আহমাদ মোস্তফা কামাল

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কীভাবে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের কাছে এক অনিবার্য প্রসঙ্গ হয়ে উঠলেন সেটি ভাবলে খানিকটা বিস্ময়ই জাগে। না, জনপ্রিয় লেখক তিনি নন, নন সব পাঠকের লেখকও, জনচিত্ত জয় করার মতো লেখা তিনি লেখেননি কোনো দিন। ফলে দেশের সব পাঠক তাঁর নাম জানবে, এ রকম আশা করার কোনো কারণ নেই। নেই বটে, তবু এক বিরাট অংশ তাঁর নাম জানে ভিন্ন একটি কারণে। কোনো এক সময় নাম-না-জানা কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসটিকে কলেজ-পাঠ্য হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। আবশ্যিকভাবে পড়তে হতো বলে লেখকের নামটিও সেই সময়কার কলেজ-শিক্ষার্থীদের জানা হয়ে যেত। পাঠ্য বইয়ের পাঠকেরা পরবর্তীকালে তাদের পাঠতৃষ্ণা ধরে রাখেন এমন কোনো নমুনা অন্তত বাংলাদেশে দেখা যায়নি। ফলে তারা সবাই যে সৈয়দের অন্য লেখাগুলোও খুঁজে পড়েছেন সেটি ভাবার কোনো অবকাশও নেই। আর এখন তো তিনি পাঠ্যতালিকায়ও নেই, সাহিত্যবিমুখ এই জাতি তাঁর নাম জানবেই-বা কীভাবে?
জনগণ না জানুক, যারা লেখালেখি করতে চান, বিশেষ করে কথাসাহিত্য নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের পাঠ-তালিকায় প্রথমদিকের নাম হিসেবে সৈয়দের নাম থাকেই। এটা গত কয়েক দশক ধরে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কীভাবে ঘটল এই ঘটনাটি? কীভাবে আবিষ্কৃত হলেন তিনি? কীভাবে চিহ্নিত হলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান লেখক হিসেবে? বিষয়টি রহস্যময় লাগে এই জন্য যে, সৈয়দ ছিলেন এমন এক লেখক—দেশের সাহিত্যসমাজের সঙ্গে যাঁর কোনো যোগাযোগই ছিল না। শক্তিমান লেখক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সঙ্গে এই যোগাযোগের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়, সাহিত্যের থাকে এমন এক স্বয়ম্ভূ শক্তি যে, যোগাযোগ-ধরাধরি-দলাদলি ছাড়াই তা নিজ গুণে ও যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়; কিন্তু সত্য হচ্ছে এই যে, তেমন গুণটুন না থাকলেও সাহিত্যসমাজে অনেকে প্রতিষ্ঠা পান স্রেফ যোগাযোগের ফলে। সৈয়দের সেটি মোটেই ছিল না। আর থাকবেই বা কীভাবে? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরির সুবাদে তাঁর লেখক-জীবনের প্রায় সবটুকুই কেটেছে বিদেশ-বিভুঁইয়ে। পূর্ব বাঙলায় যখন কেবলমাত্র সাহিত্য সমাজ গড়ে উঠতে শুরু করেছে তখন তিনি বিদেশে কর্মরত। মারাও গেলেন বিদেশেই, ১৯৭১ সালে, মাত্র ঊন পঞ্চাশ বছর বয়সে—তিনটে উপন্যাস, দুটো গল্পগ্রন্থ, দুটো নাটক আর বেশ কিছু অগ্রন্থিত রচনা রেখে। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের যে নতুন প্রজন্ম লেখালেখি করতে এলেন তাদের সঙ্গে সৈয়দের দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ তো রইলই না, বরং, তাঁর ওই স্বল্পসংখ্যক রচনা স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলো। নতুন দেশ, অপরিমেয় রক্ত, অশ্রু আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা, নানারকম অস্থিরতা, হতাশা, স্বপ্নভঙ্গ—এই সবকিছুর মধ্যে সাহিত্যের মতো সুকুমারবৃত্তির দিকে কতটুকুই-বা নজর থাকে মানুষের? তাও একজন দূরবর্তী লেখক, যাকে চাক্ষুষ দেখা যায়নি খুব একটা, ১৯৫৪ সালের পর দেশে এসেছিলেন মাত্র দু-বার, এমনকি এখন পর্যন্ত যাঁর ব্যক্তি-জীবন সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না প্রায়, তাঁর বইগুলো আর প্রকাশিত হলো কি না, সেই খবরই-বা কে রাখে? যুগে যুগে কত লেখকই তো এভাবে হারিয়ে গেছেন, এ তো নতুন কিছু নয়। কিন্তু সৈয়দ হারালেন না, বরং, রইলেন তরুণদের আগ্রহের কেন্দ্রে। রইলেন তাঁর রচিত সাহিত্য নিয়ে কৌতূহলের কারণে; ব্যক্তি নয়, সাহিত্য-বিচারই যেখানে প্রধান হয়ে উঠল। এদিক থেকে সৈয়দ খুবই ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক, যাঁর সাহিত্য-আলোচনার সময় ব্যক্তি সৈয়দের প্রসঙ্গ প্রায় আসেই না। তাঁর তিরোধানের পর থেকে, গত শতকের সাত-আট-ন’য়ের দশকে তো বটেই এমনকি নতুন শতকের প্রথম বা দ্বিতীয় শতকে এসেও তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ কমল না কারও। কী কারণ এর? এসব বিষয় নিয়ে আমি একাধিক প্রবন্ধ লিখেছি বিভিন্ন সময়ে। আজ একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলি।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমরা আসলে খুব কমই জানি। কতগুলো কেজো তথ্য তুলে ধরা মানে ব্যক্তিমানুষের মনোজগৎ বুঝে ওঠা নয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর স্ত্রী আন মারি ‘আমার স্বামী ওয়ালীউল্লাহ’ শিরোনামে একটি ক্ষীণকায় স্মৃতিকথা লিখেছেন। সেখানে বরং অনেক প্রাণবন্তভাবে তাঁকে পাওয়া যায়। আমরা সেখান থেকে একটু ঘুরে আসব, তবে তার আগে সহায়ক সূত্র হয়েছে ওই কেজো তথ্যগুলোও দেখে নিতে পারি একবার। তাঁর জন্ম ১৫ আগস্ট, ১৯২২, নোয়াখালীতে, তবে আদি নিবাস চট্টগ্রামে। মাত্র আট বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিলেন। বাবা ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় বদলি হতেন তিনি এবং সেই সূত্রে ওয়ালীউল্লাহকে মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফেনী, চুঁচুড়া, হুগলি, সাতক্ষীরার বিভিন্ন স্কুলে পড়তে হয়েছে। ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন করেন ফেনী হাইস্কুল থেকে। এরপর কলকাতার সেন্ট পল কলেজে কিছুদিন, ঢাকায় কিছুদিন এবং তারপর ময়মনসিংহ থেকে ডিস্টিংকশনসহ বিএ পাস করে। এই যে তাঁর ছুটে বেড়ানো শৈশব-কৈশোর, আন মারি একে দেখেছেন মমতাময়ীর ভিন্নমাত্রিক চোখে: ‘‘এভাবে ওকে নিরন্তর জায়গা বদল করতে হয়েছে, যার মানে সম্ভবত কোনো ঘনিষ্ঠ স্কুলবন্ধু বানানোর সুযোগ ও পায়নি। তার ওপর আট বছর বয়সেই ও মাকে হারিয়েছে। এই দুটি কারণে সম্ভবত ওর চরিত্রের মধ্যে একটা অন্তর্মুখিতা, এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা ও উন্মূলতা দেখা যায়।’’

তিনি যে বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ, উন্মূল ও অন্তর্মুখী ছিলেন সেটি তিনি স্বীকারও করেছেন আন মারির কাছে লেখা এক মর্মস্পর্শী চিঠিতে। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আবারও কিছু তথ্য। ১৯৪৩ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন তিনি। ১৯৪৮ পর্যন্ত কলকাতাতেই ছিলেন। এই সময় দি স্টেটসম্যান পত্রিকার সাব এডিটর পদে এবং কমরেড পাবলিশিং কোম্পানিতে প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করতেন, সম্পাদনা করতেন কনটেমপোরারি ও মিসেল্যানি নামের দুটো ম্যাগাজিনও। দেশভাগের পর যোগ দেন পাকিস্তান রেডিওতে, বার্তা সম্পাদক হিসেবে। ১৯৫২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় পাকিস্তান দূতাবাসের প্রেস অ্যাটাশে হিসেবে নিযুক্ত হন, এবং সেখানেই পরিচয় হয় আন মারির সঙ্গে, পরে প্রেম ও বিয়ে। ১৯৫৪ সালের আগস্টে ঢাকায় তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করা হয় তাঁকে, ১৯৫৫ সালের মার্চে করাচিতে, একই বছরের ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়ায়, ১৯৫৯ সালে আবার করাচিতে, ওই বছরেরই অক্টোবরে ফার্স্ট সেক্রেটারির মর্যাদায় প্রেস ও কালচারাল অ্যাটাশে হিসেবে জার্মানিতে, ১৯৬১ সালে প্যারিসে। তার মানে হলো—চাকরি-জীবনের প্রথম ১২ বছরে তিনি স্থির হয়ে বসতে পারেননি কোথাও বেশি দিন। ক্রমাগত তাঁকে বদলি করা হয়েছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। অবশ্য ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত প্যারিসেই ছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকারের চাকরি ত্যাগ করে যোগ দিলেন ইউনেসকো-তে, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সে চুক্তি বাতিল হলো। তিনি তাই পাকিস্তান সরকারের চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছিলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় তিনি সে পরিকল্পনা বাতিল করেন, বেকার জীবনই অব্যাহত রাখেন। পাকিস্তান দূতাবাসের চাকরি ছেড়ে কেন তিনি ইউনেসকো-তে যোগ দিয়েছিলেন এ সম্পর্কে আন মারি লিখেছেন: ‘‘পাকিস্তানের কথা প্রচারের এ চাকরির প্রতি এক ধরনের বিরক্তি জন্ম নিতে শুরু করল ওর মধ্যে, বিশেষত যে কথা এখন আর সে বিশ্বাস করে না সেগুলোই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার বলা, প্রতিবছর ইকবালের বার্ষিকী আয়োজন করা ইত্যাদি ওর ভালো লাগছিল না। পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর প্রথম কয়েকটি বছর যে বিরাট প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল, ওর মধ্যে যদি সেটা থেকেও থাকত, বহু আগেই সেটা হারিয়ে গেছে।’’
পাকিস্তানের প্রতি মোহ কাটিয়ে উঠেছিলেন তিনি আগেই, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বেকারত্ব মেনে নিয়েছেন তবু চাকরিতে ফেরত যাননি, বরং, দেশকে কীভাবে সহায়তা করা যায় সেই ভাবনাতেই অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্য ফরাসি বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মারলো ও কয়েকজন ফরাসি সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। (এই আঁদ্রে মারলো পরবর্তী মাসগুলোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠনের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।) লন্ডনে গিয়ে বাঙালি মুক্তিকামী মানুষদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জনমত গঠন ও প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন। কিন্তু যুদ্ধাক্রান্ত দেশ নিয়ে গভীর উদ্বেগ তাঁর সংবেদনশীল হৃদয় বেশি দিন সইতে পারেনি, অক্টোবরের ১০ তারিখে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
যা হোক, ১৯৫৪ সালে ঢাকার বদলি হওয়ার পর আন মারিকে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লেখেন সৈয়দ, যে চিঠিতে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের এক গভীর দুঃখবোধের পরিচয় মেলে: “কদিন আগেও ভাবছিলাম, আমি কত উন্মূল; এখন বলা চলে, আবার ঘরে ফিরে এসেছি, কিন্তু এখানে কাকে চিনি আমি? বস্তুত কাউকে না। বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি ছাড়া আমি কারও বাড়িতে যাই না, বন্ধুদের বাড়িতে গেলে সেখানে খাই। যে কয়েকজন মাত্র বন্ধু আছে আমার, তারা শুধুই বন্ধু, বলা চলে সাধারণ বন্ধু, তারাও দুজনের বেশি হবে না। লেখক হিসেবে অনেকে আমাকে চেনে, কিন্তু আমি তাদের চিনি না, হয়তো তাদের আমার ভালো লাগবে না। আত্মীয় সম্পর্কের কথা বলতে গেলে ভাই ছাড়া কারও সঙ্গে সম্পর্ক নেই। আমার কাছে বাকিদের কারও অস্তিত্ব নেই। তাদের সঙ্গে আমি দেখা করি না, তারাও দেখা করে না আমার সঙ্গে। এমনকি আমার সঙ্গে আমার সৎ বোনদের কোনো সম্পর্ক নেই (তারা ঢাকায় থাকে না)। তারা কেউ আমাকে চিঠি লেখে না, আমিও তাদের কাউকে চিঠি লিখি না। নিজেকে আমার সম্পূর্ণ উন্মূল মনে হয়, যেন আমার নিজের বলে কোনো জায়গা নেই। আমি নিঃসঙ্গ, ভীষণ নিঃসঙ্গ। আমার মতো নিজেকে এমন নিঃসঙ্গ আর কেউ বোধ করে বলে মনে হয় না। এটা কি ভালো না খারাপ? হয়তো এক দিক দিয়ে এতে আমি উপকৃত হই, এর ফলে হয়তো যে কোনো প্রথা ভাঙা আমার জন্য সহজ হয়ে যায়...। কিন্তু মানসিকভাবে আমার এই একাকিত্ব এবং কারও ভালোবাসা না পাওয়াটা খারাপ। যেসব পরিবারে অনেক ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, তাদের দেখে আমার ঈর্ষা হয়। উচ্চতা ও খাঁটি মানবিক সম্পর্কের কারণে এ জাতীয় সঙ্গ অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে পূর্ণতার অনুভূতি এনে দেয়। এটি সম্ভবত স্বামী বা স্ত্রীর ভালোবাসার মতোই জরুরি। ”
শৈশবে মাকে হারিয়েছিলেন তিনি, একটিমাত্র ভাই ছিল তাঁর, সম্ভবত সৎ-মায়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি, ফলে সৎ বোনদের সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক ছিল না, হয়তো বাবার সঙ্গেও দূরত্ব ছিল অনতিক্রম্য। অনেকগুলো ভাইবোন নেই কেন, সে নিয়ে দুঃখ করছেন প্রেমিকার কাছে, এবং বলছেন ‘এ জাতীয় সঙ্গ অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে পূর্ণতার অনুভূতি এনে দেয়’। বোঝাই যায়, এক ধরনের মর্মান্তিক শূন্যতাবোধে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। আত্মীয়-স্বজনহীন, বন্ধু-বান্ধবহীন এক অদ্ভুত জীবন ছিল তাঁর। এই শূন্যতাবোধের, বিচ্ছিন্নতাবোধের, নিঃসঙ্গতাবোধের কোনো ছাপ কি পড়েছিল তাঁর লেখায়? পড়ারই কথা, এবং পড়েছিলও। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে, আরেকটি বিষয়। তাঁর প্রথম বইটি গল্পের, ‘নয়নচারা’, বেরোয় ১৯৪৪; আর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’-এর প্রকাশকাল ১৯৪৬। দ্বিতীয় গল্পের বই ‘দুই তীর’ ১৯৬৫ সালে আর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়। প্রায় বিশ বছরের বিরতি। এই সময়ে কী করছিলেন তিনি? লেখেননি? লিখেছেন। সব সময়ই লেখার মধ্যে থেকেছেন, তবে এই সময়ে তিনি ইংরেজিতে লেখার দিকে ঝুঁকেছিলেন। লালসালুর ইংরেজি ও ফরাসি অনুবাদ তো হয়েছিলই, তার সঙ্গে রচনা করছিলেন ‘আগলি এশিয়ান’ নামে আরেকটি উপন্যাস। ‘উ টু কুক বিনস’ নামে একটি ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাসও লিখেছিলেন। বাংলা ভাষাটি যাঁর হাতে নূপুরের ছন্দে বেজে ওঠে তিনি কেন ইংরেজিতে লিখতে গেলেন? সে কি কেবলই সাহিত্যিক কারণে? বাংলা ভাষায় নিজের চিন্তাকে যথার্থভাবে প্রকাশ করতে পারছিলেন না বলে? আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পাওয়ার লোভে? না, এর কোনোটিই নয়। কারণটি করুণ, আন মারিকে লেখা তাঁর আরেকটি চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন সে-কথা: “কারও জন্য কাজ করাটা আমি ঘৃণা করি। আমি স্বাধীন থাকতে চাই। কিন্তু তা কী করে সম্ভব?...নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব অনিশ্চয়তায় ভুগছি। ভবিষ্যতে কী করব জানি না; কেননা এখন যা করছি তা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য কোনো সুযোগ খোলা নেই। অদূর ভবিষ্যতেও সেগুলোর ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।...এ জন্যেই যে বইটি এখন লিখছি তার ওপর এত ভরসা। মনে হচ্ছে বাইরের কোনো প্রকাশক এটি গ্রহণ করলে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলব।”

কী সিদ্ধান্ত? বোঝাই যাচ্ছে, চাকরি করতে তাঁর ভালো লাগে না, বিকল্প আয়ের কোনো ব্যবস্থাও নেই, ভেবেছিলেন ইংরেজিতে বই লিখলে সেটি যদি বাইরের কোনো প্রকাশক গ্রহণ করেন তাহলে তিনি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ‘কঠিন’ সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এই নিঃসঙ্গ, উন্মূল মানুষটি সকল আশ্রয় খুঁজে নিতেন লেখালেখির কাছেই, সব ছেড়ে তিনি কেবল লেখালেখিই করতে চেয়েছিলেন, এই চিঠিটি যেন সেই কথাটিই বলে দেয়।
আমাদের মনে মাঝে মাঝে এই প্রশ্ন জাগে যে, দীর্ঘকাল বিদেশে বসবাস করেও তিনি কীভাবে পূর্ববাংলার জনজীবনের নিখুঁত ছবি আঁকতে পেরেছিলেন? প্রশ্নটি জেগেছিল আন মারির মনেও, উত্তরে ওয়ালীউল্লাহ লিখেছিলেন: “আমার বইপত্র আর লেখালেখির ব্যাপারে তুমি খুব প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন তুলেছ, তা হলো, আমি যে গ্রাম আর তার মানুষজন নিয়ে লিখি, গোর্কি ওদের যতটা কাছ থেকে জানতেন, অতটা জানাশোনা কি তাদের নিয়ে আমার আছে? জানি না, তুমি এটা মনে করো কি না যে ওদের নিয়ে লিখতে গেলে ওদের মধ্যে আমাকে বসবাস করতে হবে। আমার পক্ষে সেটা করা সম্ভব নয়।...আমি তাদের গোটা জীবন বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে পারি, আর সেটা পারি আমি গ্রামের মানুষ নই এবং গ্রামে বসবাস করি না বলে। ওদের মধ্যে বসবাস করলেও গুটিকয়েক গ্রামবাসীর জীবনের আক্ষরিক ও ফটোগ্রাফিক বিবরণ তুলে ধরা আমার লক্ষ্য হতো না। বরং আমি যাদের চিনতাম, তারা যে এক বৃহৎ সামাজিক-অর্থনৈতিক বুনোটের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ সেটা বোঝানোই আমার লক্ষ্য।...আমার লেখা বই, আমার নাটক, আমার গল্পগুলো ব্যক্তি অভিজ্ঞতার ফটোগ্রাফিক প্রতিফলন নয়, বরং এগুলো তার চেয়ে বেশি কিছু। অন্তত আমি সেটাই মনে করি। আমি যখন ধর্মীয় কুসংস্কার, মোল্লাদের হাতে গরিব মানুষের শোষণকে আক্রমণ করি, তখন আমি গোটা ব্যবস্থাটাকেই আক্রমণ করি।”
হ্যাঁ, তিনি যেমন আক্রমণ করেছেন গোটা সমাজ ব্যবস্থাটাকেই, তেমনই চেয়েছেন মানুষ সদাশয় হোক, শুভ ও কল্যাণের পক্ষে থাকুক, মানুষের সঙ্গে মানুষের কার্যকর ও মমতাময় যোগাযোগ গড়ে উঠুক, ভালোবাসায় পূর্ণ থাকুক তাদের হৃদয়। এই আকাঙ্ক্ষা দেখি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও, আন মারিকে লেখা আরেকটি চিঠিতে: “উপলব্ধি করতে পারছি কারও সঙ্গে পরিচয় থাকা কতটা জরুরি, বন্ধু নয়, পরিচিতজন নয়, এমন কেউ যে আমাকে বোঝে, যার ওপর নির্ভরতা জাগে, নিজেকে সম্পূর্ণ করে তোলার অনুভূতি তৈরি হয়। মানুষের সাহায্য দরকার, এমন ধরনের সাহায্য যা অগোচরে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে। মানুষের এও জানা থাকা দরকার, কেননা মানুষ আসলে নিঃসঙ্গ।...একেক জনের ভালোবাসার প্রয়োজন একেক রকম। একেক জনের ভালোবাসার তীব্রতাও একেক রকম। যখন আমি বলি যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তখন হয়তো কথাটি দিয়ে এই বোঝাতে চাই যে, তোমার কাছে আমি সহজ বোধ করি, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আমি তোমার কথা ভাবি এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আমি ভাবি যে, তোমার সঙ্গে সবকিছু নিয়ে কথা বলা যায়।”
প্রিয় কথা-জাদুকর, আপনি স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জীবন পার করেছেন, জীবনের ওপার থেকে আপনি কি জানতে পারছেন আপনার দেশের পাঠকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আপনাকে ভালোবেসেছে? কেউ তাদের বলে দেয়নি ভালোবাসতে, কেউ চাপিয়ে দেয়নি ভালোবাসার ভার, আপনার লেখাগুলোই তাদের শিখিয়েছে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে একজন লেখককে অনিবার্য প্রসঙ্গ করে তুলতে হয়।
আজ ১৫ আগস্ট, সোমবার। ১৯২২ সালের আজকের এই দিনে জন্ম হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর। তাঁর জন্মের ১০০ বছর পূর্ণ হলো আজ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কীভাবে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের কাছে এক অনিবার্য প্রসঙ্গ হয়ে উঠলেন সেটি ভাবলে খানিকটা বিস্ময়ই জাগে। না, জনপ্রিয় লেখক তিনি নন, নন সব পাঠকের লেখকও, জনচিত্ত জয় করার মতো লেখা তিনি লেখেননি কোনো দিন। ফলে দেশের সব পাঠক তাঁর নাম জানবে, এ রকম আশা করার কোনো কারণ নেই। নেই বটে, তবু এক বিরাট অংশ তাঁর নাম জানে ভিন্ন একটি কারণে। কোনো এক সময় নাম-না-জানা কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসটিকে কলেজ-পাঠ্য হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। আবশ্যিকভাবে পড়তে হতো বলে লেখকের নামটিও সেই সময়কার কলেজ-শিক্ষার্থীদের জানা হয়ে যেত। পাঠ্য বইয়ের পাঠকেরা পরবর্তীকালে তাদের পাঠতৃষ্ণা ধরে রাখেন এমন কোনো নমুনা অন্তত বাংলাদেশে দেখা যায়নি। ফলে তারা সবাই যে সৈয়দের অন্য লেখাগুলোও খুঁজে পড়েছেন সেটি ভাবার কোনো অবকাশও নেই। আর এখন তো তিনি পাঠ্যতালিকায়ও নেই, সাহিত্যবিমুখ এই জাতি তাঁর নাম জানবেই-বা কীভাবে?
জনগণ না জানুক, যারা লেখালেখি করতে চান, বিশেষ করে কথাসাহিত্য নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের পাঠ-তালিকায় প্রথমদিকের নাম হিসেবে সৈয়দের নাম থাকেই। এটা গত কয়েক দশক ধরে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কীভাবে ঘটল এই ঘটনাটি? কীভাবে আবিষ্কৃত হলেন তিনি? কীভাবে চিহ্নিত হলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান লেখক হিসেবে? বিষয়টি রহস্যময় লাগে এই জন্য যে, সৈয়দ ছিলেন এমন এক লেখক—দেশের সাহিত্যসমাজের সঙ্গে যাঁর কোনো যোগাযোগই ছিল না। শক্তিমান লেখক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সঙ্গে এই যোগাযোগের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়, সাহিত্যের থাকে এমন এক স্বয়ম্ভূ শক্তি যে, যোগাযোগ-ধরাধরি-দলাদলি ছাড়াই তা নিজ গুণে ও যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়; কিন্তু সত্য হচ্ছে এই যে, তেমন গুণটুন না থাকলেও সাহিত্যসমাজে অনেকে প্রতিষ্ঠা পান স্রেফ যোগাযোগের ফলে। সৈয়দের সেটি মোটেই ছিল না। আর থাকবেই বা কীভাবে? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরির সুবাদে তাঁর লেখক-জীবনের প্রায় সবটুকুই কেটেছে বিদেশ-বিভুঁইয়ে। পূর্ব বাঙলায় যখন কেবলমাত্র সাহিত্য সমাজ গড়ে উঠতে শুরু করেছে তখন তিনি বিদেশে কর্মরত। মারাও গেলেন বিদেশেই, ১৯৭১ সালে, মাত্র ঊন পঞ্চাশ বছর বয়সে—তিনটে উপন্যাস, দুটো গল্পগ্রন্থ, দুটো নাটক আর বেশ কিছু অগ্রন্থিত রচনা রেখে। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের যে নতুন প্রজন্ম লেখালেখি করতে এলেন তাদের সঙ্গে সৈয়দের দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ তো রইলই না, বরং, তাঁর ওই স্বল্পসংখ্যক রচনা স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলো। নতুন দেশ, অপরিমেয় রক্ত, অশ্রু আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা, নানারকম অস্থিরতা, হতাশা, স্বপ্নভঙ্গ—এই সবকিছুর মধ্যে সাহিত্যের মতো সুকুমারবৃত্তির দিকে কতটুকুই-বা নজর থাকে মানুষের? তাও একজন দূরবর্তী লেখক, যাকে চাক্ষুষ দেখা যায়নি খুব একটা, ১৯৫৪ সালের পর দেশে এসেছিলেন মাত্র দু-বার, এমনকি এখন পর্যন্ত যাঁর ব্যক্তি-জীবন সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না প্রায়, তাঁর বইগুলো আর প্রকাশিত হলো কি না, সেই খবরই-বা কে রাখে? যুগে যুগে কত লেখকই তো এভাবে হারিয়ে গেছেন, এ তো নতুন কিছু নয়। কিন্তু সৈয়দ হারালেন না, বরং, রইলেন তরুণদের আগ্রহের কেন্দ্রে। রইলেন তাঁর রচিত সাহিত্য নিয়ে কৌতূহলের কারণে; ব্যক্তি নয়, সাহিত্য-বিচারই যেখানে প্রধান হয়ে উঠল। এদিক থেকে সৈয়দ খুবই ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক, যাঁর সাহিত্য-আলোচনার সময় ব্যক্তি সৈয়দের প্রসঙ্গ প্রায় আসেই না। তাঁর তিরোধানের পর থেকে, গত শতকের সাত-আট-ন’য়ের দশকে তো বটেই এমনকি নতুন শতকের প্রথম বা দ্বিতীয় শতকে এসেও তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ কমল না কারও। কী কারণ এর? এসব বিষয় নিয়ে আমি একাধিক প্রবন্ধ লিখেছি বিভিন্ন সময়ে। আজ একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলি।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমরা আসলে খুব কমই জানি। কতগুলো কেজো তথ্য তুলে ধরা মানে ব্যক্তিমানুষের মনোজগৎ বুঝে ওঠা নয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর স্ত্রী আন মারি ‘আমার স্বামী ওয়ালীউল্লাহ’ শিরোনামে একটি ক্ষীণকায় স্মৃতিকথা লিখেছেন। সেখানে বরং অনেক প্রাণবন্তভাবে তাঁকে পাওয়া যায়। আমরা সেখান থেকে একটু ঘুরে আসব, তবে তার আগে সহায়ক সূত্র হয়েছে ওই কেজো তথ্যগুলোও দেখে নিতে পারি একবার। তাঁর জন্ম ১৫ আগস্ট, ১৯২২, নোয়াখালীতে, তবে আদি নিবাস চট্টগ্রামে। মাত্র আট বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিলেন। বাবা ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় বদলি হতেন তিনি এবং সেই সূত্রে ওয়ালীউল্লাহকে মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফেনী, চুঁচুড়া, হুগলি, সাতক্ষীরার বিভিন্ন স্কুলে পড়তে হয়েছে। ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন করেন ফেনী হাইস্কুল থেকে। এরপর কলকাতার সেন্ট পল কলেজে কিছুদিন, ঢাকায় কিছুদিন এবং তারপর ময়মনসিংহ থেকে ডিস্টিংকশনসহ বিএ পাস করে। এই যে তাঁর ছুটে বেড়ানো শৈশব-কৈশোর, আন মারি একে দেখেছেন মমতাময়ীর ভিন্নমাত্রিক চোখে: ‘‘এভাবে ওকে নিরন্তর জায়গা বদল করতে হয়েছে, যার মানে সম্ভবত কোনো ঘনিষ্ঠ স্কুলবন্ধু বানানোর সুযোগ ও পায়নি। তার ওপর আট বছর বয়সেই ও মাকে হারিয়েছে। এই দুটি কারণে সম্ভবত ওর চরিত্রের মধ্যে একটা অন্তর্মুখিতা, এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা ও উন্মূলতা দেখা যায়।’’

তিনি যে বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ, উন্মূল ও অন্তর্মুখী ছিলেন সেটি তিনি স্বীকারও করেছেন আন মারির কাছে লেখা এক মর্মস্পর্শী চিঠিতে। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আবারও কিছু তথ্য। ১৯৪৩ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন তিনি। ১৯৪৮ পর্যন্ত কলকাতাতেই ছিলেন। এই সময় দি স্টেটসম্যান পত্রিকার সাব এডিটর পদে এবং কমরেড পাবলিশিং কোম্পানিতে প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করতেন, সম্পাদনা করতেন কনটেমপোরারি ও মিসেল্যানি নামের দুটো ম্যাগাজিনও। দেশভাগের পর যোগ দেন পাকিস্তান রেডিওতে, বার্তা সম্পাদক হিসেবে। ১৯৫২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় পাকিস্তান দূতাবাসের প্রেস অ্যাটাশে হিসেবে নিযুক্ত হন, এবং সেখানেই পরিচয় হয় আন মারির সঙ্গে, পরে প্রেম ও বিয়ে। ১৯৫৪ সালের আগস্টে ঢাকায় তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করা হয় তাঁকে, ১৯৫৫ সালের মার্চে করাচিতে, একই বছরের ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়ায়, ১৯৫৯ সালে আবার করাচিতে, ওই বছরেরই অক্টোবরে ফার্স্ট সেক্রেটারির মর্যাদায় প্রেস ও কালচারাল অ্যাটাশে হিসেবে জার্মানিতে, ১৯৬১ সালে প্যারিসে। তার মানে হলো—চাকরি-জীবনের প্রথম ১২ বছরে তিনি স্থির হয়ে বসতে পারেননি কোথাও বেশি দিন। ক্রমাগত তাঁকে বদলি করা হয়েছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। অবশ্য ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত প্যারিসেই ছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকারের চাকরি ত্যাগ করে যোগ দিলেন ইউনেসকো-তে, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সে চুক্তি বাতিল হলো। তিনি তাই পাকিস্তান সরকারের চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছিলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় তিনি সে পরিকল্পনা বাতিল করেন, বেকার জীবনই অব্যাহত রাখেন। পাকিস্তান দূতাবাসের চাকরি ছেড়ে কেন তিনি ইউনেসকো-তে যোগ দিয়েছিলেন এ সম্পর্কে আন মারি লিখেছেন: ‘‘পাকিস্তানের কথা প্রচারের এ চাকরির প্রতি এক ধরনের বিরক্তি জন্ম নিতে শুরু করল ওর মধ্যে, বিশেষত যে কথা এখন আর সে বিশ্বাস করে না সেগুলোই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার বলা, প্রতিবছর ইকবালের বার্ষিকী আয়োজন করা ইত্যাদি ওর ভালো লাগছিল না। পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর প্রথম কয়েকটি বছর যে বিরাট প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল, ওর মধ্যে যদি সেটা থেকেও থাকত, বহু আগেই সেটা হারিয়ে গেছে।’’
পাকিস্তানের প্রতি মোহ কাটিয়ে উঠেছিলেন তিনি আগেই, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বেকারত্ব মেনে নিয়েছেন তবু চাকরিতে ফেরত যাননি, বরং, দেশকে কীভাবে সহায়তা করা যায় সেই ভাবনাতেই অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্য ফরাসি বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মারলো ও কয়েকজন ফরাসি সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। (এই আঁদ্রে মারলো পরবর্তী মাসগুলোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠনের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।) লন্ডনে গিয়ে বাঙালি মুক্তিকামী মানুষদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জনমত গঠন ও প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন। কিন্তু যুদ্ধাক্রান্ত দেশ নিয়ে গভীর উদ্বেগ তাঁর সংবেদনশীল হৃদয় বেশি দিন সইতে পারেনি, অক্টোবরের ১০ তারিখে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
যা হোক, ১৯৫৪ সালে ঢাকার বদলি হওয়ার পর আন মারিকে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লেখেন সৈয়দ, যে চিঠিতে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের এক গভীর দুঃখবোধের পরিচয় মেলে: “কদিন আগেও ভাবছিলাম, আমি কত উন্মূল; এখন বলা চলে, আবার ঘরে ফিরে এসেছি, কিন্তু এখানে কাকে চিনি আমি? বস্তুত কাউকে না। বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি ছাড়া আমি কারও বাড়িতে যাই না, বন্ধুদের বাড়িতে গেলে সেখানে খাই। যে কয়েকজন মাত্র বন্ধু আছে আমার, তারা শুধুই বন্ধু, বলা চলে সাধারণ বন্ধু, তারাও দুজনের বেশি হবে না। লেখক হিসেবে অনেকে আমাকে চেনে, কিন্তু আমি তাদের চিনি না, হয়তো তাদের আমার ভালো লাগবে না। আত্মীয় সম্পর্কের কথা বলতে গেলে ভাই ছাড়া কারও সঙ্গে সম্পর্ক নেই। আমার কাছে বাকিদের কারও অস্তিত্ব নেই। তাদের সঙ্গে আমি দেখা করি না, তারাও দেখা করে না আমার সঙ্গে। এমনকি আমার সঙ্গে আমার সৎ বোনদের কোনো সম্পর্ক নেই (তারা ঢাকায় থাকে না)। তারা কেউ আমাকে চিঠি লেখে না, আমিও তাদের কাউকে চিঠি লিখি না। নিজেকে আমার সম্পূর্ণ উন্মূল মনে হয়, যেন আমার নিজের বলে কোনো জায়গা নেই। আমি নিঃসঙ্গ, ভীষণ নিঃসঙ্গ। আমার মতো নিজেকে এমন নিঃসঙ্গ আর কেউ বোধ করে বলে মনে হয় না। এটা কি ভালো না খারাপ? হয়তো এক দিক দিয়ে এতে আমি উপকৃত হই, এর ফলে হয়তো যে কোনো প্রথা ভাঙা আমার জন্য সহজ হয়ে যায়...। কিন্তু মানসিকভাবে আমার এই একাকিত্ব এবং কারও ভালোবাসা না পাওয়াটা খারাপ। যেসব পরিবারে অনেক ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, তাদের দেখে আমার ঈর্ষা হয়। উচ্চতা ও খাঁটি মানবিক সম্পর্কের কারণে এ জাতীয় সঙ্গ অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে পূর্ণতার অনুভূতি এনে দেয়। এটি সম্ভবত স্বামী বা স্ত্রীর ভালোবাসার মতোই জরুরি। ”
শৈশবে মাকে হারিয়েছিলেন তিনি, একটিমাত্র ভাই ছিল তাঁর, সম্ভবত সৎ-মায়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি, ফলে সৎ বোনদের সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক ছিল না, হয়তো বাবার সঙ্গেও দূরত্ব ছিল অনতিক্রম্য। অনেকগুলো ভাইবোন নেই কেন, সে নিয়ে দুঃখ করছেন প্রেমিকার কাছে, এবং বলছেন ‘এ জাতীয় সঙ্গ অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে পূর্ণতার অনুভূতি এনে দেয়’। বোঝাই যায়, এক ধরনের মর্মান্তিক শূন্যতাবোধে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। আত্মীয়-স্বজনহীন, বন্ধু-বান্ধবহীন এক অদ্ভুত জীবন ছিল তাঁর। এই শূন্যতাবোধের, বিচ্ছিন্নতাবোধের, নিঃসঙ্গতাবোধের কোনো ছাপ কি পড়েছিল তাঁর লেখায়? পড়ারই কথা, এবং পড়েছিলও। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে, আরেকটি বিষয়। তাঁর প্রথম বইটি গল্পের, ‘নয়নচারা’, বেরোয় ১৯৪৪; আর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’-এর প্রকাশকাল ১৯৪৬। দ্বিতীয় গল্পের বই ‘দুই তীর’ ১৯৬৫ সালে আর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়। প্রায় বিশ বছরের বিরতি। এই সময়ে কী করছিলেন তিনি? লেখেননি? লিখেছেন। সব সময়ই লেখার মধ্যে থেকেছেন, তবে এই সময়ে তিনি ইংরেজিতে লেখার দিকে ঝুঁকেছিলেন। লালসালুর ইংরেজি ও ফরাসি অনুবাদ তো হয়েছিলই, তার সঙ্গে রচনা করছিলেন ‘আগলি এশিয়ান’ নামে আরেকটি উপন্যাস। ‘উ টু কুক বিনস’ নামে একটি ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাসও লিখেছিলেন। বাংলা ভাষাটি যাঁর হাতে নূপুরের ছন্দে বেজে ওঠে তিনি কেন ইংরেজিতে লিখতে গেলেন? সে কি কেবলই সাহিত্যিক কারণে? বাংলা ভাষায় নিজের চিন্তাকে যথার্থভাবে প্রকাশ করতে পারছিলেন না বলে? আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পাওয়ার লোভে? না, এর কোনোটিই নয়। কারণটি করুণ, আন মারিকে লেখা তাঁর আরেকটি চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন সে-কথা: “কারও জন্য কাজ করাটা আমি ঘৃণা করি। আমি স্বাধীন থাকতে চাই। কিন্তু তা কী করে সম্ভব?...নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব অনিশ্চয়তায় ভুগছি। ভবিষ্যতে কী করব জানি না; কেননা এখন যা করছি তা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য কোনো সুযোগ খোলা নেই। অদূর ভবিষ্যতেও সেগুলোর ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।...এ জন্যেই যে বইটি এখন লিখছি তার ওপর এত ভরসা। মনে হচ্ছে বাইরের কোনো প্রকাশক এটি গ্রহণ করলে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলব।”

কী সিদ্ধান্ত? বোঝাই যাচ্ছে, চাকরি করতে তাঁর ভালো লাগে না, বিকল্প আয়ের কোনো ব্যবস্থাও নেই, ভেবেছিলেন ইংরেজিতে বই লিখলে সেটি যদি বাইরের কোনো প্রকাশক গ্রহণ করেন তাহলে তিনি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ‘কঠিন’ সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এই নিঃসঙ্গ, উন্মূল মানুষটি সকল আশ্রয় খুঁজে নিতেন লেখালেখির কাছেই, সব ছেড়ে তিনি কেবল লেখালেখিই করতে চেয়েছিলেন, এই চিঠিটি যেন সেই কথাটিই বলে দেয়।
আমাদের মনে মাঝে মাঝে এই প্রশ্ন জাগে যে, দীর্ঘকাল বিদেশে বসবাস করেও তিনি কীভাবে পূর্ববাংলার জনজীবনের নিখুঁত ছবি আঁকতে পেরেছিলেন? প্রশ্নটি জেগেছিল আন মারির মনেও, উত্তরে ওয়ালীউল্লাহ লিখেছিলেন: “আমার বইপত্র আর লেখালেখির ব্যাপারে তুমি খুব প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন তুলেছ, তা হলো, আমি যে গ্রাম আর তার মানুষজন নিয়ে লিখি, গোর্কি ওদের যতটা কাছ থেকে জানতেন, অতটা জানাশোনা কি তাদের নিয়ে আমার আছে? জানি না, তুমি এটা মনে করো কি না যে ওদের নিয়ে লিখতে গেলে ওদের মধ্যে আমাকে বসবাস করতে হবে। আমার পক্ষে সেটা করা সম্ভব নয়।...আমি তাদের গোটা জীবন বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে পারি, আর সেটা পারি আমি গ্রামের মানুষ নই এবং গ্রামে বসবাস করি না বলে। ওদের মধ্যে বসবাস করলেও গুটিকয়েক গ্রামবাসীর জীবনের আক্ষরিক ও ফটোগ্রাফিক বিবরণ তুলে ধরা আমার লক্ষ্য হতো না। বরং আমি যাদের চিনতাম, তারা যে এক বৃহৎ সামাজিক-অর্থনৈতিক বুনোটের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ সেটা বোঝানোই আমার লক্ষ্য।...আমার লেখা বই, আমার নাটক, আমার গল্পগুলো ব্যক্তি অভিজ্ঞতার ফটোগ্রাফিক প্রতিফলন নয়, বরং এগুলো তার চেয়ে বেশি কিছু। অন্তত আমি সেটাই মনে করি। আমি যখন ধর্মীয় কুসংস্কার, মোল্লাদের হাতে গরিব মানুষের শোষণকে আক্রমণ করি, তখন আমি গোটা ব্যবস্থাটাকেই আক্রমণ করি।”
হ্যাঁ, তিনি যেমন আক্রমণ করেছেন গোটা সমাজ ব্যবস্থাটাকেই, তেমনই চেয়েছেন মানুষ সদাশয় হোক, শুভ ও কল্যাণের পক্ষে থাকুক, মানুষের সঙ্গে মানুষের কার্যকর ও মমতাময় যোগাযোগ গড়ে উঠুক, ভালোবাসায় পূর্ণ থাকুক তাদের হৃদয়। এই আকাঙ্ক্ষা দেখি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও, আন মারিকে লেখা আরেকটি চিঠিতে: “উপলব্ধি করতে পারছি কারও সঙ্গে পরিচয় থাকা কতটা জরুরি, বন্ধু নয়, পরিচিতজন নয়, এমন কেউ যে আমাকে বোঝে, যার ওপর নির্ভরতা জাগে, নিজেকে সম্পূর্ণ করে তোলার অনুভূতি তৈরি হয়। মানুষের সাহায্য দরকার, এমন ধরনের সাহায্য যা অগোচরে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে। মানুষের এও জানা থাকা দরকার, কেননা মানুষ আসলে নিঃসঙ্গ।...একেক জনের ভালোবাসার প্রয়োজন একেক রকম। একেক জনের ভালোবাসার তীব্রতাও একেক রকম। যখন আমি বলি যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তখন হয়তো কথাটি দিয়ে এই বোঝাতে চাই যে, তোমার কাছে আমি সহজ বোধ করি, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আমি তোমার কথা ভাবি এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আমি ভাবি যে, তোমার সঙ্গে সবকিছু নিয়ে কথা বলা যায়।”
প্রিয় কথা-জাদুকর, আপনি স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জীবন পার করেছেন, জীবনের ওপার থেকে আপনি কি জানতে পারছেন আপনার দেশের পাঠকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আপনাকে ভালোবেসেছে? কেউ তাদের বলে দেয়নি ভালোবাসতে, কেউ চাপিয়ে দেয়নি ভালোবাসার ভার, আপনার লেখাগুলোই তাদের শিখিয়েছে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে একজন লেখককে অনিবার্য প্রসঙ্গ করে তুলতে হয়।
আজ ১৫ আগস্ট, সোমবার। ১৯২২ সালের আজকের এই দিনে জন্ম হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর। তাঁর জন্মের ১০০ বছর পূর্ণ হলো আজ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
আহমাদ মোস্তফা কামাল

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কীভাবে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের কাছে এক অনিবার্য প্রসঙ্গ হয়ে উঠলেন সেটি ভাবলে খানিকটা বিস্ময়ই জাগে। না, জনপ্রিয় লেখক তিনি নন, নন সব পাঠকের লেখকও, জনচিত্ত জয় করার মতো লেখা তিনি লেখেননি কোনো দিন। ফলে দেশের সব পাঠক তাঁর নাম জানবে, এ রকম আশা করার কোনো কারণ নেই। নেই বটে, তবু এক বিরাট অংশ তাঁর নাম জানে ভিন্ন একটি কারণে। কোনো এক সময় নাম-না-জানা কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসটিকে কলেজ-পাঠ্য হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। আবশ্যিকভাবে পড়তে হতো বলে লেখকের নামটিও সেই সময়কার কলেজ-শিক্ষার্থীদের জানা হয়ে যেত। পাঠ্য বইয়ের পাঠকেরা পরবর্তীকালে তাদের পাঠতৃষ্ণা ধরে রাখেন এমন কোনো নমুনা অন্তত বাংলাদেশে দেখা যায়নি। ফলে তারা সবাই যে সৈয়দের অন্য লেখাগুলোও খুঁজে পড়েছেন সেটি ভাবার কোনো অবকাশও নেই। আর এখন তো তিনি পাঠ্যতালিকায়ও নেই, সাহিত্যবিমুখ এই জাতি তাঁর নাম জানবেই-বা কীভাবে?
জনগণ না জানুক, যারা লেখালেখি করতে চান, বিশেষ করে কথাসাহিত্য নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের পাঠ-তালিকায় প্রথমদিকের নাম হিসেবে সৈয়দের নাম থাকেই। এটা গত কয়েক দশক ধরে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কীভাবে ঘটল এই ঘটনাটি? কীভাবে আবিষ্কৃত হলেন তিনি? কীভাবে চিহ্নিত হলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান লেখক হিসেবে? বিষয়টি রহস্যময় লাগে এই জন্য যে, সৈয়দ ছিলেন এমন এক লেখক—দেশের সাহিত্যসমাজের সঙ্গে যাঁর কোনো যোগাযোগই ছিল না। শক্তিমান লেখক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সঙ্গে এই যোগাযোগের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়, সাহিত্যের থাকে এমন এক স্বয়ম্ভূ শক্তি যে, যোগাযোগ-ধরাধরি-দলাদলি ছাড়াই তা নিজ গুণে ও যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়; কিন্তু সত্য হচ্ছে এই যে, তেমন গুণটুন না থাকলেও সাহিত্যসমাজে অনেকে প্রতিষ্ঠা পান স্রেফ যোগাযোগের ফলে। সৈয়দের সেটি মোটেই ছিল না। আর থাকবেই বা কীভাবে? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরির সুবাদে তাঁর লেখক-জীবনের প্রায় সবটুকুই কেটেছে বিদেশ-বিভুঁইয়ে। পূর্ব বাঙলায় যখন কেবলমাত্র সাহিত্য সমাজ গড়ে উঠতে শুরু করেছে তখন তিনি বিদেশে কর্মরত। মারাও গেলেন বিদেশেই, ১৯৭১ সালে, মাত্র ঊন পঞ্চাশ বছর বয়সে—তিনটে উপন্যাস, দুটো গল্পগ্রন্থ, দুটো নাটক আর বেশ কিছু অগ্রন্থিত রচনা রেখে। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের যে নতুন প্রজন্ম লেখালেখি করতে এলেন তাদের সঙ্গে সৈয়দের দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ তো রইলই না, বরং, তাঁর ওই স্বল্পসংখ্যক রচনা স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলো। নতুন দেশ, অপরিমেয় রক্ত, অশ্রু আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা, নানারকম অস্থিরতা, হতাশা, স্বপ্নভঙ্গ—এই সবকিছুর মধ্যে সাহিত্যের মতো সুকুমারবৃত্তির দিকে কতটুকুই-বা নজর থাকে মানুষের? তাও একজন দূরবর্তী লেখক, যাকে চাক্ষুষ দেখা যায়নি খুব একটা, ১৯৫৪ সালের পর দেশে এসেছিলেন মাত্র দু-বার, এমনকি এখন পর্যন্ত যাঁর ব্যক্তি-জীবন সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না প্রায়, তাঁর বইগুলো আর প্রকাশিত হলো কি না, সেই খবরই-বা কে রাখে? যুগে যুগে কত লেখকই তো এভাবে হারিয়ে গেছেন, এ তো নতুন কিছু নয়। কিন্তু সৈয়দ হারালেন না, বরং, রইলেন তরুণদের আগ্রহের কেন্দ্রে। রইলেন তাঁর রচিত সাহিত্য নিয়ে কৌতূহলের কারণে; ব্যক্তি নয়, সাহিত্য-বিচারই যেখানে প্রধান হয়ে উঠল। এদিক থেকে সৈয়দ খুবই ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক, যাঁর সাহিত্য-আলোচনার সময় ব্যক্তি সৈয়দের প্রসঙ্গ প্রায় আসেই না। তাঁর তিরোধানের পর থেকে, গত শতকের সাত-আট-ন’য়ের দশকে তো বটেই এমনকি নতুন শতকের প্রথম বা দ্বিতীয় শতকে এসেও তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ কমল না কারও। কী কারণ এর? এসব বিষয় নিয়ে আমি একাধিক প্রবন্ধ লিখেছি বিভিন্ন সময়ে। আজ একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলি।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমরা আসলে খুব কমই জানি। কতগুলো কেজো তথ্য তুলে ধরা মানে ব্যক্তিমানুষের মনোজগৎ বুঝে ওঠা নয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর স্ত্রী আন মারি ‘আমার স্বামী ওয়ালীউল্লাহ’ শিরোনামে একটি ক্ষীণকায় স্মৃতিকথা লিখেছেন। সেখানে বরং অনেক প্রাণবন্তভাবে তাঁকে পাওয়া যায়। আমরা সেখান থেকে একটু ঘুরে আসব, তবে তার আগে সহায়ক সূত্র হয়েছে ওই কেজো তথ্যগুলোও দেখে নিতে পারি একবার। তাঁর জন্ম ১৫ আগস্ট, ১৯২২, নোয়াখালীতে, তবে আদি নিবাস চট্টগ্রামে। মাত্র আট বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিলেন। বাবা ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় বদলি হতেন তিনি এবং সেই সূত্রে ওয়ালীউল্লাহকে মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফেনী, চুঁচুড়া, হুগলি, সাতক্ষীরার বিভিন্ন স্কুলে পড়তে হয়েছে। ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন করেন ফেনী হাইস্কুল থেকে। এরপর কলকাতার সেন্ট পল কলেজে কিছুদিন, ঢাকায় কিছুদিন এবং তারপর ময়মনসিংহ থেকে ডিস্টিংকশনসহ বিএ পাস করে। এই যে তাঁর ছুটে বেড়ানো শৈশব-কৈশোর, আন মারি একে দেখেছেন মমতাময়ীর ভিন্নমাত্রিক চোখে: ‘‘এভাবে ওকে নিরন্তর জায়গা বদল করতে হয়েছে, যার মানে সম্ভবত কোনো ঘনিষ্ঠ স্কুলবন্ধু বানানোর সুযোগ ও পায়নি। তার ওপর আট বছর বয়সেই ও মাকে হারিয়েছে। এই দুটি কারণে সম্ভবত ওর চরিত্রের মধ্যে একটা অন্তর্মুখিতা, এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা ও উন্মূলতা দেখা যায়।’’

তিনি যে বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ, উন্মূল ও অন্তর্মুখী ছিলেন সেটি তিনি স্বীকারও করেছেন আন মারির কাছে লেখা এক মর্মস্পর্শী চিঠিতে। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আবারও কিছু তথ্য। ১৯৪৩ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন তিনি। ১৯৪৮ পর্যন্ত কলকাতাতেই ছিলেন। এই সময় দি স্টেটসম্যান পত্রিকার সাব এডিটর পদে এবং কমরেড পাবলিশিং কোম্পানিতে প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করতেন, সম্পাদনা করতেন কনটেমপোরারি ও মিসেল্যানি নামের দুটো ম্যাগাজিনও। দেশভাগের পর যোগ দেন পাকিস্তান রেডিওতে, বার্তা সম্পাদক হিসেবে। ১৯৫২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় পাকিস্তান দূতাবাসের প্রেস অ্যাটাশে হিসেবে নিযুক্ত হন, এবং সেখানেই পরিচয় হয় আন মারির সঙ্গে, পরে প্রেম ও বিয়ে। ১৯৫৪ সালের আগস্টে ঢাকায় তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করা হয় তাঁকে, ১৯৫৫ সালের মার্চে করাচিতে, একই বছরের ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়ায়, ১৯৫৯ সালে আবার করাচিতে, ওই বছরেরই অক্টোবরে ফার্স্ট সেক্রেটারির মর্যাদায় প্রেস ও কালচারাল অ্যাটাশে হিসেবে জার্মানিতে, ১৯৬১ সালে প্যারিসে। তার মানে হলো—চাকরি-জীবনের প্রথম ১২ বছরে তিনি স্থির হয়ে বসতে পারেননি কোথাও বেশি দিন। ক্রমাগত তাঁকে বদলি করা হয়েছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। অবশ্য ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত প্যারিসেই ছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকারের চাকরি ত্যাগ করে যোগ দিলেন ইউনেসকো-তে, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সে চুক্তি বাতিল হলো। তিনি তাই পাকিস্তান সরকারের চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছিলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় তিনি সে পরিকল্পনা বাতিল করেন, বেকার জীবনই অব্যাহত রাখেন। পাকিস্তান দূতাবাসের চাকরি ছেড়ে কেন তিনি ইউনেসকো-তে যোগ দিয়েছিলেন এ সম্পর্কে আন মারি লিখেছেন: ‘‘পাকিস্তানের কথা প্রচারের এ চাকরির প্রতি এক ধরনের বিরক্তি জন্ম নিতে শুরু করল ওর মধ্যে, বিশেষত যে কথা এখন আর সে বিশ্বাস করে না সেগুলোই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার বলা, প্রতিবছর ইকবালের বার্ষিকী আয়োজন করা ইত্যাদি ওর ভালো লাগছিল না। পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর প্রথম কয়েকটি বছর যে বিরাট প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল, ওর মধ্যে যদি সেটা থেকেও থাকত, বহু আগেই সেটা হারিয়ে গেছে।’’
পাকিস্তানের প্রতি মোহ কাটিয়ে উঠেছিলেন তিনি আগেই, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বেকারত্ব মেনে নিয়েছেন তবু চাকরিতে ফেরত যাননি, বরং, দেশকে কীভাবে সহায়তা করা যায় সেই ভাবনাতেই অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্য ফরাসি বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মারলো ও কয়েকজন ফরাসি সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। (এই আঁদ্রে মারলো পরবর্তী মাসগুলোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠনের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।) লন্ডনে গিয়ে বাঙালি মুক্তিকামী মানুষদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জনমত গঠন ও প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন। কিন্তু যুদ্ধাক্রান্ত দেশ নিয়ে গভীর উদ্বেগ তাঁর সংবেদনশীল হৃদয় বেশি দিন সইতে পারেনি, অক্টোবরের ১০ তারিখে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
যা হোক, ১৯৫৪ সালে ঢাকার বদলি হওয়ার পর আন মারিকে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লেখেন সৈয়দ, যে চিঠিতে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের এক গভীর দুঃখবোধের পরিচয় মেলে: “কদিন আগেও ভাবছিলাম, আমি কত উন্মূল; এখন বলা চলে, আবার ঘরে ফিরে এসেছি, কিন্তু এখানে কাকে চিনি আমি? বস্তুত কাউকে না। বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি ছাড়া আমি কারও বাড়িতে যাই না, বন্ধুদের বাড়িতে গেলে সেখানে খাই। যে কয়েকজন মাত্র বন্ধু আছে আমার, তারা শুধুই বন্ধু, বলা চলে সাধারণ বন্ধু, তারাও দুজনের বেশি হবে না। লেখক হিসেবে অনেকে আমাকে চেনে, কিন্তু আমি তাদের চিনি না, হয়তো তাদের আমার ভালো লাগবে না। আত্মীয় সম্পর্কের কথা বলতে গেলে ভাই ছাড়া কারও সঙ্গে সম্পর্ক নেই। আমার কাছে বাকিদের কারও অস্তিত্ব নেই। তাদের সঙ্গে আমি দেখা করি না, তারাও দেখা করে না আমার সঙ্গে। এমনকি আমার সঙ্গে আমার সৎ বোনদের কোনো সম্পর্ক নেই (তারা ঢাকায় থাকে না)। তারা কেউ আমাকে চিঠি লেখে না, আমিও তাদের কাউকে চিঠি লিখি না। নিজেকে আমার সম্পূর্ণ উন্মূল মনে হয়, যেন আমার নিজের বলে কোনো জায়গা নেই। আমি নিঃসঙ্গ, ভীষণ নিঃসঙ্গ। আমার মতো নিজেকে এমন নিঃসঙ্গ আর কেউ বোধ করে বলে মনে হয় না। এটা কি ভালো না খারাপ? হয়তো এক দিক দিয়ে এতে আমি উপকৃত হই, এর ফলে হয়তো যে কোনো প্রথা ভাঙা আমার জন্য সহজ হয়ে যায়...। কিন্তু মানসিকভাবে আমার এই একাকিত্ব এবং কারও ভালোবাসা না পাওয়াটা খারাপ। যেসব পরিবারে অনেক ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, তাদের দেখে আমার ঈর্ষা হয়। উচ্চতা ও খাঁটি মানবিক সম্পর্কের কারণে এ জাতীয় সঙ্গ অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে পূর্ণতার অনুভূতি এনে দেয়। এটি সম্ভবত স্বামী বা স্ত্রীর ভালোবাসার মতোই জরুরি। ”
শৈশবে মাকে হারিয়েছিলেন তিনি, একটিমাত্র ভাই ছিল তাঁর, সম্ভবত সৎ-মায়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি, ফলে সৎ বোনদের সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক ছিল না, হয়তো বাবার সঙ্গেও দূরত্ব ছিল অনতিক্রম্য। অনেকগুলো ভাইবোন নেই কেন, সে নিয়ে দুঃখ করছেন প্রেমিকার কাছে, এবং বলছেন ‘এ জাতীয় সঙ্গ অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে পূর্ণতার অনুভূতি এনে দেয়’। বোঝাই যায়, এক ধরনের মর্মান্তিক শূন্যতাবোধে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। আত্মীয়-স্বজনহীন, বন্ধু-বান্ধবহীন এক অদ্ভুত জীবন ছিল তাঁর। এই শূন্যতাবোধের, বিচ্ছিন্নতাবোধের, নিঃসঙ্গতাবোধের কোনো ছাপ কি পড়েছিল তাঁর লেখায়? পড়ারই কথা, এবং পড়েছিলও। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে, আরেকটি বিষয়। তাঁর প্রথম বইটি গল্পের, ‘নয়নচারা’, বেরোয় ১৯৪৪; আর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’-এর প্রকাশকাল ১৯৪৬। দ্বিতীয় গল্পের বই ‘দুই তীর’ ১৯৬৫ সালে আর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়। প্রায় বিশ বছরের বিরতি। এই সময়ে কী করছিলেন তিনি? লেখেননি? লিখেছেন। সব সময়ই লেখার মধ্যে থেকেছেন, তবে এই সময়ে তিনি ইংরেজিতে লেখার দিকে ঝুঁকেছিলেন। লালসালুর ইংরেজি ও ফরাসি অনুবাদ তো হয়েছিলই, তার সঙ্গে রচনা করছিলেন ‘আগলি এশিয়ান’ নামে আরেকটি উপন্যাস। ‘উ টু কুক বিনস’ নামে একটি ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাসও লিখেছিলেন। বাংলা ভাষাটি যাঁর হাতে নূপুরের ছন্দে বেজে ওঠে তিনি কেন ইংরেজিতে লিখতে গেলেন? সে কি কেবলই সাহিত্যিক কারণে? বাংলা ভাষায় নিজের চিন্তাকে যথার্থভাবে প্রকাশ করতে পারছিলেন না বলে? আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পাওয়ার লোভে? না, এর কোনোটিই নয়। কারণটি করুণ, আন মারিকে লেখা তাঁর আরেকটি চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন সে-কথা: “কারও জন্য কাজ করাটা আমি ঘৃণা করি। আমি স্বাধীন থাকতে চাই। কিন্তু তা কী করে সম্ভব?...নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব অনিশ্চয়তায় ভুগছি। ভবিষ্যতে কী করব জানি না; কেননা এখন যা করছি তা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য কোনো সুযোগ খোলা নেই। অদূর ভবিষ্যতেও সেগুলোর ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।...এ জন্যেই যে বইটি এখন লিখছি তার ওপর এত ভরসা। মনে হচ্ছে বাইরের কোনো প্রকাশক এটি গ্রহণ করলে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলব।”

কী সিদ্ধান্ত? বোঝাই যাচ্ছে, চাকরি করতে তাঁর ভালো লাগে না, বিকল্প আয়ের কোনো ব্যবস্থাও নেই, ভেবেছিলেন ইংরেজিতে বই লিখলে সেটি যদি বাইরের কোনো প্রকাশক গ্রহণ করেন তাহলে তিনি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ‘কঠিন’ সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এই নিঃসঙ্গ, উন্মূল মানুষটি সকল আশ্রয় খুঁজে নিতেন লেখালেখির কাছেই, সব ছেড়ে তিনি কেবল লেখালেখিই করতে চেয়েছিলেন, এই চিঠিটি যেন সেই কথাটিই বলে দেয়।
আমাদের মনে মাঝে মাঝে এই প্রশ্ন জাগে যে, দীর্ঘকাল বিদেশে বসবাস করেও তিনি কীভাবে পূর্ববাংলার জনজীবনের নিখুঁত ছবি আঁকতে পেরেছিলেন? প্রশ্নটি জেগেছিল আন মারির মনেও, উত্তরে ওয়ালীউল্লাহ লিখেছিলেন: “আমার বইপত্র আর লেখালেখির ব্যাপারে তুমি খুব প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন তুলেছ, তা হলো, আমি যে গ্রাম আর তার মানুষজন নিয়ে লিখি, গোর্কি ওদের যতটা কাছ থেকে জানতেন, অতটা জানাশোনা কি তাদের নিয়ে আমার আছে? জানি না, তুমি এটা মনে করো কি না যে ওদের নিয়ে লিখতে গেলে ওদের মধ্যে আমাকে বসবাস করতে হবে। আমার পক্ষে সেটা করা সম্ভব নয়।...আমি তাদের গোটা জীবন বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে পারি, আর সেটা পারি আমি গ্রামের মানুষ নই এবং গ্রামে বসবাস করি না বলে। ওদের মধ্যে বসবাস করলেও গুটিকয়েক গ্রামবাসীর জীবনের আক্ষরিক ও ফটোগ্রাফিক বিবরণ তুলে ধরা আমার লক্ষ্য হতো না। বরং আমি যাদের চিনতাম, তারা যে এক বৃহৎ সামাজিক-অর্থনৈতিক বুনোটের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ সেটা বোঝানোই আমার লক্ষ্য।...আমার লেখা বই, আমার নাটক, আমার গল্পগুলো ব্যক্তি অভিজ্ঞতার ফটোগ্রাফিক প্রতিফলন নয়, বরং এগুলো তার চেয়ে বেশি কিছু। অন্তত আমি সেটাই মনে করি। আমি যখন ধর্মীয় কুসংস্কার, মোল্লাদের হাতে গরিব মানুষের শোষণকে আক্রমণ করি, তখন আমি গোটা ব্যবস্থাটাকেই আক্রমণ করি।”
হ্যাঁ, তিনি যেমন আক্রমণ করেছেন গোটা সমাজ ব্যবস্থাটাকেই, তেমনই চেয়েছেন মানুষ সদাশয় হোক, শুভ ও কল্যাণের পক্ষে থাকুক, মানুষের সঙ্গে মানুষের কার্যকর ও মমতাময় যোগাযোগ গড়ে উঠুক, ভালোবাসায় পূর্ণ থাকুক তাদের হৃদয়। এই আকাঙ্ক্ষা দেখি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও, আন মারিকে লেখা আরেকটি চিঠিতে: “উপলব্ধি করতে পারছি কারও সঙ্গে পরিচয় থাকা কতটা জরুরি, বন্ধু নয়, পরিচিতজন নয়, এমন কেউ যে আমাকে বোঝে, যার ওপর নির্ভরতা জাগে, নিজেকে সম্পূর্ণ করে তোলার অনুভূতি তৈরি হয়। মানুষের সাহায্য দরকার, এমন ধরনের সাহায্য যা অগোচরে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে। মানুষের এও জানা থাকা দরকার, কেননা মানুষ আসলে নিঃসঙ্গ।...একেক জনের ভালোবাসার প্রয়োজন একেক রকম। একেক জনের ভালোবাসার তীব্রতাও একেক রকম। যখন আমি বলি যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তখন হয়তো কথাটি দিয়ে এই বোঝাতে চাই যে, তোমার কাছে আমি সহজ বোধ করি, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আমি তোমার কথা ভাবি এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আমি ভাবি যে, তোমার সঙ্গে সবকিছু নিয়ে কথা বলা যায়।”
প্রিয় কথা-জাদুকর, আপনি স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জীবন পার করেছেন, জীবনের ওপার থেকে আপনি কি জানতে পারছেন আপনার দেশের পাঠকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আপনাকে ভালোবেসেছে? কেউ তাদের বলে দেয়নি ভালোবাসতে, কেউ চাপিয়ে দেয়নি ভালোবাসার ভার, আপনার লেখাগুলোই তাদের শিখিয়েছে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে একজন লেখককে অনিবার্য প্রসঙ্গ করে তুলতে হয়।
আজ ১৫ আগস্ট, সোমবার। ১৯২২ সালের আজকের এই দিনে জন্ম হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর। তাঁর জন্মের ১০০ বছর পূর্ণ হলো আজ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কীভাবে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের কাছে এক অনিবার্য প্রসঙ্গ হয়ে উঠলেন সেটি ভাবলে খানিকটা বিস্ময়ই জাগে। না, জনপ্রিয় লেখক তিনি নন, নন সব পাঠকের লেখকও, জনচিত্ত জয় করার মতো লেখা তিনি লেখেননি কোনো দিন। ফলে দেশের সব পাঠক তাঁর নাম জানবে, এ রকম আশা করার কোনো কারণ নেই। নেই বটে, তবু এক বিরাট অংশ তাঁর নাম জানে ভিন্ন একটি কারণে। কোনো এক সময় নাম-না-জানা কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসটিকে কলেজ-পাঠ্য হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। আবশ্যিকভাবে পড়তে হতো বলে লেখকের নামটিও সেই সময়কার কলেজ-শিক্ষার্থীদের জানা হয়ে যেত। পাঠ্য বইয়ের পাঠকেরা পরবর্তীকালে তাদের পাঠতৃষ্ণা ধরে রাখেন এমন কোনো নমুনা অন্তত বাংলাদেশে দেখা যায়নি। ফলে তারা সবাই যে সৈয়দের অন্য লেখাগুলোও খুঁজে পড়েছেন সেটি ভাবার কোনো অবকাশও নেই। আর এখন তো তিনি পাঠ্যতালিকায়ও নেই, সাহিত্যবিমুখ এই জাতি তাঁর নাম জানবেই-বা কীভাবে?
জনগণ না জানুক, যারা লেখালেখি করতে চান, বিশেষ করে কথাসাহিত্য নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের পাঠ-তালিকায় প্রথমদিকের নাম হিসেবে সৈয়দের নাম থাকেই। এটা গত কয়েক দশক ধরে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কীভাবে ঘটল এই ঘটনাটি? কীভাবে আবিষ্কৃত হলেন তিনি? কীভাবে চিহ্নিত হলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান লেখক হিসেবে? বিষয়টি রহস্যময় লাগে এই জন্য যে, সৈয়দ ছিলেন এমন এক লেখক—দেশের সাহিত্যসমাজের সঙ্গে যাঁর কোনো যোগাযোগই ছিল না। শক্তিমান লেখক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সঙ্গে এই যোগাযোগের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়, সাহিত্যের থাকে এমন এক স্বয়ম্ভূ শক্তি যে, যোগাযোগ-ধরাধরি-দলাদলি ছাড়াই তা নিজ গুণে ও যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়; কিন্তু সত্য হচ্ছে এই যে, তেমন গুণটুন না থাকলেও সাহিত্যসমাজে অনেকে প্রতিষ্ঠা পান স্রেফ যোগাযোগের ফলে। সৈয়দের সেটি মোটেই ছিল না। আর থাকবেই বা কীভাবে? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরির সুবাদে তাঁর লেখক-জীবনের প্রায় সবটুকুই কেটেছে বিদেশ-বিভুঁইয়ে। পূর্ব বাঙলায় যখন কেবলমাত্র সাহিত্য সমাজ গড়ে উঠতে শুরু করেছে তখন তিনি বিদেশে কর্মরত। মারাও গেলেন বিদেশেই, ১৯৭১ সালে, মাত্র ঊন পঞ্চাশ বছর বয়সে—তিনটে উপন্যাস, দুটো গল্পগ্রন্থ, দুটো নাটক আর বেশ কিছু অগ্রন্থিত রচনা রেখে। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের যে নতুন প্রজন্ম লেখালেখি করতে এলেন তাদের সঙ্গে সৈয়দের দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ তো রইলই না, বরং, তাঁর ওই স্বল্পসংখ্যক রচনা স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলো। নতুন দেশ, অপরিমেয় রক্ত, অশ্রু আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা, নানারকম অস্থিরতা, হতাশা, স্বপ্নভঙ্গ—এই সবকিছুর মধ্যে সাহিত্যের মতো সুকুমারবৃত্তির দিকে কতটুকুই-বা নজর থাকে মানুষের? তাও একজন দূরবর্তী লেখক, যাকে চাক্ষুষ দেখা যায়নি খুব একটা, ১৯৫৪ সালের পর দেশে এসেছিলেন মাত্র দু-বার, এমনকি এখন পর্যন্ত যাঁর ব্যক্তি-জীবন সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না প্রায়, তাঁর বইগুলো আর প্রকাশিত হলো কি না, সেই খবরই-বা কে রাখে? যুগে যুগে কত লেখকই তো এভাবে হারিয়ে গেছেন, এ তো নতুন কিছু নয়। কিন্তু সৈয়দ হারালেন না, বরং, রইলেন তরুণদের আগ্রহের কেন্দ্রে। রইলেন তাঁর রচিত সাহিত্য নিয়ে কৌতূহলের কারণে; ব্যক্তি নয়, সাহিত্য-বিচারই যেখানে প্রধান হয়ে উঠল। এদিক থেকে সৈয়দ খুবই ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক, যাঁর সাহিত্য-আলোচনার সময় ব্যক্তি সৈয়দের প্রসঙ্গ প্রায় আসেই না। তাঁর তিরোধানের পর থেকে, গত শতকের সাত-আট-ন’য়ের দশকে তো বটেই এমনকি নতুন শতকের প্রথম বা দ্বিতীয় শতকে এসেও তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ কমল না কারও। কী কারণ এর? এসব বিষয় নিয়ে আমি একাধিক প্রবন্ধ লিখেছি বিভিন্ন সময়ে। আজ একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলি।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমরা আসলে খুব কমই জানি। কতগুলো কেজো তথ্য তুলে ধরা মানে ব্যক্তিমানুষের মনোজগৎ বুঝে ওঠা নয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর স্ত্রী আন মারি ‘আমার স্বামী ওয়ালীউল্লাহ’ শিরোনামে একটি ক্ষীণকায় স্মৃতিকথা লিখেছেন। সেখানে বরং অনেক প্রাণবন্তভাবে তাঁকে পাওয়া যায়। আমরা সেখান থেকে একটু ঘুরে আসব, তবে তার আগে সহায়ক সূত্র হয়েছে ওই কেজো তথ্যগুলোও দেখে নিতে পারি একবার। তাঁর জন্ম ১৫ আগস্ট, ১৯২২, নোয়াখালীতে, তবে আদি নিবাস চট্টগ্রামে। মাত্র আট বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিলেন। বাবা ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় বদলি হতেন তিনি এবং সেই সূত্রে ওয়ালীউল্লাহকে মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফেনী, চুঁচুড়া, হুগলি, সাতক্ষীরার বিভিন্ন স্কুলে পড়তে হয়েছে। ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন করেন ফেনী হাইস্কুল থেকে। এরপর কলকাতার সেন্ট পল কলেজে কিছুদিন, ঢাকায় কিছুদিন এবং তারপর ময়মনসিংহ থেকে ডিস্টিংকশনসহ বিএ পাস করে। এই যে তাঁর ছুটে বেড়ানো শৈশব-কৈশোর, আন মারি একে দেখেছেন মমতাময়ীর ভিন্নমাত্রিক চোখে: ‘‘এভাবে ওকে নিরন্তর জায়গা বদল করতে হয়েছে, যার মানে সম্ভবত কোনো ঘনিষ্ঠ স্কুলবন্ধু বানানোর সুযোগ ও পায়নি। তার ওপর আট বছর বয়সেই ও মাকে হারিয়েছে। এই দুটি কারণে সম্ভবত ওর চরিত্রের মধ্যে একটা অন্তর্মুখিতা, এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা ও উন্মূলতা দেখা যায়।’’

তিনি যে বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ, উন্মূল ও অন্তর্মুখী ছিলেন সেটি তিনি স্বীকারও করেছেন আন মারির কাছে লেখা এক মর্মস্পর্শী চিঠিতে। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আবারও কিছু তথ্য। ১৯৪৩ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন তিনি। ১৯৪৮ পর্যন্ত কলকাতাতেই ছিলেন। এই সময় দি স্টেটসম্যান পত্রিকার সাব এডিটর পদে এবং কমরেড পাবলিশিং কোম্পানিতে প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করতেন, সম্পাদনা করতেন কনটেমপোরারি ও মিসেল্যানি নামের দুটো ম্যাগাজিনও। দেশভাগের পর যোগ দেন পাকিস্তান রেডিওতে, বার্তা সম্পাদক হিসেবে। ১৯৫২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় পাকিস্তান দূতাবাসের প্রেস অ্যাটাশে হিসেবে নিযুক্ত হন, এবং সেখানেই পরিচয় হয় আন মারির সঙ্গে, পরে প্রেম ও বিয়ে। ১৯৫৪ সালের আগস্টে ঢাকায় তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করা হয় তাঁকে, ১৯৫৫ সালের মার্চে করাচিতে, একই বছরের ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়ায়, ১৯৫৯ সালে আবার করাচিতে, ওই বছরেরই অক্টোবরে ফার্স্ট সেক্রেটারির মর্যাদায় প্রেস ও কালচারাল অ্যাটাশে হিসেবে জার্মানিতে, ১৯৬১ সালে প্যারিসে। তার মানে হলো—চাকরি-জীবনের প্রথম ১২ বছরে তিনি স্থির হয়ে বসতে পারেননি কোথাও বেশি দিন। ক্রমাগত তাঁকে বদলি করা হয়েছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। অবশ্য ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত প্যারিসেই ছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকারের চাকরি ত্যাগ করে যোগ দিলেন ইউনেসকো-তে, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সে চুক্তি বাতিল হলো। তিনি তাই পাকিস্তান সরকারের চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছিলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় তিনি সে পরিকল্পনা বাতিল করেন, বেকার জীবনই অব্যাহত রাখেন। পাকিস্তান দূতাবাসের চাকরি ছেড়ে কেন তিনি ইউনেসকো-তে যোগ দিয়েছিলেন এ সম্পর্কে আন মারি লিখেছেন: ‘‘পাকিস্তানের কথা প্রচারের এ চাকরির প্রতি এক ধরনের বিরক্তি জন্ম নিতে শুরু করল ওর মধ্যে, বিশেষত যে কথা এখন আর সে বিশ্বাস করে না সেগুলোই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার বলা, প্রতিবছর ইকবালের বার্ষিকী আয়োজন করা ইত্যাদি ওর ভালো লাগছিল না। পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর প্রথম কয়েকটি বছর যে বিরাট প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল, ওর মধ্যে যদি সেটা থেকেও থাকত, বহু আগেই সেটা হারিয়ে গেছে।’’
পাকিস্তানের প্রতি মোহ কাটিয়ে উঠেছিলেন তিনি আগেই, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বেকারত্ব মেনে নিয়েছেন তবু চাকরিতে ফেরত যাননি, বরং, দেশকে কীভাবে সহায়তা করা যায় সেই ভাবনাতেই অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্য ফরাসি বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মারলো ও কয়েকজন ফরাসি সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। (এই আঁদ্রে মারলো পরবর্তী মাসগুলোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠনের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।) লন্ডনে গিয়ে বাঙালি মুক্তিকামী মানুষদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জনমত গঠন ও প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন। কিন্তু যুদ্ধাক্রান্ত দেশ নিয়ে গভীর উদ্বেগ তাঁর সংবেদনশীল হৃদয় বেশি দিন সইতে পারেনি, অক্টোবরের ১০ তারিখে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
যা হোক, ১৯৫৪ সালে ঢাকার বদলি হওয়ার পর আন মারিকে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লেখেন সৈয়দ, যে চিঠিতে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের এক গভীর দুঃখবোধের পরিচয় মেলে: “কদিন আগেও ভাবছিলাম, আমি কত উন্মূল; এখন বলা চলে, আবার ঘরে ফিরে এসেছি, কিন্তু এখানে কাকে চিনি আমি? বস্তুত কাউকে না। বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি ছাড়া আমি কারও বাড়িতে যাই না, বন্ধুদের বাড়িতে গেলে সেখানে খাই। যে কয়েকজন মাত্র বন্ধু আছে আমার, তারা শুধুই বন্ধু, বলা চলে সাধারণ বন্ধু, তারাও দুজনের বেশি হবে না। লেখক হিসেবে অনেকে আমাকে চেনে, কিন্তু আমি তাদের চিনি না, হয়তো তাদের আমার ভালো লাগবে না। আত্মীয় সম্পর্কের কথা বলতে গেলে ভাই ছাড়া কারও সঙ্গে সম্পর্ক নেই। আমার কাছে বাকিদের কারও অস্তিত্ব নেই। তাদের সঙ্গে আমি দেখা করি না, তারাও দেখা করে না আমার সঙ্গে। এমনকি আমার সঙ্গে আমার সৎ বোনদের কোনো সম্পর্ক নেই (তারা ঢাকায় থাকে না)। তারা কেউ আমাকে চিঠি লেখে না, আমিও তাদের কাউকে চিঠি লিখি না। নিজেকে আমার সম্পূর্ণ উন্মূল মনে হয়, যেন আমার নিজের বলে কোনো জায়গা নেই। আমি নিঃসঙ্গ, ভীষণ নিঃসঙ্গ। আমার মতো নিজেকে এমন নিঃসঙ্গ আর কেউ বোধ করে বলে মনে হয় না। এটা কি ভালো না খারাপ? হয়তো এক দিক দিয়ে এতে আমি উপকৃত হই, এর ফলে হয়তো যে কোনো প্রথা ভাঙা আমার জন্য সহজ হয়ে যায়...। কিন্তু মানসিকভাবে আমার এই একাকিত্ব এবং কারও ভালোবাসা না পাওয়াটা খারাপ। যেসব পরিবারে অনেক ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, তাদের দেখে আমার ঈর্ষা হয়। উচ্চতা ও খাঁটি মানবিক সম্পর্কের কারণে এ জাতীয় সঙ্গ অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে পূর্ণতার অনুভূতি এনে দেয়। এটি সম্ভবত স্বামী বা স্ত্রীর ভালোবাসার মতোই জরুরি। ”
শৈশবে মাকে হারিয়েছিলেন তিনি, একটিমাত্র ভাই ছিল তাঁর, সম্ভবত সৎ-মায়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি, ফলে সৎ বোনদের সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক ছিল না, হয়তো বাবার সঙ্গেও দূরত্ব ছিল অনতিক্রম্য। অনেকগুলো ভাইবোন নেই কেন, সে নিয়ে দুঃখ করছেন প্রেমিকার কাছে, এবং বলছেন ‘এ জাতীয় সঙ্গ অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে পূর্ণতার অনুভূতি এনে দেয়’। বোঝাই যায়, এক ধরনের মর্মান্তিক শূন্যতাবোধে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। আত্মীয়-স্বজনহীন, বন্ধু-বান্ধবহীন এক অদ্ভুত জীবন ছিল তাঁর। এই শূন্যতাবোধের, বিচ্ছিন্নতাবোধের, নিঃসঙ্গতাবোধের কোনো ছাপ কি পড়েছিল তাঁর লেখায়? পড়ারই কথা, এবং পড়েছিলও। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে, আরেকটি বিষয়। তাঁর প্রথম বইটি গল্পের, ‘নয়নচারা’, বেরোয় ১৯৪৪; আর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’-এর প্রকাশকাল ১৯৪৬। দ্বিতীয় গল্পের বই ‘দুই তীর’ ১৯৬৫ সালে আর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়। প্রায় বিশ বছরের বিরতি। এই সময়ে কী করছিলেন তিনি? লেখেননি? লিখেছেন। সব সময়ই লেখার মধ্যে থেকেছেন, তবে এই সময়ে তিনি ইংরেজিতে লেখার দিকে ঝুঁকেছিলেন। লালসালুর ইংরেজি ও ফরাসি অনুবাদ তো হয়েছিলই, তার সঙ্গে রচনা করছিলেন ‘আগলি এশিয়ান’ নামে আরেকটি উপন্যাস। ‘উ টু কুক বিনস’ নামে একটি ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাসও লিখেছিলেন। বাংলা ভাষাটি যাঁর হাতে নূপুরের ছন্দে বেজে ওঠে তিনি কেন ইংরেজিতে লিখতে গেলেন? সে কি কেবলই সাহিত্যিক কারণে? বাংলা ভাষায় নিজের চিন্তাকে যথার্থভাবে প্রকাশ করতে পারছিলেন না বলে? আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পাওয়ার লোভে? না, এর কোনোটিই নয়। কারণটি করুণ, আন মারিকে লেখা তাঁর আরেকটি চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন সে-কথা: “কারও জন্য কাজ করাটা আমি ঘৃণা করি। আমি স্বাধীন থাকতে চাই। কিন্তু তা কী করে সম্ভব?...নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব অনিশ্চয়তায় ভুগছি। ভবিষ্যতে কী করব জানি না; কেননা এখন যা করছি তা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য কোনো সুযোগ খোলা নেই। অদূর ভবিষ্যতেও সেগুলোর ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।...এ জন্যেই যে বইটি এখন লিখছি তার ওপর এত ভরসা। মনে হচ্ছে বাইরের কোনো প্রকাশক এটি গ্রহণ করলে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলব।”

কী সিদ্ধান্ত? বোঝাই যাচ্ছে, চাকরি করতে তাঁর ভালো লাগে না, বিকল্প আয়ের কোনো ব্যবস্থাও নেই, ভেবেছিলেন ইংরেজিতে বই লিখলে সেটি যদি বাইরের কোনো প্রকাশক গ্রহণ করেন তাহলে তিনি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ‘কঠিন’ সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এই নিঃসঙ্গ, উন্মূল মানুষটি সকল আশ্রয় খুঁজে নিতেন লেখালেখির কাছেই, সব ছেড়ে তিনি কেবল লেখালেখিই করতে চেয়েছিলেন, এই চিঠিটি যেন সেই কথাটিই বলে দেয়।
আমাদের মনে মাঝে মাঝে এই প্রশ্ন জাগে যে, দীর্ঘকাল বিদেশে বসবাস করেও তিনি কীভাবে পূর্ববাংলার জনজীবনের নিখুঁত ছবি আঁকতে পেরেছিলেন? প্রশ্নটি জেগেছিল আন মারির মনেও, উত্তরে ওয়ালীউল্লাহ লিখেছিলেন: “আমার বইপত্র আর লেখালেখির ব্যাপারে তুমি খুব প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন তুলেছ, তা হলো, আমি যে গ্রাম আর তার মানুষজন নিয়ে লিখি, গোর্কি ওদের যতটা কাছ থেকে জানতেন, অতটা জানাশোনা কি তাদের নিয়ে আমার আছে? জানি না, তুমি এটা মনে করো কি না যে ওদের নিয়ে লিখতে গেলে ওদের মধ্যে আমাকে বসবাস করতে হবে। আমার পক্ষে সেটা করা সম্ভব নয়।...আমি তাদের গোটা জীবন বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে পারি, আর সেটা পারি আমি গ্রামের মানুষ নই এবং গ্রামে বসবাস করি না বলে। ওদের মধ্যে বসবাস করলেও গুটিকয়েক গ্রামবাসীর জীবনের আক্ষরিক ও ফটোগ্রাফিক বিবরণ তুলে ধরা আমার লক্ষ্য হতো না। বরং আমি যাদের চিনতাম, তারা যে এক বৃহৎ সামাজিক-অর্থনৈতিক বুনোটের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ সেটা বোঝানোই আমার লক্ষ্য।...আমার লেখা বই, আমার নাটক, আমার গল্পগুলো ব্যক্তি অভিজ্ঞতার ফটোগ্রাফিক প্রতিফলন নয়, বরং এগুলো তার চেয়ে বেশি কিছু। অন্তত আমি সেটাই মনে করি। আমি যখন ধর্মীয় কুসংস্কার, মোল্লাদের হাতে গরিব মানুষের শোষণকে আক্রমণ করি, তখন আমি গোটা ব্যবস্থাটাকেই আক্রমণ করি।”
হ্যাঁ, তিনি যেমন আক্রমণ করেছেন গোটা সমাজ ব্যবস্থাটাকেই, তেমনই চেয়েছেন মানুষ সদাশয় হোক, শুভ ও কল্যাণের পক্ষে থাকুক, মানুষের সঙ্গে মানুষের কার্যকর ও মমতাময় যোগাযোগ গড়ে উঠুক, ভালোবাসায় পূর্ণ থাকুক তাদের হৃদয়। এই আকাঙ্ক্ষা দেখি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও, আন মারিকে লেখা আরেকটি চিঠিতে: “উপলব্ধি করতে পারছি কারও সঙ্গে পরিচয় থাকা কতটা জরুরি, বন্ধু নয়, পরিচিতজন নয়, এমন কেউ যে আমাকে বোঝে, যার ওপর নির্ভরতা জাগে, নিজেকে সম্পূর্ণ করে তোলার অনুভূতি তৈরি হয়। মানুষের সাহায্য দরকার, এমন ধরনের সাহায্য যা অগোচরে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে। মানুষের এও জানা থাকা দরকার, কেননা মানুষ আসলে নিঃসঙ্গ।...একেক জনের ভালোবাসার প্রয়োজন একেক রকম। একেক জনের ভালোবাসার তীব্রতাও একেক রকম। যখন আমি বলি যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তখন হয়তো কথাটি দিয়ে এই বোঝাতে চাই যে, তোমার কাছে আমি সহজ বোধ করি, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আমি তোমার কথা ভাবি এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আমি ভাবি যে, তোমার সঙ্গে সবকিছু নিয়ে কথা বলা যায়।”
প্রিয় কথা-জাদুকর, আপনি স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জীবন পার করেছেন, জীবনের ওপার থেকে আপনি কি জানতে পারছেন আপনার দেশের পাঠকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আপনাকে ভালোবেসেছে? কেউ তাদের বলে দেয়নি ভালোবাসতে, কেউ চাপিয়ে দেয়নি ভালোবাসার ভার, আপনার লেখাগুলোই তাদের শিখিয়েছে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে একজন লেখককে অনিবার্য প্রসঙ্গ করে তুলতে হয়।
আজ ১৫ আগস্ট, সোমবার। ১৯২২ সালের আজকের এই দিনে জন্ম হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর। তাঁর জন্মের ১০০ বছর পূর্ণ হলো আজ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৬ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১১ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৭ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

প্রিয় কথা-জাদুকর, আপনি স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জীবন পার করেছেন, জীবনের ওপার থেকে আপনি কি জানতে পারছেন আপনার দেশের পাঠকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আপনাকে ভালোবেসেছে...
১৫ আগস্ট ২০২২
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১১ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৭ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৭ দিন আগেনিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

প্রিয় কথা-জাদুকর, আপনি স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জীবন পার করেছেন, জীবনের ওপার থেকে আপনি কি জানতে পারছেন আপনার দেশের পাঠকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আপনাকে ভালোবেসেছে...
১৫ আগস্ট ২০২২
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৬ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৭ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

প্রিয় কথা-জাদুকর, আপনি স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জীবন পার করেছেন, জীবনের ওপার থেকে আপনি কি জানতে পারছেন আপনার দেশের পাঠকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আপনাকে ভালোবেসেছে...
১৫ আগস্ট ২০২২
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৬ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১১ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

প্রিয় কথা-জাদুকর, আপনি স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জীবন পার করেছেন, জীবনের ওপার থেকে আপনি কি জানতে পারছেন আপনার দেশের পাঠকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আপনাকে ভালোবেসেছে...
১৫ আগস্ট ২০২২
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৬ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১১ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৭ দিন আগে