Ajker Patrika

শিশুদের জন্য হুমায়ূন আহমেদ

জাহীদ রেজা নূর
আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০২২, ১০: ১০
শিশুদের জন্য হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা মূলত বড়দের জন্য তাঁর লেখালেখির কারণে। পরে টেলিভিশনে নাটক লিখে, প্রযোজনা করে, চলচ্চিত্র তৈরি করেও তিনি দর্শকদের ভালোবাসা পেয়েছেন। কিন্তু হ‌ুমায়ূনের শিশুসাহিত্য নিয়ে আলোচনা হয়েছে খুব কম।

শিশুদের মানস গঠন বলতে নানা জন নানা কিছু বোঝেন। মার্ক টোয়েন, লুইস ক্যারল, সুকুমার রায়দের যেমন একটা ননসেন্স জগৎ আছে, তেমনি চার্লস ডিকেন্স, রবার্ট লুই স্টিভেনসনদের রয়েছে আলাদা জগৎ। অন্যদিকে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনরাও আলাদা। শিশুর ভাবনা জগৎটির জন্য যে জায়গাটুকু গড়ে দেওয়া দরকার, তা নিয়েই তো শিশুসাহিত্যিকদের কাজ।

হুমায়ূন আহমেদ শিশুসাহিত্য রচনায় কোন দলভুক্ত, তা নিয়ে মন্তব্য করার চেয়ে তাঁর কয়েকটি লেখা নিয়ে কথা বলাই ভালো হবে।

পড়তে শুরু করলেই মনে হয়, ‘ইশ্‌! কানী ডাইনীটার জন্য কি যে মায়া লাগে!’
লাগবে না! ও তো সব মন্ত্র ভুলে বসে আছে। কাউকে ভয় দেখাতে পারে না, কাউকে শাস্তি দিতে পারে না! এক মন্ত্র বলতে গিয়ে আরেক মন্ত্র বলে বসে! এই যেমন, প্রচণ্ড খিদেয় কাহিল হয়ে খাবার-দাবারের মন্ত্রটা বলতে গেল: 

ইরকিম বিরকিম
নাগা খিরকিম
এলট বেলট ইলবিল ঝাঁ
পোলাও কোরমা এসে যা! 

 কিন্তু পোলাও আসে না, কোরমাও আসে না! আসবে কী করে? ও তো এক শব্দের জায়গায় অন্য শব্দ বলেছে। মন্ত্র-টন্ত্র ভুলে কানী ডাইনীটা না খেয়েই মারা যেত। কিন্তু মৌ নামের এক মিষ্টি মেয়ে কটক পাহাড়ে গিয়ে ডাইনীটাকে দেখে বুঝতে পারে, এই বুড়ো বয়সে ডাইনীটা আসলে কারও কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তাই বুড়িটাকে বাড়িতে নিয়ে আসাই ভালো। যেই ভাবা সেই কাজ, কটক পাহাড়ের ত্রাস এই ডাইনী চলে এল মৌদের বাড়ি, বাচ্চারা সবাই ডাইনীর কাছে গল্প শোনে। ভয়ের গল্পেও বাচ্চারা আর ভয় পায় না!

এটা হুমায়ূন আহমেদের ‘কানী ডাইনী’ নামের রূপকথার গল্প।

লক্ষ করলেই দেখা যাবে, রূপকথার দৈত্য, ডাইনি, ভূতেরা হুমায়ূন আহমেদের গল্পে এমনভাবে ঢুকে পড়ে, যেন মনেই হয় না ওরা রূপকথা থেকে উঠে এসেছে। মনে হয়, ওরা আমাদের আশপাশেই বসবাস করে। নীলগঞ্জ হাইস্কুলের ড্রিল স্যার ইয়াকুব আলীর কথাটাই ধরা যাক। বেঁটেখাটো মানুষটা ভয়ংকর রোগা। ড্রিল স্যাররা তো একেকজন বডিবিল্ডারের মতো হন। অসুখ কাকে বলে তাঁরা তা জানেনই না। কিন্তু এই ইয়াকুব আলী বছরের বেশির ভাগ সময়ই রোগে ভুগতেন। ছাত্রদের ইয়াকুব স্যার ব্যায়াম করান কবিতার সুরে সুরে। এই যেমন প্রাইমারি সেকশনের ব্যায়ামের কবিতাগুলো এ রকম:

বায়ু বহে ভীম বেগে শব্দ শন শন
এইবার দাও দেখি পাঁচ বুক ডন

পাঁচবার বুকডনের পর আবার কবিতা: 

দেখ দেখ উড়ে যায় সাদা সাদা বক
এইবার দাও দেখি দশ বৈঠক। 

অর্থাৎ এবার দশটা বৈঠক দিতে হবে। এভাবেই এগিয়ে চলে ব্যায়াম। সেই ইয়াকুব স্যারের কাছেই কিনা এসে হাজির হলো আমগাছের ভূত! এই ভূতটির খুব ইচ্ছে তার ছেলেকে ব্যায়াম শেখাবে।

ব্যায়াম করলে ছেলের ওজন বাড়বে। তা না হলে লজ্জায় ওরা ভূতসমাজে মুখ দেখাতে পারছে না। ভূতদের প্রধান কাজই হচ্ছে মানুষকে ভয় দেখানো, কিন্তু এই ভূতের বাচ্চাটা ভয় দেখাবে কী, নিজেই ভয়ে মরে! জটিল সমস্যা, এই সমস্যা থেকে তো ভূতটাকে বাঁচাতে হয়! ভূতের অনুনয়-বিনয়ে ইয়াকুব আলীর মন গলল, সত্যিই তিনি ভূতের বাচ্চাকে ব্যায়াম শেখাতে লাগলেন।

হুমায়ূন আহমেদ ভূতেদের খাবারের কথা ভেবেছেন। ভূতদের খাবার হলো আলো। চাঁদের আলো খেতে সবচেয়ে ভালো লাগে। সূর্যের আলোও খাওয়া যায়, কিন্তু তা সহজে হজম হয় না। তারার আলো আর মোমবাতির আলো খেতে খুব ভালো। ইলেকট্রিক বাতির আলো খেতে একেবারেই টেস্ট নেই। খেলে অ্যালার্জি হয়। ইয়াকুব আলী এই ভূতের বাচ্চার নাম দিয়েছিলেন গোবর। ভূতটার 
নাম আসলে ‘ৎৎঘুঁত’। এই নামে কি কেউ কাউকে ডাকতে পারে? তাই ওর নাম হলো গোবর। গোবর মানে গোবর পালোয়ান, যিনি বিখ্যাত কুস্তিগির! বলে রাখি, হেডমাস্টারমশাই কীভাবে গাছের ওপরে উঠলেন, কেনই বা হেডমাস্টারমশাই গোবরকে স্কুল শেষ করিয়ে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিতে চাইছিলেন,
সে কথাগুলো জানা যাবে ‘গোবর বাবু’ 
গল্পটা পড়লেই। 
‘পুতুল’ বলে একটি গল্প আছে হুমায়ূন আহমেদের। পরে চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম এ গল্পটি নিয়ে ‘দূরত্ব’ নামে একটি সিনেমা তৈরি করেছেন। পুতুল নামের বড়লোক ছেলে হঠাৎ বাড়ির কাউকে না বলে চলে যায় পার্কে। সেখানে অন্তু নামে ওর বয়সী এক হতদরিদ্র ছেলের সঙ্গে দেখা হয়। দুজনের জীবন একেবারে দুই রকম। দুজন দুজনকে শুরুতে বুঝতেই পারে না। একটু বন্ধুত্ব হলে ওদের নিয়ে হ‌ুমায়ূন লিখলেন, ‘দুজনে ছোট ছোট পা ফেলে এগোচ্ছে। পুতুল লক্ষ করল, অন্তু গভীর মনোযোগের সঙ্গে রাস্তা থেকে সিগারেটের প্যাকেট কুড়িয়ে নিচ্ছে।’
‘ওইগুলো দিয়ে তুমি কী করবে?’ 
‘খেলুম।’ 
‘কী খেলা?’ 
‘চাড়া খেলা। সিগারেটের প্যাকেট হইল ট্যাকা। ফাইভ ফাইভের প্যাকেট হইল পাঁচ শ ট্যাকা, স্টার হইল দশ ট্যাকা, আর বেনসন হইল হাজার ট্যাকা।’ 
‘সত্যি?’ 

বলতে বলতেই পুতুল একটা ফাইভ ফাইভের প্যাকেট পেয়ে গেল। কী অদ্ভুত উত্তেজনা! 
যাঁরা একসময় চাড়া খেলেছেন, তাঁরা এই বর্ণনায় নস্টালজিক হয়ে যেতে পারেন। আগের দুটো কাহিনি থেকে এই কাহিনি ভিন্নতর। বাস্তব এসে শরীরে ছ্যাঁকা দেয়।

ছড়াও লিখেছেন তিনি। কয়েকটি ছড়ার কয়েকটি পঙ্‌ক্তি পড়া হোক: ‘বরিশালের আমড়া/বসে বসে কামড়া।’ কিংবা ‘আমি এক রূপবতী/কেশবতী মায়াবতী/কলাবতী কন্যা আমার নাম/আমায় দেখে লজ্জা পায়/ফুলগুলি সব মুখ লুকায়/আমার মতো কে আছে কোথায়? 
‘আকাশপরী আকাশপরী/কাঁদছে আমার মন/এসো তুমি আমার ঘরে/রইল নিমন্ত্রণ।’ 
হ‌ুমায়ূনের মনকাড়া শিশুসাহিত্য নিয়ে লিখলেই তো হবে না, শিশুদের হাতে তুলে দিতে হবে তাঁর বইগুলো। দেখা যাবে, সেই বইগুলো দিয়েই শিশু গড়ে নিতে পারছে তার নিজের জগৎ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ৪ বিচারকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল যুক্তরাষ্ট্র

প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার পর যা বলল ইইউ

আপনাদের সঙ্গে হাত মেলাব না, বিস্ফোরক তামিম

কাগজে-কলমে মেয়র হওয়ায় দায়িত্ব পালন করলাম: জাতীয় ঈদগাহ পরিদর্শন শেষে ইশরাক

এপ্রিলে নির্বাচন ঘোষণায় বিএনপি ও জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি: সালাহউদ্দিন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত