Ajker Patrika

হোয়াইট হাউসের নামে ভুয়া বিতর্ক: রাকিব ও তার পরিবার প্রতারণার শিকার

রংপুর প্রতিনিধি
আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২৩, ২১: ৫২
Thumbnail image

৭৩টি দেশের ৫৩৪ জন বিতার্কিককে পেছনে ফেলে ১৪৪টি বিতর্ক প্রতিযোগিতা জিতে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে সেরা বিতার্কিক নির্বাচিত হয়েছে রংপুরের শাহ মুহাম্মদ রাকিব হাসান (১৭)। এর মধ্য দিয়ে রাকিব অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। দেশের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের অনলাইন ও প্রিন্ট সংস্করণে এমন খবর প্রকাশ হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে রাকিবকে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়। সেখানে রংপুর জেলা প্রশাসকও উপস্থিত ছিলেন। 

কিন্তু পরে জানা যায় খবরটি ভুয়া। হোয়াইট হাউস এমন কোনো বিতর্কের আয়োজনই করেনি। 

খবরটি ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পর রাকিবকে প্রতারণার জন্য দায়ী করে কোনো কোনো গণমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আজকের পত্রিকার কাছে এ নিয়ে তার পরিবার উষ্মা প্রকাশ করে। রাকিবের পরিবারের দাবি, একটি চক্রের মাধ্যমে তাঁরা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এ জন্য তাঁরা উল্টো গণমাধ্যমকে দোষারোপ করেছেন। তাঁরা বলেন, এ-সংক্রান্ত খবর প্রকাশ করতে গিয়ে কোনো গণমাধ্যমই রাকিব বা তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। 

রাকিবের ওই কথিত অর্জনের বিষয়ে গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন হোয়াইট হাউসের উদ্যোগে ‘ফাইন্ডিং ওয়ার্ল্ড ফিউচার লিডার্স ২০২৩’ আয়োজনে একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশের রংপুরের স্কুলছাত্র শাহ মুহাম্মদ রাকিব হাসান সেরা বিতার্কিক হয়েছে। এতে বলা হয়, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে প্রতিযোগিতাটি শেষ হয় ১৪ মার্চ। অনলাইনে হওয়া সেই বিতর্কে অংশ নেয় বিভিন্ন দেশের ৫৩৪ জন বিতার্কিক। 

গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভবিষ্যতের নেতা খুঁজতে’ প্রতিবছর দুটি ক্যাটাগরিতে সংসদীয় বিতর্কের আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। একটি ব্রিটিশ সংসদীয় বিতর্ক, অন্যটি এশিয়ান সংসদীয় বিতর্ক। এবারের আয়োজনে চ্যাম্পিয়ন দেশ রাশিয়া। এরপরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্র। 

প্রতিবেদনগুলোতে আরও বলা হয়, হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশি স্কুলছাত্র রাকিব ৫৩৪ জন প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে সেরা বিতার্কিক হয়েছে। রাকিব ১৪৪টি বিতর্কে অংশ নিয়ে সবকটি জিতেছে। এর মধ্য দিয়ে হোয়াইট হাউসের রেকর্ড বুকে নাম উঠেছে রাকিবের। রাকিবের আগে লুইস অ্যান্ডারসন নামের একজন টানা ১৩৯টি বিতর্কে জিতে রেকর্ড গড়েছিলেন। 

এদিকে গণমাধ্যমে এই খবর প্রকাশিত হলে বাংলাদেশি ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা রিউমর স্ক্যানার অনুসন্ধানে জানতে পারে, হোয়াইট হাউস সম্প্রতি এমন কোনো প্রতিযোগিতার আয়োজন করেনি। এ বিষয়ে হোয়াইট হাউস বা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কোনো সংশ্লিষ্টতারও প্রমাণ মেলেনি। হোয়াইট হাউসের ডোমেইনের সঙ্গে মিল রেখে ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে ভুয়া প্রতিযোগিতার খবর ছড়ানো হয়। বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাস থেকেও এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়। 

রিউমর স্ক্যানার অনুসন্ধানে আরও জানতে পারে, রাকিব তার ফেসবুক পোস্টে প্রতিযোগিতার ‘লিগ্যাল ডকুমেন্টস’ দাবি করে কিছু ছবি প্রকাশ করেছিল। এতে যুক্তরাষ্ট্রের দুজন কর্মকর্তার জাল স্বাক্ষরের প্রমাণ মিলেছে। তা ছাড়া রাকিব দুটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জড়িয়ে ভুয়া খবরের স্ক্রিনশট তার ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করেছে। 

এমনকি কথিত এই আয়োজনের পুরস্কার বিতরণের প্রস্তুতি সভার একটি ছবিও হোয়াইট হাউসের নামে খোলা ভুয়া সাইটটিতে রয়েছে। রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, এটি মূলত ২০১৮ সালের বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক প্রতিযোগিতার ছবি। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাকিব আজকের পত্রিকাকে জানায়, সে নিয়মিত বিভিন্ন বিতর্কে অংশ নেয়। বিভিন্ন সময় দেশে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সে অনেক পুরস্কার জিতেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুকের একটি পেজে ‘২৫ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ কাউন্সিলের বিতর্ক প্রতিযোগিতা হবে’, এমন পোস্ট সামনে এলে সেখানে সে নাম, মোবাইল নম্বর, ই-মেইল ঠিকানা দিয়ে নিবন্ধন করে। এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি তাকে একটি ই-মেইলের মাধ্যমে জানানো হয় যে, ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে অনলাইনে বিতর্কটি অনুষ্ঠিত হবে। 

 ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ মার্চ রাকিব অনলাইনে বিতর্কটিতে অংশ নেয়। ২০ মার্চ একই ই-মেইল ঠিকানা থেকে জানানো হয়, রাকিব সেরা বিতার্কিক হয়েছে। সেরা বিতার্কিক হিসেবে স্বীকৃতির প্রমাণ হিসেবে একটি ওয়েবসাইট লিংকও তাকে দেওয়া হয়। তাকে জানানো হয়, ২৮ মার্চ স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টায় ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউস সাউথ কোর্ট অডিটোরিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কার বিতরণ করা হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, বিশেষ অতিথি থাকবেন জেফ জায়েন্টস। 

পরিবার বলছে, পাসপোর্ট না থাকায় রাকিব ওই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেনি। 

এরপর বিষয়টি পারিবারিকভাবে যাচাই করার জন্য রাকিব তার দাদা (বাবার চাচা) ভোরের কাগজ পত্রিকার দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলা প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান বকুলকে জানায়। 

রাকিবের পরিবারের দাবি, শুরু থেকে গণমাধ্যমে রাকিবের বিশ্বসেরা বিতার্কিক হওয়ার যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর একটিতেও রাকিব বা তার পরিবারের কারও বক্তব্য নেই। ফলে কোনো গণমাধ্যমকে তাঁরা এ সংক্রান্ত খবর সরবরাহ করেছেন—এমন দোষ দেওয়া যায় না। গণমাধ্যমগুলো নিজেরা অতি উৎসাহী হয়ে খবরটি প্রকাশ করে। যাচাই-বাছাই ছাড়া, রাকিব ও তার পরিবারের সঙ্গে যোগযোগ না করে খবরটি প্রকাশ করে গণমাধ্যমগুলো দায়িত্বশীল কাজ করেনি। 

এ বিষয়ে রাকিবের বাবা শাহ মুহাম্মদ আবু সায়েম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ডিবেট নিয়ে আমরা একবার প্রতারিত হয়েছি। আমরা নিউজ করার বিষয়ে কোনো মিডিয়াকে বলিনি। কোনো মিডিয়া আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করেই নিউজ ছাপিয়ে দিয়েছে। এখন দেখছি গণমাধ্যমই আমাদের প্রতারণার দোষ দিচ্ছে। আর যে রিউমর স্ক্যানার রাকিবকে প্রতারক বলছে, তারও কোনো ভিত্তি নেই। রিউমর স্ক্যানারও রাকিব বা আমাদের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।’ 

রাকিবের মা রোকেয়া বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার ছেলে প্রতারণার শিকার হয়েছে। আমার ছেলেকে আর কোনো এক্সট্রা কারিকুলারের সঙ্গে যুক্ত রাখব না। যেখানে আমি ভুক্তভোগী, আমাদের কোনো কথাবার্তা না শুনে নিউজ করা হলো। নিউজ করার আগে আমাদের সঙ্গে মিডিয়াগুলো যোগাযোগ করলে আজ আমার ছেলেকে কেউ প্রতারক বলতে পারত না।’ 

রোকেয়া বেগম আরও বলেন, ‘আমার ছেলে একজন প্রতিবন্ধী। যেখানে ওর নিজের কাজ নিজেই ঠিকঠাক করতে পারে না, সেখানে সে এত বড় প্রতারণা কীভাবে করবে? বিভিন্ন টেলিভিশন, পত্রিকা অনলাইন এখন আমার ছেলেকে প্রতারক বলছে। নানা ভাষায় গালমন্দ করছে। সংবাদমাধ্যমে এসব প্রকাশ না হলে আজ এই প্রতারণার কথা শুনতে হতো না। এসব কিছুর জন্য দায়ী মিডিয়াগুলোই। বর্তমানে আমরা কী পরিস্থিতির মধ্যে আছি, আপনাদের বোঝানো যাবে না।’ 

কথিত ফেসবুক পেজ থেকে আমন্ত্রণ, বিতর্কে অংশ নেওয়া এবং সেরা বিতার্কিক নির্বাচিত হওয়ার খবর রাকিব তার ফেসবুক আইডিতে বেশ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে শেয়ার করেছে। প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার স্বীকৃতির সনদও এই ফেসবুক পেজ থেকে তাকে সরবরাহ করা হয়েছে বলে দাবি করেছে রাকিব। সেগুলোও সে ফেসবুকে শেয়ার করেছে। 

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে শাহ মুহাম্মদ রাকিব আজকের পত্রিকাকে বলে, ‘আমি প্রতারণার শিকার হয়েছি। এখন আমাকে নিয়ে মানুষ বাজে মন্তব্য করছে। বাংলাদেশসহ আমেরিকার নিউজগুলো সব একই রকম। সব মিডিয়াই কপি-পেস্ট সাংবাদিকতা করেছে। একটা ঘটনা বিস্তারিত না জেনে কীভাবে দেশের গণমাধ্যম এমন কাজ করল বুঝতে পারছি না।’ 

এদিকে সেরা বিতার্কিক হওয়ার খবর পেয়ে রংপুর পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহ মুহাম্মদ রাকিব হাসানকে ২ এপ্রিল সম্মাননা দেয় সমাজসেবা অধিদপ্তর। রংপুর গ্রাস রুট কো-অপারেশনের সহযোগিতায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের আয়োজনে রংপুর জেলা প্রশাসনের সৌজন্যে রাকিবের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেওয়া হয়। 

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক আব্দুল মতিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা সিভিল সার্জন মো. জাহাঙ্গীর কবির, বিভাগীয় সমাজসেবা কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক মোশাররফ হোসেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) গোলাম রব্বানী প্রমুখ। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. চিত্রলেখা নাজনীন এ বিষয়ে বলেন, ‘আমি তো ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলাম মাত্র। অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। তা ছাড়া প্রতিযোগিতার খবরটি যে ভুয়া, তা আমরা জানতাম না।’ 

উল্লেখ্য, শুরুতেই খবরটি আজকের পত্রিকার হাতে আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে রাকিব ও তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এ-সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্যাদি যাচাই করে এবং রাকিবের সঙ্গে কথা বলে খবরটির সত্যতা না পাওয়ায় আজকের পত্রিকা এ-সংক্রান্ত খবর প্রকাশ থেকে বিরত থাকে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত