Ajker Patrika

সার কারখানায় হাত হারাল কিশোর, শিশুশ্রমিক নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন

মো. ইমরান হোসাইন, কর্ণফুলী (চট্টগ্রাম)
আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২১: ২৯
সার কারখানায় হাত হারাল কিশোর, শিশুশ্রমিক নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানাধীন রাঙ্গাদিয়া ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের ১ নম্বর ব্যাগিং প্ল্যান্টে কাজ করছিল অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মো. ইফাত হোসেন (১৬)। এ সময় বেল্টে আটকা পড়া সারের বস্তা তুলতে গিয়ে কাটা পড়ে ইফাতের বাম হাত। ঘটনার পর স্থানীয় শ্রমিকেরা বিচ্ছিন্ন হাতসহ তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ইফাতকে ঢাকার পঙ্গু পাঠানো হয়। সেখানে তার অস্ত্রোপচার করা হলেও বিচ্ছিন্ন হাতটি জোড়া লাগানো যায়নি। 

জানা যায়, গত শনিবার বিকেলে কর্ণফুলী থানাধীন রাঙ্গাদিয়া ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের ১ নম্বর ব্যাগিং প্ল্যান্টে এ ঘটনা ঘটে।

ইফাত স্থানীয় মেরিন একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তার বাবা ইকবাল হোসেন দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে কয়েক মাস ধরে তাঁর সেই কাজ নেই। তাই পরিবারকে সহায়তা করতে এবং নিজের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে সার কারখানায় দৈনিক মজুরি কাজ নেয় ইফাত। ইচ্ছা ছিল কয়েক দিন কাজ করে স্কুলের বেতন পরিশোধ ও খাতাপত্র কিনে লেখাপড়া শুরু করবে। কিন্তু কারখানায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। 

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে গত ২১ জানুয়ারি থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এ সুযোগে পরিবারের অভাব ঘোচাতে ডিএপি সার কারখানার ব্যাগিং প্ল্যান্টে দৈনিক মজুরিতে কাজ নেয় ইফাত। কারখানায় শ্রমিক সরবরাহে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এয়ার মোহাম্মদ অ্যান্ড ব্রাদার্সের শ্রমিক মাঝি তাকে কাজ দেয়। 

সার কারখানার পাশেই রাঙ্গাদিয়া শাহাদতনগরে বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করে ইফাতের পরিবার। কথা বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন মা ইয়াসমিন বেগম। তিনি বলেন, ‘আর্থিক অনটনের মধ্যেও ইফাতের পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল। আমি বিচার চাই না, আমার ছেলে যেন বাঁচতে পারে আর আমাকে মা বলে ডাকতে পারে শুধু এটাই চাই।’

এদিকে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৮ বছরের নিচে শ্রমিক নিয়োগে বিধিনিষেধ থাকলেও এখানে মানা হয় না। ইফাতের মতো বেশ কিছু শিশু-কিশোর এ কারখানায় অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। শ্রমিক সরবরাহে নিয়োজিত ঠিকাদারেরা তাদের কম বেতনে এখানে নিয়োগ দেয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক বলেন, ‘১৮ বছরের নিচে কোনো শ্রমিকের কারখানায় প্রবেশের নিয়ম নেই। অথচ ঠিকাদারের লোকজন মজুরি খরচ বাঁচাতে অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাজে নিয়ে আসে। তাদের কৌশলে কারখানায় ঢোকানো হয়। এ ক্ষেত্রে ঠিকাদারের চেয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের গাফিলতি বেশি।’

শিশু-কিশোর শ্রমিক নিয়োগের বিষয়টি স্বীকার করেছেন কারখানার ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মো. আলমগীর জলিল। তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে কিছু কিছু অপ্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক কাজে দেখা যায়। ফটক দিয়ে ট্রাকে করে তারা কারখানার ভেতরে ঢুকে পড়ে। আর এ কাজটি ঠিকাদারের লোকজন করে। এটি ঠিকাদারের গাফিলতি। তবে এখন থেকে আমরা নজরদারি বাড়িয়ে দিয়েছি।’

মো. আলমগীর জলিল আরও বলেন, ‘আহত শ্রমিকের চিকিৎসার খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করছেন। কারখানা কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনার বিষয়টি আমলে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।’

কারখানার মহাব্যবস্থাপক (কারিগরি) মো. দেলোয়ার হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের এই কমিটির অপর দুজন হলেন— মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) ফজর আলী ও সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আজিম উদ্দিন।

এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা তদন্তের কাজ শুরু করেছি। আশা করছি, এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্তকাজ শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া যাবে।’

অপ্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক জোগান দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এয়ার মোহাম্মদ অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী এয়ার মোহাম্মদ বলেন, ‘আমার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ব্যবহার করা হলেও মূলত কাজ পায় স্থানীয় আইয়ুব আলী নামে এক ব্যক্তি। তিনিই সবকিছু দেখাশোনা করেন। তারপরও আহত শ্রমিকের চিকিৎসা খরচ চালিয়ে যাচ্ছি। সুস্থ হয়ে উঠলে উভয় পক্ষ বসে বিষয়টি সমাধান করব।’

এ ব্যাপারে জানতে আইয়ুব আলীর মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। 

কর্ণফুলী থানার ওসি দুলাল মাহমুদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ডিএপি সার কারখানায় দুর্ঘটনায় আহত স্কুলছাত্রের বিষয়টি জানতে পেরেছি। তবে এ ঘটনায় পরিবারের কেউ থানায় অভিযোগ করেননি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত