডিবি। তার পরও ডিবি এই মামলার কোনো কিনারা করতে পারেনি। গত বৃহস্পতিবার মোখলেসুর রহমানের কাছ থেকে শুনলাম, সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় ডিবি একপর্যায়ে এই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল।

আজকের ‘আষাঢ়ে নয়’ লেখার আগে মিলনের স্ত্রী মুনিরা, তাঁর দুই সন্তান সৌরভ আর সৃষ্টির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম। তাঁদের আর খুঁজে পেলাম না। সে সময় তাঁরা মোহাম্মদপুরের যে বাসায় ছিলেন, সেখানে আর নেই। জানি না কোথায় আছেন, কেমন আছেন।

মিলনের দুই সন্তান এত দিনে হয়তো অনেক বড় হয়েছেন। আর তাঁরা এটা জেনে বড় হয়েছেন, সারা দিন সভা-সেমিনারে আইনের শাসনের যে বুলি আওড়ানো হয়, সবই বাকোয়াজ, মিথ্যে। বাবার হত্যা মামলা তো তাঁদের তা-ই বলে।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত