Ajker Patrika

বঙ্গবন্ধু পরিবারের অজানা অধ্যায়

নওশাদ জামিল
বঙ্গবন্ধু পরিবারের অজানা অধ্যায়

শতাব্দীর পর শতাব্দী পরাধীন ছিল বাঙালি জাতি, গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতি অর্জন করেছে রক্তভেজা লাল-সবুজের পতাকা, প্রতিষ্ঠা করেছে নিজস্ব ভূখণ্ড ও মানচিত্র। এ অর্জনের প্রধান কান্ডারি, স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় একসূত্রেই গাঁথা। বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির বিজয়কে কখনো বিচ্ছিন্ন করে ভাবা উচিত নয়। ফলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জানা ও গবেষণা অত্যন্ত জরুরি। এ তাগিদ থেকে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যকে নিয়ে সম্প্রতি তিনটি উপন্যাস লিখেছেন কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম অনুপ্রেরণাদাতা বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে নিয়ে তিনি লিখেছেন অনন্য আবেগদীপ্ত উপন্যাস ‘আমার রেণু’। এটিই ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস। লিখেছেন শেখ রাসেলকে নিয়ে ভিন্নধারার উপন্যাস ‘রাসেল তার আব্বুর হাত ধরে হেঁটে যায়’। লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘হে সন্তপ্ত সময়’। সম্প্রতি তিনটি বই প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের প্রধানতম প্রকাশনা সংস্থা আগামী প্রকাশনী। বইগুলোয় যেমন বঙ্গবন্ধুর কথা ঘুরেফিরে উঠে এসেছে, তেমনই উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের অজানা অধ্যায়।

বাঙালির ইতিহাস বড় বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ, তার ঘোরলাগা ইতিহাসের ভেতর এত বেশি রোমাঞ্চকর ঘটনার ঘনঘটা, সেই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় নিয়ে হাজার হাজার উপন্যাস লেখা সম্ভব। বাঙালির ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে নিয়ে কটি উপন্যাস লেখা হয়েছে? বাস্তবতায় দেখা যায়, বাঙালির গৌরবগাথা নিয়ে শিল্প-সাহিত্য, চলচ্চিত্রে যত বহুমাত্রিক কাজ হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। যুদ্ধ, ইতিহাস নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকাসহ সারা বিশ্বেই বহুমাত্রিক কাজ হয়েছে, হচ্ছে এখনো। ইউরোপে ‘ওয়ার লিটারেচার’ হিসেবে একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারা রয়েছে। আমাদের শিল্প-সাহিত্য, চলচ্চিত্র ‘ওয়ার লিটারেচার’ তত গুরুত্বপূর্ণ হয়নি এখনো। সেটা হলে জাতি যেমন অনুপ্রেরণা পাবে, তেমনই পাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য সাহস।

ইতিহাস নিয়ে খুব বেশি উপন্যাস লেখা হয়নি, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই যে ইতিহাসের আশ্রয়ে উপন্যাস রচনা সহজ নয়। ইতিহাসের তথ্য ও ঘটনাপঞ্জি ক্রমানুসারে সাজালেই ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস হয়ে যাবে, তা তো নয়। কেননা ঐতিহাসিকের কাজ আর ঔপন্যাসিকের কাজ এক নয়—দুজনের কাজ পুরোপুরি ভিন্নধর্মী। ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত সত্য ও নির্মোহভাবে উপস্থাপন করেন; ঔপন্যাসিক কল্পনাবোধের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের নানা অলিগলিতে টর্চ ফেলে—শুধু ওপর থেকে নয়, এক পাশ থেকেও নয়, চারদিক থেকে আলো ফেলে চাপা ত্রস্ত্র অন্ধকারের মধ্যে খোঁজেন নতুন আলো, নতুন দীপ্তি। আনোয়ারা সৈয়দ হক সেই দীপ্তির সন্ধানে নিজেকে বর্তমান থেকে সরিয়ে উপস্থিত হয়েছেন ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে, কল্পনার আশ্রয়ে অবলোকন করেছেন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বাপর নানামাত্রিক ঘটনাপ্রবাহ। ইতিহাসকে পাশে রেখে, কল্পনার সঙ্গে সেতুবন্ধ নির্মাণ করে হাজির করেছেন ইতিহাসের নায়ক-নায়িকাদের, খলনায়কদেরও। শুধু নায়ক-নায়িকা নন, ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষজন কী ভাবেন, তাঁদের স্বপ্ন, ইচ্ছা, সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন, দৃশ্যপুঞ্জ ও ঘটনাকে সংবেদনশীল দৃষ্টিতে উপস্থাপন করেছেন তিনি।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ পড়তে পড়তে উপলব্ধি করেছিলাম যে বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—তাঁরা ইতিহাসের নিছক চরিত্র নয়, উপন্যাসেরও মহৎ চরিত্র। ‘আমার রেণু’ পড়তে পড়তে একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয় যে তিনি ইতিহাসের অন্যতম নেপথ্য নায়িকা। তাঁকে জানার মধ্য দিয়ে আমার অসাধারণ দৃঢ়চেতা এক বাঙালি নারীর কথা যেমন জানতে পারি, তেমনই জানতে পারি বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকেও।

আনোয়ারা সৈয়দ হক অত্যন্ত পরিশ্রমী লেখক; ইতিহাসের চরিত্রকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে গিয়ে তাঁকে দিনের পর দিন প্রচুর বইপুস্তক পড়তে হয়েছে, বিশদ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়েছে, সব মিলিয়ে তাঁকে ইতিহাসের পাতায় মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে হয়েছে বছরের পর বছর। ইতিহাসের প্রতিপক্ষ হিসেবে নয়, পরিপূরক হিসেবে তিনি উপন্যাস রচনা করেছেন, তার জন্য তাঁকে সর্বদা সজাগ থাকতে হয়েছে—কোনো তথ্য ভুল যেন না হয়ে যায়! কেননা ইতিহাস বিকৃতির কোনো অধিকার ঔপন্যাসিকের নেই, ঐতিহাসিকেরও নেই।

আনোয়ারা সৈয়দ হক উপন্যাস লিখতে গিয়ে তথ্যের বিকৃতি করেননি, আবার ডকু-ফিকশনও লেখেননি, লিখেছেন উপন্যাসই। ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে গিয়ে কেউ কেউ শুধু ডকুমেন্টই লেখেন, ফিকশনটা আর লিখতে পারেন না। আনোয়ারা সৈয়দ হক ডকুমেন্টকে নির্ভর করে ফিকশনই লিখেছেন—তাঁর লেখায় ডকু যতটুকু, ফিকশন তার চেয়ে বেশি। ইতিহাস তো উপন্যাস নয়, আবার উপন্যাস ইতিহাসও নয়। দুটি আলাদা। তবে এটাও সত্য যে ইতিহাস উপন্যাসের একটা উপাদানমাত্র। সেটা শক্তিশালী উপাদানই, কিন্তু আখ্যান এড়িয়ে ইতিহাসের সরণি ধরে হাঁটলে উপন্যাস পাওয়া যায় না; ইতিহাসকে পাশে রেখে আখ্যানের আলপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছানো যায় উপন্যাসের জমিনে। তিনি উপন্যাসের উর্বর জমিনেরই সন্ধান পেয়েছেন, ফলিয়েছেন রত্নভান্ডার।

আনোয়ারা সৈয়দ হক তাঁর ‘আমার রেণু’ উপন্যাসটি অত্যন্ত দরদ দিয়ে লিখেছেন, তুলে এনেছেন ইতিহাসের ভিন্নধর্মী অধ্যায়। এটি যেন আমাদেরই গৌরবের ইতিহাস।

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছাকে অবলম্বন করে আখ্যানের ডালপালা বিস্তার হয়েছে, তাতে এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও। উপন্যাস লিখতে গিয়ে তিনি ইতিহাসের যেমন আশ্রয় নিয়েছেন, তেমনই ঔপন্যাসিকের প্রধান শক্তি কল্পনাও বাধাগ্রস্ত করেননি। বাস্তবতা ও কল্পনার আকাশে রেণু হয়ে উঠেছে ইতিহাসের অনন্য এক চরিত্র। অনুরূপভাবে তিনি বেশ খেটেখুটে লিখেছেন ‘হে সন্তপ্ত সময়’। উপন্যাসের মূলে রয়েছেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। উপন্যাসের পটভূমি ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সময়কাল। এই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকারা অনেকেই জীবিত, অনেকেই মৃত, ফলে লেখককে অনেক ভেবেচিন্তে সময়কে উপস্থাপন করতে হয়েছে।

লেখক তাঁর নিজস্ব বয়ানে বিভিন্ন বই ও পত্রিকার সাহায্যে উপন্যাসটি রচনা করেছেন। তুলে ধরেছেন পিতা-মাতা এবং প্রায় সর্বস্ব হারানো দুই বোনের সংগ্রামী জীবনের আলেখ্য। এ ছাড়া শেখ রাসেলকে নিয়ে লেখাটা শুধু শিশু-কিশোরেরা নয়, বড়দেরও নানা অজানা তথ্যের সন্ধান দেবে, পাশাপাশি দেবে উপন্যাস পাঠের অনন্য স্বাদ ও উপলব্ধি।

মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে ইতিহাসভিত্তিক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস, নাটক, কবিতা রচিত হয়েছে, নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু চলচ্চিত্রও; কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। বাস্তবতা যখন হতাশাময়, তখন ইতিহাসে সাহিত্যের দায় মোচনে এগিয়ে এসেছেন কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, রচনা করেছেন ইতিহাসভিত্তিক তিনটি উপন্যাস। নির্দ্বিধায় বলা যায়, তাতে ইতিহাসের কিছুটা দায় মোচন হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

গবেষণায় বেরিয়ে এল আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’র গল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’

গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।

ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’

মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’

মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।

রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।

মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’

১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। ছবি: সংগৃহীত

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।

মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।

নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।

বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল যেন তাঁর দীর্ঘ কোনো বাক্যের সমাপ্তি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ছবি: সংগৃহীত
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ছবি: সংগৃহীত

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।

সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।

১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।

তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।

ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।

তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।

২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।

চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।

তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের কলম

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ০০: ১০
সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের কলম

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।

লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।

লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।

১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।

লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।

‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।

এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত