Ajker Patrika

৬টি শাল নিয়ে যাত্রা করা রাজকন্যায় এখন আছে সব ধরনের পোশাক

মন্টি বৈষ্ণব
৬টি শাল নিয়ে যাত্রা করা রাজকন্যায় এখন আছে সব ধরনের পোশাক

ফাতেমা নূর লিমন একজন নারী উদ্যোক্তা। তিনি কাজ করছেন দেশীয় কাপড় নিয়ে। সেই ছোটবেলা থেকে লিমন এমন কিছু করতে চাইতেন, যেখানে থাকবে স্বাধীনতা ও নিজস্বতা। সেই স্বপ্ন থেকেই লিমনের উদ্যোক্তা হওয়া। আর তাঁর এই ইচ্ছেটা পাকাপোক্ত হয় কলেজজীবন থেকে। তবে সে সময়ই শুরু করতে পারেননি। করোনা মহামারির মধ্যে মাত্র ২৭০০ টাকা পুঁজি করে লিমন শুরু করেন ‘রাজকন্যা ক্লথিং’-এর যাত্রা। আজ রাজকন্যার পসরার দিকে তাকালে বোঝাই যাবে না যে, মাত্র ছয়টি শীতের শাল নিয়ে যাত্রা করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। 

লিমন ২০২০ সালে মাত্র ২৭০০ টাকা নিয়ে অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্ম ‘রাজকন্যা ক্লথিং’ শুরু করেন। ছয়টি শীতের শাল নিয়ে কাজ শুরু করলেও এখন সব ধরনের পোশাকের সংগ্রহ আছে রাজকন্যা ক্লথিংয়ে। প্রতিদিনই এই সংগ্রহে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা। 

লিমনের জন্ম নরসিংদীর নানির বাড়িতে। বাবা সরকারি চাকরি করতেন সেই সুবাদে জন্মের পর ১০ বছর কাটিয়েছেন জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ থানায়। সেখানে লিমনের খুব সুন্দর শৈশব কেটেছে। এর পর চলে যান গাজীপুরে। সেখানেই স্কুল-কলেজের পাঠ। অর্থনীতিতে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর করেছেন বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে। 

মাত্র ছয়টি শাল নিয়ে যাত্রা করা রাজকন্যা ক্লথিংয়ে এখন রয়েছে শাড়ি, থ্রিপিসসহ নানা ধরনের পণ্যরাজকন্যা ক্লথিংয়ের কর্ণধার লিমনের কাছে উদ্যোক্তা হওয়ার কথা জানতে চাইলে বলেন, ‘ছোটবেলায় ঈদে সবাই যখন বাটা মেহেদি কাঠি দিয়ে ডিজাইন করে হাতে দিত, সেটা দেখে আমি আমার ছোট বোনের হাতে মেহেদি দিয়ে দিতাম। সবাই ওর মেহেদি আঁকা হাত দেখে খুব প্রশংসা করত। যখন একটু বড় হলাম, আম্মাকে দেখতাম আমাদের তিন বোনের সব জামা নিজেই তৈরি করতেন। ব্যাপারটা আমার খুব পছন্দ হয়। আস্তে আস্তে আমিও সেলাইয়ের কাজ শিখতে শুরু করি। মেহেদির ডিজাইনটাই আমি কাপড়ে আনি; সুঁই-সুতা দিয়ে জামা, শাড়ি, কুশন, বিছানার চাদর করতে থাকি। সেলাইয়ের কাজে আমার কখনো ক্লান্তি বা একঘেয়েমি লাগত না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে পারতাম। আমি যখন কলেজে পড়ি, তখন আমাদের এলাকায় কলেজপড়ুয়া মেয়েদের জন্য তেমন ভালো মানের পোশাক পাওয়া যেত না। তখন ভাবতাম, আমি যদি একটা দোকান নিতে পারতাম।’ 

সে সময়ের কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠে যেন সুদূরে চলে যায়। একটা স্বপ্ন, একটা উদ্যোগের ঘোর এখনো যেন যায়নি লিমনের কণ্ঠ থেকে। তিনি বলে চলেন, ‘এর পর কলেজ শেষে ঢাকায় এলাম। সে সময় যখন বুটিক হাউসগুলোতে যেতাম, সেখানকার জামা, পাঞ্জাবি, শাড়ি দেখে মনে হতো এসব কাজ তো আমিও পারি; অথচ কত দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এই চিন্তা থেকে একদিন ঠিক করে ফেলি পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নয়, ব্যবসা করব। ব্যবসা করতে গেলে নিজেদের অনেক ধরনের কাজ জানতে হয়। তাই আমরা দুই বন্ধু মহিলা সংস্থা থেকে ব্লক, বাটিক, সেলাইয়ের ট্রেনিং নিলাম।’ 

কিন্তু এই পরিকল্পনায় ছেদ পড়ে। তাও লিমনেরই। হঠাৎ বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। সংসারের সবকিছু মিলিয়ে আর স্বপ্নের পথে হাঁটা হয়নি। আর তখন তো অনলাইন ছিল না, অল্প পুঁজিতে কিছু ভাবাই যেত না উল্লেখ করে লিমন বলেন, ‘সাত বছর চাকরি করলাম। ৯ টা-৬টা অফিস করে এলে পরিবারে সময় দেওয়া যায় না। সন্তানের দেখাশোনা করার কেউ নেই। অফিসে থাকলে সন্তানের জন্য সারা দিন একটা দুশ্চিন্তা কাজ করত। এক সময় অনলাইন ব্যবসা চালু হওয়ায় বুঝতে পারলাম ঘরে বসে অল্প পুঁজিতেই ব্যবসা শুরু করা যায়। এতে বাচ্চাদের দেখাশোনা করা যাবে, আবার পাশাপাশি নিজের মতো করে ব্যবসাটাও করা যাবে। প্রয়োজন শুধু অনলাইন ব্যবসার খুঁটিনাটি বিষয়ে ধারণা রাখা। তাই কিছুদিন এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জানলাম, সবার সঙ্গে কথা বললাম এবং এর পর ব্যবসার কাজটা শুরু করে দিলাম।’ 

মাত্র ২৭০০ টাকায় নিজের স্বপ্নের উদ্যোগটি শুরু করেছিলেন ফাতেমা নূর লিমন।লিমন মেয়েদের পোশাক (শাড়ি, থ্রিপিছ, পাঞ্জাবি, বেবি ড্রেস, শীতের শাল) নিয়েই বেশি কাজ করেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা মাথায় নিয়ে কাজ করছেন। কোথা থেকে প্রোডাক্ট আনবেন, কাপড়ের মান কেমন হবে, ক্রেতা প্রোডাক্ট পেয়ে খুশি হবেন কিনা, পণ্য কেনা, ফটোসেশন—এসবের জন্য অনেক জায়গায় যাওয়া—সবকিছু মিলিয়ে নান প্রতিবন্ধকতার মধ্যে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন দুই সন্তানের জননী লিমন। 

নিজের কাজ সম্পর্কে লিমন বলেন, ‘সবাই আসলে ভয় পায়, শুরু করবে কি-না, পারবে কি-না, ব্যবসার ক্ষতি ইত্যাদি। তবে আমার বোনেরা খুব সাপোর্ট দিয়েছেন। আমার খুব ভালো কয়েকজন সহকর্মী ছিলেন, তাঁরাও খুব সাহস দিয়েছেন। আর আমার ছোট বোন (জান্নাতুল রাইয়ান প্রান্ত) আমার পাশে আছে সব সময়। সে পণ্যের মডেল হয়ে, ফটোগ্রাফার হিসেবে, ছবি এডিট করে, আমার পেজের অ্যাডমিন হয়ে আমাকে সহযোগিতা করছে। ওর কাছ থেকে মানসিক সাপোর্টও পেয়েছি অনেক। আমি খুব ভাগ্যবান মনে করি নিজেকে যে, আমার এমন বোন আছে। আমার পরিবারে আছে এক ছেলে (১১), এক মেয়ে (৭), আর স্বামী। আমরা চার বোন, বাবা অবসরপ্রাপ্ত এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার, মা গৃহিণী।’ 

রাজকন্যার পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে দিতে চান লিমনলিমন কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘আমি এখনো শিখছি, সাফল্য অনেক দূরে। তবে এটুকু বলতে পারি, এখন অনেক মেয়েই ব্যবসা করছেন, সফল হয়েছে—এমন অনেক উদাহরণ আছে ৷ ব্যবসাতে অল্প কয়েক দিনে লাভবান হওয়া যায় না, অনেক সময়ের ব্যাপার। তবে ধৈর্য ধরতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে। আমি যখন শুরু করি, তখন করোনা মহামারি শুরু হয়েছিল। বাইরে যাওয়া খুব ঝুঁকিপূর্ণ ছিল নিজের জন্য এবং পরিবারের জন্যও। তাই যাত্রাটা খুব সহজ ছিল না। তবে সব প্রতিকূলতাকে নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। সবার সাপোর্ট পেলে হয়তো দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।’ 

বেশ বড় স্বপ্ন দেখেন লিমন। সেই ছোটবেলায় দেখা নানা বুটিক হাউসের মতো নিজের একটা ব্র্যান্ড গড়ে তুলতে চান তিনি। বললেন, ‘আমার স্বপ্ন আমার পেজে শুধু আমার ডিজাইন করা পোশাকই পাওয়া যাবে, যা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। আমি প্রথমে আমার এলাকায় একটা শোরুম দিতে চাই। এটা আমার জীবনের প্রথম স্বপ্ন, যাতে এলাকার কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারি। দেশের সব বিভাগীয় শহরগুলোতে রাজকন্যার আউটলেট থাকবে। সেখানে সুলভ মূল্যে দেশীয় মানসম্পন্ন পণ্য মানুষের হাতে তুলে দিতে চাই। পাশাপাশি আমি আমাদের দেশীয় পণ্য দেশের বাইরেও পৌঁছে দিতে চাই।’ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত