Ajker Patrika

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন: জনবলের সংকটে স্থবির নাগরিক সেবা

  • ১৪ বছরেও কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছায়নি নাগরিক সেবা।
  • ২৪২টি পদের বিপরীতে কর্মরত মাত্র ৬৭ জন।
  • দীর্ঘদিন ধরে খালি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ।
  • তিন মেয়রের আমলেও স্থায়ী সমাধান মেলেনি।
কুমিল্লা প্রতিনিধি
আপডেট : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯: ১৭
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন: জনবলের সংকটে স্থবির নাগরিক সেবা

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও নাগরিক সেবা পৌঁছায়নি কাঙ্ক্ষিত মানে। জনবলের তীব্র সংকটে স্থবির হয়ে পড়েছে সেবা কার্যক্রম। ২৪২টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত মাত্র ৬৭ জন। ফলে নগরীর ১২ লাখ বাসিন্দা প্রতিদিন ভোগান্তির মুখে পড়ছে। তিন মেয়রের আমল ও প্রশাসকদের দায়িত্বকালেও এই সংকটের স্থায়ী সমাধান হয়নি। নগরবাসী এখনো অপেক্ষায় রয়েছে একটি আধুনিক ও সেবামুখী মহানগরের।

২০১১ সালে সদর ও সদর দক্ষিণ পৌরসভা একত্র হয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন গঠিত হয়। প্রথম দিকে ২২০ জনবল নিয়ে কার্যক্রম শুরু হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পদগুলো শূন্য হতে থাকে। বর্তমানে চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ জনবলও নেই। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রধান প্রকৌশলী, রাজস্ব কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও নগর পরিকল্পনাবিদের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। ফলে কর্মকর্তাদের একাধিক দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে, যার কারণে সেবার মান চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সায়েম ভূঁইয়া বলেন, ‘আমি পাঁচ বছর ধরে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দায়িত্বও পালন করছি। একজন চিকিৎসক থাকলে ভালো হতো। চাহিদা জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি।’

এই পরিস্থিতি শুধু নাগরিকদের জন্য নয়, কর্মকর্তাদের জন্যও চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। আরেক নির্বাহী প্রকৌশলী মাঈন উদ্দিন চিশতী বলেন, ‘শুধু লোক দেওয়া যথেষ্ট নয়, দক্ষ লোকবল দরকার। সংকটের কারণে আমাদের কাজের চাপ কয়েক গুণ বেড়েছে। সবার আগে জরুরি ভিত্তিতে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজন।’

নগরীতে গত ১৪ বছরে তিনজন মেয়র দায়িত্ব পালন করেছেন। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে সেবা খাত উন্নয়নের কথা থাকলেও বাস্তবে জনবলের সংকট কাটেনি; বরং শূন্য পদ বেড়েছে। মেয়রদের সময় কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য ও নগর-পরিকল্পনার মতো খাতগুলো স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রশাসক দায়িত্ব পালন করলেও সংকটের সমাধান হয়নি। কর্মকর্তাদের ওপর বাড়তি চাপ ও নাগরিকদের ভোগান্তি দিনে দিনে বেড়েছে।

নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডে যানজট, জলাবদ্ধতা, বর্জ্য অপসারণ ও দখলদারত্ব নিত্যদিনের সমস্যা। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোবারক হোসেন বলেন, ‘মহল্লায় ডাস্টবিন নেই, ল্যাম্পপোস্টে বাতি নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পাওয়া যায় না। কাউন্সিলর না থাকায় সিটি করপোরেশনে যেতে হয়। সেখানেও সহজে সেবা পাওয়া যায় না। আমরা নিয়মিত ট্যাক্স দিচ্ছি। তবু নাগরিক সুবিধা নেই। সাধারণ সমস্যা সমাধানে স্থানীয় কর্মকর্তার অভাব সরাসরি নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করছে।’

৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শামস তাজরীজ বলেন, সিটি করপোরেশনে মেয়র-কাউন্সিলর নেই। জনবলের সংকট তীব্র। যানজটের কারণে জীবনযাপন কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠাকুরপাড়া এলাকার গৃহবধূ শারমিন আক্তার বলেন, প্রতিদিন বর্জ্য পড়ে থাকে। সময়মতো সংগ্রহ করা হয় না। বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা ও যানজট বেড়ে যায়। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় নগরী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। রানীরবাজার এলাকার ব্যবসায়ী মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, অবৈধ দখল উচ্ছেদে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় সিটি করপোরেশনের কোনো অভিযান সফল হয় না।

এ ধরনের অভিযোগ নগরীর বিভিন্ন এলাকার নাগরিকদের জীবনযাত্রার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। যানজট, জলাবদ্ধতা ও বর্জ্য অপসারণের সমস্যা নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

কুমিল্লায় সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন শাহ মো. আলমগীর খান। তাঁর মতে, একজন কর্মকর্তাকে ১০টি খাতের দায়িত্ব দিলে কোনো খাতেই যথাযথ সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। আর নাগরিক সমস্যার মূলে রয়েছে সিটি করপোরেশনের জনবলসংকট। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল হক বলেন, নগর পরিকল্পনাবিদের পদ খালি থাকায় শহর অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে উঠছে। সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া আধুনিক নগরী গড়ে তোলা সম্ভব নয়।

নবনিযুক্ত প্রশাসক মো. শাহ আলম বলেন, ‘২৪২ পদের জন্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদা পাঠানো হয়েছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে দ্রুত সংকট কাটিয়ে সেবার মান বাড়ানো সম্ভব। দুই মাসের মধ্যে জনবলের ঘাটতি কমানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।’

নাগরিকেরা বলছেন, ১৪ বছর ধরে চলা জনবলসংকটে কুমিল্লা সিটি পূর্ণাঙ্গ সেবা সংস্থা হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। তিন মেয়রের সময় পার হয়েছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি। এখন প্রতিশ্রুতিই শেষ ভরসা। ১২ লাখ নাগরিকের প্রত্যাশা, সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে জনবলসংকটের সমাধান করবে। এতে সেবার মান উন্নত হবে এবং কুমিল্লা সত্যিকার অর্থে আধুনিক, বসবাসযোগ্য নগরীতে রূপ নেবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুন যেসব প্রশ্ন তুলল, সর্বশেষ যা জানা গেল

বিমানবন্দরের মতো কৌশলগত স্থাপনায় আগুন নিরাপত্তা ঘাটতির স্পষ্ট প্রমাণ: জামায়াত আমির

জামায়াত-এনসিপির পথে হঠাৎ যেন ভিন্ন বাঁক

রোববার শিক্ষা ভবন অভিমুখে থালা-বাটি নিয়ে শিক্ষকদের ‘ভুখা মিছিল’

হোয়াইট হাউস থেকে খালি হাতে ফিরলেন জেলেনস্কি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত