Ajker Patrika

বছরজুড়ে মব-আতঙ্ক

শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা 
এআই দিয়ে বানানো প্রতীকী ছবি
এআই দিয়ে বানানো প্রতীকী ছবি

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরেও আইন- শৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। মনোবল হারানো পুলিশ বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে মাথাচাড়া দেওয়া অপরাধীদের দৌরাত্ম্যে মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। মানুষের মনে বেশি আতঙ্ক তৈরি করেছে ‘মব’।

সরকার বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং উন্নতির দিকে যাচ্ছে। তবে খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, গণপিটুনি, ‘মব জাস্টিস’, শিক্ষকদের হেনস্তা, পুলিশের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন ঘটনা ভিন্ন কথা বলছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট সারা দেশে বিভিন্ন থানা ও পুলিশের স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, আগুন, লুটের ঘটনায় পুলিশের মনোবল ভেঙে যায়। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিন পর পুলিশ সদস্যরা কাজে ফিরলেও তাঁদের মানসিক শক্তি এখনো ফেরেনি। সক্রিয় হয়ে উঠেছে অপরাধীরা। পুরান ঢাকার মিটফোর্ডে প্রকাশ্যে ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগকে নির্মমভাবে হত্যা, কুমিল্লায় এক নারী ও তাঁর দুই সন্তানকে কুপিয়ে-পিটিয়ে হত্যা, কুমিল্লায় এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া, বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণসহ বিভিন্ন ঘটনায় মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা ও যৌথ বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি।

জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আগের চেয়ে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে এখন দুর্বল, এটা অপরাধীরা ভালোভাবেই বোঝে। এ জন্য অপরাধে রাশ টানা যাচ্ছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এই এক বছরে জনগণের মধ্যে আইন মানার প্রবণতা কম ছিল। পুলিশের দায়িত্ব পালনের পরিবেশ অনুকূল ছিল না। সব মিলিয়ে অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক বছরে দেশে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৭৮৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৩ হাজার ৮৩২টি খুন, ৪ হাজার ১০৫টি ধর্ষণ এবং পুলিশের ওপর হামলার ৫২০টি মামলা। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ছয় মাসে ১৪১টি ‘মব ভায়োলেন্সের’ ঘটনায় প্রাণ গেছে অন্তত ৮৩ জনের। খুন, ধর্ষণ, পুলিশের ওপর হামলা ও মব ভায়োলেন্সের ঘটনা সারা দেশেই ঘটেছে। ছিনতাই, ডাকাতি, চুরি নিত্যদিনের অপরাধে পরিণত হয়েছে। ছিনতাইয়ের একের পর এক ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে। ভুক্তভোগীদের অনেকে মামলা করতে আগ্রহী না হওয়ায় ছিনতাই, ডাকাতি ও চুরির ঘটনা প্রকৃতপক্ষে অনেক বেশি।

আজকের পত্রিকার জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য থেকে জানা যায়, সাতক্ষীরায় গত বছরের ৫ আগস্টের পর সহিংসতায় আশাশুনির প্রতাপনগরে ৯ জন, সদর উপজেলায় ৪ জন এবং তালা উপজেলায় ১ জন নিহত হন। বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও মাছের ঘেরে ব্যাপক লুটপাট হয়।

সুনামগঞ্জে সরকার পতনের পর একাধিক স্থানে ‘মব’ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। কয়েকটি স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের লাঞ্ছনা ও জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ ওঠে।

ঠাকুরগাঁওয়ে একাধিক শিক্ষক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও শিক্ষকদের হেনস্তা বন্ধে বারবার নির্দেশনা দেওয়া হলেও তেমন কাজ হয়নি।

টাঙ্গাইলে মব সৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় বাড়িঘর ভাঙচুর হয়েছে। জেলার ৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক পরিবর্তন করা হয়েছে। মব আতঙ্কে দেলদুয়ার উপজেলায় এক প্রধান শিক্ষক হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৯ আগস্ট ছাত্র-জনতার চাপে পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রকৌশলী ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এ সময় এক কর্মকর্তার শরীরে সিগারেটের প্যাকেট পিনআপ করা হয়, এতে তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলায় মবের হামলায় নারী, শিক্ষক ও নিরীহ মানুষ সহিংসতার শিকার হয়েছেন, কেউ কেউ প্রাণও হারিয়েছেন।

গত বছরের জুনে কুমিল্লার মুরাদনগরে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের পর ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ঘটনাটি দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই মামলার প্রধান আসামি ফজর আলীর ভাই শাহ পরানকে র‍্যাব গ্রেপ্তার করে। জুলাইয়ে মুরাদনগরেই মব সৃষ্টি করে এক নারী ও তাঁর দুই সন্তানকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত তিনজন হলেন রোকসানা বেগম, তাঁর দুই সন্তান রাসেল ও তাসপিয়া। তাঁদের ‘মাদক কারবারি’ অপবাদ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় আটজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও তদন্ত চলমান।

খুলনায় গত বছরের আগস্ট থেকে সহিংসতা, লুটপাট, চাঁদাবাজি এবং শিক্ষা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দখল-বাণিজ্যের ঘটনা বেড়েছে। রাজশাহীতে মবের হামলায় নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের এক নেতাসহ দুজন নিহত হয়েছেন, যাঁদের একজন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। শিক্ষককে পদত্যাগ করানোর ঘটনাও আছে।

দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, পুলিশ এখনো সেই ভয়াবহতার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অনেকেই দায়িত্ব পালনে আতঙ্কে থাকেন, যা অপরাধীদের সাহসী করে তুলছে।

অবশ্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর ভাষ্য, মব ভায়োলেন্স এখন কমে এসেছে। অনেক বিষয় পুলিশ এখন আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের পদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, সত্যি কথা বলতে সরকারের পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত কেবল নীতিগত আশ্বাসে সীমাবদ্ধ। বাস্তবে পুলিশের মনোবল ফেরানো, কার্যকর অপরাধ দমন কৌশল প্রণয়ন এবং প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে। উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়বে। তাই এখনই সরকারকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে কার্যকর, সাহসী ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আজকের পত্রিকার বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা।]

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তোমাদের যে কিছু করিনি, তা-ই ভাগ্য—ডাকাতির সময় দুই কিশোরীকে সাবেক সেনা কর্মকর্তা

গাজীপুরে সাংবাদিককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা

সাধুর বেশে এসে সাবেক স্ত্রীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা

স্টার্টআপ থেকে স্মার্ট সিটি: যেভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ টানছে বাংলাদেশ

বরিশাল-১: স্বপন-কুদ্দুসের দ্বন্দ্বে নির্বাচনের আগে দলে অস্থিরতা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত