Ajker Patrika

সাত মাসে আলেশা মার্টের মালিকের সম্পত্তি বেড়েছে ২২৮ গুণ 

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা
আপডেট : ১৮ জুন ২০২৩, ১৭: ৩১
সাত মাসে আলেশা মার্টের মালিকের সম্পত্তি বেড়েছে ২২৮ গুণ 

মামলা হয়েছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম সিকদারসহ চার ব্যক্তি ও ১৪ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। ডিএমপির বনানী থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেছে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের সহকারী পুলিশ সুপার আল মামুন।

চারটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে গ্রাহকের ৪২১ কোটি টাকা পাচার করেছে আলেশা মার্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম সিকদার। অর্থপাচারে তাকে সহযোগিতা করেছেন তাঁর স্ত্রী সাদিয়া চৌধুরীসহ তিন ব্যক্তি ও দশ প্রতিষ্ঠান। সারা বছরে মঞ্জুর আলমের আয় ছিল ১৩ লাখ টাকা। তবে আলেশা মার্ট খোলার সাত মাসেই ৩১ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হন তিনি। সাত মাসে তাঁর সম্পদ ও আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ২২৮ গুণের বেশি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, এগুলো সবই গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে গড়ে তোলা সম্পদ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে গ্রাহকের অর্থপাচারের প্রাথমিক প্রমাণ মিলছে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বনানী থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছে। মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি।

গ্রাহকদের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ও মামলার পর আলেশা মার্টের অর্থপাচারের বিষয়ে আড়াই বছর ধরে অনুসন্ধান করে সিআইডি। অনুসন্ধান শেষে সিআইডি প্রতিষ্ঠান ও মালিকের বিরুদ্ধে ৪২১ কোটি ৯১ লাখ টাকা পাচারের প্রাথমিক প্রমাণ পায়। এই ঘটনায় গত ৩১ মে মামলা করা হয়।

মামলায় আসামিরা হলেন আলেশা মার্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুর আলম সিকদার, তাঁর স্ত্রী সাদিয়া চৌধুরী, প্রস্তাবিত পিপিলস ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবুল কাসেম, মোটরসাইকেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও এস কে ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আল মামুন। এছাড়াও দশটি প্রতিষ্ঠানকে আসামি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো আলেশা মার্ট লিমিটেড, আলেশা হোল্ডিং লিমিটেড, আলেশা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সার্ভিসিং লিমিটেড, আলেশা টেক লিমিটেড, আলেশা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড, আলেশা রাইড লিমিটেড, আলেশা এক্সপোর্ট–ইমপোর্ট লিমিটেড, আলেশা ফার্মেসি লিমিটেড ও আলেশা এগ্রো লিমিটেড। সবগুলো প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা বনানীর ১৭ নম্বর সড়কের রূপসা টাওয়ার।

বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, গত ৩১ মে আলেশা মার্টের মালিকের বিরুদ্ধে অর্থপাচার আইনে সিআইডির একজন কর্মকর্তা মামলাটি করেছেন। মামলা নম্বর ৪০। মামলাটি সিআইডি তদন্ত করছে বলেও জানান তিনি।

মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম সিকদার ন্যাশনাল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের চারটি অ্যাকাউন্ট থেকে ৪২১ কোটি ৯১ লাখ টাকা উত্তোলন করে বিভিন্ন সময় পাচার করেছেন।

সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে মঞ্জুর আলম সিকদারের আয়কর নথিতে তাঁর বেতনসহ অন্যান্য সোর্স থেকে বার্ষিক আয় ছিল ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা মাত্র। কিন্তু আলেশা মার্ট শুরুর পর তিনি ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৩১ কোট ৮০ লাখ ৫৮ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদের মালিক হন। সাত মাসে তাঁর সম্পদ ও আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ২২৮ গুণের বেশি। আসলে মঞ্জুর আলম হাজার হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা নিয়ে এই সম্পদের মালিক হন।

এছাড়াও গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে মঞ্জুর আলম সিকদার প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংক লিমিটেডের ডাইরেক্টরশীপ নেওয়া এবং শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন। পিপলস ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম ১০০ কোটি টাকা দিয়েছিলেন। এই ঘটনায় আবুল কাশেমকেও মামলায় আসামি করেছে সিআইডি।
 
আলেশা মার্টের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বাইক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এস কে ট্রেডার্স এর স্বত্বাধিকারী আল মামুনকে আসামি করা হয়েছে। তিনি দেশের হাজার হাজার গ্রাহককে আলেশা মার্টে বিনিয়োগ করতে প্রলুব্ধ করেছেন। তিনি সাধারণ গ্রাহকদের আস্থা তৈরি করতে নিজের প্রতিষ্ঠানের চেক দিয়েছেন। যা বিশ্বাস করে গ্রাহকেরা প্রতারিত হয়েছে। এস কে ট্রেডার্সের মামুন মঞ্জুর আলম সিকদারকে অর্থপাচারে সহযোগিতা করেছেন বলেও সিআইডি দাবি করেছে।

গত ১ মে পর্যন্ত আলেশা মার্টের বিরুদ্ধে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে ২ হাজার ৮৭ জন এবং সিআইডি সদর দপ্তরে ৩৫ জন গ্রাহক প্রতারিত হয়ে অভিযোগ করেন। এ সকল অভিযোগে অর্থ আত্মসাতের কথা বলা হয়েছে এবং তারা টাকা ফেরতে আইনি সহায়তা চেয়েছেন।
 
সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আলেশা মার্ট শুরু থেকেই আকর্ষণীয় ডিসকাউন্টে বিভিন্ন অফার দিয়ে অসংখ্য গ্রাহকের কাছ থেকে মোটরসাইকেল ও ইলেকট্রনিক বিভিন্ন পণ্য সরবরাহের কথা বলে অগ্রিম টাকা নেয়। টাকা ফেরত না দিয়ে প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের মালিক ই-কমার্স ব্যবসার আড়ালে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থপাচার করেছেন।

অর্থপাচারের মামলা হলেও এখনো কেউ গ্রেপ্তার হননি। পুলিশ বলছে আসামিরা পলাতক। তবে গ্রাহকদের অনেকেই জানিয়েছেন মঞ্জুর আলম প্রকাশ্যে রয়েছে। তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না। মঞ্জুর আলমের বিরুদ্ধ এই মামলা ছাড়াও ঢাকা ও ঢাকার বাইরে একাধিক মামলা রয়েছে। সেগুলোর কয়েকটিতে তাঁর বিরুদ্ধে আদালতের পরোয়ানাও রয়েছে। তারপরও দীর্ঘদিন ধরে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছেন। যে দশটি প্রতিষ্ঠান মঞ্জুর আলম করেছেন, তাও গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে।

অর্থপাচারের বিষয়ে মঞ্জুর আলমের বক্তব্য জানতে আলেশা মার্টের বনানীর রূপসা টাওয়ারের অফিসে দুদিন গিয়েও সেখানে পাওয়া যায়নি। তাঁর মুঠোফোনে ফোন করে ও খুদে বার্তা দিয়েও কোনো সারা মেলেনি। অপর আসামিদের বর্তমান ঠিকানায় গিয়ে তাদের পাওয়া যায়নি। তাদের ব্যবহৃত মুঠোফোনও বন্ধ। তারা পলাতক রয়েছেন।

সিআইডি’র অর্গানাইজড ক্রাইমের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) কুসুম দেওয়ান জানান, মামলাটি তদন্ত চলছে। আসামিদের গ্রেপ্তারে সিআইডির অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

প্রসঙ্গত, আলেশা মার্ট ২০২০ সালের ২৬ জুলাই আরজেএসসি (যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদপ্তর) থেকে নিবন্ধন করা হয়। একই বছরের ১০ নভেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) থেকে ট্রেড লাইসেন্স নেয়। ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত