জাকির তালুকদার
কালজয়ী কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুবার্ষিকী ছিল ১৪ সেপ্টেম্বর। এ লেখায় তুলে ধরা হলো তাঁর উপন্যাস ‘কবি’ লেখার প্রেক্ষাপট এবং এর পাত্র-পাত্রী নিয়ে অনুসন্ধানী অবলোকন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় উপন্যাস ‘কবি’। খুব উন্নতমানের উপন্যাসও যে পাঠকপ্রিয় হতে পারে, তার উদাহরণ ‘কবি’।
‘কবি’ উপন্যাসের প্রায় সব পাত্র-পাত্রীর বাস্তব অস্তিত্বের কথা তারাশঙ্কর নিজেই উল্লেখ করে গেছেন। উপন্যাসের মতোই সুখপাঠ্য এবং মনোযোগের দাবিদার ‘আমার সাহিত্য-জীবন’ স্মৃতিগ্রন্থে এ সম্পর্কে মোটামুটি বিস্তারিত বিবরণই পাওয়া যায়। সেখানে তারাশঙ্কর জানাচ্ছেন যে ‘কবি’ উপন্যাসের নিতাই চরিত্রটি যার আদলে গড়া, সে তাঁদেরই গ্রামের সতীশ ডোম। পাগলাটে কবিযশঃপ্রার্থী যুবক। কালো আবলুশের মতো গায়ের রং, অল্পস্বল্প পড়তে পারে, পথেঘাটে কবিগান গেয়ে বেড়ায়। পাশের রেলস্টেশনে কুলিগিরি করে। আর লোকের সঙ্গে কথা বলে সাধুভাষায়। মোট বইবার জন্য বেশি মজুরি চাইলে যাত্রী প্রতিবাদ করে। তার উত্তরে সতীশ ডোম সাধুভাষায় নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে এই বলে, ‘প্রভু, একবার গগনের পানে অবলোকন করেন, দেনমণির তেজটা দেখেন! আপনি প্রভু, পাদুকাপদে ছত্রমস্তকে হাঁটবেন, আমাকে মোটমস্তকে শূন্য পদে গমন করতে হবে। দুঃখীর দুঃখটা চিন্তা করে দেখে বাক্য বলুন।’
মানুষকে শ্রোতা হিসেবে না পাওয়ায় জনশূন্য আমবাগানে ঘুরে ঘুরে আমগাছগুলোকে কবিগান শোনাচ্ছে সতীশ, এমন দৃশ্যও দেখেছেন তারাশঙ্কর।
কবি হওয়ার আকাঙ্ক্ষাতেই সতীশ নিজেদের পারিবারিক চৌর্যবৃত্তি থেকে দূরে থেকেছে। রেলস্টেশনে কুলিগিরি করেছে। পাঁচ-সাত মাইলের মধ্যে যেখানেই কবিগানের আসর বসত, সেখানেই মাথায় চাদর জড়িয়ে সতীশ উপস্থিত। আসরে সে বসত কবিয়ালের দোহারদের পাশে, তাদের সুরে সুর মিলিয়ে দোয়ারকি করত সুযোগ পেলেই। তারাশঙ্কর তাঁর এলাকার যেকোনো কবিগানেই সতীশের উপস্থিতি দেখতে পেয়েছেন। সে দোয়ারকি করছে এবং ফাঁক পেলেই মুখ বাড়িয়ে কানে হাত দিয়ে দু-এক কলি গানও গেয়ে ফেলছে। সতীশ জানত যে তারাশঙ্কর নিজেও লেখক। তাই তাঁর সঙ্গে সে কথা বলত বিনম্র শ্রদ্ধায়।
তারাশঙ্করকে দেখলেই হেঁট হয়ে প্রণাম জানিয়ে বলত, প্রণাম প্রভু!
তাদের পারস্পরিক কথোপকথনের কিছুটা মনোজ্ঞ বিবরণও উপস্থাপন করেছেন তারাশঙ্কর তাঁর ‘আমার সাহিত্য-জীবন’ গ্রন্থে। লেখককে বড় আকারে প্রণাম করা মানেই সতীশের মনে মনে ইচ্ছা লেখক তাকে জিজ্ঞেস করুন, ‘কোথা হতে আগমন, কহ কিবা বিবরণ, রসভাণ্ড উপচায় কেন?’
তারাশঙ্কর সচরাচর এমন ধরনের প্রশ্নই করতেন তাকে। না করলে সতীশ নিজেই আগ বাড়িয়ে বলত, ‘কই, কিছু শুধালেন না যে?’‘কী শুধোব?’
‘কোথা থেকে আসছি? কী ব্যাপার? এত খুশি ক্যানে?’
‘সে তো বুঝতে পারছি। মেলায় গিয়েছিলে। খুব কবিগান করেছ।’
তারপরেই সে শুরু করত বিস্তারিত বর্ণনা। পথ চলতে চলতেই এগোত বর্ণনা। কিন্তু সেই বর্ণনা শেষ হওয়ার আগেই তাঁরা পৌঁছে যেতেন স্টেশনের চায়ের দোকানে। দোকানদারের নাম কোনো দিন শোনা হয়নি তারাশঙ্করের। সবাই বলত বেনে-মামার চায়ের দোকান। সেখানে বসে থাকত বাতে প্রায় পঙ্গু দ্বিজপদ।
লেখকের বাল্যবন্ধু। সেই দ্বিজপদই ‘কবি’ উপন্যাসের বিপ্রপদ। সে সতীশকেও বলত ‘কপিবর’। মাঝে মাঝে ঘুঁটে ছেঁদা করে একফালি দড়ি পরিয়ে সতীশকে
উপহার দিত—নে, মেডেল।
উপন্যাসের রাজার নাম বাস্তবেও রাজা মিয়া। সে ছিল মুসলমান। তবে সে হিন্দি বলত না। ঠাকুরঝি রাজার শ্যালিকা নয়। সতীশের সঙ্গে বাস্তবে তার প্রেমও হয়নি। তবে ঠাকুরঝির বাস্তব অস্তিত্ব ছিল। সে ছিল গ্রামান্তরের রুইদাস সম্প্রদায়ের মেয়ে। দুধ বিক্রি করতে আসত। সতীশও তার কাছ থেকে দুধ কিনত প্রতিদিন এক পোয়া করে। মেয়েটি চলাফেরাতেও যেমন ছিল খুব দ্রুত, আবার কথাও বলত দ্রুতলয়ে হড়বড় করে। সে নিজে তার ঠাকুরঝিকে নিয়ে খুব ভয়ে ভয়ে থাকত। কথায় কথায় ঠাকুরঝির উল্লেখ করত। যেমন—ঠাকুরঝি বকবে জি!...ঠাকুরঝিকে না-শুধিয়ে লারব।... দাঁড়াও বাপু, ঠাকুরঝি আসুক।... ওই ঠাকুরঝি আসছে, লাও বাপু শিগগির দুধ লিয়ে লাও; ঠাকুরঝি বকবে। সেই মেয়ে বারবার ঠাকুরঝির উল্লেখ করত বলেই উপন্যাসে তার আসল নাম ঢেকে গিয়ে সে-ই পরিণত হয়েছে ঠাকুরঝিতে।
এই কয়েকটি চরিত্র নিয়েই প্রথমে ‘কবি’ গল্পটি লিখেছিলেন তারাশঙ্কর। পরে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসে রূপ দেওয়ার সময় যোগ হলো ঝুমুর নাচের দল। এরা পদাবলি জানে, খেউড় জানে। আবার আধুনিক খেমটা-টপ্পাও জানে। মল্লারপুরে ঝুমুরদলের একটা পাড়াই আছে। আজকাল হয়তো লুপ্ত হয়ে গেল বা গেছে। পণ্ডিত হরেকৃষ্ণ সাহিত্যরত্ন আবিষ্কার করেছেন, এককালে, মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পরবর্তীকালে পূর্ববঙ্গে তখন বৈষ্ণবধর্ম ও কীর্তনের সমাদর বেশি, সেইকালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহু কীর্তনিয়ার দল ছোট-বড়, ভালো-মন্দনির্বিশেষে ওই অঞ্চলে যেত এবং যথেষ্ট উপার্জন করে দেশে ফিরত। ওই ছোট-বড়দের মধ্যে ছোটরা শেষ প্রসার ও সমাদরের জন্য দলের মধ্যে গায়িকা গ্রহণ করে। ক্রমে গায়িকারাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। তার থেকে ক্রমে নাচ, তারপর আদি রসাশ্রিত গানের প্রচলন হয়। তারপর হিন্দু-মুসলমান সব সম্প্রদায়ের মনোরঞ্জনের জন্য ধর্ম বাদ দিয়ে নিছক নাচ-গানের দলের পরিণতিতে পৌঁছাল।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়দের গ্রামে ছোটদের ঝুমুর দেখা নিষিদ্ধ ছিল। পরে তারাশঙ্কর ঝুমুরনাচ দেখেছেন। ভদ্রজনের আসরে সেটি আসলে ছিল খেমটা নাচের অনুকরণ। আর যেসব আসরে ভদ্রজনেরা যান না, সেখানে এটি পুরোপুরি অশ্লীল দেহনাচানো উৎসব। আর ঝুমুরদলের আবরণের আড়ালে চলে দেহব্যবসা। ‘কবি’ উপন্যাসের বসন বা বসন্তকে এমন একটি ঝুমুরদলের সঙ্গেই দেখেছিলেন তারাশঙ্কর। দেখেছিলেন মাসিকেও। লেখক মোটামুটি বিস্তারিত জানিয়েছেন বাস্তবের বসনের কথাও।
‘আমাদের গ্রামে স্টেশনের ধারে কোনো মেলা-ফেরত একদল ঝুমুর এসে নামল। বড়ো বটতলায় ঘর পাতলে। তাদেরই একটি মেয়ের হল কলেরা। এই মেয়েটির নামই বসন। এককালে সুশ্রী ছিল, শীর্ণকায়া, দীর্ঘাঙ্গী, গৌরবর্ণ রং, বড়ো বড়ো উগ্রদৃষ্টি দুটি চোখ, মাথায় অপর্যাপ্ত চুল। দেহটা দেখে মনে হয়, কোনো রক্তপায়ী সরীসৃপ নিঃশেষে ওর দেহের শুধু রক্তই নয়—সারাংশও টেনে নিয়েছে। আমি তখন কলেরা-ম্যালেরিয়ায় সেবা করে বেড়াই, আগুন লাগলে বালতি নিয়ে ছুটি, দুর্ভিক্ষে চাল-কাপড় সংগ্রহ করে বিলিয়ে বেড়াই। কলেরার ওষুধ আমার কাছে আছে। ক্যালোমেল ১/৬ গ্রেন আর সোডিবাইকার্ব পাউডার।
কেয়োলিন আছে। রেক্টাল স্যালাইনের গ্লাস ও রবার টিউব রাখি। দিতেও পারি। কিছু প্রতিষেধক রাখি। যাদের হয়নি, ইনজেকশন দিই। কোথাও কারও কলেরা হলে খবর আগেই আসে আমার কাছে। কাজেই খবরটি এল। গেলাম। দলটির মুখ শুকিয়ে গেছে। সকলে অদূরে বসে আছে, মেয়েটি ছটফট করছে—জল আর জল শব্দ। কাছেই অদূরে বসে আছে মাসি। আর-একটা পুরুষ, যে বসনের ভালোবাসার জন। মদও রয়েছে দেখলাম।
যথাসাধ্য করে এলাম।
এটা সকালবেলার কথা। ওই সময়েই বসনের অস্থিরতা দেখে মাসি বলেছিল, ভগবানকে ডাক্ বউ, ভগবানকে ডাক।
সে বলেছিল, না।
এই সময়টুকুর মধ্যেই এ-কথা, সে-কথার মধ্যে ওই কথাটিও শুনেছিলাম—বসন মলে তার ওয়ারিশ হবে ওই মাসি। বলেছিল, আমার নেকন দেখো না।
বিকেলবেলা ওদের দলের ওই বসনের ভালোবাসার মানুষটি এসে খবর দিলে, একটুকুন ভালো আছে। একবার যদি আসেন।
এ-দিকে, অর্থাৎ রোগী ভালো থাকার সংবাদ এলে উৎসাহ এবং আকর্ষণ দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। উৎসাহিত হয়েই গেলাম। তখন দেখলাম, ওরা একটু আশ্রয়স্থল পেয়েছে। স্টেশনের পাশেই সে-সময় আমাদের শম্ভুকাকার এক আশ্রম ছিল। শম্ভুকাকা কানে খাটো, সে-আমলের তান্ত্রিক লোক, কারণ করেন, গাঁজা খান, পৃথিবীর কোনো কিছুকে ভয় করেন না, যত ক্রোধ, তত কোমলতা। তিনিই ওদের অবস্থা দেখে ডেকে ওই ঘরে ঠাঁই দিয়েছেন—থাক এইখানে।
গিয়ে দেখলাম, মেয়েটি ঘুমুচ্ছে।
যেতেই মাসি তাকে ডাকলে, বসন।
আমি বারণ করবার আগেই সে ডেকেছিল, মেয়েটি
ক্লান্ত চোখ মেলে চাইলে। প্রাণের আবেগে হাত বাড়িয়ে আমার পা খুঁজলে।
আমি বললাম, থাক।
তার ঠোঁট দুটি কাঁপল। বললে, আপনি না থাকলে মরে যেতাম বাবু, এরা হয়তো জ্যান্তেই ফেলে পালাত, আমাকে শেয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খেয়ে দিত।’
সংক্ষেপে এই-ই হলো ‘কবি’ উপন্যাসের পাত্র-পাত্রী এবং তাদের বাস্তব জীবনের কিছু খণ্ডচিত্র। বাকিটুকু তারাশঙ্করের অপরিমেয় প্রতিভার সৃষ্টি। মূলত তারাশঙ্কর বাস্তবের পাত্র-পাত্রী নিয়েই লিখেছিলেন তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘কবি’।
কালজয়ী কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুবার্ষিকী ছিল ১৪ সেপ্টেম্বর। এ লেখায় তুলে ধরা হলো তাঁর উপন্যাস ‘কবি’ লেখার প্রেক্ষাপট এবং এর পাত্র-পাত্রী নিয়ে অনুসন্ধানী অবলোকন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় উপন্যাস ‘কবি’। খুব উন্নতমানের উপন্যাসও যে পাঠকপ্রিয় হতে পারে, তার উদাহরণ ‘কবি’।
‘কবি’ উপন্যাসের প্রায় সব পাত্র-পাত্রীর বাস্তব অস্তিত্বের কথা তারাশঙ্কর নিজেই উল্লেখ করে গেছেন। উপন্যাসের মতোই সুখপাঠ্য এবং মনোযোগের দাবিদার ‘আমার সাহিত্য-জীবন’ স্মৃতিগ্রন্থে এ সম্পর্কে মোটামুটি বিস্তারিত বিবরণই পাওয়া যায়। সেখানে তারাশঙ্কর জানাচ্ছেন যে ‘কবি’ উপন্যাসের নিতাই চরিত্রটি যার আদলে গড়া, সে তাঁদেরই গ্রামের সতীশ ডোম। পাগলাটে কবিযশঃপ্রার্থী যুবক। কালো আবলুশের মতো গায়ের রং, অল্পস্বল্প পড়তে পারে, পথেঘাটে কবিগান গেয়ে বেড়ায়। পাশের রেলস্টেশনে কুলিগিরি করে। আর লোকের সঙ্গে কথা বলে সাধুভাষায়। মোট বইবার জন্য বেশি মজুরি চাইলে যাত্রী প্রতিবাদ করে। তার উত্তরে সতীশ ডোম সাধুভাষায় নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে এই বলে, ‘প্রভু, একবার গগনের পানে অবলোকন করেন, দেনমণির তেজটা দেখেন! আপনি প্রভু, পাদুকাপদে ছত্রমস্তকে হাঁটবেন, আমাকে মোটমস্তকে শূন্য পদে গমন করতে হবে। দুঃখীর দুঃখটা চিন্তা করে দেখে বাক্য বলুন।’
মানুষকে শ্রোতা হিসেবে না পাওয়ায় জনশূন্য আমবাগানে ঘুরে ঘুরে আমগাছগুলোকে কবিগান শোনাচ্ছে সতীশ, এমন দৃশ্যও দেখেছেন তারাশঙ্কর।
কবি হওয়ার আকাঙ্ক্ষাতেই সতীশ নিজেদের পারিবারিক চৌর্যবৃত্তি থেকে দূরে থেকেছে। রেলস্টেশনে কুলিগিরি করেছে। পাঁচ-সাত মাইলের মধ্যে যেখানেই কবিগানের আসর বসত, সেখানেই মাথায় চাদর জড়িয়ে সতীশ উপস্থিত। আসরে সে বসত কবিয়ালের দোহারদের পাশে, তাদের সুরে সুর মিলিয়ে দোয়ারকি করত সুযোগ পেলেই। তারাশঙ্কর তাঁর এলাকার যেকোনো কবিগানেই সতীশের উপস্থিতি দেখতে পেয়েছেন। সে দোয়ারকি করছে এবং ফাঁক পেলেই মুখ বাড়িয়ে কানে হাত দিয়ে দু-এক কলি গানও গেয়ে ফেলছে। সতীশ জানত যে তারাশঙ্কর নিজেও লেখক। তাই তাঁর সঙ্গে সে কথা বলত বিনম্র শ্রদ্ধায়।
তারাশঙ্করকে দেখলেই হেঁট হয়ে প্রণাম জানিয়ে বলত, প্রণাম প্রভু!
তাদের পারস্পরিক কথোপকথনের কিছুটা মনোজ্ঞ বিবরণও উপস্থাপন করেছেন তারাশঙ্কর তাঁর ‘আমার সাহিত্য-জীবন’ গ্রন্থে। লেখককে বড় আকারে প্রণাম করা মানেই সতীশের মনে মনে ইচ্ছা লেখক তাকে জিজ্ঞেস করুন, ‘কোথা হতে আগমন, কহ কিবা বিবরণ, রসভাণ্ড উপচায় কেন?’
তারাশঙ্কর সচরাচর এমন ধরনের প্রশ্নই করতেন তাকে। না করলে সতীশ নিজেই আগ বাড়িয়ে বলত, ‘কই, কিছু শুধালেন না যে?’‘কী শুধোব?’
‘কোথা থেকে আসছি? কী ব্যাপার? এত খুশি ক্যানে?’
‘সে তো বুঝতে পারছি। মেলায় গিয়েছিলে। খুব কবিগান করেছ।’
তারপরেই সে শুরু করত বিস্তারিত বর্ণনা। পথ চলতে চলতেই এগোত বর্ণনা। কিন্তু সেই বর্ণনা শেষ হওয়ার আগেই তাঁরা পৌঁছে যেতেন স্টেশনের চায়ের দোকানে। দোকানদারের নাম কোনো দিন শোনা হয়নি তারাশঙ্করের। সবাই বলত বেনে-মামার চায়ের দোকান। সেখানে বসে থাকত বাতে প্রায় পঙ্গু দ্বিজপদ।
লেখকের বাল্যবন্ধু। সেই দ্বিজপদই ‘কবি’ উপন্যাসের বিপ্রপদ। সে সতীশকেও বলত ‘কপিবর’। মাঝে মাঝে ঘুঁটে ছেঁদা করে একফালি দড়ি পরিয়ে সতীশকে
উপহার দিত—নে, মেডেল।
উপন্যাসের রাজার নাম বাস্তবেও রাজা মিয়া। সে ছিল মুসলমান। তবে সে হিন্দি বলত না। ঠাকুরঝি রাজার শ্যালিকা নয়। সতীশের সঙ্গে বাস্তবে তার প্রেমও হয়নি। তবে ঠাকুরঝির বাস্তব অস্তিত্ব ছিল। সে ছিল গ্রামান্তরের রুইদাস সম্প্রদায়ের মেয়ে। দুধ বিক্রি করতে আসত। সতীশও তার কাছ থেকে দুধ কিনত প্রতিদিন এক পোয়া করে। মেয়েটি চলাফেরাতেও যেমন ছিল খুব দ্রুত, আবার কথাও বলত দ্রুতলয়ে হড়বড় করে। সে নিজে তার ঠাকুরঝিকে নিয়ে খুব ভয়ে ভয়ে থাকত। কথায় কথায় ঠাকুরঝির উল্লেখ করত। যেমন—ঠাকুরঝি বকবে জি!...ঠাকুরঝিকে না-শুধিয়ে লারব।... দাঁড়াও বাপু, ঠাকুরঝি আসুক।... ওই ঠাকুরঝি আসছে, লাও বাপু শিগগির দুধ লিয়ে লাও; ঠাকুরঝি বকবে। সেই মেয়ে বারবার ঠাকুরঝির উল্লেখ করত বলেই উপন্যাসে তার আসল নাম ঢেকে গিয়ে সে-ই পরিণত হয়েছে ঠাকুরঝিতে।
এই কয়েকটি চরিত্র নিয়েই প্রথমে ‘কবি’ গল্পটি লিখেছিলেন তারাশঙ্কর। পরে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসে রূপ দেওয়ার সময় যোগ হলো ঝুমুর নাচের দল। এরা পদাবলি জানে, খেউড় জানে। আবার আধুনিক খেমটা-টপ্পাও জানে। মল্লারপুরে ঝুমুরদলের একটা পাড়াই আছে। আজকাল হয়তো লুপ্ত হয়ে গেল বা গেছে। পণ্ডিত হরেকৃষ্ণ সাহিত্যরত্ন আবিষ্কার করেছেন, এককালে, মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পরবর্তীকালে পূর্ববঙ্গে তখন বৈষ্ণবধর্ম ও কীর্তনের সমাদর বেশি, সেইকালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহু কীর্তনিয়ার দল ছোট-বড়, ভালো-মন্দনির্বিশেষে ওই অঞ্চলে যেত এবং যথেষ্ট উপার্জন করে দেশে ফিরত। ওই ছোট-বড়দের মধ্যে ছোটরা শেষ প্রসার ও সমাদরের জন্য দলের মধ্যে গায়িকা গ্রহণ করে। ক্রমে গায়িকারাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। তার থেকে ক্রমে নাচ, তারপর আদি রসাশ্রিত গানের প্রচলন হয়। তারপর হিন্দু-মুসলমান সব সম্প্রদায়ের মনোরঞ্জনের জন্য ধর্ম বাদ দিয়ে নিছক নাচ-গানের দলের পরিণতিতে পৌঁছাল।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়দের গ্রামে ছোটদের ঝুমুর দেখা নিষিদ্ধ ছিল। পরে তারাশঙ্কর ঝুমুরনাচ দেখেছেন। ভদ্রজনের আসরে সেটি আসলে ছিল খেমটা নাচের অনুকরণ। আর যেসব আসরে ভদ্রজনেরা যান না, সেখানে এটি পুরোপুরি অশ্লীল দেহনাচানো উৎসব। আর ঝুমুরদলের আবরণের আড়ালে চলে দেহব্যবসা। ‘কবি’ উপন্যাসের বসন বা বসন্তকে এমন একটি ঝুমুরদলের সঙ্গেই দেখেছিলেন তারাশঙ্কর। দেখেছিলেন মাসিকেও। লেখক মোটামুটি বিস্তারিত জানিয়েছেন বাস্তবের বসনের কথাও।
‘আমাদের গ্রামে স্টেশনের ধারে কোনো মেলা-ফেরত একদল ঝুমুর এসে নামল। বড়ো বটতলায় ঘর পাতলে। তাদেরই একটি মেয়ের হল কলেরা। এই মেয়েটির নামই বসন। এককালে সুশ্রী ছিল, শীর্ণকায়া, দীর্ঘাঙ্গী, গৌরবর্ণ রং, বড়ো বড়ো উগ্রদৃষ্টি দুটি চোখ, মাথায় অপর্যাপ্ত চুল। দেহটা দেখে মনে হয়, কোনো রক্তপায়ী সরীসৃপ নিঃশেষে ওর দেহের শুধু রক্তই নয়—সারাংশও টেনে নিয়েছে। আমি তখন কলেরা-ম্যালেরিয়ায় সেবা করে বেড়াই, আগুন লাগলে বালতি নিয়ে ছুটি, দুর্ভিক্ষে চাল-কাপড় সংগ্রহ করে বিলিয়ে বেড়াই। কলেরার ওষুধ আমার কাছে আছে। ক্যালোমেল ১/৬ গ্রেন আর সোডিবাইকার্ব পাউডার।
কেয়োলিন আছে। রেক্টাল স্যালাইনের গ্লাস ও রবার টিউব রাখি। দিতেও পারি। কিছু প্রতিষেধক রাখি। যাদের হয়নি, ইনজেকশন দিই। কোথাও কারও কলেরা হলে খবর আগেই আসে আমার কাছে। কাজেই খবরটি এল। গেলাম। দলটির মুখ শুকিয়ে গেছে। সকলে অদূরে বসে আছে, মেয়েটি ছটফট করছে—জল আর জল শব্দ। কাছেই অদূরে বসে আছে মাসি। আর-একটা পুরুষ, যে বসনের ভালোবাসার জন। মদও রয়েছে দেখলাম।
যথাসাধ্য করে এলাম।
এটা সকালবেলার কথা। ওই সময়েই বসনের অস্থিরতা দেখে মাসি বলেছিল, ভগবানকে ডাক্ বউ, ভগবানকে ডাক।
সে বলেছিল, না।
এই সময়টুকুর মধ্যেই এ-কথা, সে-কথার মধ্যে ওই কথাটিও শুনেছিলাম—বসন মলে তার ওয়ারিশ হবে ওই মাসি। বলেছিল, আমার নেকন দেখো না।
বিকেলবেলা ওদের দলের ওই বসনের ভালোবাসার মানুষটি এসে খবর দিলে, একটুকুন ভালো আছে। একবার যদি আসেন।
এ-দিকে, অর্থাৎ রোগী ভালো থাকার সংবাদ এলে উৎসাহ এবং আকর্ষণ দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। উৎসাহিত হয়েই গেলাম। তখন দেখলাম, ওরা একটু আশ্রয়স্থল পেয়েছে। স্টেশনের পাশেই সে-সময় আমাদের শম্ভুকাকার এক আশ্রম ছিল। শম্ভুকাকা কানে খাটো, সে-আমলের তান্ত্রিক লোক, কারণ করেন, গাঁজা খান, পৃথিবীর কোনো কিছুকে ভয় করেন না, যত ক্রোধ, তত কোমলতা। তিনিই ওদের অবস্থা দেখে ডেকে ওই ঘরে ঠাঁই দিয়েছেন—থাক এইখানে।
গিয়ে দেখলাম, মেয়েটি ঘুমুচ্ছে।
যেতেই মাসি তাকে ডাকলে, বসন।
আমি বারণ করবার আগেই সে ডেকেছিল, মেয়েটি
ক্লান্ত চোখ মেলে চাইলে। প্রাণের আবেগে হাত বাড়িয়ে আমার পা খুঁজলে।
আমি বললাম, থাক।
তার ঠোঁট দুটি কাঁপল। বললে, আপনি না থাকলে মরে যেতাম বাবু, এরা হয়তো জ্যান্তেই ফেলে পালাত, আমাকে শেয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খেয়ে দিত।’
সংক্ষেপে এই-ই হলো ‘কবি’ উপন্যাসের পাত্র-পাত্রী এবং তাদের বাস্তব জীবনের কিছু খণ্ডচিত্র। বাকিটুকু তারাশঙ্করের অপরিমেয় প্রতিভার সৃষ্টি। মূলত তারাশঙ্কর বাস্তবের পাত্র-পাত্রী নিয়েই লিখেছিলেন তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘কবি’।
গতবছরের আন্দোলন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বের প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে। প্রবাসীরা নানা জায়গা থেকে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন, কেউ সরাসরি আন্দোলনে যোগ দিতে দেশে এসেছিলেন, কেউ বা বিদেশ থেকেই আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহায়তা দিয়ে আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিলেন। প্রবাসীদের এমন ভূমিকা
১ দিন আগেচোখ মেলে দেখি সাদা পরী আকাশি রঙের খাম হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে বিস্তীর্ণ জলরাশি। সমুদ্র পাড়ের বেঞ্চে শরীর এলিয়ে শুয়ে আছি। হাতে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর “সাঁতারু ও জলকন্যা”। সমুদ্রের ঢেউ এর আছড়ে পড়ার শব্দ আর ঝিরি ঝিরি বাতাসে খুব বেশিক্ষণ বইটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারিনি।
৯ দিন আগেবাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কবি মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদের স্মৃতিকে সম্মান জানাতে গুলশানে নির্মিত ‘কবি আল মাহমুদ পাঠাগার’ উদ্বোধন করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। আজ মঙ্গলবার বিকেলে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ পার্কে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পাঠাগারটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।
১৫ দিন আগেকাচের আচ্ছাদনের ভেতর অনেক পুরোনো একটা ডায়েরি। তার একটি পাতা মেলে ধরা। পাতাটিতে লেখা রয়েছে এস এম সুলতানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, নাম-ঠিকানা। সে পাতারই নিচের দিকে লেখা—‘আপনি কেন ছবি আঁকেন? বিশ্ব প্রকৃতিকে ভালোবাসি বলে’। নিচে শিল্পীর নাম লেখা।
১৮ দিন আগে