সুদেব চক্রবর্তী

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক প্রমথ চৌধুরী। তাঁর অনেক অগ্রন্থিত লেখা এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা লেখাপত্র বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন মলয়েন্দু দিন্দা। তাঁর সংগৃহীত লেখাগুলো মন ফকিরা থেকে, প্রথম প্রকাশ পেয়েছে প্রমথ চৌধুরীর দুটি বই অগ্রন্থিত রচনা-১, অগ্রন্থিত রচনা-২ নামে। সেখান থেকেই প্রমথ চৌধুরীর প্রয়াণ দিবসে দুষ্প্রাপ্য ৩টি লেখা আজও প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় পুনঃপাঠ হিসেবে তুলে দেওয়া হলো আজকের পত্রিকার সাহিত্য পাতায়।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।’ প্রমথ চৌধুরী সবুজপত্র পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। চলিত রীতির প্রসারে সবুজপত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং ওই সময়ে সবুজপত্র এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে শিবরাম চক্রবর্তী ওই সময়কে চিহ্নিত করেছিলেন প্রমথ চৌধুরীর ‘বীরবলী আমল’ হিসেবে। বীরবল ছিল প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম।
সাহিত্যে আমাদের আদিরূপটি হলো কাব্য, গদ্য এসেছে অনেক পরে। বাংলা ভাষায় প্রথম যে গদ্যের নিদর্শন আমরা পাই, সেটি হলো ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আসামের রাজা কর্তৃক কোচবিহারে রাজার নিকট লেখা একটি পত্র। আসামের একটি পত্রিকা থেকে এই তথ্যটি জানা যায় ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে। আজকে ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রের কাছে ভাষার রূপ হলো এমন—মৌখিক ও লৈখিক। মৌখিক দুই ধরনের—আঞ্চলিক ও প্রমিত। একইভাবে লৈখিকও দুই ধরনের—সাধু ও চলিত। চলিত ভাষা সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা, সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। এই মৌখিক ভাষাকে বিশেষভাবে ‘চলিত ভাষা’ বলা হয়।’ উনিশ শতকের তৃতীয় দশকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে এ রীতির প্রথম ব্যবহার হয়। তারপর এই রীতির আরও বিকাশ ঘটান প্যারীচাঁদ মিত্র এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ। আর সবশেষে এ রীতির পূর্ণ সাহিত্যিক বিকাশ ঘটে প্রমথ চৌধুরীর হাতে। বিবর্তনের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে শ্রুতির যুগ পেরিয়ে সাহিত্য লিখিত রূপ পায়, বাংলা ভাষায় যার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ, এর অনেক পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গদ্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ছিল তৎসম শব্দে ঠাসা, সাধু ভাষা কিংবা এসবের সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ। সাধু ভাষার দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে আজকের গদ্য থিতু হয়েছে চলিত রীতিতে। এই চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠায় প্রমথ চৌধুরীর মাধ্যম ছিল সবুজপত্র। যার ফলস্বরূপ আমরা দেখি ১৯৭০-এর দশক থেকে চলিত গদ্যরীতি এক প্রকার স্বীকৃতি পেয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকা সাধু ভাষার বাইরে ভাবতেই পারত না। ৬০-এর দশকে তো স্কুল-কলেজের সব পাঠ্যবই উঁচু রীতির সাধু ভাষায় লেখা হতো।
প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ের। সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের জামাতা। সেই হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথেরও জামাতা। কিন্তু একই সময়ের হলেও, আত্মীয়তার বন্ধনজনিত কারণে কাছাকাছি থাকলেও প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে। নিজেই একটা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বরং রবীন্দ্রনাথই প্রমথ চৌধুরী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, বিশেষ করে ভাষার চলিত রীতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’, ‘সেঁজুতি’, ‘আকাশ প্রদীপ’, ‘শেষ লেখা’ প্রভৃতি রচনায় যে চলিত রীতি আমরা দেখি, তার পেছনে অবদান প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব। এ কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অকপটে স্বীকার করেছেন।
প্রমথ চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সমালোচক এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর সমালোচনা ছিল গঠনমূলক। এটা করতে গিয়ে তিনি যে ছদ্মনামটি ধারণ করেছিলেন তার সার্থকতাও প্রমাণিত হয়েছে। বীরবল সম্রাট আকবরের সভার নবরত্নের একজন। প্রমথ চৌধুরীও বাংলা সাহিত্যের একজন রত্ন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সম্রাট আকবরের বীরবল কেবল বিদূষকই ছিলেন না, একজন তুখোড় যোদ্ধাও ছিলেন। প্রমথ চৌধুরীও ছিলেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণকারী। বীরবল ছদ্মনাম কেন গ্রহণ করলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায় না। তবে তিনি একবার জানিয়েছিলেন, ‘আমি যখন দেশের লোককে রসিকতাচ্ছলে কতকগুলি সত্য কথা শোনাতে মনস্থ করি তখন আমি না ভেবে চিন্তে বীরবলের নাম অবলম্বন করলুম।’ পরবর্তী সময়ে তাঁর রচনাশৈলী ‘বীরবলী স্ট্যাইল’ নামে পরিচিত হলো। এই স্টাইলটাই হলো চলিত গদ্যরীতি, যা বাংলা সাহিত্যের গদ্য রচনায় বড় অবদান। যার ফলেই আজকে সর্বত্র চলিত রীতির ছড়াছড়ি। প্রসঙ্গত বলা যায়, বাংলাদেশের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক-এর সম্পাদকীয় লেখা হতো সাধু ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর চলিত রীতির প্রভাবের ফলে দীর্ঘদিন সাধু ভাষায় সম্পাদকীয় লেখা ইত্তেফাক ফিরে এসেছে চলিত ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর সময়কার অনেক লেখকই সে সময় আপত্তি তুলেছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সাধু ভাষার পক্ষে। তাঁর কাছে চলিত ভাষা ‘কঠিন’ মনে হয়েছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে জয়টা চলিত ভাষারই হয়েছে। যাঁরা চলিত ভাষার বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই পরবর্তীতে চলিত রীতিতে লিখেছেন। সেই সময়ে যাঁরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবতেন, তাঁরাই কেবল সাধু ভাষায় লিখতেন। তবে সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ, পরশুরাম, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ প্রমুখ লেখকেরা চলিত ভাষায় ফিরেছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতার জায়গা এইখানেই।
তবে প্রমথ চৌধুরীর এই প্রচেষ্টাকে বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে। আমরা জানি ভাষার সঙ্গে রাজনীতিও সংশ্লিষ্ট থাকে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর রাজনীতির প্রয়োজনেই শাসকগোষ্ঠীর ইংরেজি ভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষার এমন একটি রূপ দরকার ছিল, যেটি হবে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অক্ষয়কুমার দত্ত বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের মতো উঁচু বা মাঝারি রীতির নয়, বরং একটু সাদামাটা। আগে কী রূপ ছিল? তৎসম শব্দের আধিক্য, লৌকিক ক্রিয়াপদ ও বাগধারার ব্যবহার কম। এই ধারার পরিবর্তন করে ক্রিয়া, সর্বনাম, অনুসর্গের চেহারা বদল করা জরুরি ছিল। প্রমথ চৌধুরী নিজে ছিলেন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। ফলে চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি রাজনৈতিক বিষয়টাও আমলে নিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আসে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের কথা, যিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘বিশ্বকবি’ সম্বোধন করেছিলেন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ও ভেবেছিলেন সাদামাটা রীতির বাংলার কথা। এটা তিনি শুরু করেছিলেন সন্ধ্যা পত্রিকার মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে গিয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী এবং বাংলা গদ্যের চলিত রূপের পরিণতি দান করেছিলেন। এর আগে আমরা দেখেছি স্বামী বিবেকানন্দ ‘বাঙালা ভাষা’ প্রবন্ধে চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারে জোর দিয়ে বলেছেন। রাজনীতির কারণে যেমনি চলিত রীতি প্রয়োজন ছিল, তেমনি ধর্ম প্রচারের জন্যও এটার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন স্বামী বিবেকাননন্দ, কেশবচন্দ্র প্রমুখ।
বীরবল তথা প্রমথ চৌধুরী চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্ল্যাটফর্মটি বেছে নিয়েছিলেন, সেটি হলো সাহিত্য পত্রিকা সবুজপত্র। বাংলা সাহিত্যে ছোট কাগজের যে ধারণা সেটা শুরু হয়েছিল সবুজপত্র দিয়ে। যদিও বঙ্গদর্শন পত্রিকাকে কেউ কেউ প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেন, কিন্তু সবুজপত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য দেখলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘ভাবী পত্রিকাটি হবে বিশিষ্ট সাহিত্য পত্রিকা, মুনাফার লোভ থাকবে না এতে। আয়তনেও ছোট হবে।’ রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পত্রিকাটির নাম ‘কনিষ্ঠ’ রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়সহ যাঁরা সম্পাদনা পরিষদে ছিলেন তাঁরা ওই নামটি গ্রহণ করেননি। রবীন্দ্রনাথ সবুজকে তারুণ্যের প্রতীক ধরে নিয়ে লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সবুজের অভিযান’, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল সবুজপত্রের প্রথম সংখ্যাতেই। সবুজপত্র প্রকাশিত হয়েছিলো ২৫ শে বৈশাখ, ১৩২১ বঙ্গাব্দে (১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ)।
সবুজপত্রের ভাষা ছিল সাধারণের ভাষা। এ নিয়ে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা ছিল। কিন্তু সবুজপত্র তাতে দমে যায়নি। এই পত্রিকা এবং লেখালেখির জন্যই প্রমথ চৌধুরী সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। ‘ঠাকুমার ঝুলি’ খ্যাত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র একবার সবুজপত্রে লেখা পাঠিয়েছেন, কিন্তু ছাপা হতে দেরি হচ্ছে। কেন দেরি হচ্ছে এই মনঃকষ্টে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একসময়ে রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কোনো সাময়িকী বা সাহিত্য পত্রিকায় লিখবেন না। কিন্তু সবুজপত্রের কারণে রবীন্দ্রনাথ তার সিদ্ধান্ত বদলাতে অনেকটা বাধ্যই হয়েছিলেন। চলিত গদ্যরীতির ব্যাপারে প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্রের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সাহিত্যকে গুরুগম্ভীর ও ভারমুক্ত করে প্রাঞ্জল করে তোলা, জীবনমুখী করা। সবুজপত্র কেবল চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারেই সচেষ্ট ছিল না, বরং সাহিত্য নিয়ে তাদের চিন্তাটাও ভিন্ন ছিল। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র মনে করতেন তাই লেখা উচিত, যা মানবজাতির মঙ্গলসাধন করতে পারে বা সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে। প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্র বঙ্কিমচন্দ্রের এই মতের সাথে একমত ছিল না। তাদের মতে, সাহিত্য আর শিক্ষা এক বস্তু না।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসঙ্গ যেহেতু এল, তার ‘রচনার শিল্পগুণ’ প্রবন্ধটি সাহিত্যের ছাত্র মাত্রেই কমবেশি পড়েছেন। এই রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র প্রাঞ্জলতার ওপর খুব জোর দিয়েছেন। কিন্তু পাঠক জানেন বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা কতটা গুরুগম্ভীর, তৎসম শব্দে ভরা। প্রমথ চৌধুরী এই ধারাটাকেই ভাঙতে চেয়েছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতা হলো বঙ্কিমচন্দ্র বা মাইকেল মধুসূদনের সময়ে বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দের ব্যবহার ছিল ৬০ শতাংশ, যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ৪০ শতাংশেরও নীচে নেমে আসে। অর্থাৎ, চলিত রীতি প্রসারের যে উদ্যোগ প্রমথ চৌধুরী গ্রহণ করেছিলেন, সবুজপত্রের মাধ্যমে তা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় রূপ নেয়।
প্রমথ চৌধুরী যেহেতু রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন তাই তিনি ঝুঁকে পড়েন রাজনীতিতে। রাজনীতির প্রতি তাঁর আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবুজপত্র প্রকাশের পাঁচ বছরের মাথায় তিনি পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র বন্ধ করার পক্ষে ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টাতেই সবুজপত্র বন্ধ হতে পারেনি। পরবর্তীতে সবুজপত্রের সম্পাদক হন সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। কিন্তু তত দিনে বিশ্বযুদ্ধ, অসহযোগ আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, রবীন্দ্রনাথের ‘নাইট উপাধি’ বর্জনসহ নানা পরিস্থিতিতে ১০ বছরের আয়ু নিয়ে বন্ধ হয়ে যায় সবুজপত্র। সবুজপত্রের দশ বছরের যে আয়ুষ্কাল, তাকে সফল বলতেই হবে। সবুজপত্রের মোট ১০৮টি সংখ্যা যাতে ১১৩ জন লেখকের ৩১৪টি প্রবন্ধ, ১১০টি কবিতা, ৩১টি নিবন্ধ,৬টি সমালোচনা, ৩টি গান, ৮২টি গল্প, ৬টি নাটক এবং ২টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
১৯১৪ সালে সবুজপত্র প্রকাশের পূর্বে ১৯০২ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরী বীরবল ছদ্মনামে চলিত ভাষার পক্ষে কলম ধরেছিলেন। বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে গদ্য রচনার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ক্রিস্টোফার হেলিস বলেছিলেন, ‘‘He wrote thus because he thought thus. He wrote thus because he could not write otherwise. ” এই বক্তব্যটি প্রমথ চৌধুরীর জন্য শতভাগ সঠিক। আবার সবুজপত্রের দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই তিনি গল্প লেখা শুরু করেন। ‘চার ইয়ারি কথা’, ‘আহুতি’, ‘বড়বাবুর বড়দিন’ প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো তাকে গল্পকারের খ্যাতিও এনে দেয়। আবার তার কবিতাগুলোকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ইস্পাতের ছুরি। অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তার সম্পর্কে বলেছিলেন ‘তিনি আসলে পূর্ব বা পশ্চিম কোনো বঙ্গের লোক ছিলেন না। তিনি বিদ্যানগরের বিদগ্ধ নাগরিক ছিলেন। রাণী ভিক্টোরিয়া শাসিত ভারত সাম্রারাজ্যের প্রজা নন, কালিদাসের উজ্জয়িনী ও পেরিক্লিসের এথেন্স নগরের তিনি বাসিন্দা। এ কাল ও সেকালের জ্ঞানরাজ্যে তার অবাধ ভ্রমণের ছাড়পত্র ছিল। তিনি রাজলেখক।’ বলা বাহুল্য, প্রমথ চৌধুরী জন্মেছিলেন যশোরে, তবে তার পৈতৃক নিবাস পাবনা। বড় হয়েছেন কৃষ্ণনগরে, যৌবন কেটেছে কোলকাতা ও বিলেতে, আর বার্ধক্য শেষে মৃত্যুবরণ করেছেন শান্তিনিকেতনে। বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী রত্ন হয়েই আলো ছড়াবেন, বীরবল নামের সার্থকতা এখানেই।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক প্রমথ চৌধুরী। তাঁর অনেক অগ্রন্থিত লেখা এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা লেখাপত্র বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন মলয়েন্দু দিন্দা। তাঁর সংগৃহীত লেখাগুলো মন ফকিরা থেকে, প্রথম প্রকাশ পেয়েছে প্রমথ চৌধুরীর দুটি বই অগ্রন্থিত রচনা-১, অগ্রন্থিত রচনা-২ নামে। সেখান থেকেই প্রমথ চৌধুরীর প্রয়াণ দিবসে দুষ্প্রাপ্য ৩টি লেখা আজও প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় পুনঃপাঠ হিসেবে তুলে দেওয়া হলো আজকের পত্রিকার সাহিত্য পাতায়।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।’ প্রমথ চৌধুরী সবুজপত্র পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। চলিত রীতির প্রসারে সবুজপত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং ওই সময়ে সবুজপত্র এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে শিবরাম চক্রবর্তী ওই সময়কে চিহ্নিত করেছিলেন প্রমথ চৌধুরীর ‘বীরবলী আমল’ হিসেবে। বীরবল ছিল প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম।
সাহিত্যে আমাদের আদিরূপটি হলো কাব্য, গদ্য এসেছে অনেক পরে। বাংলা ভাষায় প্রথম যে গদ্যের নিদর্শন আমরা পাই, সেটি হলো ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আসামের রাজা কর্তৃক কোচবিহারে রাজার নিকট লেখা একটি পত্র। আসামের একটি পত্রিকা থেকে এই তথ্যটি জানা যায় ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে। আজকে ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রের কাছে ভাষার রূপ হলো এমন—মৌখিক ও লৈখিক। মৌখিক দুই ধরনের—আঞ্চলিক ও প্রমিত। একইভাবে লৈখিকও দুই ধরনের—সাধু ও চলিত। চলিত ভাষা সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা, সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। এই মৌখিক ভাষাকে বিশেষভাবে ‘চলিত ভাষা’ বলা হয়।’ উনিশ শতকের তৃতীয় দশকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে এ রীতির প্রথম ব্যবহার হয়। তারপর এই রীতির আরও বিকাশ ঘটান প্যারীচাঁদ মিত্র এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ। আর সবশেষে এ রীতির পূর্ণ সাহিত্যিক বিকাশ ঘটে প্রমথ চৌধুরীর হাতে। বিবর্তনের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে শ্রুতির যুগ পেরিয়ে সাহিত্য লিখিত রূপ পায়, বাংলা ভাষায় যার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ, এর অনেক পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গদ্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ছিল তৎসম শব্দে ঠাসা, সাধু ভাষা কিংবা এসবের সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ। সাধু ভাষার দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে আজকের গদ্য থিতু হয়েছে চলিত রীতিতে। এই চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠায় প্রমথ চৌধুরীর মাধ্যম ছিল সবুজপত্র। যার ফলস্বরূপ আমরা দেখি ১৯৭০-এর দশক থেকে চলিত গদ্যরীতি এক প্রকার স্বীকৃতি পেয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকা সাধু ভাষার বাইরে ভাবতেই পারত না। ৬০-এর দশকে তো স্কুল-কলেজের সব পাঠ্যবই উঁচু রীতির সাধু ভাষায় লেখা হতো।
প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ের। সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের জামাতা। সেই হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথেরও জামাতা। কিন্তু একই সময়ের হলেও, আত্মীয়তার বন্ধনজনিত কারণে কাছাকাছি থাকলেও প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে। নিজেই একটা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বরং রবীন্দ্রনাথই প্রমথ চৌধুরী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, বিশেষ করে ভাষার চলিত রীতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’, ‘সেঁজুতি’, ‘আকাশ প্রদীপ’, ‘শেষ লেখা’ প্রভৃতি রচনায় যে চলিত রীতি আমরা দেখি, তার পেছনে অবদান প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব। এ কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অকপটে স্বীকার করেছেন।
প্রমথ চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সমালোচক এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর সমালোচনা ছিল গঠনমূলক। এটা করতে গিয়ে তিনি যে ছদ্মনামটি ধারণ করেছিলেন তার সার্থকতাও প্রমাণিত হয়েছে। বীরবল সম্রাট আকবরের সভার নবরত্নের একজন। প্রমথ চৌধুরীও বাংলা সাহিত্যের একজন রত্ন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সম্রাট আকবরের বীরবল কেবল বিদূষকই ছিলেন না, একজন তুখোড় যোদ্ধাও ছিলেন। প্রমথ চৌধুরীও ছিলেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণকারী। বীরবল ছদ্মনাম কেন গ্রহণ করলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায় না। তবে তিনি একবার জানিয়েছিলেন, ‘আমি যখন দেশের লোককে রসিকতাচ্ছলে কতকগুলি সত্য কথা শোনাতে মনস্থ করি তখন আমি না ভেবে চিন্তে বীরবলের নাম অবলম্বন করলুম।’ পরবর্তী সময়ে তাঁর রচনাশৈলী ‘বীরবলী স্ট্যাইল’ নামে পরিচিত হলো। এই স্টাইলটাই হলো চলিত গদ্যরীতি, যা বাংলা সাহিত্যের গদ্য রচনায় বড় অবদান। যার ফলেই আজকে সর্বত্র চলিত রীতির ছড়াছড়ি। প্রসঙ্গত বলা যায়, বাংলাদেশের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক-এর সম্পাদকীয় লেখা হতো সাধু ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর চলিত রীতির প্রভাবের ফলে দীর্ঘদিন সাধু ভাষায় সম্পাদকীয় লেখা ইত্তেফাক ফিরে এসেছে চলিত ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর সময়কার অনেক লেখকই সে সময় আপত্তি তুলেছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সাধু ভাষার পক্ষে। তাঁর কাছে চলিত ভাষা ‘কঠিন’ মনে হয়েছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে জয়টা চলিত ভাষারই হয়েছে। যাঁরা চলিত ভাষার বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই পরবর্তীতে চলিত রীতিতে লিখেছেন। সেই সময়ে যাঁরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবতেন, তাঁরাই কেবল সাধু ভাষায় লিখতেন। তবে সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ, পরশুরাম, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ প্রমুখ লেখকেরা চলিত ভাষায় ফিরেছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতার জায়গা এইখানেই।
তবে প্রমথ চৌধুরীর এই প্রচেষ্টাকে বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে। আমরা জানি ভাষার সঙ্গে রাজনীতিও সংশ্লিষ্ট থাকে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর রাজনীতির প্রয়োজনেই শাসকগোষ্ঠীর ইংরেজি ভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষার এমন একটি রূপ দরকার ছিল, যেটি হবে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অক্ষয়কুমার দত্ত বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের মতো উঁচু বা মাঝারি রীতির নয়, বরং একটু সাদামাটা। আগে কী রূপ ছিল? তৎসম শব্দের আধিক্য, লৌকিক ক্রিয়াপদ ও বাগধারার ব্যবহার কম। এই ধারার পরিবর্তন করে ক্রিয়া, সর্বনাম, অনুসর্গের চেহারা বদল করা জরুরি ছিল। প্রমথ চৌধুরী নিজে ছিলেন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। ফলে চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি রাজনৈতিক বিষয়টাও আমলে নিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আসে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের কথা, যিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘বিশ্বকবি’ সম্বোধন করেছিলেন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ও ভেবেছিলেন সাদামাটা রীতির বাংলার কথা। এটা তিনি শুরু করেছিলেন সন্ধ্যা পত্রিকার মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে গিয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী এবং বাংলা গদ্যের চলিত রূপের পরিণতি দান করেছিলেন। এর আগে আমরা দেখেছি স্বামী বিবেকানন্দ ‘বাঙালা ভাষা’ প্রবন্ধে চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারে জোর দিয়ে বলেছেন। রাজনীতির কারণে যেমনি চলিত রীতি প্রয়োজন ছিল, তেমনি ধর্ম প্রচারের জন্যও এটার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন স্বামী বিবেকাননন্দ, কেশবচন্দ্র প্রমুখ।
বীরবল তথা প্রমথ চৌধুরী চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্ল্যাটফর্মটি বেছে নিয়েছিলেন, সেটি হলো সাহিত্য পত্রিকা সবুজপত্র। বাংলা সাহিত্যে ছোট কাগজের যে ধারণা সেটা শুরু হয়েছিল সবুজপত্র দিয়ে। যদিও বঙ্গদর্শন পত্রিকাকে কেউ কেউ প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেন, কিন্তু সবুজপত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য দেখলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘ভাবী পত্রিকাটি হবে বিশিষ্ট সাহিত্য পত্রিকা, মুনাফার লোভ থাকবে না এতে। আয়তনেও ছোট হবে।’ রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পত্রিকাটির নাম ‘কনিষ্ঠ’ রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়সহ যাঁরা সম্পাদনা পরিষদে ছিলেন তাঁরা ওই নামটি গ্রহণ করেননি। রবীন্দ্রনাথ সবুজকে তারুণ্যের প্রতীক ধরে নিয়ে লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সবুজের অভিযান’, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল সবুজপত্রের প্রথম সংখ্যাতেই। সবুজপত্র প্রকাশিত হয়েছিলো ২৫ শে বৈশাখ, ১৩২১ বঙ্গাব্দে (১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ)।
সবুজপত্রের ভাষা ছিল সাধারণের ভাষা। এ নিয়ে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা ছিল। কিন্তু সবুজপত্র তাতে দমে যায়নি। এই পত্রিকা এবং লেখালেখির জন্যই প্রমথ চৌধুরী সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। ‘ঠাকুমার ঝুলি’ খ্যাত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র একবার সবুজপত্রে লেখা পাঠিয়েছেন, কিন্তু ছাপা হতে দেরি হচ্ছে। কেন দেরি হচ্ছে এই মনঃকষ্টে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একসময়ে রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কোনো সাময়িকী বা সাহিত্য পত্রিকায় লিখবেন না। কিন্তু সবুজপত্রের কারণে রবীন্দ্রনাথ তার সিদ্ধান্ত বদলাতে অনেকটা বাধ্যই হয়েছিলেন। চলিত গদ্যরীতির ব্যাপারে প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্রের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সাহিত্যকে গুরুগম্ভীর ও ভারমুক্ত করে প্রাঞ্জল করে তোলা, জীবনমুখী করা। সবুজপত্র কেবল চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারেই সচেষ্ট ছিল না, বরং সাহিত্য নিয়ে তাদের চিন্তাটাও ভিন্ন ছিল। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র মনে করতেন তাই লেখা উচিত, যা মানবজাতির মঙ্গলসাধন করতে পারে বা সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে। প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্র বঙ্কিমচন্দ্রের এই মতের সাথে একমত ছিল না। তাদের মতে, সাহিত্য আর শিক্ষা এক বস্তু না।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসঙ্গ যেহেতু এল, তার ‘রচনার শিল্পগুণ’ প্রবন্ধটি সাহিত্যের ছাত্র মাত্রেই কমবেশি পড়েছেন। এই রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র প্রাঞ্জলতার ওপর খুব জোর দিয়েছেন। কিন্তু পাঠক জানেন বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা কতটা গুরুগম্ভীর, তৎসম শব্দে ভরা। প্রমথ চৌধুরী এই ধারাটাকেই ভাঙতে চেয়েছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতা হলো বঙ্কিমচন্দ্র বা মাইকেল মধুসূদনের সময়ে বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দের ব্যবহার ছিল ৬০ শতাংশ, যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ৪০ শতাংশেরও নীচে নেমে আসে। অর্থাৎ, চলিত রীতি প্রসারের যে উদ্যোগ প্রমথ চৌধুরী গ্রহণ করেছিলেন, সবুজপত্রের মাধ্যমে তা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় রূপ নেয়।
প্রমথ চৌধুরী যেহেতু রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন তাই তিনি ঝুঁকে পড়েন রাজনীতিতে। রাজনীতির প্রতি তাঁর আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবুজপত্র প্রকাশের পাঁচ বছরের মাথায় তিনি পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র বন্ধ করার পক্ষে ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টাতেই সবুজপত্র বন্ধ হতে পারেনি। পরবর্তীতে সবুজপত্রের সম্পাদক হন সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। কিন্তু তত দিনে বিশ্বযুদ্ধ, অসহযোগ আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, রবীন্দ্রনাথের ‘নাইট উপাধি’ বর্জনসহ নানা পরিস্থিতিতে ১০ বছরের আয়ু নিয়ে বন্ধ হয়ে যায় সবুজপত্র। সবুজপত্রের দশ বছরের যে আয়ুষ্কাল, তাকে সফল বলতেই হবে। সবুজপত্রের মোট ১০৮টি সংখ্যা যাতে ১১৩ জন লেখকের ৩১৪টি প্রবন্ধ, ১১০টি কবিতা, ৩১টি নিবন্ধ,৬টি সমালোচনা, ৩টি গান, ৮২টি গল্প, ৬টি নাটক এবং ২টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
১৯১৪ সালে সবুজপত্র প্রকাশের পূর্বে ১৯০২ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরী বীরবল ছদ্মনামে চলিত ভাষার পক্ষে কলম ধরেছিলেন। বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে গদ্য রচনার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ক্রিস্টোফার হেলিস বলেছিলেন, ‘‘He wrote thus because he thought thus. He wrote thus because he could not write otherwise. ” এই বক্তব্যটি প্রমথ চৌধুরীর জন্য শতভাগ সঠিক। আবার সবুজপত্রের দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই তিনি গল্প লেখা শুরু করেন। ‘চার ইয়ারি কথা’, ‘আহুতি’, ‘বড়বাবুর বড়দিন’ প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো তাকে গল্পকারের খ্যাতিও এনে দেয়। আবার তার কবিতাগুলোকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ইস্পাতের ছুরি। অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তার সম্পর্কে বলেছিলেন ‘তিনি আসলে পূর্ব বা পশ্চিম কোনো বঙ্গের লোক ছিলেন না। তিনি বিদ্যানগরের বিদগ্ধ নাগরিক ছিলেন। রাণী ভিক্টোরিয়া শাসিত ভারত সাম্রারাজ্যের প্রজা নন, কালিদাসের উজ্জয়িনী ও পেরিক্লিসের এথেন্স নগরের তিনি বাসিন্দা। এ কাল ও সেকালের জ্ঞানরাজ্যে তার অবাধ ভ্রমণের ছাড়পত্র ছিল। তিনি রাজলেখক।’ বলা বাহুল্য, প্রমথ চৌধুরী জন্মেছিলেন যশোরে, তবে তার পৈতৃক নিবাস পাবনা। বড় হয়েছেন কৃষ্ণনগরে, যৌবন কেটেছে কোলকাতা ও বিলেতে, আর বার্ধক্য শেষে মৃত্যুবরণ করেছেন শান্তিনিকেতনে। বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী রত্ন হয়েই আলো ছড়াবেন, বীরবল নামের সার্থকতা এখানেই।
সুদেব চক্রবর্তী

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক প্রমথ চৌধুরী। তাঁর অনেক অগ্রন্থিত লেখা এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা লেখাপত্র বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন মলয়েন্দু দিন্দা। তাঁর সংগৃহীত লেখাগুলো মন ফকিরা থেকে, প্রথম প্রকাশ পেয়েছে প্রমথ চৌধুরীর দুটি বই অগ্রন্থিত রচনা-১, অগ্রন্থিত রচনা-২ নামে। সেখান থেকেই প্রমথ চৌধুরীর প্রয়াণ দিবসে দুষ্প্রাপ্য ৩টি লেখা আজও প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় পুনঃপাঠ হিসেবে তুলে দেওয়া হলো আজকের পত্রিকার সাহিত্য পাতায়।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।’ প্রমথ চৌধুরী সবুজপত্র পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। চলিত রীতির প্রসারে সবুজপত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং ওই সময়ে সবুজপত্র এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে শিবরাম চক্রবর্তী ওই সময়কে চিহ্নিত করেছিলেন প্রমথ চৌধুরীর ‘বীরবলী আমল’ হিসেবে। বীরবল ছিল প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম।
সাহিত্যে আমাদের আদিরূপটি হলো কাব্য, গদ্য এসেছে অনেক পরে। বাংলা ভাষায় প্রথম যে গদ্যের নিদর্শন আমরা পাই, সেটি হলো ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আসামের রাজা কর্তৃক কোচবিহারে রাজার নিকট লেখা একটি পত্র। আসামের একটি পত্রিকা থেকে এই তথ্যটি জানা যায় ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে। আজকে ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রের কাছে ভাষার রূপ হলো এমন—মৌখিক ও লৈখিক। মৌখিক দুই ধরনের—আঞ্চলিক ও প্রমিত। একইভাবে লৈখিকও দুই ধরনের—সাধু ও চলিত। চলিত ভাষা সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা, সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। এই মৌখিক ভাষাকে বিশেষভাবে ‘চলিত ভাষা’ বলা হয়।’ উনিশ শতকের তৃতীয় দশকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে এ রীতির প্রথম ব্যবহার হয়। তারপর এই রীতির আরও বিকাশ ঘটান প্যারীচাঁদ মিত্র এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ। আর সবশেষে এ রীতির পূর্ণ সাহিত্যিক বিকাশ ঘটে প্রমথ চৌধুরীর হাতে। বিবর্তনের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে শ্রুতির যুগ পেরিয়ে সাহিত্য লিখিত রূপ পায়, বাংলা ভাষায় যার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ, এর অনেক পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গদ্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ছিল তৎসম শব্দে ঠাসা, সাধু ভাষা কিংবা এসবের সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ। সাধু ভাষার দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে আজকের গদ্য থিতু হয়েছে চলিত রীতিতে। এই চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠায় প্রমথ চৌধুরীর মাধ্যম ছিল সবুজপত্র। যার ফলস্বরূপ আমরা দেখি ১৯৭০-এর দশক থেকে চলিত গদ্যরীতি এক প্রকার স্বীকৃতি পেয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকা সাধু ভাষার বাইরে ভাবতেই পারত না। ৬০-এর দশকে তো স্কুল-কলেজের সব পাঠ্যবই উঁচু রীতির সাধু ভাষায় লেখা হতো।
প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ের। সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের জামাতা। সেই হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথেরও জামাতা। কিন্তু একই সময়ের হলেও, আত্মীয়তার বন্ধনজনিত কারণে কাছাকাছি থাকলেও প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে। নিজেই একটা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বরং রবীন্দ্রনাথই প্রমথ চৌধুরী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, বিশেষ করে ভাষার চলিত রীতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’, ‘সেঁজুতি’, ‘আকাশ প্রদীপ’, ‘শেষ লেখা’ প্রভৃতি রচনায় যে চলিত রীতি আমরা দেখি, তার পেছনে অবদান প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব। এ কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অকপটে স্বীকার করেছেন।
প্রমথ চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সমালোচক এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর সমালোচনা ছিল গঠনমূলক। এটা করতে গিয়ে তিনি যে ছদ্মনামটি ধারণ করেছিলেন তার সার্থকতাও প্রমাণিত হয়েছে। বীরবল সম্রাট আকবরের সভার নবরত্নের একজন। প্রমথ চৌধুরীও বাংলা সাহিত্যের একজন রত্ন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সম্রাট আকবরের বীরবল কেবল বিদূষকই ছিলেন না, একজন তুখোড় যোদ্ধাও ছিলেন। প্রমথ চৌধুরীও ছিলেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণকারী। বীরবল ছদ্মনাম কেন গ্রহণ করলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায় না। তবে তিনি একবার জানিয়েছিলেন, ‘আমি যখন দেশের লোককে রসিকতাচ্ছলে কতকগুলি সত্য কথা শোনাতে মনস্থ করি তখন আমি না ভেবে চিন্তে বীরবলের নাম অবলম্বন করলুম।’ পরবর্তী সময়ে তাঁর রচনাশৈলী ‘বীরবলী স্ট্যাইল’ নামে পরিচিত হলো। এই স্টাইলটাই হলো চলিত গদ্যরীতি, যা বাংলা সাহিত্যের গদ্য রচনায় বড় অবদান। যার ফলেই আজকে সর্বত্র চলিত রীতির ছড়াছড়ি। প্রসঙ্গত বলা যায়, বাংলাদেশের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক-এর সম্পাদকীয় লেখা হতো সাধু ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর চলিত রীতির প্রভাবের ফলে দীর্ঘদিন সাধু ভাষায় সম্পাদকীয় লেখা ইত্তেফাক ফিরে এসেছে চলিত ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর সময়কার অনেক লেখকই সে সময় আপত্তি তুলেছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সাধু ভাষার পক্ষে। তাঁর কাছে চলিত ভাষা ‘কঠিন’ মনে হয়েছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে জয়টা চলিত ভাষারই হয়েছে। যাঁরা চলিত ভাষার বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই পরবর্তীতে চলিত রীতিতে লিখেছেন। সেই সময়ে যাঁরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবতেন, তাঁরাই কেবল সাধু ভাষায় লিখতেন। তবে সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ, পরশুরাম, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ প্রমুখ লেখকেরা চলিত ভাষায় ফিরেছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতার জায়গা এইখানেই।
তবে প্রমথ চৌধুরীর এই প্রচেষ্টাকে বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে। আমরা জানি ভাষার সঙ্গে রাজনীতিও সংশ্লিষ্ট থাকে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর রাজনীতির প্রয়োজনেই শাসকগোষ্ঠীর ইংরেজি ভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষার এমন একটি রূপ দরকার ছিল, যেটি হবে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অক্ষয়কুমার দত্ত বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের মতো উঁচু বা মাঝারি রীতির নয়, বরং একটু সাদামাটা। আগে কী রূপ ছিল? তৎসম শব্দের আধিক্য, লৌকিক ক্রিয়াপদ ও বাগধারার ব্যবহার কম। এই ধারার পরিবর্তন করে ক্রিয়া, সর্বনাম, অনুসর্গের চেহারা বদল করা জরুরি ছিল। প্রমথ চৌধুরী নিজে ছিলেন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। ফলে চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি রাজনৈতিক বিষয়টাও আমলে নিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আসে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের কথা, যিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘বিশ্বকবি’ সম্বোধন করেছিলেন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ও ভেবেছিলেন সাদামাটা রীতির বাংলার কথা। এটা তিনি শুরু করেছিলেন সন্ধ্যা পত্রিকার মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে গিয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী এবং বাংলা গদ্যের চলিত রূপের পরিণতি দান করেছিলেন। এর আগে আমরা দেখেছি স্বামী বিবেকানন্দ ‘বাঙালা ভাষা’ প্রবন্ধে চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারে জোর দিয়ে বলেছেন। রাজনীতির কারণে যেমনি চলিত রীতি প্রয়োজন ছিল, তেমনি ধর্ম প্রচারের জন্যও এটার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন স্বামী বিবেকাননন্দ, কেশবচন্দ্র প্রমুখ।
বীরবল তথা প্রমথ চৌধুরী চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্ল্যাটফর্মটি বেছে নিয়েছিলেন, সেটি হলো সাহিত্য পত্রিকা সবুজপত্র। বাংলা সাহিত্যে ছোট কাগজের যে ধারণা সেটা শুরু হয়েছিল সবুজপত্র দিয়ে। যদিও বঙ্গদর্শন পত্রিকাকে কেউ কেউ প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেন, কিন্তু সবুজপত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য দেখলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘ভাবী পত্রিকাটি হবে বিশিষ্ট সাহিত্য পত্রিকা, মুনাফার লোভ থাকবে না এতে। আয়তনেও ছোট হবে।’ রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পত্রিকাটির নাম ‘কনিষ্ঠ’ রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়সহ যাঁরা সম্পাদনা পরিষদে ছিলেন তাঁরা ওই নামটি গ্রহণ করেননি। রবীন্দ্রনাথ সবুজকে তারুণ্যের প্রতীক ধরে নিয়ে লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সবুজের অভিযান’, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল সবুজপত্রের প্রথম সংখ্যাতেই। সবুজপত্র প্রকাশিত হয়েছিলো ২৫ শে বৈশাখ, ১৩২১ বঙ্গাব্দে (১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ)।
সবুজপত্রের ভাষা ছিল সাধারণের ভাষা। এ নিয়ে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা ছিল। কিন্তু সবুজপত্র তাতে দমে যায়নি। এই পত্রিকা এবং লেখালেখির জন্যই প্রমথ চৌধুরী সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। ‘ঠাকুমার ঝুলি’ খ্যাত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র একবার সবুজপত্রে লেখা পাঠিয়েছেন, কিন্তু ছাপা হতে দেরি হচ্ছে। কেন দেরি হচ্ছে এই মনঃকষ্টে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একসময়ে রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কোনো সাময়িকী বা সাহিত্য পত্রিকায় লিখবেন না। কিন্তু সবুজপত্রের কারণে রবীন্দ্রনাথ তার সিদ্ধান্ত বদলাতে অনেকটা বাধ্যই হয়েছিলেন। চলিত গদ্যরীতির ব্যাপারে প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্রের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সাহিত্যকে গুরুগম্ভীর ও ভারমুক্ত করে প্রাঞ্জল করে তোলা, জীবনমুখী করা। সবুজপত্র কেবল চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারেই সচেষ্ট ছিল না, বরং সাহিত্য নিয়ে তাদের চিন্তাটাও ভিন্ন ছিল। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র মনে করতেন তাই লেখা উচিত, যা মানবজাতির মঙ্গলসাধন করতে পারে বা সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে। প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্র বঙ্কিমচন্দ্রের এই মতের সাথে একমত ছিল না। তাদের মতে, সাহিত্য আর শিক্ষা এক বস্তু না।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসঙ্গ যেহেতু এল, তার ‘রচনার শিল্পগুণ’ প্রবন্ধটি সাহিত্যের ছাত্র মাত্রেই কমবেশি পড়েছেন। এই রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র প্রাঞ্জলতার ওপর খুব জোর দিয়েছেন। কিন্তু পাঠক জানেন বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা কতটা গুরুগম্ভীর, তৎসম শব্দে ভরা। প্রমথ চৌধুরী এই ধারাটাকেই ভাঙতে চেয়েছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতা হলো বঙ্কিমচন্দ্র বা মাইকেল মধুসূদনের সময়ে বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দের ব্যবহার ছিল ৬০ শতাংশ, যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ৪০ শতাংশেরও নীচে নেমে আসে। অর্থাৎ, চলিত রীতি প্রসারের যে উদ্যোগ প্রমথ চৌধুরী গ্রহণ করেছিলেন, সবুজপত্রের মাধ্যমে তা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় রূপ নেয়।
প্রমথ চৌধুরী যেহেতু রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন তাই তিনি ঝুঁকে পড়েন রাজনীতিতে। রাজনীতির প্রতি তাঁর আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবুজপত্র প্রকাশের পাঁচ বছরের মাথায় তিনি পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র বন্ধ করার পক্ষে ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টাতেই সবুজপত্র বন্ধ হতে পারেনি। পরবর্তীতে সবুজপত্রের সম্পাদক হন সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। কিন্তু তত দিনে বিশ্বযুদ্ধ, অসহযোগ আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, রবীন্দ্রনাথের ‘নাইট উপাধি’ বর্জনসহ নানা পরিস্থিতিতে ১০ বছরের আয়ু নিয়ে বন্ধ হয়ে যায় সবুজপত্র। সবুজপত্রের দশ বছরের যে আয়ুষ্কাল, তাকে সফল বলতেই হবে। সবুজপত্রের মোট ১০৮টি সংখ্যা যাতে ১১৩ জন লেখকের ৩১৪টি প্রবন্ধ, ১১০টি কবিতা, ৩১টি নিবন্ধ,৬টি সমালোচনা, ৩টি গান, ৮২টি গল্প, ৬টি নাটক এবং ২টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
১৯১৪ সালে সবুজপত্র প্রকাশের পূর্বে ১৯০২ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরী বীরবল ছদ্মনামে চলিত ভাষার পক্ষে কলম ধরেছিলেন। বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে গদ্য রচনার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ক্রিস্টোফার হেলিস বলেছিলেন, ‘‘He wrote thus because he thought thus. He wrote thus because he could not write otherwise. ” এই বক্তব্যটি প্রমথ চৌধুরীর জন্য শতভাগ সঠিক। আবার সবুজপত্রের দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই তিনি গল্প লেখা শুরু করেন। ‘চার ইয়ারি কথা’, ‘আহুতি’, ‘বড়বাবুর বড়দিন’ প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো তাকে গল্পকারের খ্যাতিও এনে দেয়। আবার তার কবিতাগুলোকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ইস্পাতের ছুরি। অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তার সম্পর্কে বলেছিলেন ‘তিনি আসলে পূর্ব বা পশ্চিম কোনো বঙ্গের লোক ছিলেন না। তিনি বিদ্যানগরের বিদগ্ধ নাগরিক ছিলেন। রাণী ভিক্টোরিয়া শাসিত ভারত সাম্রারাজ্যের প্রজা নন, কালিদাসের উজ্জয়িনী ও পেরিক্লিসের এথেন্স নগরের তিনি বাসিন্দা। এ কাল ও সেকালের জ্ঞানরাজ্যে তার অবাধ ভ্রমণের ছাড়পত্র ছিল। তিনি রাজলেখক।’ বলা বাহুল্য, প্রমথ চৌধুরী জন্মেছিলেন যশোরে, তবে তার পৈতৃক নিবাস পাবনা। বড় হয়েছেন কৃষ্ণনগরে, যৌবন কেটেছে কোলকাতা ও বিলেতে, আর বার্ধক্য শেষে মৃত্যুবরণ করেছেন শান্তিনিকেতনে। বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী রত্ন হয়েই আলো ছড়াবেন, বীরবল নামের সার্থকতা এখানেই।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক প্রমথ চৌধুরী। তাঁর অনেক অগ্রন্থিত লেখা এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা লেখাপত্র বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছেন মলয়েন্দু দিন্দা। তাঁর সংগৃহীত লেখাগুলো মন ফকিরা থেকে, প্রথম প্রকাশ পেয়েছে প্রমথ চৌধুরীর দুটি বই অগ্রন্থিত রচনা-১, অগ্রন্থিত রচনা-২ নামে। সেখান থেকেই প্রমথ চৌধুরীর প্রয়াণ দিবসে দুষ্প্রাপ্য ৩টি লেখা আজও প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় পুনঃপাঠ হিসেবে তুলে দেওয়া হলো আজকের পত্রিকার সাহিত্য পাতায়।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।’ প্রমথ চৌধুরী সবুজপত্র পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। চলিত রীতির প্রসারে সবুজপত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং ওই সময়ে সবুজপত্র এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে শিবরাম চক্রবর্তী ওই সময়কে চিহ্নিত করেছিলেন প্রমথ চৌধুরীর ‘বীরবলী আমল’ হিসেবে। বীরবল ছিল প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম।
সাহিত্যে আমাদের আদিরূপটি হলো কাব্য, গদ্য এসেছে অনেক পরে। বাংলা ভাষায় প্রথম যে গদ্যের নিদর্শন আমরা পাই, সেটি হলো ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আসামের রাজা কর্তৃক কোচবিহারে রাজার নিকট লেখা একটি পত্র। আসামের একটি পত্রিকা থেকে এই তথ্যটি জানা যায় ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে। আজকে ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রের কাছে ভাষার রূপ হলো এমন—মৌখিক ও লৈখিক। মৌখিক দুই ধরনের—আঞ্চলিক ও প্রমিত। একইভাবে লৈখিকও দুই ধরনের—সাধু ও চলিত। চলিত ভাষা সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা, সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। এই মৌখিক ভাষাকে বিশেষভাবে ‘চলিত ভাষা’ বলা হয়।’ উনিশ শতকের তৃতীয় দশকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে এ রীতির প্রথম ব্যবহার হয়। তারপর এই রীতির আরও বিকাশ ঘটান প্যারীচাঁদ মিত্র এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ। আর সবশেষে এ রীতির পূর্ণ সাহিত্যিক বিকাশ ঘটে প্রমথ চৌধুরীর হাতে। বিবর্তনের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে শ্রুতির যুগ পেরিয়ে সাহিত্য লিখিত রূপ পায়, বাংলা ভাষায় যার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ, এর অনেক পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গদ্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ছিল তৎসম শব্দে ঠাসা, সাধু ভাষা কিংবা এসবের সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ। সাধু ভাষার দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে আজকের গদ্য থিতু হয়েছে চলিত রীতিতে। এই চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠায় প্রমথ চৌধুরীর মাধ্যম ছিল সবুজপত্র। যার ফলস্বরূপ আমরা দেখি ১৯৭০-এর দশক থেকে চলিত গদ্যরীতি এক প্রকার স্বীকৃতি পেয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকা সাধু ভাষার বাইরে ভাবতেই পারত না। ৬০-এর দশকে তো স্কুল-কলেজের সব পাঠ্যবই উঁচু রীতির সাধু ভাষায় লেখা হতো।
প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ের। সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের জামাতা। সেই হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথেরও জামাতা। কিন্তু একই সময়ের হলেও, আত্মীয়তার বন্ধনজনিত কারণে কাছাকাছি থাকলেও প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে। নিজেই একটা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বরং রবীন্দ্রনাথই প্রমথ চৌধুরী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, বিশেষ করে ভাষার চলিত রীতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’, ‘সেঁজুতি’, ‘আকাশ প্রদীপ’, ‘শেষ লেখা’ প্রভৃতি রচনায় যে চলিত রীতি আমরা দেখি, তার পেছনে অবদান প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব। এ কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অকপটে স্বীকার করেছেন।
প্রমথ চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সমালোচক এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর সমালোচনা ছিল গঠনমূলক। এটা করতে গিয়ে তিনি যে ছদ্মনামটি ধারণ করেছিলেন তার সার্থকতাও প্রমাণিত হয়েছে। বীরবল সম্রাট আকবরের সভার নবরত্নের একজন। প্রমথ চৌধুরীও বাংলা সাহিত্যের একজন রত্ন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সম্রাট আকবরের বীরবল কেবল বিদূষকই ছিলেন না, একজন তুখোড় যোদ্ধাও ছিলেন। প্রমথ চৌধুরীও ছিলেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণকারী। বীরবল ছদ্মনাম কেন গ্রহণ করলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায় না। তবে তিনি একবার জানিয়েছিলেন, ‘আমি যখন দেশের লোককে রসিকতাচ্ছলে কতকগুলি সত্য কথা শোনাতে মনস্থ করি তখন আমি না ভেবে চিন্তে বীরবলের নাম অবলম্বন করলুম।’ পরবর্তী সময়ে তাঁর রচনাশৈলী ‘বীরবলী স্ট্যাইল’ নামে পরিচিত হলো। এই স্টাইলটাই হলো চলিত গদ্যরীতি, যা বাংলা সাহিত্যের গদ্য রচনায় বড় অবদান। যার ফলেই আজকে সর্বত্র চলিত রীতির ছড়াছড়ি। প্রসঙ্গত বলা যায়, বাংলাদেশের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক-এর সম্পাদকীয় লেখা হতো সাধু ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর চলিত রীতির প্রভাবের ফলে দীর্ঘদিন সাধু ভাষায় সম্পাদকীয় লেখা ইত্তেফাক ফিরে এসেছে চলিত ভাষায়। প্রমথ চৌধুরীর সময়কার অনেক লেখকই সে সময় আপত্তি তুলেছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সাধু ভাষার পক্ষে। তাঁর কাছে চলিত ভাষা ‘কঠিন’ মনে হয়েছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে জয়টা চলিত ভাষারই হয়েছে। যাঁরা চলিত ভাষার বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই পরবর্তীতে চলিত রীতিতে লিখেছেন। সেই সময়ে যাঁরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবতেন, তাঁরাই কেবল সাধু ভাষায় লিখতেন। তবে সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ, পরশুরাম, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ প্রমুখ লেখকেরা চলিত ভাষায় ফিরেছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতার জায়গা এইখানেই।
তবে প্রমথ চৌধুরীর এই প্রচেষ্টাকে বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে। আমরা জানি ভাষার সঙ্গে রাজনীতিও সংশ্লিষ্ট থাকে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর রাজনীতির প্রয়োজনেই শাসকগোষ্ঠীর ইংরেজি ভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষার এমন একটি রূপ দরকার ছিল, যেটি হবে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অক্ষয়কুমার দত্ত বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের মতো উঁচু বা মাঝারি রীতির নয়, বরং একটু সাদামাটা। আগে কী রূপ ছিল? তৎসম শব্দের আধিক্য, লৌকিক ক্রিয়াপদ ও বাগধারার ব্যবহার কম। এই ধারার পরিবর্তন করে ক্রিয়া, সর্বনাম, অনুসর্গের চেহারা বদল করা জরুরি ছিল। প্রমথ চৌধুরী নিজে ছিলেন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। ফলে চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি রাজনৈতিক বিষয়টাও আমলে নিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আসে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের কথা, যিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘বিশ্বকবি’ সম্বোধন করেছিলেন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ও ভেবেছিলেন সাদামাটা রীতির বাংলার কথা। এটা তিনি শুরু করেছিলেন সন্ধ্যা পত্রিকার মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে গিয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী এবং বাংলা গদ্যের চলিত রূপের পরিণতি দান করেছিলেন। এর আগে আমরা দেখেছি স্বামী বিবেকানন্দ ‘বাঙালা ভাষা’ প্রবন্ধে চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারে জোর দিয়ে বলেছেন। রাজনীতির কারণে যেমনি চলিত রীতি প্রয়োজন ছিল, তেমনি ধর্ম প্রচারের জন্যও এটার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন স্বামী বিবেকাননন্দ, কেশবচন্দ্র প্রমুখ।
বীরবল তথা প্রমথ চৌধুরী চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্ল্যাটফর্মটি বেছে নিয়েছিলেন, সেটি হলো সাহিত্য পত্রিকা সবুজপত্র। বাংলা সাহিত্যে ছোট কাগজের যে ধারণা সেটা শুরু হয়েছিল সবুজপত্র দিয়ে। যদিও বঙ্গদর্শন পত্রিকাকে কেউ কেউ প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেন, কিন্তু সবুজপত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য দেখলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘ভাবী পত্রিকাটি হবে বিশিষ্ট সাহিত্য পত্রিকা, মুনাফার লোভ থাকবে না এতে। আয়তনেও ছোট হবে।’ রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পত্রিকাটির নাম ‘কনিষ্ঠ’ রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়সহ যাঁরা সম্পাদনা পরিষদে ছিলেন তাঁরা ওই নামটি গ্রহণ করেননি। রবীন্দ্রনাথ সবুজকে তারুণ্যের প্রতীক ধরে নিয়ে লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সবুজের অভিযান’, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল সবুজপত্রের প্রথম সংখ্যাতেই। সবুজপত্র প্রকাশিত হয়েছিলো ২৫ শে বৈশাখ, ১৩২১ বঙ্গাব্দে (১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ)।
সবুজপত্রের ভাষা ছিল সাধারণের ভাষা। এ নিয়ে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা ছিল। কিন্তু সবুজপত্র তাতে দমে যায়নি। এই পত্রিকা এবং লেখালেখির জন্যই প্রমথ চৌধুরী সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। ‘ঠাকুমার ঝুলি’ খ্যাত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র একবার সবুজপত্রে লেখা পাঠিয়েছেন, কিন্তু ছাপা হতে দেরি হচ্ছে। কেন দেরি হচ্ছে এই মনঃকষ্টে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একসময়ে রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কোনো সাময়িকী বা সাহিত্য পত্রিকায় লিখবেন না। কিন্তু সবুজপত্রের কারণে রবীন্দ্রনাথ তার সিদ্ধান্ত বদলাতে অনেকটা বাধ্যই হয়েছিলেন। চলিত গদ্যরীতির ব্যাপারে প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্রের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সাহিত্যকে গুরুগম্ভীর ও ভারমুক্ত করে প্রাঞ্জল করে তোলা, জীবনমুখী করা। সবুজপত্র কেবল চলিত রীতি প্রয়োগের ব্যাপারেই সচেষ্ট ছিল না, বরং সাহিত্য নিয়ে তাদের চিন্তাটাও ভিন্ন ছিল। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র মনে করতেন তাই লেখা উচিত, যা মানবজাতির মঙ্গলসাধন করতে পারে বা সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে। প্রমথ চৌধুরী বা সবুজপত্র বঙ্কিমচন্দ্রের এই মতের সাথে একমত ছিল না। তাদের মতে, সাহিত্য আর শিক্ষা এক বস্তু না।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রসঙ্গ যেহেতু এল, তার ‘রচনার শিল্পগুণ’ প্রবন্ধটি সাহিত্যের ছাত্র মাত্রেই কমবেশি পড়েছেন। এই রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র প্রাঞ্জলতার ওপর খুব জোর দিয়েছেন। কিন্তু পাঠক জানেন বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা কতটা গুরুগম্ভীর, তৎসম শব্দে ভরা। প্রমথ চৌধুরী এই ধারাটাকেই ভাঙতে চেয়েছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সফলতা হলো বঙ্কিমচন্দ্র বা মাইকেল মধুসূদনের সময়ে বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দের ব্যবহার ছিল ৬০ শতাংশ, যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ৪০ শতাংশেরও নীচে নেমে আসে। অর্থাৎ, চলিত রীতি প্রসারের যে উদ্যোগ প্রমথ চৌধুরী গ্রহণ করেছিলেন, সবুজপত্রের মাধ্যমে তা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় রূপ নেয়।
প্রমথ চৌধুরী যেহেতু রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন তাই তিনি ঝুঁকে পড়েন রাজনীতিতে। রাজনীতির প্রতি তাঁর আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবুজপত্র প্রকাশের পাঁচ বছরের মাথায় তিনি পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র বন্ধ করার পক্ষে ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টাতেই সবুজপত্র বন্ধ হতে পারেনি। পরবর্তীতে সবুজপত্রের সম্পাদক হন সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। কিন্তু তত দিনে বিশ্বযুদ্ধ, অসহযোগ আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, রবীন্দ্রনাথের ‘নাইট উপাধি’ বর্জনসহ নানা পরিস্থিতিতে ১০ বছরের আয়ু নিয়ে বন্ধ হয়ে যায় সবুজপত্র। সবুজপত্রের দশ বছরের যে আয়ুষ্কাল, তাকে সফল বলতেই হবে। সবুজপত্রের মোট ১০৮টি সংখ্যা যাতে ১১৩ জন লেখকের ৩১৪টি প্রবন্ধ, ১১০টি কবিতা, ৩১টি নিবন্ধ,৬টি সমালোচনা, ৩টি গান, ৮২টি গল্প, ৬টি নাটক এবং ২টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
১৯১৪ সালে সবুজপত্র প্রকাশের পূর্বে ১৯০২ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরী বীরবল ছদ্মনামে চলিত ভাষার পক্ষে কলম ধরেছিলেন। বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে গদ্য রচনার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ক্রিস্টোফার হেলিস বলেছিলেন, ‘‘He wrote thus because he thought thus. He wrote thus because he could not write otherwise. ” এই বক্তব্যটি প্রমথ চৌধুরীর জন্য শতভাগ সঠিক। আবার সবুজপত্রের দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই তিনি গল্প লেখা শুরু করেন। ‘চার ইয়ারি কথা’, ‘আহুতি’, ‘বড়বাবুর বড়দিন’ প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো তাকে গল্পকারের খ্যাতিও এনে দেয়। আবার তার কবিতাগুলোকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ইস্পাতের ছুরি। অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তার সম্পর্কে বলেছিলেন ‘তিনি আসলে পূর্ব বা পশ্চিম কোনো বঙ্গের লোক ছিলেন না। তিনি বিদ্যানগরের বিদগ্ধ নাগরিক ছিলেন। রাণী ভিক্টোরিয়া শাসিত ভারত সাম্রারাজ্যের প্রজা নন, কালিদাসের উজ্জয়িনী ও পেরিক্লিসের এথেন্স নগরের তিনি বাসিন্দা। এ কাল ও সেকালের জ্ঞানরাজ্যে তার অবাধ ভ্রমণের ছাড়পত্র ছিল। তিনি রাজলেখক।’ বলা বাহুল্য, প্রমথ চৌধুরী জন্মেছিলেন যশোরে, তবে তার পৈতৃক নিবাস পাবনা। বড় হয়েছেন কৃষ্ণনগরে, যৌবন কেটেছে কোলকাতা ও বিলেতে, আর বার্ধক্য শেষে মৃত্যুবরণ করেছেন শান্তিনিকেতনে। বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী রত্ন হয়েই আলো ছড়াবেন, বীরবল নামের সার্থকতা এখানেই।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৬ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১১ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৬ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আ
০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১১ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৬ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৭ দিন আগেনিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আ
০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৬ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৬ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আ
০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৬ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১১ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও লেখক প্রমথ চৌধুরী যে কারণে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, সেটি হলো চলিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল সবুজপত্র সাহিত্য পত্রিকা। এই কাজটিতেও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আ
০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৬ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১১ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৬ দিন আগে