Ajker Patrika

বরগুনার সড়ক যোগাযোগ: ঝুঁকিপূর্ণ ৩৫৭ লোহার সেতু, উদ্বেগ

  • গত এক বছরে ১৮টি সেতু ধসে মারা গেছে ৯ জন।
  • ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে এসব সেতু নির্মিত হয়।
  • ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো এখন গলার কাঁটা: সনাক সভাপতি
বরগুনা প্রতিনিধি
বরগুনা সদর উপজেলার গৌরীচন্না খালের ওপর নির্মিত লোহার সেতুটির মাঝখানের স্লিপারের ঢালাই ধসে পড়েছে। এরপর বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে যানবাহন ও মানুষজন। ছবি: আজকের পত্রিকা
বরগুনা সদর উপজেলার গৌরীচন্না খালের ওপর নির্মিত লোহার সেতুটির মাঝখানের স্লিপারের ঢালাই ধসে পড়েছে। এরপর বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে যানবাহন ও মানুষজন। ছবি: আজকের পত্রিকা

‘নড়বড়ে পোল দিয়া যহন স্কুলে যাই আর আই, তহন খুব ডর লাগে। পোলে ওডলেই সব লইয়া কাঁপতে থাকে, আতঙ্কে পোল পার হই। মাঝেমধ্যে মায় আর বাবায় পার কইরা দিয়া যায়। যহন হেরা থাহে না, তহন মনে হয় এই বুঝি খালে পইড় যামু। অনেক দিন ডরে স্কুলেও যাই না।’ চোখে-মুখে আতঙ্ক নিয়ে কথাগুলো বলছিল বরগুনার বামনা উপজেলার হোগলপাতি গ্রামের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আসমা আক্তার। প্রতিদিন তাকে ঝুঁকিপূর্ণ একটি সেতু পার হয়ে পাশের পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার টিয়ারখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করতে হয়।

সরেজমিনে হোগলপাতি গ্রামে দেখা গেছে, গ্রামটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে হলতা নদী। নদীটি বামনা ও মঠবাড়িয়া উপজেলাকে বিভক্ত করেছে। একসময় প্রমত্তা হলতা এখন একটি সরু খাল। এর ওপর রয়েছে প্রায় ৩০ বছরের পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেতুটির লোহার বিম নেই বললেই চলে। ক্ষয়ে যাওয়া বিমের ওপর সেতুর স্ল্যাবগুলো ঠিক রাখার জন্য স্থানীয়রা খেজুরগাছ দিয়ে খুঁটি বানিয়ে কোনোরকমে চলাচলের উপযোগী করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে মেরামত ও সংস্কারের অভাবে বরগুনা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অন্তত ৩৫৭টি সেতু চলাচলের অনুপযোগী। এগুলোর মধ্যে ধসে পড়েছে ১৮টি। ভাঙা ও ঝুঁকিপূর্ণ এসব সেতু দিয়ে প্রতিদিন পার হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ ও যানবাহন। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) আওতায় হালকা যান চলাচল (কম খরচে) প্রকল্পের অধীনে এসব সেতু নির্মাণ করা হয়।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক বছরে ১৮টি সেতু ধসে প্রাণ হারিয়েছে ৯ জন। বিকল্প পথ না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে এসব সেতু পার হতে হচ্ছে। একের পর এক সেতু ধসে দুর্ঘটনা ঘটলেও টনক নড়ছে না কর্তৃপক্ষের।

এলজিইডির কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, আমতলীতে ৯৮, তালতলীতে ৩১, বরগুনা সদরে ৮১, বামনায় ৪৪, বেতাগীতে ৬৪ এবং পাথরঘাটায় ৩৯টি ঝুঁকিপূর্ণ সেতু। এগুলো নতুন করে নির্মাণে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া জরুরি ভিত্তিতে নির্মাণের জন্য ১৪২টি সেতু চিহ্নিত করা হয়েছে; যার সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫০ কোটি টাকা।

বরগুনা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মেহেদী হাসান জানান, ৩৫৭ সেতুর সব কটিই ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১৪২টি জরুরি ভিত্তিতে নির্মাণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। নতুন কোনো প্রকল্প না এলে এসব সেতু নির্মাণ বা মেরামত করা সম্ভব নয়।

কাঠ দিয়ে স্ল্যাব বানিয়ে যাতায়াত

সদর উপজেলার গৌরীচন্না বাজারের পশ্চিম পাশে খালে রয়েছে একটি আন্ত-উপজেলা সংযোগ লোহার সেতু। ওই সেতু দিয়ে বেতাগী উপজেলার সরিসামুড়ি ইউনিয়নের জনগণ জেলা সদরে যাতায়াত করে। এ ছাড়া গৌরিচন্নায় অবস্থিত একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শত শত শিক্ষার্থী ওই সেতু দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করে। কয়েক বছর আগে সেতুটির মাঝখান দিয়ে ভেঙে যাওয়ায় বর্তমানে কাঠ দিয়ে স্ল্যাব বানিয়ে যাতায়াত করছে স্থানীয়রা।

মাসুম বিল্লাহ নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘প্রায় ৬ বছর আগে সেতুটির মাঝখানের লোহার পিলার ভেঙে প্রায় ২০ ফুট জায়গায় সিমেন্টের ঢালাই ধসে পড়ে। স্থানীয়রা চলাচলের জন্য কাঠ দিয়ে স্লিপার তৈরি করে। সেটা দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলছে অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল। যেকোনো সময় সেতু ধসে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’

বরগুনা জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি মনির হোসেন কামাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বরগুনার ছয়টি উপজেলার ৩৫৭টি লোহার সেতু এখন গলার কাঁটা। এসব সেতু পারাপারের সময় ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা।’

নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বলেন, ‘নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে সেতু নির্মাণের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হলে বরগুনাবাসীর দীর্ঘদিনের কষ্ট ও দুর্ভোগ কেটে যাবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত