Ajker Patrika

তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য সামনের ৬ মাস কঠিন সময় : বিজিএমইএ সভাপতি  

সাজ্জাদ হোসেন, ঢাকা
আপডেট : ০৮ জুলাই ২০২৩, ১৬: ০৪
তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য সামনের ৬ মাস কঠিন সময় : বিজিএমইএ সভাপতি  

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় পকেটে টান পড়েছে উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত বিশ্বের মানুষেরও। আয়-ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় খরচের লাগাম টানতে হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির ঋণ পরিশোধেও। যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে, যার ফলে পোশাকসহ অন্যান্য ননফুড আইটেমে খরচ অনেকটাই সংকোচন করছে। বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান মনে করেন, আগামী ছয় মাস তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য খুবই কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। তৈরি পোশাক নিয়ে সামনের দিনগুলোতে কী চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা আছে তা নিয়ে ৫ জুলাই ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে আজকের পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে কথা বলেছেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। 

আজকের পত্রিকা: ২০২২-২৩ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে যে টার্গেট ছিল, সেটা অর্জন করা গেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তৈরি পোশাকের প্রধান আমদানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি ও সুদের হার বেড়ে যাওয়ার চাপে আছে সেখানকার ভোক্তারা।
ফারুক হাসান: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্ব অর্থনীতিতে চাপ থাকার কারণে পোশাকসহ অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচ কমিয়ে দিয়েছে ভোক্তারা। এর জন্য ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়া এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য কারণ। এই সংকটের মধ্যেও আমাদের তৈরি পোশাক খাতে গত বছরের যে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল, সেটা কোনোমতে অর্জন করা গেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশের মতো। কিন্তু আগের অর্থবছরে এই খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩০ শতাংশ। পোশাক খাতে গত বছরের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির জন্য ইউক্রেন যুদ্ধ অন্যতম কারণ। সার্বিক বিবেচনায় রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা গেলেও প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক নয়। 

আজকের পত্রিকা: একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক আমদানির সবচেয়ে বড় দেশ। মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ২০ শতাংশের বেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয়। গত প্রায় পাঁচ মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি নেতিবাচক ধারায় আছে। সেটা আপনাদের জন্য কতটুকু শঙ্কার?
ফারুক হাসান: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির তীব্র চাপে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অনেক দেশের নাগরিকের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে, যার বহিঃপ্রকাশ যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক ধারা। আমাদের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ২০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি কমে যাওয়া স্বভাবতই খুবই উদ্বেগের। মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য ব্যাংকের সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়ার ফলে বাসাবাড়ি, গাড়ি ও খাবারদাবারের পেছনে খরচের পর মানুষের হাতে আর টাকা থাকছে না। ফলে স্বভাবতই ভোক্তারা এখন পোশাকের পেছনে খরচ কমিয়ে দিয়েছে। 

তৈরি পোশাক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র সার্বিকভাবে গত চার মাস ধরে মোট আমদানির প্রায় ২২ শতাংশ এবং ভলিয়মের দিক দিয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ কমিয়েছে। সেই হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি একটু ভালো। তবে এই ভালো ভালো নয়। প্রধান বাজারগুলোতে রপ্তানি সংকুচিত হওয়ার কারণে আমরা নতুন এমার্জিং মার্কেট যেমন—ভারত, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় পণ্য রপ্তানি বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি। 

আজকের পত্রিকা: ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে এই যুদ্ধ শিগগির শেষ হচ্ছে না। যুদ্ধের জেরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির অন্যতম দেশ জার্মানিতে ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক মন্দাভাব দেখা দিতে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাত কেমন পারফর্ম করতে পারে?
ফারুক হাসান: ইউক্রেন যুদ্ধের এখন যা অবস্থা এবং ইউরোপের অর্থনীতি ধীরে ধীরে মন্দার দিকে যাচ্ছে। এটা সহজে অনুমান করা যায় সামনের দিনগুলোতে তৈরি পোশাকে রপ্তানি ধরে রাখাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে যাবে। জার্মানিসহ ইউরোপের অনেক দেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার রেশে জার্মানিসহ ইউরোপের অনেক দেশে এখন মন্দা দেখা দিয়েছে। বৈদেশিক সমস্যা ছাড়াও আমাদের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যা যেমন গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ, একই সঙ্গে কাস্টম বন্ডের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। একই সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার লক্ষণ দেখছি না। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস তৈরি পোশাক খাত খুবই কঠিন সময়ের মধ্যে যাবে। 

আজকের পত্রিকা: আপনি বলছেন, তৈরি পোশাকের জন্য সামনের ছয় মাস খুবই কঠিন সময়। অন্যদিকে এই বছরের প্রবৃদ্ধিও আশাব্যঞ্জক নয়। এই অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি বাধাপ্রাপ্ত হবে নিশ্চিত।
ফারুক হাসান: দেশের রপ্তানি আয় বাড়ানোর জন্য শীর্ষস্থানীয় রপ্তানির পণ্য তৈরি পোশাকে বিনিয়োগ খুবই জরুরি। তবে বর্তমান যে অবস্থা বিরাজ করছে, সেখানে এ অবস্থায় বিনিয়োগ করা খুবই কঠিন। অনেকেই এখন নতুন করে বিনিয়োগ করা বন্ধ রেখেছেন। এ বছর নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব তো হবেই না, বরং যে কর্মসংস্থানগুলো আছে, সেগুলো ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। 

আজকের পত্রিকা: ডলার সংকটের কারণে ক্যাপিটাল মেশিনারি ইমপোর্টের ক্ষেত্রে এলসি খোলায় কি কোন সমস্যা হচ্ছে?
ফারুক হাসান: বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিবেচনায় বর্তমানে আরএমজি খাতে তেমন বড় কোনো ইনভেস্টমেন্ট হবে না। তবে হাই অ্যান্ড প্রোডাক্ট প্রস্তুত করার জন্য যে ক্ষমতা প্রয়োজন, তার জন্য আমরা টেকনোলজিতে ইনভেস্ট করছি। তৈরি পোশাক খাতে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এখন বিনিয়োগ করাটা ঝুঁকিপূর্ণ। এখন যদি তৈরি পোশাক খাতে বড় ধরনের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ইনভেস্ট করা হয়, তাহলে ক্রেতারা পণ্যের দাম কমানোর ক্ষেত্রে আরও বেশি সুযোগ নেবে। তাছাড়া নতুন বিনিয়োগের জন্য যে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি করতে হয়, তা ডলারের সংকট থাকায় এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে। দেশে যে ডলারের সংকট আছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। 

আজকের পত্রিকা: আইএমএফের পরামর্শে সরকার ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারেও ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যাংক ঋণ এখন আগের চেয়ে ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাইছি।
ফারুক হাসান: ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় অন্যান্য খাতের মতো তৈরি পোশাক খাতেও বিনিয়োগের খরচ বাড়াবে। একই সঙ্গে উৎপাদনে খরচও বাড়বে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে আমরা আমাদের প্রতিযোগী ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া সঙ্গে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ সেসব দেশগুলোতে ব্যাংকের সুদের হার আমাদের চেয়ে অনেক কম, যার ফলে ব্যাংক ঋণের কস্ট অফ ইনভেস্টমেন্ট, প্রোডাকশন এবং কস্ট অব গুডস বেড়ে যাবে, যার ভার দিন শেষে বহন করতে হবে ভোক্তাদের। 

আজকের পত্রিকা: যে সমস্যাগুলোর কথা বলছেন, সেগুলো মোকাবিলা করে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়—এ রকম কোনো পরিকল্পনা কি আপনারা করছেন? 
ফারুক হাসান: তৈরি পোশাক খাতে বর্তমানে যেসব সমস্যা আছে, সেগুলা কাটিয়ে ওঠার জন্য দেশ-বিদেশে দৌড়ঝাঁপ করছি। ক্রেতাদের মধ্যে মনোবল ফিরে আনার জন্য আমি শরীর খারাপ নিয়েও বায়ারদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ফ্রান্সের ছুটে এসেছি, যাতে আমাদের মেম্বাররা পোশাক খাত নিয়ে একটু আশ্বস্ত হতে পারে। তৈরি পোশাক নিয়ে ফ্রান্সে এখন তিনটা মেলা হচ্ছে। সেখানে আমাদের অনেক রপ্তানিকারক অংশগ্রহণ করছেন। আমি ফ্রান্সে ছুটে এসেছি ক্রেতা ও উৎপাদকদের একটু সাহস জোগাতে। 

আজকের পত্রিকা: শিল্প উৎপাদনের অন্যতম অনুষঙ্গ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। শিল্পের রেকর্ড পরিমাণ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ দেওয়ার শর্তে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের সরবরাহ কেমন পাচ্ছেন। 
ফারুক হাসান: বৈশ্বিক বিভিন্ন সমস্যা ছাড়াও তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য শিল্প খাতে গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহে সংকট আছে। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হবে এই শর্তে গ্যাসের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। তার পরও আমরা গ্যাসের পর্যাপ্ত সংগ্রহ পাচ্ছি না। বিশ্ববাজারে এখন গ্যাসের দাম দিনে দিনে কমছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির এই সংকটের মধ্যে রপ্তানিকারকদের উৎসাহিত করার জন্য সরকারের উচিত উৎপাদনশিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গ সমন্বয় করা। 

আজকের পত্রিকা: সম্প্রতি আপনি রিপাবলিকান পার্টির টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের সিনেটর টেড ক্রুজসহ কয়েকজন মার্কিন আইন প্রণতাকে চিঠি লিখেছেন বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানি ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করার জন্য। কোনো সাড়া পেয়েছেন কি? 
ফারুক হাসান: এখনো তেমন কোনো ইতিবাচক সাড়া পাইনি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। কিন্তু আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে তুলা কিনি, তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো শুল্ক দিতে হয় না। আমরা আমাদের তুলার মোট চাহিদার ১০ থেকে ১২ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করে থাকি। একটা স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রের তুলা রপ্তানিতে শুল্ক মওকুফ করতে পারে, তাহলে উন্নত দেশ হিসেবে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পোশাক রপ্তানিতে একই সুবিধা প্রত্যাশা করি। তা ছাড়া তৈরি পোশাক রপ্তানিতে যদি শুল্ক উঠিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা কম দামে পোশাক কিনতে পারবে। একই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়বে। সামনের দিনের ট্যাড ক্রসের সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে পোশাক রপ্তানির ওপর শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়ে আলোচনার সম্ভাবনা আছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পালানোর গুঞ্জনের অবসান ঘটিয়ে দেশে ফিরলেন আবদুল হামিদ

মেঘালয়ে হানিমুনের সময় ভাড়াটে খুনি দিয়ে স্বামীকে হত্যা, উত্তর প্রদেশে নববধূর আত্মসমর্পণ

কানাডার লেকে বোট উল্টে বাংলাদেশের পাইলট ও গার্মেন্টস ব্যবসায়ীর মৃত্যু

এআই যুগে চাকরি পেতে যে দক্ষতা লাগবেই, জানালেন মাইক্রোসফটের সিইও

ঈদের ছুটির সুযোগে মাদ্রাসার গাছ বেচে দিলেন সুপার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত