Ajker Patrika

ব্যবহৃত জিনিসপত্রে মা-বাবাকে খুঁজছে মেঘ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২১: ৪০
ব্যবহৃত জিনিসপত্রে মা-বাবাকে খুঁজছে মেঘ

ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম পুরোনো শাড়ি, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট আর নোটবুকসহ কিছু পত্রিকার কাটিং। বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রীসহ আছে ক্যামেরায় তোলা নানান ছবি—যা সুতোয় বেঁধে ঝোলানো কিংবা দেয়ালে সাঁটানো। এসবের সামনে সমুদ্র গভীর চোখ নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ১৫ বছরের এক কিশোর। উজ্জ্বল ফরসা, পাতলা গড়নের লম্বাটে গায়ে কালো টি-শার্ট জড়ানো কিশোরের নাম মাহির সরওয়ার মেঘ। 

গভীর সমুদ্রের আকাশে জমে থাকা মেঘের মতো গুমোট ও দুর্বোধ্য তার দৈহিক ভাষা। যা বোঝা খুব সহজ নয়। বোঝা যাবেই-বা কীভাবে! কারণ, মাহির সরওয়ার মেঘ যে এসব সাজিয়ে রাখা জিনিসপত্রের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতিতে হাতড়ে খুঁজছে তার মা-বাবাকে। 

সাগর-রুনি দম্পতির ব্যবহৃত জিনিসপত্র স্থান পেয়েছে ঘরের দেয়ালেহ্যাঁ, এই মেঘ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির একমাত্র সন্তান। ঠিক ১১ বছর আগে, আজকের এদিনে নিজ বাড়িতে রাতের অন্ধকারে দুর্বৃত্তরা যাদের খুন করেছিল। সেই ছোট্টবেলায় হারানো মা-বাবা মেঘের মস্তিষ্কে না থাকলেও মনে আছে। তাঁদের রেখে যাওয়া এসব নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রই এখন মা-বাবার স্পর্শ পাওয়ার শেষ অবলম্বন ‘ও লেভেল’ পড়ুয়া এই উঠতি কিশোরের। 

১১ বছর আগে খুন হলেও সাগর-রুনির হত্যা মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। কোনো কূলকিনারাই করতে পারেনি দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্তকারী সংস্থা। তাই বিচারের দাবিতে এই সাংবাদিক দম্পতির পরিবার আয়োজন করেছে এক ভিন্নধর্মী চিত্র প্রদর্শনীর। রুনির ভাই নওশের রোমানের তত্ত্বাবধানে রাজাবাজারের ইন্দিরা রোডের ‘সাগর-রুনি ক্রাইম সিন ডু নট ক্রস’ দিনব্যাপী এই প্রদর্শনী চলছে। সাগর-রুনির ব্যবহার করা বিভিন্ন জিনিসপত্র দিয়ে ১০ জন শিল্পী বেশ কিছু চিত্রকর্ম বানিয়েছেন। প্রদর্শন করা হয়েছে তাঁদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও ছবি। সে সবই ঘুরে ঘুরে দেখছিল মেঘ সঙ্গে তার এক বন্ধু। যে বয়সে বন্ধুরা এলে মা-বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা। সেই বয়সে মেঘ তার মা-বাবার রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্নের সঙ্গে বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। দুটি ঘরে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। প্রথম ঘরটিতে মূলত ব্যবহার করা জিনিসপত্র দিয়ে বানানো শিল্পকর্মগুলো রাখা। এই ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়বে বড় এক গ্রিলের জানালা। কাঠ আর কাচের পাল্লার এই জানালায় মেঘের সাত-আট বছর বয়সী চারটি পোর্ট্রেট ছবি সাঁটানো। জানালা থেকে সোজা মেঝের দিকে কাগজ দিয়ে বানানো চার জোড়া পা। প্রথম দেখায় মনে হবে ছোট্ট মেঘ জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে তার মা-বাবাকে দেখছে। দরজা থেকে কয়েক পা বাড়িয়ে হাতের বাঁ দিকে তাকালে চোখে পড়বে ছোট্ট বেলকনির দরজা। দরজার দুই পাল্লায় সাগর ও রুনির ছবি সাঁটানো।

বেলকনির দড়িতে রোদে দেওয়া কাঁচা হলুদ শাড়ি। এই বেলকনির দরজার কার্নিশে রাখা রুনির ব্যবহার করা প্রসাধনী সামগ্রী। দেখে যেন মনে হবে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রোদ পোহাচ্ছেন মেঘের মা-বাবা। এসব চিত্রকর্ম বন্ধুদের দেখিয়ে প্রয়াত মা-বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে মেঘ। 

এক ফাঁকে কথা হয় তার সঙ্গে। পড়াশোনা আর শখের ক্রিকেট প্র্যাকটিস করে তার দিন কাটে। পরীক্ষার কারণে এখন ক্রিকেট প্র্যাকটিসে কম সময় দেওয়া হচ্ছে। মেঘ বলে, ‘আজ এই প্রদর্শনী নিয়ে দিন কাটবে। বন্ধুরা আসছে তাদের সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি। কোন চিত্রকর্মটা কী বোঝাচ্ছে, সেটাও বলার চেষ্টা করছি।’ 

আর একটি ঘরে কয়েকটি মনিটরে দেখানো হচ্ছে সাগর-রুনিকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংবাদ। ঘরের এক কোনায় ছোট্ট একটি টেবিলে রাখা সাগর-রুনি ও মেঘের ফ্রেমে বাঁধানো দুটি ছবি। আর দুটি খাতার সঙ্গে রাখা আছে কয়েক রঙের কালির কলম। প্রদর্শনী দেখতে এসেছে মেঘের স্বজন, সাগর-রুনির বন্ধু ও সহকর্মীরা। 

বন্ধুকে নিয়ে চিত্র প্রদর্শনীর পরিদর্শনে মেঘতন্ময় শান্ত নীল নামে একজন এখানে এসে লিখেছেন, ‘অবুঝ বয়সে যে দুঃখ ও ক্ষোভ হৃদয়ে গেঁথে গেছে, তা হয়তো মোছা সম্ভব নয়। কিন্তু পাহাড়সম ক্ষোভ কিছুটা হালকা হোক ন্যায়বিচারের মাধ্যমে। মেঘ বিশ্বাস করুক, এই রাষ্ট্র ও সমাজ তার পাশে আছে। এই প্রত্যাশায়।’ 

মেঘের স্বজন পরিচয়ে আরেকজন লিখেছেন, ‘দীর্ঘ ১১ বছর ধরে যে বিচার কার্যক্রম হয়নি, আমরা চাই তার সুষ্ঠু বিচার কার্যক্রম হোক। তাহলে আমরা সুষ্ঠু বিচার পাব।’ 

মেঘের সাত-আট বছর বয়সী চারটি ছবিসাগর-রুনি হত্যার বিচার চেয়ে এই প্রদর্শনী বেলা ১১টায় শুরু হয়ে চলে রাত ৮টা পর্যন্ত। দুই ঘরজুড়েই ছিল প্রদর্শনীর আদলে সাজানো সাগর-রুনির রেখে যাওয়া সংসার। যেখানে তাঁদের সন্তান খুঁজে ফিরছে মা ও বাবাকে। এসবের ভিড়ে বিচারের বাণী কি মেঘের মনে বৃষ্টি হয়ে ঝরে? প্রত্যেকটা শিল্পকর্মই একেকটা প্রশ্ন সামনে এনেছে, কিন্তু উত্তর কি আদৌ আছে? 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মেঘালয়ে হানিমুনে গিয়ে বর খুন, নিখোঁজ নববধূকে উদ্ধারে নেমেছে ড্রোন

ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত

গ্রামীণ ব্যাংক ঘিরে ‘নাশকতার পরিকল্পনা’ রাতভর পুলিশি পাহারা

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান বিচার ও কিছু প্রশ্ন

‘তাণ্ডব’ সিনেমার শো চলার সময় ছায়াবাণী হলে দর্শকদের ভাঙচুর, টাকা লুট

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত