Ajker Patrika

বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বেগ, গরিবমুখী প্রবৃদ্ধির ওপর জোর এমসিসিআইয়ের

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০৩ জুন ২০২৫, ১৭: ৫২
বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বেগ, গরিবমুখী প্রবৃদ্ধির ওপর জোর এমসিসিআইয়ের

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজেট বাস্তবায়ন অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ঢাকা (এমসিসিআই)। বাজেটকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে বাজেট ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা, করনীতি সংস্কার, করব্যবস্থার অটোমেশন, কর সংগ্রহে সামগ্রিক সিস্টেম লস কমানো ও কর প্রশাসনের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে জানায় তারা। একই সঙ্গে বর্তমান বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে এমসিসিআই চিন্তিত বলে জানায় ব্যবসায়ী সংগঠনটি। এই চিন্তা দূর করার মতো বাজেটে কোনো নির্দেশনা নেই বলে তাদের পর্যবেক্ষণ।

কার্যকরী করহার কমানোর কোনোরূপ পদক্ষেপ না থাকায় এমসিসিআই হতাশা ব্যক্ত করেছে। এমসিসিআই সব সময় বলে আসছে, প্রতিষ্ঠানের টার্নওভারের ওপর ন্যূনতম কর (মিনিমাম ট্যাক্স) করনীতির পরিপন্থী। তাই এটি বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে তারা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে গরিবমুখী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ওপর অধিকতর নজর দেওয়া উচিত বলেও মনে করে তারা।

আজ মঙ্গলবার এমসিসিআই বাজেটোত্তর প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলে।

গতকাল সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের ৫৪তম জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী দায়িত্ব নেওয়ার পর এটি অর্থ উপদেষ্টার প্রথম বাজেট।

বাজেটোত্তর প্রতিক্রিয়ায় এমসিসিআই আরও বলেছে, তারা সব সময় কর প্রশাসনে অর্থবহ কাঠামোগত পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়ে আসছে, যেন কর প্রশাসন যথাযথভাবে রাজস্ব সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। করহার বৃদ্ধির মাধ্যমে নিয়মিত কর প্রদানকারী ব্যক্তি বা ব্যবসায়ীদের ওপর আরও বেশি করের বোঝা চাপানোর চেষ্টা, বিষয়টি সঠিকভাবে সমাধা করার জন্য এমসিসিআই জোর দাবি জানায়। এই ব্যবস্থা সমাধানের জন্য কর জাল বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছে তারা।

এমসিসিআই মনে করে, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির কারণে রপ্তানি বাজার সংকুচিত হওয়া; মন্থর বিনিয়োগব্যবস্থা, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার, বিশ্বব্যাপী চলমান যুদ্ধাবস্থা ও ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীতকরণের সময় বাজেট প্রস্তুতকরণ অর্থ উপদেষ্টার জন্য একটি দুঃসাহসিক কাজ ছিল।

প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা (জিডিপির ১২.৭ শতাংশ), যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের (৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা) চেয়ে প্রায় দশমিক ৮৮ শতাংশ কম এবং সংশোধিত বাজেটের (৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা) চেয়ে ৬ দশমিক ১৮ শতাংশ বেশি।

অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনার লক্ষ্যে অন্তর্বতী সরকার আসন্ন অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ।

প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা বর্তমান অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার (৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা) চেয়ে ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ বেশি। এই ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা এবং অবশিষ্ট ৬৫ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে রাজস্ববহির্ভূত খাত থেকে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা (যা জিডিপির ৩.৬২ শতাংশ)। মোট ঘাটতির মধ্যে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বাইরের উৎস থেকে এবং ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংস্থান করা হবে। এই ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক খাত থেকে এবং ২১ হাজার কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে।

বিনিয়োগ স্থবিরতা ও অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে এমসিসিআইয়ের উদ্বেগ

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) দেশের বর্তমান বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিনিয়োগ ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ২৯.৩৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই বিনিয়োগ হ্রাসের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই বিনিয়োগ স্থবিরতা কর্মসংস্থান কমাচ্ছে এবং দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে অর্থনীতির সংকটকে আরও তীব্র করছে।

আইএমএফের শর্ত ও বাজেট ঘাটতি

এমসিসিআই জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সুপারিশ করা করব্যবস্থার সংস্কার শর্তাবলির কারণে চূড়ান্ত বাজেট ঘাটতি বাড়তে পারে। আইএমএফ ঋণের শর্ত মেনে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে গিয়ে করদাতাদের ওপর বাড়তি করের বোঝা চাপানোর সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এমসিসিআই সরকারের প্রকল্প অর্থায়নে ব্যয় সীমিত রাখতে যথাযথ আর্থিক ব্যবস্থাপনার পরামর্শ দিয়েছে।

ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ ও মূল্যস্ফীতি

২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের (৯৯ হাজার কোটি টাকা) চেয়ে ৫.০৫ শতাংশ বেশি। এমসিসিআই সতর্ক করেছে যে, এই উচ্চ ঋণ গ্রহণের ফলে অর্থনীতিতে ’ক্রাউডিং আউট’ প্রভাব তৈরি হতে পারে, যা বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য তহবিল সংকট সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে, যার বোঝা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপরই পড়বে। এমসিসিআই এই দুই বিষয়ের মধ্যে সমন্বয়ের ওপর জোর দিয়েছে এবং ব্যাংকিং খাতের পুনর্গঠনে বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে।

সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী ও দরিদ্রমুখী প্রবৃদ্ধি

এমসিসিআই মনে করে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে দরিদ্রমুখী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ওপর বেশি নজর দেওয়া উচিত। উদ্বেগজনকভাবে প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর জন্য বরাদ্দ গত অর্থবছরের (১ লাখ ৩৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা) তুলনায় প্রায় ১৪.১৯ শতাংশ কমিয়ে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা করা হয়েছে। এমসিসিআই এই খাতে বরাদ্দ যৌক্তিকভাবে বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্তরায়

এমসিসিআই চিহ্নিত করেছে যে, অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, অবকাঠামো, জ্বালানির অসম বণ্টন এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এখনও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান বাধা। দুর্বল রাজস্ব আদায় (বর্তমান অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত ৬২.৪১ শতাংশ) ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের ধীরগতি (বর্তমান অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত ৪১.৩১ শতাংশ) অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের কারণ। এ ছাড়া উচ্চ আমদানি প্রবণতা ও বৈশ্বিক অস্থিরতা বিবেচনা করে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে সতর্ক থাকার ওপরও এমসিসিআই জোর দিয়েছে।

করনীতি ও সংস্কারের আহ্বান

  • টার্নওভার কর: লাভ-ক্ষতি নির্বিশেষে টার্নওভার কর ০.৬০% থেকে ১% এবং ক্ষেত্রবিশেষে ৩% পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাবে এমসিসিআই হতাশা ব্যক্ত করেছে। তারা এই ’ন্যূনতম কর’ বাতিল করে শুধু লাভজনক ব্যবসার করযোগ্য আয়ের ওপর কর আরোপের দাবি জানিয়েছে।
  • আইপিও/পিও: পাবলিক কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে আইপিওর মাধ্যমে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার হস্তান্তরে ২২.৫% আয়কর হারের বিধানের পরিবর্তে ’পিও’ (পাবলিক অফারিং) অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছে।
  • পারকুইজিট: কর্মচারীদের ’পারকুইজিট’ বাবদ সীমা ১০ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকায় বৃদ্ধিকে স্বাগত জানালেও এমসিসিআই মনে করে এর কোনো নির্দিষ্ট সীমা থাকা উচিত নয়।
  • উৎসে কর রিটার্ন: উৎসে করের রিটার্ন মাসিক থেকে ত্রৈমাসিক করার প্রস্তাবকে এমসিসিআই সময় ও অর্থ সাশ্রয়ী হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে।
  • রয়্যালটি ও কারিগরি সেবা ফি: রয়্যালটি, লাইসেন্স ফি, কারিগরি সেবা ফি ইত্যাদির ক্ষেত্রে বিডার প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী শুধু টার্নওভারের ৬% ব্যয় নির্বাহের বিধান প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে।
  • কর নেট সম্প্রসারণ: ১ কোটি ১৪ লাখ ইটিআইএনধারীর মধ্যে মাত্র ৪৫ লাখ আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া এবং অধিকাংশ রিটার্ন শূন্য হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এমসিসিআই সুষ্ঠু কর ব্যবস্থাপনা ও আধুনিক করনীতিমালার মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের আওতা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে।
  • প্রান্তিক করদাতা: প্রান্তিক করদাতাদের ন্যূনতম কর ৩০০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকা বৃদ্ধি করায় তাঁদের ওপর করের বোঝা বাড়বে বলে এমসিসিআই মনে করে।
  • ভ্যাট আইন: ভ্যাট আইনের কাঠামোগত সংস্কারে উল্লেখযোগ্য পরামর্শ না থাকায় এমসিসিআই হতাশা প্রকাশ করেছে।
  • আগাম কর: শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে আগাম কর ৩% থেকে ২% কমানোর প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেও এমসিসিআই তা শূন্য করার দাবি জানিয়েছে।
  • আগাম কর সমন্বয়: আগাম কর সমন্বয় বা উৎসে কর কর্তনের ক্ষেত্রে সময়সীমা ৪ করমেয়াদ থেকে ৬ করমেয়াদ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাবকে এমসিসিআই স্বাগত জানিয়েছে।
  • ই-ইনভয়েসিং ও ইএফডি: এমসিসিআই বিশ্বাস করে, ই-ইনভয়েসিং ও ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস (ইএফডি) পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করলে ভ্যাট সংগ্রহ প্রক্রিয়া দ্রুত হবে এবং ভ্যাটের নেট বৃদ্ধি পাবে।

সবশেষে, এমসিসিআই জোর দিয়ে বলেছে যে, কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি ও করনেট সম্প্রসারণের জন্য করব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন ও জনবান্ধব করনীতি অত্যন্ত জরুরি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে ইচ্ছাকৃতভাবে বন্দী ছিলেন শেখ মুজিব—পোস্ট ডিলিট করলেন সারজিস

রিল বানাতে গিয়ে যমুনায় তলিয়ে গেল ৬ কিশোরী

হামজা-সোহেলের গোলে বাংলাদেশের জয়

ইশরাককে মেয়রের শপথ পড়ানো স্থানীয় সরকারের হাতে, ইসির করণীয় শেষ: সানাউল্লাহ

নওফেলের বিদেশি স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করবে দুদক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত