Ajker Patrika

পূজা থেকে উৎসব

মানবর্দ্ধন পাল
আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০২২, ১৩: ৪৬
Thumbnail image

বাঙালি হিন্দুসমাজের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার ইতিহাসও একমুখীন নয়। এর পৌরাণিক ইতিহাস আছে। আবার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসও আছে। দুর্গাপূজার পৌরাণিক তাৎপর্য প্রায় সর্বজনবিদিত। ‘রামায়ণ’ মহাকাব্যে রামচন্দ্রের ১৪ বছর বনবাসকালে রাবণ কর্তৃক সীতা হরণের পর রাম রাবণবধ ও সীতাকে উদ্ধারের জন্য দুর্গাদেবীর আরাধনা করেছিলেন। তা ছিল শরৎকালে দেবীর অকালবোধন। বসন্তকালের চৈত্র মাসে আরাধ্য চণ্ডী বা বাসন্তী দেবীর পূজার আয়োজন তিনি করেছিলেন শরতে। সেই পূজাই পৌরাণিক মতে, শারদীয় দুর্গাপূজা। কিন্তু এই পূজার সামাজিক ইতিহাস ভিন্ন।

বর্তমানকালে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। ‘বর্তমানকাল’ শব্দটি লিখলাম এ কারণে যে প্রাচীনকালে এ দেশে দুর্গাপূজা সামাজিকভাবে জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত ছিল না। আঠারো শতকের শেষের দিকে এ দেশে দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয়। তাতে তখন সর্বসাধারণের অংশগ্রহণ ছিল না। হিন্দু রাজা, জমিদার ও বনেদি পরিবারে দুর্গাপূজার আয়োজন হতো। সেখানে নিমন্ত্রিতও থাকত তাদের শ্রেণির লোকজন ও স্বজনেরা। আর ইংরেজ তোষণকারী জমিদারদের ‘মহামান্য’ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হতো ইংরেজ হর্তাকর্তারা। নিম্নবর্গের মানুষ সেখানে অংশ নেওয়া বা দর্শনের সুযোগ পেত না। ভোগ তো দূরের কথা, কিঞ্চিৎ উপভোগের সুযোগ থেকেও তারা বঞ্চিত হতো। চাবুক ও লাঠি হাতে পাহারায় থাকত একাধিক দ্বাররক্ষী।

১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পরও বাংলার বনেদি পরিবারে এ ধরনের দুর্গাপূজা আয়োজনের ইতিহাস পাওয়া যায়। কলকাতার নবকৃষ্ণ দেব ছিলেন লর্ড ক্লাইভের সেরেস্তাদার বা হিসাবরক্ষক। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে অবৈধ সম্পদ অর্জন করে তিনি তাঁর বাড়িতে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হন সাঙ্গপাঙ্গসহ লর্ড ক্লাইভ। তখন ক্লাইভকে খুশি করতে নবকৃষ্ণ সেই দুর্গাপূজায় মদ-মাংসসহ বাইজির নাচ-গানের ব্যাপক আয়োজন করেছিলেন। ইংরেজতোষণই ছিল এমন পূজার আসল উদ্দেশ্য। তারপর শতেক বছর ধরে বাংলায় যত দুর্গাপূজা হয়েছে, সবই বনেদি ধনিক শ্রেণির পারিবারিক আয়োজনে এবং তাতে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল নিষিদ্ধ।

বনেদি হিন্দুসম্প্রদায়ের এমন সংরক্ষিত দুর্গাপূজার আয়োজন বাংলায় চলেছে প্রায় শতাব্দীব্যাপী। রাগে-দুঃখে, ক্ষোভে-অপমানে সাধারণ বাঙালি হিন্দুসমাজ যখন সংক্ষুব্ধ, তখন ১৮১৯ সালে শুরু হয় ‘বারোয়ারি’ দুর্গাপূজার সূচনা। বারোয়ারি শব্দটি মূলত হিন্দি ভাষার। বারো হলো সংখ্যাবাচক শব্দ আর ‘ইয়ার’ শব্দের অর্থ বন্ধু। বারো ইয়ার থেকে বারোয়ারি শব্দের উৎপত্তি। গঙ্গার ওপারে হুগলির গুপ্তিপাড়া গ্রামের বারোজন ব্রাহ্মণ মিলে পরামর্শ করে আয়োজন করেন দুর্গাপূজার। আশপাশের গ্রামের মানুষও এর সঙ্গে সম্মিলিত হয়। এভাবে বারোয়ারি দুর্গাপূজার সৃষ্টি। তারা বারো গ্রামের সবার কাছ থেকে স্বেচ্ছাদানে চাঁদা সংগ্রহ করে সবার সম্মিলিত উদ্যোগে আয়োজন করেন দশভুজা বন্দনার। তাতেও অভিজাত ব্রাহ্মণ ও বর্ণহিন্দুরা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগকে দমাতে পারেনি। প্রবহমান কালের ধারায় এই বারোয়ারি দুর্গাপূজা বাংলার সবখানে বিস্তার লাভ করে। আর জ্যামিতিক হারে কমতে থাকে ব্যক্তি উদ্যোগে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজা। এখন তা প্রায় শূন্যের কোঠায় এবং যৎসামান্য হলেও নিষ্প্রাণ।

এভাবে বারোয়ারি আয়োজনের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজা কালক্রমে অভিজাত বর্ণহিন্দু ও ধনিক সম্প্রদায়ের হাত থেকে মাটির কাছাকাছি সাধারণ মানুষের কাছে চলে আসে। দেবী দশভুজা যেন ধনিক-বণিকের কারা-মন্দিরের সুদীর্ঘ বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে তাঁর গণ পূজক সন্তানদের মাটির ঘরে চলে আসেন। এভাবে কালক্রমে বারোয়ারি দুর্গাপূজা হয়ে ওঠে সর্বজনীন। ‘সর্বজনীন’ মানে সবার সহযোগিতায়, সবার অংশগ্রহণে উদ্‌যাপন হয় যে অনুষ্ঠান।

একালে বাঙালি হিন্দুসমাজের দুর্গাপূজা কেবল যাগযজ্ঞ, চণ্ডীপাঠ ও বেদমন্ত্র উচ্চারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাঙালির লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে দুর্গাপূজা হয়ে উঠেছে দুর্গোৎসব। ঢাকের বাদ্যি-উলুধ্বনি ও কাঁসরঘণ্টার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাহারি সাজসজ্জা, কারুকার্যময় নতুন পোশাক, দৃষ্টিনন্দন আলোকসজ্জা, আগমনী গান, পালাগান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিজয়া দশমীর শোভাযাত্রা, নারীদের সিঁদুর খেলা—আরও কত-কী! এভাবে বারোয়ারি দুর্গাপূজা সবার সহযোগিতা এবং অংশগ্রহণের মাধ্যমে একালে হয়ে উঠেছে 
সর্বজনীন উৎসব।

বাঙালির কাছে দেবী দুর্গা আর পৌরাণিক রূপে থাকেননি—কন্যা স্বরূপিণী হয়ে উঠেছেন। হিমালয়ের গিরিশৃঙ্গে স্বামী শিবের ঘর থেকে কন্যা স্বরূপিণী দুর্গা বছরে একবার পিতৃগৃহে আসেন। বাস্তবজীবনে বিবাহিত কন্যারা শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি এলে যেমন পারিবারিক উৎসবের আয়োজন হয়, তেমনি দুর্গোৎসব যেন বাঙালি হিন্দুসমাজে পিতৃগৃহে সসন্তানে কন্যার আগমন। দেবী দুর্গা তখন কেবল ‘শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’ থাকেন না—মাতৃরূপেণ এবং কন্যারূপেণ সংস্থিতা হয়ে ওঠেন। মহালয়ার পিতৃতর্পণ থেকে শুরু হয় দেবীর আগমনবার্তা। দেবীর আগমনী গানে তারই ছন্দিত সুরেলা প্রকাশ। শারদীয় আশ্বিনের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে দেবীর আগমন এবং পরবর্তী তিন দিন পূজিত-বন্দিত হয়ে দশমীতে দেবী ফিরে যান স্বামীগৃহে। বিসর্জনের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে দুর্গোৎসবের। দশমীতে তাই কন্যা বিদায়ের বিষাদ যেন উষ্ণপ্রস্রবণের মতো জেগে ওঠে বাঙালির অন্তরে।

সংস্কৃতির রূপান্তরের মাধ্যমে একালে পৌরাণিক দুর্গাপূজা রূপ লাভ করেছে শারদীয় উৎসবে। উৎসব মানেই মানুষের সম্মিলন, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মানুষের মিলনক্ষেত্র—সম্মিলিত আনন্দযজ্ঞ। এখন বাংলাদেশের বাঙালির অন্যতম জনপ্রিয় স্লোগান—ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। এই লক্ষ্যে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনার অভিসারী হোক আগামীর বাংলাদেশ। আর যেন রামু, নাসিরনগর,দিনাজপুর, মাগুরা, ভোলা ও কুমিল্লার নানুয়ার দিঘিপাড়ের দুর্ঘটনার মতো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের খবর আমাদের দেখতে বা শুনতে না হয়। দুর্গা নামের তাৎপর্য যদি হয় দুর্গতিনাশিনী, তবে আমাদের জীবনের সর্ববিধ দুর্গতি তিনি দূরীভূত করুন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত