Ajker Patrika

এক কঠিন বাস্তবতায় জন্ম নিয়েছিল ‘কল্প বসন’

মন্টি বৈষ্ণব
Thumbnail image

রাজশাহীর মেয়ে শবনম রেজা মিতু। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান মিতু ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠেছেন রাজশাহীতে। মিতু পড়ালেখা করেছেন রাজশাহীর নবাবগঞ্জ সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ‍্যালয় এবং রাজশাহী নিউ গভর্নমেন্ট ডিগ্রি কলেজ থেকে। এর পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মনোবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেন।

জীবন প্রবাহের অনেক ঘটনাচক্রের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ মিতু সফল নারী উদ্যোক্তা। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ‘কল্প বসন’। ২০১৪ সাল থেকেই মিতুর ইচ্ছা ছিল একটা বুটিক হাউস দেওয়ার। কিন্তু বিয়ে-সংসারের কাজের চাপে সে ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যায়। আর দিন শেষে মিতুর পরিচয় গিয়ে দাঁড়ায় একজন গৃহিণী হিসেবে। সেই বুটিক হাউস থেকে যায় কল্পজগতেই। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। দৃঢ়তা থাকলে সবই বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব। মিতুর ‘কল্প বসন’ তারই প্রমাণ।

একটা সময় সংসারের নিয়মনীতির বেড়াজাল অতিষ্ঠ করে তোলে মিতুর জীবন। বেরিয়ে আসেন সেই বেড়াজাল থেকে। একমাত্র সন্তান নিয়ে শুরু হয় তাঁর একার লড়াই। ধীরে ধীরে মানসিক পীড়নে অসুস্থও হয়ে পড়েন। জীবনের স্বস্তির নিশ্বাসটুকু যখন তিনি হারিয়ে ফেললেন, ঠিক তখনই সন্তানের কথা চিন্তা করে ভাবেন জীবনে বেঁচে থাকতে হলে নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে, আর কিছু একটা করতে হবে। সেই উপলব্ধি থেকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি ফিরে পান। পরিকল্পনা করেন উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশের। আর সেই স্বপ্নের জায়গা থেকে নিজের এলাকার ঐতিহ্যের সঙ্গে দেশি পণ্য রাজশাহী সিল্ক নিয়ে শুরু করেন অনলাইনভিত্তিক শপিং প্ল্যাটফর্ম ‘কল্প বসন’।

‘কল্প বসন’-এর শুরুর গল্পটা মিতুর কাছ থেকে শুনতে চাইলে বলেন, ‘২০২০ সালে করোনার সময়ে জীবনের কঠিন বাস্তবতায় ১৩ অক্টোবর থেকে শুরু করি রাজশাহী সিল্ক নিয়ে আমার ছোট উদ্যোগ—কল্প বসন। দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে গেছে। এখন আমার মাসিক আয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা।’

চাকরিকে প্রাধান্য না দিয়ে দেশি পণ্যের উদ্যোক্তা হিসেবেই নিজেকে গড়তে চেয়েছেন মিতু। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমার একমাত্র সন্তান, আর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছা থেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। এ ক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় কাজ কাজ করে। সেটা হলো, আমাদের সমাজ বাস্তবতায় নারীরা চাইলে নিজের সন্তানকে একাই বড় করে তুলতে পারে। এ ক্ষেত্রে নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়াটা খুব জরুরি। উদ্যোক্তা হওয়ার কারণে নিজের সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব নিতে পেরেছি। এটা আমার জীবনের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি।’

তারপরও মানুষের কথা তো থেমে থাকে না। সমাজের অন্য দশজন নারীর মতোই তাঁকেও শুনতে হয় বিচিত্র সব মন্তব্য। এসব ডিঙিয়েই মিতু এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁর স্বপ্নের পথে। তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজ নারীদের চলার পথটা অনেক বেশি কঠিন করে তুলেছে। দেশে একজন নারী উদ্যোক্তা হওয়া সহজ বিষয় নয়। কারণ, সমাজের কিছু মানুষ নারীদের অনলাইনে কাজ করার বিষয়টা ভালোভাবে নিতে পারেন না। প্রায় সময় শুনতে হয়, এত পড়াশোনা করে এখন অনলাইনে কাপড় বেচে, হিজাব পরে লাইভ করে, নারীদের এত ঘরের বাইরে যাওয়া ঠিক না। এর সঙ্গে আছে পণ্যের দাম। ভালো মানের রাজশাহী সিল্ক নিয়ে যেহেতু আমার কাজ, তাই পণ্যের দাম নিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু আমি অনেক ধৈর্যশীল। তাই সব ধরনের প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পছন্দ করি। নারী উদ্যোক্তাদের পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু সে বাধাকে জয় করার সাহস রাখতে হবে নিজের ভেতরে।’

কল্প বসনের সিগনেচার পণ্য মটকা সিল্কের শাড়িএই লড়াইয়ে পরিবারকে সব সময় পাশে পেয়েছেন মিতু। বললেন, ‘আমার পরিবার আমাকে সব সময় সহযোগিতা করেছে। সব থেকে বড় অবদান আমার আপু সুলতানা শ‍্যামলীর। সে আমার পাশে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ছায়ার মতো রয়েছে। কল্প বসনের পরামর্শদাতা হিসেবে আছেন তিনি। তাঁর কথা অনুযায়ী আমি আমার ব্যবসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। নারী উদ্যোক্তা হতে হলে পরিবারের সাপোর্টটা অনেক দরকার।’

মিতু রাজশাহী সিল্ক নিয়ে কাজ করেন। এর পাশাপাশি তিনি তাঁত, নকশি পণ্য নিয়েও কাজ করেন। মিতুর পরিবার বলতে একমাত্র ছেলে আরাফ আরিয়ান। তাঁকে নিয়ে তাঁর পুরো জগৎ। সকল দুঃখ-কষ্ট দূর করে তিনি ছেলেকে মানবিক মানুষ হিসবে গড়ে তুলতে চান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের নারীরা চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে। শুধু সামাজিকতার ভয়ে, কে কখন কী বলবে এসব ভেবে অনেক নারী কিছুই করার সাহস পান না। নারীদের জন্য আমাদের সমাজের চলার পথটা খুব বেশি মসৃণ নয়। আমাদের দেশে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক কিছুই আছে। শুধু প্রয়োজন ধৈর্য, সাহস, মনোবল ও পরিবারের সহযোগিতা।’

‘কল্প বসন’-এর স্বত্বাধিকারী শবনম রেজা মিতুর কাছে দেশীয় পণ্য রাজশাহী সিল্ক নিয়ে কাজ করার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার কাজটা একটু কঠিন। কারণ, আমার পণ্য, মানে রাজশাহী সিল্ক একটু দামি। রাজশাহী সিল্ককে অনেকেই স্বর্ণের সঙ্গে তুলনা করে। আমি ভালো মানের রাজশাহী সিল্ক নিয়ে কাজ করি। আমি প্রথমে তাঁতির তাঁত থেকে সিল্ক পণ্য সংগ্রহ করি। এর পর নিজে কারিগর দিয়ে ডিজাইন করে তৈরি করি আমার সব সিল্কপণ্য। রাজশাহী সিল্কের বিভিন্ন ধরনের শাড়ি, থ্রিপিস, টুপিস, ওয়ান পিস, ওড়না, ছেলেদের শার্ট, মেয়েদের কুর্তি, মসলিনের টাইডাই, বাটিক, হ‍্যান্ড প্রিন্ট পণ্য ইত্যাদি রয়েছে পণ্যতালিকায়।

মসলিনের হ্যান্ড প্রিন্ট শাড়িতবে নিজের সিগনেচার পণ্য হিসেবে মনে করেন মটকা সিল্ক শাড়িকে। বললেন, ‘এখানে রয়েছে আমার নিজস্বতার ছোঁয়া। মটকা সিল্কের প্রাইস একটু বেশি। তাই প্রথম দিকে বিক্রি নিয়ে একটু ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল। কিন্তু যখন ক্রেতা বুঝেছে শাড়িটা ভালো মানের, তখন থেকে আর কোনো রকম বাধা আসেনি। আমি এই এক বছরে ১৮ পিস মটকা সিল্ক শাড়ি বিক্রি করেছি। সিল্কের পাশাপাশি আমার কিছু নকশি কাজের ড্রেস আছে, যেটা শুধু “কল্প বসন”-এই পাওয়া যায়। এবার শীতে “কল্প বসন”-এর প্রধান চমক রাজশাহী সিল্কের শাল, সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের দেশি শাল। আমি বিশ্বাস করি প্রতিটা নারীর নিজের জন্যই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা দরকার। নারীরা স্বভাবগতভাবেই অনেক গুণের অধিকারী। শুধু দরকার সে গুনের সঠিক ব্যবহার।’

মিতুর জীবনে অনেক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ‘কল্প বসন’। কল্প বসনকে নিয়ে অনেক পরিকল্পনা আছে মিতুর মনে। মিতুর ‘কল্প বসন’-এর একটি শোরুম করার ইচ্ছা রয়েছে তাঁর। সেখানে থাকবে নিজেদের কারখানা, যেখানে কাজ করবেন সুবিধাবঞ্চিত নারীরা। এখন ‘কল্প বসন’-এর কাজের সঙ্গে যুক্ত আছে প্রায় দশ-বারোজন মানুষ। ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশা করেন মিতু।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত