নওশাদ জামিল

সেই দিনের কথা, সেই সকালের কথা মাঝেমধ্যেই জ্বলজ্বল করে মনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টায় আসার কথা তাঁর। তবে এর আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে। উপস্থিত হয়েছিলাম আমরা কয়েকজন সাংবাদিক ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ। ঠিক সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে দৃপ্ত পায়ে উপস্থিত হলেন এক চিরসবুজ নায়ক। পরনে তাঁর জিনস প্যান্ট, নীল রঙের হাফহাতা শার্ট। সৌম্যকান্তি চেহারার ৮০ পেরোনো সেই তরুণের নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়! সেমিনার হলে ঢুকেই তিনি বললেন, ‘সুপ্রভাত! বাংলাদেশে এলেই মনটা ভালো হয়ে যায় আমার। কেননা, এই বাংলাদেশের সাথেই তো আমার নাড়ির সংযোগ। তাই সব সময়ই এ দেশের প্রতি নাড়ির টান অনুভব করি।’
অভিনয় কিংবা আবৃত্তি করতে নয়, আমাদের সঙ্গে আলাপচারিতা, বলা যায় আড্ডা দিতেই শিল্পকলা একাডেমিতে হাজির হয়েছিলেন দুই বাংলার কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেদিন সেই আলাপচারিতায়, আড্ডায় প্রাণোচ্ছল ভঙ্গিমায় তিনি বলেছিলেন তাঁর ব্যক্তি ও শিল্পীজীবনের নানা অজানা কথা। বলেছিলেন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ভালোবাসার কথা, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগের কথা। বলেছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের চলচ্চিত্র, নাটক, সংস্কৃতি নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা।
১৯৫৯ সালে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে অভিনয়জগতে পথচলা শুরু করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তারপর ইতিহাস, তাঁর হিরণ্ময় পথচলা। বিস্ময়কর সাফল্য, মুগ্ধকর সব অর্জন। সৌমিত্র প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করেছিলেন, যার ফলে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, শুধুই সামনে চলা শুরু হয়ে যায় তাঁর। শুরু হয়ে যায় শিল্পের নানা মাধ্যমে তাঁর পদচারণ। সৌমিত্রের সেই পথচলা থেমে যায় ২০২০ সালের এই দিনে। আজ ১৫ নভেম্বর, মঙ্গলবার তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। দুই শতাধিক চলচ্চিত্র, নাটকে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র, মঞ্চ নাটক, টিভি নাটকসহ শিল্পের নানা মাধ্যমে কাজ করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশ ও ভারতের সুধী মহলে উচ্চ প্রশংসিত তাঁর নাট্যাভিনয়, পরিচালনা ও রচনা। অভিনয়, আবৃত্তির পাশাপাশি তিনি একজন কবিও। তাঁর কাব্যচর্চার ফসল পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ। এ ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন, কাজ করেছেন শিল্প-সংস্কৃতির নানা অঙ্গনে। অভিনয়ের জন্য ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন। দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডিলিটসহ নানা পুরস্কার। ফরাসি সরকারের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩ বছর। তরুণ বয়সে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সময় সৌমিত্র যতটা আকর্ষণীয় ছিলেন, ৮০ বছর বয়সে ‘অহল্যা’ শর্ট ফিল্মে অভিনয়েও ততটাই। কী চমৎকার করে যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কথা বলতেন, কী শুদ্ধভাবে ও সঠিক উচ্চারণে! আহা! আমরা মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনেছিলাম, তন্ময় হয়ে তাঁকে দেখেছিলাম। কিংবদন্তি অভিনেতার সান্নিধ্য পেয়ে আনন্দ-আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম।
পরিচয়ের পর্ব শেষে শুরু হয় আড্ডা ও আলাপন। ঘড়ির কাঁটা তখন বেলা ১১টায়। আমাদের আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। সূচনা পর্বে গোলাম কুদ্দুছ ভাই প্রশ্ন করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। পর্যায়ক্রমে আমি তাঁকে নানা প্রশ্ন করি, প্রশ্ন করে আমার কয়েকজন বন্ধু ও কয়েকজন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও।
পাক্কা দুই ঘণ্টার আলাপচারিতা। মাঝে চা-কফির আপ্যায়ন। মাঝেমধ্যে হাস্যরস, কৌতুক, সিরিয়াস সব কথাবার্তাও। আড্ডা-আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মেলে ধরেন নিজের মনের জানালা, খুলে দেন তাঁর ঘরে-বাইরের চালচিত্র। উন্মোচন করে যেন ঢেলে দেন কথার ফোয়ারা।
গোলাম কুদ্দুছ ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র বলেন, ‘আমার বাবা একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর। কিন্তু তখনো অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রশ্নটি ওঠেনি। এ কারণেই হয়তো বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন বাবা। কিন্তু একান্ত নিমগ্নতায় বাবাকে অভিনয় আর আবৃত্তিটাই করতে দেখেছি। প্রথম জীবনে বাবার কাছ থেকেই আবৃত্তি শিখেছি। বাবা আমাকে বোঝাতেন কীভাবে অভিনয় করতে হয়, আবৃত্তি করতে হয়। ছোটবেলায় বাবা জোরে উচ্চারণ করে বোঝাতেন সঠিক উচ্চারণবিধি, বোঝাতেন আবৃত্তির কলাকৌশল। মূলত বাবাকে দেখেই একসময় অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। পরে কলকাতায় শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। তারপর তো অভিনয় হয়ে ওঠে আমার জীবনের আরাধ্য।’
আপনি যদি অভিনেতা না হতেন, তাহলে কী হতেন—আমার এ রকম সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘চলচ্চিত্র ও মঞ্চ দুটিই আমার প্রিয় মাধ্যম। অভিনেতা পরিচয়ই প্রধান পরিচয়। যদি আমি অভিনয় না করতাম, অভিনেতা না হতাম, তাহলে হয়তো আবৃত্তিকার হতাম। কিংবা কবি ও লেখক হতাম।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে একজন চমৎকার আবৃত্তিশিল্পী ও কবি, সেটা স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি শিশুর মতো স্বর্গীয় হাসিতে উজ্জ্বল করে দেন শিল্পকলা একাডেমির ছোট্ট সেমিনার হল। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘আমি কবিতা লিখতে পছন্দ করি, কবিতা আবৃত্তি করতেও পছন্দ করি। কিন্তু আমাকে তো সবাই চেনে অভিনেতা হিসেবেই। কবি হিসেবে তো নামডাক নেই!’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাকি ছোটবেলায় সারাক্ষণ হীনম্মন্যতায় ভুগতেন! যাঁরা ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে ২৩ বছরের সুদর্শন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখেছেন, তারা কি কখনো ভাবতে পেরেছেন, এই মানুষটিই তরুণ বয়সে নিজের চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চমৎকার হাস্যরসের মধ্য দিয়ে শোনালের জীবনের কথা। অভিনয়জীবনের শুরুর দিকের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘অভিনয় যে করব, এই অঙ্গনের মানুষের ভালোবাসা কাড়ব, তা কখনো ভাবিনি। আমার ভেতরে একটা হীনম্মন্যতা ছিল। আর সেটা ছিল আমার চেহারা নিয়ে! একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতার মুখে এ কথা শুনে হয়তো হাসবেন। তবে এর কারণ ছিল। অল্প বয়সে টাইফয়েড হয়েছিল। খুব রুগ্ণ ছিলাম। বাড়ির লোকেরা বলত, ছেলেটা কালো, হ্যাংলা-পাতলা! ব্যঙ্গ করে প্রায়ই বলত, তোর তো চেহারা নেই। নাক-চোখ-মুখেরও তেমন সুন্দর আদল নেই। ছোটবেলায় তা শুনে সংকুচিত হতাম। খেলাধুলো খুব করতাম, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো ছিলাম না। ভালো ছাত্রও ছিলাম না। তবে আমার অভিনয় দেখে অনেকেরই ভালো বলত। অভিনয়ে তো নিজেকে আড়াল করা যায়। নিজেকে আড়াল করার জন্যই অভিনয়ে এসেছিলাম।’
সৌমিত্রের বাবা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় পেশায় উকিল হলেও ভালোবাসতেন আবৃত্তি, নাটক, গান। বাবার কণ্ঠে আবৃত্তি শুনেই ছেলেবেলা পার করেছেন সৌমিত্র। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার আবৃত্তি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কবিতা পড়লে তিনি দেখিয়ে দিতেন কীভাবে পড়তে হয়। কীভাবে সঠিক ও শুদ্ধ উচ্চারণ করতে হয়।’
আড্ডা-আলাপচারিতায় একে একে চলতে থাকে কৌতূহলোদ্দীপক নানা প্রশ্ন। আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাট্যজন সৈয়দ হাসান ইমাম, নাট্যজন কেরামত মওলা, অভিনেতা ও নাট্যজন ড. ইনামুল হকসহ অনেকেই।
অভিনয়ের প্রেমে কীভাবে পড়লেন জানতে চাইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কলকাতায় বিখ্যাতদের অভিনয় দেখতাম ছোটবেলা থেকেই। শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। তারপর তাঁর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল। প্রায় তিন বছর তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। থিয়েটার নিয়ে আমার চিন্তাভাবনার ভিত তৈরি হয়েছিল তাঁর কাছ থেকেই। সত্যজিৎ রায় তখন ‘পথের পাঁচালী’ তৈরি করেছেন। এর সিক্যুয়াল ‘অপরাজিতা’ তৈরি করবেন তিনি। তাঁর এক সহকারীর কাছে শুনেছিলাম এসব। শিশিরকুমার ভাদুড়ি একদিন সত্যজিৎ রায়ের বাসায় নিয়ে যান। তখনই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে খানিকটা আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। তিনি যেন সারাক্ষণ মনে মনে অভিনেতাকে খুঁজতেন। চলচ্চিত্রের সঙ্গে মানানসই মুখ খুঁজতেন। আমি তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজ করি।’
কিছুক্ষণ পর হাসতে হাসতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘সামান্য পরিচয় ও দেখা-সাক্ষাতে আমাকে যে সত্যজিৎ রায় মনে রেখেছিলেন, সেটা ভাবতে পারিনি। তার পরের ছবি ছিল তৃতীয় সিক্যুয়াল ‘অপুর সংসার’। সেই চলচ্চিত্রের জন্য খুঁজছিলেন অভিনেতা। হঠাৎ একদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। নিজের গাড়ি করে নিয়ে গেলেন তাঁর অন্য একটি ছবির শুটিং দেখাতে। সেখানেই সত্যজিৎ রায় নামকরা অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যান। তাঁকে বলেন, এ হচ্ছে অপুর সংসারের অপু। এর আগ পর্যন্ত জানতাম না যে আমিই অপুর সংসারের অপু হব।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সবিনয়ে আমি জানতে চাই প্রথম ক্যামেরার সামনে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা। স্মৃতিচারণ করে সৌমিত্র বলেন, ‘মঞ্চে টুকটাক কাজ করলেও ক্যামেরার সামনে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। শিশিরকুমার ভাদুড়ির কাছেই প্রথম শুনেছিলাম যে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের কাজে কিছু তফাত থাকে। অবশ্য শিশিরকুমার নিজে চিত্রাভিনয়ে তেমন আকৃষ্ট হননি। তাঁর ভালো লাগেনি, মঞ্চেই চলে এসেছিলেন। চিত্রাভিনয়ের খুঁটিনাটি দিক নিয়ে তখন ভাবতাম। নিয়মিত চলচ্চিত্র দেখতাম। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিতা’ দেখলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম সত্যজিৎ রায়ের অভিনয়ের ধারা। বোঝার চেষ্টা করলাম তাঁর পরিচালনা ও ক্যামেরার কাজ। ফলে ‘অপুর সংসার’ করার আগে থেকেই সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কীভাবে কাজ করতে হবে, আমার ভেতরে তার একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়েছিল। ‘অপুর সংসার’-এর শুটিংয়ের অনেক আগে থেকেই সত্যজিৎ রায় আমাকে নিয়ে যেতেন নানা জায়গায়, বিভিন্ন বই পড়তে দিতেন, চলচ্চিত্র দেখতে বলতেন। তখন চিত্রনাট্যের খসড়াও আমাকে দিয়েছিলেন। চিত্রনাট্য পড়ে নিজের মতো প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। সত্যজিৎ রায় আগে থেকেই সব বোঝাচ্ছিলেন যেন ক্যামেরার সামনে আমার কোনো আড়ষ্টতা না থাকে। তখন তিনি আমার কিছু ক্যামেরার টেস্ট নিয়েছিলেন। ক্যামেরা জিনিসটা কী, চিনতে শিখিয়েছিলেন। ক্যামেরায় কীভাবে কাজ করতে হয় তা বুঝিয়েছিলেন। ফলে প্রথম শুটিং করতে গিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়নি।’
স্মৃতিময় আড্ডায় ও আলাপে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। আড্ডায় উঠে এল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কথাও। আলাপচারিতার এক ফাঁকে রামেন্দু মজুমদার বলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাট্যকার ও সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকার সম্পাদকও। কলকাতার বিখ্যাত ‘এক্ষণ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কবিতার চর্চা করছেন সেই ছোটবেলা থেকেই।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেকে আড়াল করার জন্য অভিনয়ে এসেছিলেন, কিন্তু কবিতায় কীভাবে এলেন—আমার এরকম প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র বলেন, ‘কবিতায় নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ এল কিশোর বয়সে। তখন মেয়েদের প্রতি ভালো লাগার ব্যাপারটা শুরু হয়। বিশেষ মেয়েকে ভালো লাগার বিষয়টা তো থাকে। তখন তো একটু হাত ধরতেও কত অপেক্ষা করতে হতো! নিজের কথা যেখানে বলা যাচ্ছে না, তার একটা উপায় হিসেবেই কবিতা লেখার শুরু। গোপন প্রেমিকার উদ্দেশ্যেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায় যেন হাসির ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায় সেমিনার হলে। একজন হাসতে হাসতে জানতে চান, যাকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লেখা শুরু, তাকে জীবনে পেয়েছিলেন কি?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও হাসির দীর্ঘ আভা ছড়িয়ে বলেন, যাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলাম, তাকে পেয়েছিলাম। তাঁর কথায় ও রসিকতায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলাম সবাই।
আমার এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে অতীতসাগরে ডুব দেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ডুবুরির মতো গভীর থেকে যেন তুলে আনেন তাঁর স্মৃতিগুচ্ছ। কবিতা লেখা ও বই পড়ার প্রতি নিজের ভালো লাগার কথা প্রকাশ করে সৌমিত্র বলেন, ‘আমার ভেতরে কবিতা লেখার তাগিদ টের পাই ছোটবেলায়। অভিনয়, আবৃত্তি, কবিতা—এসব শুরু করেছিলাম পারিবারিক সুন্দর একটা আবহে। কবিতা লেখার আগে থেকেই অভিনয়টার প্রতি টান ছিল। আবৃত্তির প্রতি অনুরাগ ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি অভিনয় করছি, আবৃত্তি করছি। কেননা, আমাদের বাড়িতে থিয়েটারের চর্চা ছিল। আবৃত্তির চর্চাও ছিল। কিশোর বয়সে আমার মধ্যে কবিতা লেখার ঝোঁক এসেছিল। মোটামুটি ষোলো বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। বেশির ভাগ বাঙালি ছেলে যেমন কিশোর বয়সে কবিতা লেখে, তেমনই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। কিশোর বয়সে অধিকাংশ বাঙালি ছেলেই প্রেমে পড়লে কবিতা লেখে, আমিও তেমনভাবে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। অবশ্য এটার পেছনেও অনুপ্রেরণা ছিল পরিবার। আমাদের বাড়িতে সাহিত্যের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা ছিল। আমার দাদু সাহিত্যচর্চা করতেন। আমার বাবা-মা সাহিত্য খুব ভালোবাসতেন। ছোটবেলা থেকে আমাদের বইটই পড়ার কোনো বাধানিষেধ ছিল না। অনেক বাঙালির বাড়িতে নানা রকম বাধা থাকে বাইরের বই পড়ার।আমাদের বাড়িতে তা ছিল না। বলা যায়, আমাকে বেশ উৎসাহ দিতেন বাবা-মা। ছোটবেলা থেকেই আমি বইয়ের পোকা ছিলাম। প্রচুর ছড়া ও কবিতা পড়তাম।’
আলাপের এক ফাঁকে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নাটক সম্পর্কে বলতে গিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কলকাতার নাটকের অবনমন হয়েছে। মান কমে গেছে। সিনেমারও একই অবস্থা। কলকাতায় এখন সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার রাজনীতিতে নোংরা জৌলুশ আছে। তরুণেরা বাংলা ভুলে যাচ্ছে, মিশ্র ভাষায় কথা বলছে। বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে কথা বলছে। বাঙালি জাতিটাকে টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশই। বাংলা ভাষাকে গৌরব দিয়েছে বাংলাদেশই।’
নাট্যজন কেরামত মওলার এক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিনয় ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না। অভিনয়ই তো আমাকে রুটি-রুজি দিয়েছে। আমাকে খ্যাতি ও সম্মান দিয়েছে, বিপুল মানুষের ভালোবাসা দিয়েছে।’
অভিনয়ের পাশাপাশি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাটকও লিখেছেন। নাটক লেখার বিষয়ে প্রশ্ন রামেন্দু মজুমদারের। উত্তরে গুণী এই অভিনেতা বলেন, ‘আসলে প্রয়োজনের তাগিদে নাটক লেখা শুরু করেছিলাম। নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিল রেখে জীবনের সঞ্চিত খাতায় অনেক নাটক লিখেছিলাম। কমবেশি অনেক নাটকই দর্শক ও শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে, মানুষের প্রশংসা পেয়েছে।’
নাটকের ভবিষ্যৎ কী—এমন প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিজ্ঞতা ও ত্যাগ কখনো বিফলে যায় না; যায়নি অতীতে, ভবিষ্যতেও যাবে না হয়তো। সেই সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের জীবনের সঙ্গে মিল রেখে কতটুকু প্রাসঙ্গিক আমাদের নাটক, সেটার ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করে। ভালো নাটক সব সময়ই বেঁচে থাকবে। ভালো নাটক মানুষ গ্রহণ করবেই।
একজন ভালো অভিনেতার গুণাবলি সম্পর্কে জানতে চাইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিনেতা হওয়া সহজ নয়। বড় সাধনার বিষয়। ভালো অভিনেতার কাছে মানুষ বিষয়, সমাজ বিষয়, রাষ্ট্রও বিষয়। যে অভিনেতা শুধু আত্মপ্রদর্শন করে, তাকে আমার বড় অভিনেতা মনে হয় না। বড় অভিনেতা তার অভিনয়ে সমাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গ দেখায়, মানুষকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি ভাবতে শেখায়।’
টিভি, চলচ্চিত্র ও মঞ্চ—এসব জায়গায় অভিনয় করতে গিয়ে নিজেকে কি আলাদা করে তৈরি করতে হয়—নাট্যব্যক্তিত্ব কেরামত মওলার প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রথমত অভিনয়, তারপর পরিবেশ বুঝে উপস্থাপন। এতে আমি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। যিনি ছবি আঁকেন, তিনি ছোট ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন, বড় ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন। সে-ই সত্যিকার অভিনেতা, যে সমাজের ভাবনাচিন্তা, অবস্থা অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারে।’
আমাদের আলাপে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নানা দিকও। উঠে এসেছিল দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের কথাও। পাশাপাশি দুই দেশ, পাশাপাশি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। ভাষা এক, সংস্কৃতিও এক। তার পরও দূরত্ব রয়ে গেছে অনেক জায়গায়। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর পথে আরও একটি বিষয় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারত, তা হলো বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে দেখার ব্যবস্থা করা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে সেটি নেই। এ বিষয়ে আমার এক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলাদেশের নাটক, চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতিকে খুব মিস করি। সাংঘাতিকভাবে মিস করি। এ দেশের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকলেও এ রকম একটি প্রতিবন্ধকতার কারণে সেটা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। এটার উত্তরণ জরুরি।’
আড্ডার এক ফাঁকে আবৃত্তিশিল্পী ও নাট্যনির্দেশক গোলাম সারোয়ার জানতে চান অভিনয়ে আবৃত্তিচর্চার প্রয়োজন আছে কি না। সৌমিত্রের জবাব, ‘অভিনয়ের জন্য আবৃত্তিরও ভীষণ দরকার। যাঁরা এটা বোঝেন না, তাঁরা এখনো চোখ বুজে আছেন। অভিনয়ের প্রারম্ভিক কাজ হলো কথা বলা, সেটা আবৃত্তিচর্চা ছাড়া হয় না। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আবৃত্তি ও গান করি। প্রতিদিন রেওয়াজ করি, সাধনা করি। জীবনে সফল হতে হলে তার কাজকে সাধনার পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটা অভিনয় হোক, আর আবৃত্তি হোক কিংবা যেকোনো মাধ্যমই হোক। একজন অভিনেতাকে চার অক্ষরের একটি শব্দ আঁকড়ে রাখতে হয়, সেটা হলো ভালোবাসা। নিজের কাজের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা থাকতে হবে। নিজের কাজ ও দায়িত্বের প্রতি ভালোবাসাই মানুষকে সাফল্য এনে দেয়, পৌঁছে দেয় সঠিক অবস্থানে। ভালোবাসা ছাড়া কিচ্ছু হয় না, হবেও না।’

সেই দিনের কথা, সেই সকালের কথা মাঝেমধ্যেই জ্বলজ্বল করে মনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টায় আসার কথা তাঁর। তবে এর আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে। উপস্থিত হয়েছিলাম আমরা কয়েকজন সাংবাদিক ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ। ঠিক সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে দৃপ্ত পায়ে উপস্থিত হলেন এক চিরসবুজ নায়ক। পরনে তাঁর জিনস প্যান্ট, নীল রঙের হাফহাতা শার্ট। সৌম্যকান্তি চেহারার ৮০ পেরোনো সেই তরুণের নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়! সেমিনার হলে ঢুকেই তিনি বললেন, ‘সুপ্রভাত! বাংলাদেশে এলেই মনটা ভালো হয়ে যায় আমার। কেননা, এই বাংলাদেশের সাথেই তো আমার নাড়ির সংযোগ। তাই সব সময়ই এ দেশের প্রতি নাড়ির টান অনুভব করি।’
অভিনয় কিংবা আবৃত্তি করতে নয়, আমাদের সঙ্গে আলাপচারিতা, বলা যায় আড্ডা দিতেই শিল্পকলা একাডেমিতে হাজির হয়েছিলেন দুই বাংলার কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেদিন সেই আলাপচারিতায়, আড্ডায় প্রাণোচ্ছল ভঙ্গিমায় তিনি বলেছিলেন তাঁর ব্যক্তি ও শিল্পীজীবনের নানা অজানা কথা। বলেছিলেন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ভালোবাসার কথা, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগের কথা। বলেছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের চলচ্চিত্র, নাটক, সংস্কৃতি নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা।
১৯৫৯ সালে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে অভিনয়জগতে পথচলা শুরু করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তারপর ইতিহাস, তাঁর হিরণ্ময় পথচলা। বিস্ময়কর সাফল্য, মুগ্ধকর সব অর্জন। সৌমিত্র প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করেছিলেন, যার ফলে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, শুধুই সামনে চলা শুরু হয়ে যায় তাঁর। শুরু হয়ে যায় শিল্পের নানা মাধ্যমে তাঁর পদচারণ। সৌমিত্রের সেই পথচলা থেমে যায় ২০২০ সালের এই দিনে। আজ ১৫ নভেম্বর, মঙ্গলবার তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। দুই শতাধিক চলচ্চিত্র, নাটকে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র, মঞ্চ নাটক, টিভি নাটকসহ শিল্পের নানা মাধ্যমে কাজ করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশ ও ভারতের সুধী মহলে উচ্চ প্রশংসিত তাঁর নাট্যাভিনয়, পরিচালনা ও রচনা। অভিনয়, আবৃত্তির পাশাপাশি তিনি একজন কবিও। তাঁর কাব্যচর্চার ফসল পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ। এ ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন, কাজ করেছেন শিল্প-সংস্কৃতির নানা অঙ্গনে। অভিনয়ের জন্য ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন। দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডিলিটসহ নানা পুরস্কার। ফরাসি সরকারের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩ বছর। তরুণ বয়সে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সময় সৌমিত্র যতটা আকর্ষণীয় ছিলেন, ৮০ বছর বয়সে ‘অহল্যা’ শর্ট ফিল্মে অভিনয়েও ততটাই। কী চমৎকার করে যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কথা বলতেন, কী শুদ্ধভাবে ও সঠিক উচ্চারণে! আহা! আমরা মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনেছিলাম, তন্ময় হয়ে তাঁকে দেখেছিলাম। কিংবদন্তি অভিনেতার সান্নিধ্য পেয়ে আনন্দ-আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম।
পরিচয়ের পর্ব শেষে শুরু হয় আড্ডা ও আলাপন। ঘড়ির কাঁটা তখন বেলা ১১টায়। আমাদের আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। সূচনা পর্বে গোলাম কুদ্দুছ ভাই প্রশ্ন করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। পর্যায়ক্রমে আমি তাঁকে নানা প্রশ্ন করি, প্রশ্ন করে আমার কয়েকজন বন্ধু ও কয়েকজন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও।
পাক্কা দুই ঘণ্টার আলাপচারিতা। মাঝে চা-কফির আপ্যায়ন। মাঝেমধ্যে হাস্যরস, কৌতুক, সিরিয়াস সব কথাবার্তাও। আড্ডা-আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মেলে ধরেন নিজের মনের জানালা, খুলে দেন তাঁর ঘরে-বাইরের চালচিত্র। উন্মোচন করে যেন ঢেলে দেন কথার ফোয়ারা।
গোলাম কুদ্দুছ ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র বলেন, ‘আমার বাবা একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর। কিন্তু তখনো অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রশ্নটি ওঠেনি। এ কারণেই হয়তো বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন বাবা। কিন্তু একান্ত নিমগ্নতায় বাবাকে অভিনয় আর আবৃত্তিটাই করতে দেখেছি। প্রথম জীবনে বাবার কাছ থেকেই আবৃত্তি শিখেছি। বাবা আমাকে বোঝাতেন কীভাবে অভিনয় করতে হয়, আবৃত্তি করতে হয়। ছোটবেলায় বাবা জোরে উচ্চারণ করে বোঝাতেন সঠিক উচ্চারণবিধি, বোঝাতেন আবৃত্তির কলাকৌশল। মূলত বাবাকে দেখেই একসময় অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। পরে কলকাতায় শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। তারপর তো অভিনয় হয়ে ওঠে আমার জীবনের আরাধ্য।’
আপনি যদি অভিনেতা না হতেন, তাহলে কী হতেন—আমার এ রকম সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘চলচ্চিত্র ও মঞ্চ দুটিই আমার প্রিয় মাধ্যম। অভিনেতা পরিচয়ই প্রধান পরিচয়। যদি আমি অভিনয় না করতাম, অভিনেতা না হতাম, তাহলে হয়তো আবৃত্তিকার হতাম। কিংবা কবি ও লেখক হতাম।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে একজন চমৎকার আবৃত্তিশিল্পী ও কবি, সেটা স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি শিশুর মতো স্বর্গীয় হাসিতে উজ্জ্বল করে দেন শিল্পকলা একাডেমির ছোট্ট সেমিনার হল। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘আমি কবিতা লিখতে পছন্দ করি, কবিতা আবৃত্তি করতেও পছন্দ করি। কিন্তু আমাকে তো সবাই চেনে অভিনেতা হিসেবেই। কবি হিসেবে তো নামডাক নেই!’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাকি ছোটবেলায় সারাক্ষণ হীনম্মন্যতায় ভুগতেন! যাঁরা ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে ২৩ বছরের সুদর্শন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখেছেন, তারা কি কখনো ভাবতে পেরেছেন, এই মানুষটিই তরুণ বয়সে নিজের চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চমৎকার হাস্যরসের মধ্য দিয়ে শোনালের জীবনের কথা। অভিনয়জীবনের শুরুর দিকের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘অভিনয় যে করব, এই অঙ্গনের মানুষের ভালোবাসা কাড়ব, তা কখনো ভাবিনি। আমার ভেতরে একটা হীনম্মন্যতা ছিল। আর সেটা ছিল আমার চেহারা নিয়ে! একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতার মুখে এ কথা শুনে হয়তো হাসবেন। তবে এর কারণ ছিল। অল্প বয়সে টাইফয়েড হয়েছিল। খুব রুগ্ণ ছিলাম। বাড়ির লোকেরা বলত, ছেলেটা কালো, হ্যাংলা-পাতলা! ব্যঙ্গ করে প্রায়ই বলত, তোর তো চেহারা নেই। নাক-চোখ-মুখেরও তেমন সুন্দর আদল নেই। ছোটবেলায় তা শুনে সংকুচিত হতাম। খেলাধুলো খুব করতাম, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো ছিলাম না। ভালো ছাত্রও ছিলাম না। তবে আমার অভিনয় দেখে অনেকেরই ভালো বলত। অভিনয়ে তো নিজেকে আড়াল করা যায়। নিজেকে আড়াল করার জন্যই অভিনয়ে এসেছিলাম।’
সৌমিত্রের বাবা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় পেশায় উকিল হলেও ভালোবাসতেন আবৃত্তি, নাটক, গান। বাবার কণ্ঠে আবৃত্তি শুনেই ছেলেবেলা পার করেছেন সৌমিত্র। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার আবৃত্তি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কবিতা পড়লে তিনি দেখিয়ে দিতেন কীভাবে পড়তে হয়। কীভাবে সঠিক ও শুদ্ধ উচ্চারণ করতে হয়।’
আড্ডা-আলাপচারিতায় একে একে চলতে থাকে কৌতূহলোদ্দীপক নানা প্রশ্ন। আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাট্যজন সৈয়দ হাসান ইমাম, নাট্যজন কেরামত মওলা, অভিনেতা ও নাট্যজন ড. ইনামুল হকসহ অনেকেই।
অভিনয়ের প্রেমে কীভাবে পড়লেন জানতে চাইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কলকাতায় বিখ্যাতদের অভিনয় দেখতাম ছোটবেলা থেকেই। শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। তারপর তাঁর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল। প্রায় তিন বছর তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। থিয়েটার নিয়ে আমার চিন্তাভাবনার ভিত তৈরি হয়েছিল তাঁর কাছ থেকেই। সত্যজিৎ রায় তখন ‘পথের পাঁচালী’ তৈরি করেছেন। এর সিক্যুয়াল ‘অপরাজিতা’ তৈরি করবেন তিনি। তাঁর এক সহকারীর কাছে শুনেছিলাম এসব। শিশিরকুমার ভাদুড়ি একদিন সত্যজিৎ রায়ের বাসায় নিয়ে যান। তখনই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে খানিকটা আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। তিনি যেন সারাক্ষণ মনে মনে অভিনেতাকে খুঁজতেন। চলচ্চিত্রের সঙ্গে মানানসই মুখ খুঁজতেন। আমি তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজ করি।’
কিছুক্ষণ পর হাসতে হাসতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘সামান্য পরিচয় ও দেখা-সাক্ষাতে আমাকে যে সত্যজিৎ রায় মনে রেখেছিলেন, সেটা ভাবতে পারিনি। তার পরের ছবি ছিল তৃতীয় সিক্যুয়াল ‘অপুর সংসার’। সেই চলচ্চিত্রের জন্য খুঁজছিলেন অভিনেতা। হঠাৎ একদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। নিজের গাড়ি করে নিয়ে গেলেন তাঁর অন্য একটি ছবির শুটিং দেখাতে। সেখানেই সত্যজিৎ রায় নামকরা অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যান। তাঁকে বলেন, এ হচ্ছে অপুর সংসারের অপু। এর আগ পর্যন্ত জানতাম না যে আমিই অপুর সংসারের অপু হব।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সবিনয়ে আমি জানতে চাই প্রথম ক্যামেরার সামনে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা। স্মৃতিচারণ করে সৌমিত্র বলেন, ‘মঞ্চে টুকটাক কাজ করলেও ক্যামেরার সামনে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। শিশিরকুমার ভাদুড়ির কাছেই প্রথম শুনেছিলাম যে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের কাজে কিছু তফাত থাকে। অবশ্য শিশিরকুমার নিজে চিত্রাভিনয়ে তেমন আকৃষ্ট হননি। তাঁর ভালো লাগেনি, মঞ্চেই চলে এসেছিলেন। চিত্রাভিনয়ের খুঁটিনাটি দিক নিয়ে তখন ভাবতাম। নিয়মিত চলচ্চিত্র দেখতাম। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিতা’ দেখলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম সত্যজিৎ রায়ের অভিনয়ের ধারা। বোঝার চেষ্টা করলাম তাঁর পরিচালনা ও ক্যামেরার কাজ। ফলে ‘অপুর সংসার’ করার আগে থেকেই সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কীভাবে কাজ করতে হবে, আমার ভেতরে তার একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়েছিল। ‘অপুর সংসার’-এর শুটিংয়ের অনেক আগে থেকেই সত্যজিৎ রায় আমাকে নিয়ে যেতেন নানা জায়গায়, বিভিন্ন বই পড়তে দিতেন, চলচ্চিত্র দেখতে বলতেন। তখন চিত্রনাট্যের খসড়াও আমাকে দিয়েছিলেন। চিত্রনাট্য পড়ে নিজের মতো প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। সত্যজিৎ রায় আগে থেকেই সব বোঝাচ্ছিলেন যেন ক্যামেরার সামনে আমার কোনো আড়ষ্টতা না থাকে। তখন তিনি আমার কিছু ক্যামেরার টেস্ট নিয়েছিলেন। ক্যামেরা জিনিসটা কী, চিনতে শিখিয়েছিলেন। ক্যামেরায় কীভাবে কাজ করতে হয় তা বুঝিয়েছিলেন। ফলে প্রথম শুটিং করতে গিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়নি।’
স্মৃতিময় আড্ডায় ও আলাপে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। আড্ডায় উঠে এল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কথাও। আলাপচারিতার এক ফাঁকে রামেন্দু মজুমদার বলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাট্যকার ও সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকার সম্পাদকও। কলকাতার বিখ্যাত ‘এক্ষণ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কবিতার চর্চা করছেন সেই ছোটবেলা থেকেই।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেকে আড়াল করার জন্য অভিনয়ে এসেছিলেন, কিন্তু কবিতায় কীভাবে এলেন—আমার এরকম প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র বলেন, ‘কবিতায় নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ এল কিশোর বয়সে। তখন মেয়েদের প্রতি ভালো লাগার ব্যাপারটা শুরু হয়। বিশেষ মেয়েকে ভালো লাগার বিষয়টা তো থাকে। তখন তো একটু হাত ধরতেও কত অপেক্ষা করতে হতো! নিজের কথা যেখানে বলা যাচ্ছে না, তার একটা উপায় হিসেবেই কবিতা লেখার শুরু। গোপন প্রেমিকার উদ্দেশ্যেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায় যেন হাসির ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায় সেমিনার হলে। একজন হাসতে হাসতে জানতে চান, যাকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লেখা শুরু, তাকে জীবনে পেয়েছিলেন কি?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও হাসির দীর্ঘ আভা ছড়িয়ে বলেন, যাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলাম, তাকে পেয়েছিলাম। তাঁর কথায় ও রসিকতায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলাম সবাই।
আমার এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে অতীতসাগরে ডুব দেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ডুবুরির মতো গভীর থেকে যেন তুলে আনেন তাঁর স্মৃতিগুচ্ছ। কবিতা লেখা ও বই পড়ার প্রতি নিজের ভালো লাগার কথা প্রকাশ করে সৌমিত্র বলেন, ‘আমার ভেতরে কবিতা লেখার তাগিদ টের পাই ছোটবেলায়। অভিনয়, আবৃত্তি, কবিতা—এসব শুরু করেছিলাম পারিবারিক সুন্দর একটা আবহে। কবিতা লেখার আগে থেকেই অভিনয়টার প্রতি টান ছিল। আবৃত্তির প্রতি অনুরাগ ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি অভিনয় করছি, আবৃত্তি করছি। কেননা, আমাদের বাড়িতে থিয়েটারের চর্চা ছিল। আবৃত্তির চর্চাও ছিল। কিশোর বয়সে আমার মধ্যে কবিতা লেখার ঝোঁক এসেছিল। মোটামুটি ষোলো বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। বেশির ভাগ বাঙালি ছেলে যেমন কিশোর বয়সে কবিতা লেখে, তেমনই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। কিশোর বয়সে অধিকাংশ বাঙালি ছেলেই প্রেমে পড়লে কবিতা লেখে, আমিও তেমনভাবে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। অবশ্য এটার পেছনেও অনুপ্রেরণা ছিল পরিবার। আমাদের বাড়িতে সাহিত্যের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা ছিল। আমার দাদু সাহিত্যচর্চা করতেন। আমার বাবা-মা সাহিত্য খুব ভালোবাসতেন। ছোটবেলা থেকে আমাদের বইটই পড়ার কোনো বাধানিষেধ ছিল না। অনেক বাঙালির বাড়িতে নানা রকম বাধা থাকে বাইরের বই পড়ার।আমাদের বাড়িতে তা ছিল না। বলা যায়, আমাকে বেশ উৎসাহ দিতেন বাবা-মা। ছোটবেলা থেকেই আমি বইয়ের পোকা ছিলাম। প্রচুর ছড়া ও কবিতা পড়তাম।’
আলাপের এক ফাঁকে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নাটক সম্পর্কে বলতে গিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কলকাতার নাটকের অবনমন হয়েছে। মান কমে গেছে। সিনেমারও একই অবস্থা। কলকাতায় এখন সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার রাজনীতিতে নোংরা জৌলুশ আছে। তরুণেরা বাংলা ভুলে যাচ্ছে, মিশ্র ভাষায় কথা বলছে। বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে কথা বলছে। বাঙালি জাতিটাকে টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশই। বাংলা ভাষাকে গৌরব দিয়েছে বাংলাদেশই।’
নাট্যজন কেরামত মওলার এক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিনয় ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না। অভিনয়ই তো আমাকে রুটি-রুজি দিয়েছে। আমাকে খ্যাতি ও সম্মান দিয়েছে, বিপুল মানুষের ভালোবাসা দিয়েছে।’
অভিনয়ের পাশাপাশি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাটকও লিখেছেন। নাটক লেখার বিষয়ে প্রশ্ন রামেন্দু মজুমদারের। উত্তরে গুণী এই অভিনেতা বলেন, ‘আসলে প্রয়োজনের তাগিদে নাটক লেখা শুরু করেছিলাম। নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিল রেখে জীবনের সঞ্চিত খাতায় অনেক নাটক লিখেছিলাম। কমবেশি অনেক নাটকই দর্শক ও শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে, মানুষের প্রশংসা পেয়েছে।’
নাটকের ভবিষ্যৎ কী—এমন প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিজ্ঞতা ও ত্যাগ কখনো বিফলে যায় না; যায়নি অতীতে, ভবিষ্যতেও যাবে না হয়তো। সেই সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের জীবনের সঙ্গে মিল রেখে কতটুকু প্রাসঙ্গিক আমাদের নাটক, সেটার ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করে। ভালো নাটক সব সময়ই বেঁচে থাকবে। ভালো নাটক মানুষ গ্রহণ করবেই।
একজন ভালো অভিনেতার গুণাবলি সম্পর্কে জানতে চাইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিনেতা হওয়া সহজ নয়। বড় সাধনার বিষয়। ভালো অভিনেতার কাছে মানুষ বিষয়, সমাজ বিষয়, রাষ্ট্রও বিষয়। যে অভিনেতা শুধু আত্মপ্রদর্শন করে, তাকে আমার বড় অভিনেতা মনে হয় না। বড় অভিনেতা তার অভিনয়ে সমাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গ দেখায়, মানুষকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি ভাবতে শেখায়।’
টিভি, চলচ্চিত্র ও মঞ্চ—এসব জায়গায় অভিনয় করতে গিয়ে নিজেকে কি আলাদা করে তৈরি করতে হয়—নাট্যব্যক্তিত্ব কেরামত মওলার প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রথমত অভিনয়, তারপর পরিবেশ বুঝে উপস্থাপন। এতে আমি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। যিনি ছবি আঁকেন, তিনি ছোট ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন, বড় ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন। সে-ই সত্যিকার অভিনেতা, যে সমাজের ভাবনাচিন্তা, অবস্থা অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারে।’
আমাদের আলাপে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নানা দিকও। উঠে এসেছিল দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের কথাও। পাশাপাশি দুই দেশ, পাশাপাশি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। ভাষা এক, সংস্কৃতিও এক। তার পরও দূরত্ব রয়ে গেছে অনেক জায়গায়। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর পথে আরও একটি বিষয় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারত, তা হলো বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে দেখার ব্যবস্থা করা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে সেটি নেই। এ বিষয়ে আমার এক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলাদেশের নাটক, চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতিকে খুব মিস করি। সাংঘাতিকভাবে মিস করি। এ দেশের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকলেও এ রকম একটি প্রতিবন্ধকতার কারণে সেটা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। এটার উত্তরণ জরুরি।’
আড্ডার এক ফাঁকে আবৃত্তিশিল্পী ও নাট্যনির্দেশক গোলাম সারোয়ার জানতে চান অভিনয়ে আবৃত্তিচর্চার প্রয়োজন আছে কি না। সৌমিত্রের জবাব, ‘অভিনয়ের জন্য আবৃত্তিরও ভীষণ দরকার। যাঁরা এটা বোঝেন না, তাঁরা এখনো চোখ বুজে আছেন। অভিনয়ের প্রারম্ভিক কাজ হলো কথা বলা, সেটা আবৃত্তিচর্চা ছাড়া হয় না। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আবৃত্তি ও গান করি। প্রতিদিন রেওয়াজ করি, সাধনা করি। জীবনে সফল হতে হলে তার কাজকে সাধনার পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটা অভিনয় হোক, আর আবৃত্তি হোক কিংবা যেকোনো মাধ্যমই হোক। একজন অভিনেতাকে চার অক্ষরের একটি শব্দ আঁকড়ে রাখতে হয়, সেটা হলো ভালোবাসা। নিজের কাজের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা থাকতে হবে। নিজের কাজ ও দায়িত্বের প্রতি ভালোবাসাই মানুষকে সাফল্য এনে দেয়, পৌঁছে দেয় সঠিক অবস্থানে। ভালোবাসা ছাড়া কিচ্ছু হয় না, হবেও না।’
নওশাদ জামিল

সেই দিনের কথা, সেই সকালের কথা মাঝেমধ্যেই জ্বলজ্বল করে মনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টায় আসার কথা তাঁর। তবে এর আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে। উপস্থিত হয়েছিলাম আমরা কয়েকজন সাংবাদিক ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ। ঠিক সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে দৃপ্ত পায়ে উপস্থিত হলেন এক চিরসবুজ নায়ক। পরনে তাঁর জিনস প্যান্ট, নীল রঙের হাফহাতা শার্ট। সৌম্যকান্তি চেহারার ৮০ পেরোনো সেই তরুণের নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়! সেমিনার হলে ঢুকেই তিনি বললেন, ‘সুপ্রভাত! বাংলাদেশে এলেই মনটা ভালো হয়ে যায় আমার। কেননা, এই বাংলাদেশের সাথেই তো আমার নাড়ির সংযোগ। তাই সব সময়ই এ দেশের প্রতি নাড়ির টান অনুভব করি।’
অভিনয় কিংবা আবৃত্তি করতে নয়, আমাদের সঙ্গে আলাপচারিতা, বলা যায় আড্ডা দিতেই শিল্পকলা একাডেমিতে হাজির হয়েছিলেন দুই বাংলার কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেদিন সেই আলাপচারিতায়, আড্ডায় প্রাণোচ্ছল ভঙ্গিমায় তিনি বলেছিলেন তাঁর ব্যক্তি ও শিল্পীজীবনের নানা অজানা কথা। বলেছিলেন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ভালোবাসার কথা, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগের কথা। বলেছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের চলচ্চিত্র, নাটক, সংস্কৃতি নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা।
১৯৫৯ সালে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে অভিনয়জগতে পথচলা শুরু করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তারপর ইতিহাস, তাঁর হিরণ্ময় পথচলা। বিস্ময়কর সাফল্য, মুগ্ধকর সব অর্জন। সৌমিত্র প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করেছিলেন, যার ফলে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, শুধুই সামনে চলা শুরু হয়ে যায় তাঁর। শুরু হয়ে যায় শিল্পের নানা মাধ্যমে তাঁর পদচারণ। সৌমিত্রের সেই পথচলা থেমে যায় ২০২০ সালের এই দিনে। আজ ১৫ নভেম্বর, মঙ্গলবার তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। দুই শতাধিক চলচ্চিত্র, নাটকে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র, মঞ্চ নাটক, টিভি নাটকসহ শিল্পের নানা মাধ্যমে কাজ করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশ ও ভারতের সুধী মহলে উচ্চ প্রশংসিত তাঁর নাট্যাভিনয়, পরিচালনা ও রচনা। অভিনয়, আবৃত্তির পাশাপাশি তিনি একজন কবিও। তাঁর কাব্যচর্চার ফসল পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ। এ ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন, কাজ করেছেন শিল্প-সংস্কৃতির নানা অঙ্গনে। অভিনয়ের জন্য ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন। দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডিলিটসহ নানা পুরস্কার। ফরাসি সরকারের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩ বছর। তরুণ বয়সে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সময় সৌমিত্র যতটা আকর্ষণীয় ছিলেন, ৮০ বছর বয়সে ‘অহল্যা’ শর্ট ফিল্মে অভিনয়েও ততটাই। কী চমৎকার করে যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কথা বলতেন, কী শুদ্ধভাবে ও সঠিক উচ্চারণে! আহা! আমরা মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনেছিলাম, তন্ময় হয়ে তাঁকে দেখেছিলাম। কিংবদন্তি অভিনেতার সান্নিধ্য পেয়ে আনন্দ-আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম।
পরিচয়ের পর্ব শেষে শুরু হয় আড্ডা ও আলাপন। ঘড়ির কাঁটা তখন বেলা ১১টায়। আমাদের আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। সূচনা পর্বে গোলাম কুদ্দুছ ভাই প্রশ্ন করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। পর্যায়ক্রমে আমি তাঁকে নানা প্রশ্ন করি, প্রশ্ন করে আমার কয়েকজন বন্ধু ও কয়েকজন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও।
পাক্কা দুই ঘণ্টার আলাপচারিতা। মাঝে চা-কফির আপ্যায়ন। মাঝেমধ্যে হাস্যরস, কৌতুক, সিরিয়াস সব কথাবার্তাও। আড্ডা-আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মেলে ধরেন নিজের মনের জানালা, খুলে দেন তাঁর ঘরে-বাইরের চালচিত্র। উন্মোচন করে যেন ঢেলে দেন কথার ফোয়ারা।
গোলাম কুদ্দুছ ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র বলেন, ‘আমার বাবা একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর। কিন্তু তখনো অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রশ্নটি ওঠেনি। এ কারণেই হয়তো বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন বাবা। কিন্তু একান্ত নিমগ্নতায় বাবাকে অভিনয় আর আবৃত্তিটাই করতে দেখেছি। প্রথম জীবনে বাবার কাছ থেকেই আবৃত্তি শিখেছি। বাবা আমাকে বোঝাতেন কীভাবে অভিনয় করতে হয়, আবৃত্তি করতে হয়। ছোটবেলায় বাবা জোরে উচ্চারণ করে বোঝাতেন সঠিক উচ্চারণবিধি, বোঝাতেন আবৃত্তির কলাকৌশল। মূলত বাবাকে দেখেই একসময় অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। পরে কলকাতায় শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। তারপর তো অভিনয় হয়ে ওঠে আমার জীবনের আরাধ্য।’
আপনি যদি অভিনেতা না হতেন, তাহলে কী হতেন—আমার এ রকম সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘চলচ্চিত্র ও মঞ্চ দুটিই আমার প্রিয় মাধ্যম। অভিনেতা পরিচয়ই প্রধান পরিচয়। যদি আমি অভিনয় না করতাম, অভিনেতা না হতাম, তাহলে হয়তো আবৃত্তিকার হতাম। কিংবা কবি ও লেখক হতাম।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে একজন চমৎকার আবৃত্তিশিল্পী ও কবি, সেটা স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি শিশুর মতো স্বর্গীয় হাসিতে উজ্জ্বল করে দেন শিল্পকলা একাডেমির ছোট্ট সেমিনার হল। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘আমি কবিতা লিখতে পছন্দ করি, কবিতা আবৃত্তি করতেও পছন্দ করি। কিন্তু আমাকে তো সবাই চেনে অভিনেতা হিসেবেই। কবি হিসেবে তো নামডাক নেই!’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাকি ছোটবেলায় সারাক্ষণ হীনম্মন্যতায় ভুগতেন! যাঁরা ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে ২৩ বছরের সুদর্শন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখেছেন, তারা কি কখনো ভাবতে পেরেছেন, এই মানুষটিই তরুণ বয়সে নিজের চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চমৎকার হাস্যরসের মধ্য দিয়ে শোনালের জীবনের কথা। অভিনয়জীবনের শুরুর দিকের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘অভিনয় যে করব, এই অঙ্গনের মানুষের ভালোবাসা কাড়ব, তা কখনো ভাবিনি। আমার ভেতরে একটা হীনম্মন্যতা ছিল। আর সেটা ছিল আমার চেহারা নিয়ে! একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতার মুখে এ কথা শুনে হয়তো হাসবেন। তবে এর কারণ ছিল। অল্প বয়সে টাইফয়েড হয়েছিল। খুব রুগ্ণ ছিলাম। বাড়ির লোকেরা বলত, ছেলেটা কালো, হ্যাংলা-পাতলা! ব্যঙ্গ করে প্রায়ই বলত, তোর তো চেহারা নেই। নাক-চোখ-মুখেরও তেমন সুন্দর আদল নেই। ছোটবেলায় তা শুনে সংকুচিত হতাম। খেলাধুলো খুব করতাম, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো ছিলাম না। ভালো ছাত্রও ছিলাম না। তবে আমার অভিনয় দেখে অনেকেরই ভালো বলত। অভিনয়ে তো নিজেকে আড়াল করা যায়। নিজেকে আড়াল করার জন্যই অভিনয়ে এসেছিলাম।’
সৌমিত্রের বাবা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় পেশায় উকিল হলেও ভালোবাসতেন আবৃত্তি, নাটক, গান। বাবার কণ্ঠে আবৃত্তি শুনেই ছেলেবেলা পার করেছেন সৌমিত্র। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার আবৃত্তি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কবিতা পড়লে তিনি দেখিয়ে দিতেন কীভাবে পড়তে হয়। কীভাবে সঠিক ও শুদ্ধ উচ্চারণ করতে হয়।’
আড্ডা-আলাপচারিতায় একে একে চলতে থাকে কৌতূহলোদ্দীপক নানা প্রশ্ন। আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাট্যজন সৈয়দ হাসান ইমাম, নাট্যজন কেরামত মওলা, অভিনেতা ও নাট্যজন ড. ইনামুল হকসহ অনেকেই।
অভিনয়ের প্রেমে কীভাবে পড়লেন জানতে চাইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কলকাতায় বিখ্যাতদের অভিনয় দেখতাম ছোটবেলা থেকেই। শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। তারপর তাঁর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল। প্রায় তিন বছর তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। থিয়েটার নিয়ে আমার চিন্তাভাবনার ভিত তৈরি হয়েছিল তাঁর কাছ থেকেই। সত্যজিৎ রায় তখন ‘পথের পাঁচালী’ তৈরি করেছেন। এর সিক্যুয়াল ‘অপরাজিতা’ তৈরি করবেন তিনি। তাঁর এক সহকারীর কাছে শুনেছিলাম এসব। শিশিরকুমার ভাদুড়ি একদিন সত্যজিৎ রায়ের বাসায় নিয়ে যান। তখনই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে খানিকটা আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। তিনি যেন সারাক্ষণ মনে মনে অভিনেতাকে খুঁজতেন। চলচ্চিত্রের সঙ্গে মানানসই মুখ খুঁজতেন। আমি তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজ করি।’
কিছুক্ষণ পর হাসতে হাসতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘সামান্য পরিচয় ও দেখা-সাক্ষাতে আমাকে যে সত্যজিৎ রায় মনে রেখেছিলেন, সেটা ভাবতে পারিনি। তার পরের ছবি ছিল তৃতীয় সিক্যুয়াল ‘অপুর সংসার’। সেই চলচ্চিত্রের জন্য খুঁজছিলেন অভিনেতা। হঠাৎ একদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। নিজের গাড়ি করে নিয়ে গেলেন তাঁর অন্য একটি ছবির শুটিং দেখাতে। সেখানেই সত্যজিৎ রায় নামকরা অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যান। তাঁকে বলেন, এ হচ্ছে অপুর সংসারের অপু। এর আগ পর্যন্ত জানতাম না যে আমিই অপুর সংসারের অপু হব।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সবিনয়ে আমি জানতে চাই প্রথম ক্যামেরার সামনে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা। স্মৃতিচারণ করে সৌমিত্র বলেন, ‘মঞ্চে টুকটাক কাজ করলেও ক্যামেরার সামনে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। শিশিরকুমার ভাদুড়ির কাছেই প্রথম শুনেছিলাম যে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের কাজে কিছু তফাত থাকে। অবশ্য শিশিরকুমার নিজে চিত্রাভিনয়ে তেমন আকৃষ্ট হননি। তাঁর ভালো লাগেনি, মঞ্চেই চলে এসেছিলেন। চিত্রাভিনয়ের খুঁটিনাটি দিক নিয়ে তখন ভাবতাম। নিয়মিত চলচ্চিত্র দেখতাম। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিতা’ দেখলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম সত্যজিৎ রায়ের অভিনয়ের ধারা। বোঝার চেষ্টা করলাম তাঁর পরিচালনা ও ক্যামেরার কাজ। ফলে ‘অপুর সংসার’ করার আগে থেকেই সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কীভাবে কাজ করতে হবে, আমার ভেতরে তার একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়েছিল। ‘অপুর সংসার’-এর শুটিংয়ের অনেক আগে থেকেই সত্যজিৎ রায় আমাকে নিয়ে যেতেন নানা জায়গায়, বিভিন্ন বই পড়তে দিতেন, চলচ্চিত্র দেখতে বলতেন। তখন চিত্রনাট্যের খসড়াও আমাকে দিয়েছিলেন। চিত্রনাট্য পড়ে নিজের মতো প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। সত্যজিৎ রায় আগে থেকেই সব বোঝাচ্ছিলেন যেন ক্যামেরার সামনে আমার কোনো আড়ষ্টতা না থাকে। তখন তিনি আমার কিছু ক্যামেরার টেস্ট নিয়েছিলেন। ক্যামেরা জিনিসটা কী, চিনতে শিখিয়েছিলেন। ক্যামেরায় কীভাবে কাজ করতে হয় তা বুঝিয়েছিলেন। ফলে প্রথম শুটিং করতে গিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়নি।’
স্মৃতিময় আড্ডায় ও আলাপে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। আড্ডায় উঠে এল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কথাও। আলাপচারিতার এক ফাঁকে রামেন্দু মজুমদার বলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাট্যকার ও সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকার সম্পাদকও। কলকাতার বিখ্যাত ‘এক্ষণ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কবিতার চর্চা করছেন সেই ছোটবেলা থেকেই।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেকে আড়াল করার জন্য অভিনয়ে এসেছিলেন, কিন্তু কবিতায় কীভাবে এলেন—আমার এরকম প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র বলেন, ‘কবিতায় নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ এল কিশোর বয়সে। তখন মেয়েদের প্রতি ভালো লাগার ব্যাপারটা শুরু হয়। বিশেষ মেয়েকে ভালো লাগার বিষয়টা তো থাকে। তখন তো একটু হাত ধরতেও কত অপেক্ষা করতে হতো! নিজের কথা যেখানে বলা যাচ্ছে না, তার একটা উপায় হিসেবেই কবিতা লেখার শুরু। গোপন প্রেমিকার উদ্দেশ্যেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায় যেন হাসির ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায় সেমিনার হলে। একজন হাসতে হাসতে জানতে চান, যাকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লেখা শুরু, তাকে জীবনে পেয়েছিলেন কি?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও হাসির দীর্ঘ আভা ছড়িয়ে বলেন, যাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলাম, তাকে পেয়েছিলাম। তাঁর কথায় ও রসিকতায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলাম সবাই।
আমার এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে অতীতসাগরে ডুব দেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ডুবুরির মতো গভীর থেকে যেন তুলে আনেন তাঁর স্মৃতিগুচ্ছ। কবিতা লেখা ও বই পড়ার প্রতি নিজের ভালো লাগার কথা প্রকাশ করে সৌমিত্র বলেন, ‘আমার ভেতরে কবিতা লেখার তাগিদ টের পাই ছোটবেলায়। অভিনয়, আবৃত্তি, কবিতা—এসব শুরু করেছিলাম পারিবারিক সুন্দর একটা আবহে। কবিতা লেখার আগে থেকেই অভিনয়টার প্রতি টান ছিল। আবৃত্তির প্রতি অনুরাগ ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি অভিনয় করছি, আবৃত্তি করছি। কেননা, আমাদের বাড়িতে থিয়েটারের চর্চা ছিল। আবৃত্তির চর্চাও ছিল। কিশোর বয়সে আমার মধ্যে কবিতা লেখার ঝোঁক এসেছিল। মোটামুটি ষোলো বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। বেশির ভাগ বাঙালি ছেলে যেমন কিশোর বয়সে কবিতা লেখে, তেমনই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। কিশোর বয়সে অধিকাংশ বাঙালি ছেলেই প্রেমে পড়লে কবিতা লেখে, আমিও তেমনভাবে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। অবশ্য এটার পেছনেও অনুপ্রেরণা ছিল পরিবার। আমাদের বাড়িতে সাহিত্যের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা ছিল। আমার দাদু সাহিত্যচর্চা করতেন। আমার বাবা-মা সাহিত্য খুব ভালোবাসতেন। ছোটবেলা থেকে আমাদের বইটই পড়ার কোনো বাধানিষেধ ছিল না। অনেক বাঙালির বাড়িতে নানা রকম বাধা থাকে বাইরের বই পড়ার।আমাদের বাড়িতে তা ছিল না। বলা যায়, আমাকে বেশ উৎসাহ দিতেন বাবা-মা। ছোটবেলা থেকেই আমি বইয়ের পোকা ছিলাম। প্রচুর ছড়া ও কবিতা পড়তাম।’
আলাপের এক ফাঁকে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নাটক সম্পর্কে বলতে গিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কলকাতার নাটকের অবনমন হয়েছে। মান কমে গেছে। সিনেমারও একই অবস্থা। কলকাতায় এখন সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার রাজনীতিতে নোংরা জৌলুশ আছে। তরুণেরা বাংলা ভুলে যাচ্ছে, মিশ্র ভাষায় কথা বলছে। বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে কথা বলছে। বাঙালি জাতিটাকে টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশই। বাংলা ভাষাকে গৌরব দিয়েছে বাংলাদেশই।’
নাট্যজন কেরামত মওলার এক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিনয় ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না। অভিনয়ই তো আমাকে রুটি-রুজি দিয়েছে। আমাকে খ্যাতি ও সম্মান দিয়েছে, বিপুল মানুষের ভালোবাসা দিয়েছে।’
অভিনয়ের পাশাপাশি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাটকও লিখেছেন। নাটক লেখার বিষয়ে প্রশ্ন রামেন্দু মজুমদারের। উত্তরে গুণী এই অভিনেতা বলেন, ‘আসলে প্রয়োজনের তাগিদে নাটক লেখা শুরু করেছিলাম। নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিল রেখে জীবনের সঞ্চিত খাতায় অনেক নাটক লিখেছিলাম। কমবেশি অনেক নাটকই দর্শক ও শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে, মানুষের প্রশংসা পেয়েছে।’
নাটকের ভবিষ্যৎ কী—এমন প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিজ্ঞতা ও ত্যাগ কখনো বিফলে যায় না; যায়নি অতীতে, ভবিষ্যতেও যাবে না হয়তো। সেই সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের জীবনের সঙ্গে মিল রেখে কতটুকু প্রাসঙ্গিক আমাদের নাটক, সেটার ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করে। ভালো নাটক সব সময়ই বেঁচে থাকবে। ভালো নাটক মানুষ গ্রহণ করবেই।
একজন ভালো অভিনেতার গুণাবলি সম্পর্কে জানতে চাইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিনেতা হওয়া সহজ নয়। বড় সাধনার বিষয়। ভালো অভিনেতার কাছে মানুষ বিষয়, সমাজ বিষয়, রাষ্ট্রও বিষয়। যে অভিনেতা শুধু আত্মপ্রদর্শন করে, তাকে আমার বড় অভিনেতা মনে হয় না। বড় অভিনেতা তার অভিনয়ে সমাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গ দেখায়, মানুষকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি ভাবতে শেখায়।’
টিভি, চলচ্চিত্র ও মঞ্চ—এসব জায়গায় অভিনয় করতে গিয়ে নিজেকে কি আলাদা করে তৈরি করতে হয়—নাট্যব্যক্তিত্ব কেরামত মওলার প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রথমত অভিনয়, তারপর পরিবেশ বুঝে উপস্থাপন। এতে আমি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। যিনি ছবি আঁকেন, তিনি ছোট ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন, বড় ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন। সে-ই সত্যিকার অভিনেতা, যে সমাজের ভাবনাচিন্তা, অবস্থা অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারে।’
আমাদের আলাপে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নানা দিকও। উঠে এসেছিল দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের কথাও। পাশাপাশি দুই দেশ, পাশাপাশি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। ভাষা এক, সংস্কৃতিও এক। তার পরও দূরত্ব রয়ে গেছে অনেক জায়গায়। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর পথে আরও একটি বিষয় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারত, তা হলো বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে দেখার ব্যবস্থা করা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে সেটি নেই। এ বিষয়ে আমার এক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলাদেশের নাটক, চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতিকে খুব মিস করি। সাংঘাতিকভাবে মিস করি। এ দেশের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকলেও এ রকম একটি প্রতিবন্ধকতার কারণে সেটা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। এটার উত্তরণ জরুরি।’
আড্ডার এক ফাঁকে আবৃত্তিশিল্পী ও নাট্যনির্দেশক গোলাম সারোয়ার জানতে চান অভিনয়ে আবৃত্তিচর্চার প্রয়োজন আছে কি না। সৌমিত্রের জবাব, ‘অভিনয়ের জন্য আবৃত্তিরও ভীষণ দরকার। যাঁরা এটা বোঝেন না, তাঁরা এখনো চোখ বুজে আছেন। অভিনয়ের প্রারম্ভিক কাজ হলো কথা বলা, সেটা আবৃত্তিচর্চা ছাড়া হয় না। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আবৃত্তি ও গান করি। প্রতিদিন রেওয়াজ করি, সাধনা করি। জীবনে সফল হতে হলে তার কাজকে সাধনার পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটা অভিনয় হোক, আর আবৃত্তি হোক কিংবা যেকোনো মাধ্যমই হোক। একজন অভিনেতাকে চার অক্ষরের একটি শব্দ আঁকড়ে রাখতে হয়, সেটা হলো ভালোবাসা। নিজের কাজের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা থাকতে হবে। নিজের কাজ ও দায়িত্বের প্রতি ভালোবাসাই মানুষকে সাফল্য এনে দেয়, পৌঁছে দেয় সঠিক অবস্থানে। ভালোবাসা ছাড়া কিচ্ছু হয় না, হবেও না।’

সেই দিনের কথা, সেই সকালের কথা মাঝেমধ্যেই জ্বলজ্বল করে মনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টায় আসার কথা তাঁর। তবে এর আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে। উপস্থিত হয়েছিলাম আমরা কয়েকজন সাংবাদিক ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ। ঠিক সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে দৃপ্ত পায়ে উপস্থিত হলেন এক চিরসবুজ নায়ক। পরনে তাঁর জিনস প্যান্ট, নীল রঙের হাফহাতা শার্ট। সৌম্যকান্তি চেহারার ৮০ পেরোনো সেই তরুণের নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়! সেমিনার হলে ঢুকেই তিনি বললেন, ‘সুপ্রভাত! বাংলাদেশে এলেই মনটা ভালো হয়ে যায় আমার। কেননা, এই বাংলাদেশের সাথেই তো আমার নাড়ির সংযোগ। তাই সব সময়ই এ দেশের প্রতি নাড়ির টান অনুভব করি।’
অভিনয় কিংবা আবৃত্তি করতে নয়, আমাদের সঙ্গে আলাপচারিতা, বলা যায় আড্ডা দিতেই শিল্পকলা একাডেমিতে হাজির হয়েছিলেন দুই বাংলার কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেদিন সেই আলাপচারিতায়, আড্ডায় প্রাণোচ্ছল ভঙ্গিমায় তিনি বলেছিলেন তাঁর ব্যক্তি ও শিল্পীজীবনের নানা অজানা কথা। বলেছিলেন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ভালোবাসার কথা, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগের কথা। বলেছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের চলচ্চিত্র, নাটক, সংস্কৃতি নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা।
১৯৫৯ সালে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে অভিনয়জগতে পথচলা শুরু করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তারপর ইতিহাস, তাঁর হিরণ্ময় পথচলা। বিস্ময়কর সাফল্য, মুগ্ধকর সব অর্জন। সৌমিত্র প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করেছিলেন, যার ফলে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, শুধুই সামনে চলা শুরু হয়ে যায় তাঁর। শুরু হয়ে যায় শিল্পের নানা মাধ্যমে তাঁর পদচারণ। সৌমিত্রের সেই পথচলা থেমে যায় ২০২০ সালের এই দিনে। আজ ১৫ নভেম্বর, মঙ্গলবার তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। দুই শতাধিক চলচ্চিত্র, নাটকে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র, মঞ্চ নাটক, টিভি নাটকসহ শিল্পের নানা মাধ্যমে কাজ করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশ ও ভারতের সুধী মহলে উচ্চ প্রশংসিত তাঁর নাট্যাভিনয়, পরিচালনা ও রচনা। অভিনয়, আবৃত্তির পাশাপাশি তিনি একজন কবিও। তাঁর কাব্যচর্চার ফসল পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ। এ ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন, কাজ করেছেন শিল্প-সংস্কৃতির নানা অঙ্গনে। অভিনয়ের জন্য ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন। দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডিলিটসহ নানা পুরস্কার। ফরাসি সরকারের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩ বছর। তরুণ বয়সে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সময় সৌমিত্র যতটা আকর্ষণীয় ছিলেন, ৮০ বছর বয়সে ‘অহল্যা’ শর্ট ফিল্মে অভিনয়েও ততটাই। কী চমৎকার করে যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কথা বলতেন, কী শুদ্ধভাবে ও সঠিক উচ্চারণে! আহা! আমরা মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনেছিলাম, তন্ময় হয়ে তাঁকে দেখেছিলাম। কিংবদন্তি অভিনেতার সান্নিধ্য পেয়ে আনন্দ-আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম।
পরিচয়ের পর্ব শেষে শুরু হয় আড্ডা ও আলাপন। ঘড়ির কাঁটা তখন বেলা ১১টায়। আমাদের আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। সূচনা পর্বে গোলাম কুদ্দুছ ভাই প্রশ্ন করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। পর্যায়ক্রমে আমি তাঁকে নানা প্রশ্ন করি, প্রশ্ন করে আমার কয়েকজন বন্ধু ও কয়েকজন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও।
পাক্কা দুই ঘণ্টার আলাপচারিতা। মাঝে চা-কফির আপ্যায়ন। মাঝেমধ্যে হাস্যরস, কৌতুক, সিরিয়াস সব কথাবার্তাও। আড্ডা-আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মেলে ধরেন নিজের মনের জানালা, খুলে দেন তাঁর ঘরে-বাইরের চালচিত্র। উন্মোচন করে যেন ঢেলে দেন কথার ফোয়ারা।
গোলাম কুদ্দুছ ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র বলেন, ‘আমার বাবা একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর। কিন্তু তখনো অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রশ্নটি ওঠেনি। এ কারণেই হয়তো বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন বাবা। কিন্তু একান্ত নিমগ্নতায় বাবাকে অভিনয় আর আবৃত্তিটাই করতে দেখেছি। প্রথম জীবনে বাবার কাছ থেকেই আবৃত্তি শিখেছি। বাবা আমাকে বোঝাতেন কীভাবে অভিনয় করতে হয়, আবৃত্তি করতে হয়। ছোটবেলায় বাবা জোরে উচ্চারণ করে বোঝাতেন সঠিক উচ্চারণবিধি, বোঝাতেন আবৃত্তির কলাকৌশল। মূলত বাবাকে দেখেই একসময় অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। পরে কলকাতায় শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। তারপর তো অভিনয় হয়ে ওঠে আমার জীবনের আরাধ্য।’
আপনি যদি অভিনেতা না হতেন, তাহলে কী হতেন—আমার এ রকম সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘চলচ্চিত্র ও মঞ্চ দুটিই আমার প্রিয় মাধ্যম। অভিনেতা পরিচয়ই প্রধান পরিচয়। যদি আমি অভিনয় না করতাম, অভিনেতা না হতাম, তাহলে হয়তো আবৃত্তিকার হতাম। কিংবা কবি ও লেখক হতাম।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে একজন চমৎকার আবৃত্তিশিল্পী ও কবি, সেটা স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি শিশুর মতো স্বর্গীয় হাসিতে উজ্জ্বল করে দেন শিল্পকলা একাডেমির ছোট্ট সেমিনার হল। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘আমি কবিতা লিখতে পছন্দ করি, কবিতা আবৃত্তি করতেও পছন্দ করি। কিন্তু আমাকে তো সবাই চেনে অভিনেতা হিসেবেই। কবি হিসেবে তো নামডাক নেই!’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাকি ছোটবেলায় সারাক্ষণ হীনম্মন্যতায় ভুগতেন! যাঁরা ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে ২৩ বছরের সুদর্শন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখেছেন, তারা কি কখনো ভাবতে পেরেছেন, এই মানুষটিই তরুণ বয়সে নিজের চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চমৎকার হাস্যরসের মধ্য দিয়ে শোনালের জীবনের কথা। অভিনয়জীবনের শুরুর দিকের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘অভিনয় যে করব, এই অঙ্গনের মানুষের ভালোবাসা কাড়ব, তা কখনো ভাবিনি। আমার ভেতরে একটা হীনম্মন্যতা ছিল। আর সেটা ছিল আমার চেহারা নিয়ে! একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতার মুখে এ কথা শুনে হয়তো হাসবেন। তবে এর কারণ ছিল। অল্প বয়সে টাইফয়েড হয়েছিল। খুব রুগ্ণ ছিলাম। বাড়ির লোকেরা বলত, ছেলেটা কালো, হ্যাংলা-পাতলা! ব্যঙ্গ করে প্রায়ই বলত, তোর তো চেহারা নেই। নাক-চোখ-মুখেরও তেমন সুন্দর আদল নেই। ছোটবেলায় তা শুনে সংকুচিত হতাম। খেলাধুলো খুব করতাম, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো ছিলাম না। ভালো ছাত্রও ছিলাম না। তবে আমার অভিনয় দেখে অনেকেরই ভালো বলত। অভিনয়ে তো নিজেকে আড়াল করা যায়। নিজেকে আড়াল করার জন্যই অভিনয়ে এসেছিলাম।’
সৌমিত্রের বাবা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় পেশায় উকিল হলেও ভালোবাসতেন আবৃত্তি, নাটক, গান। বাবার কণ্ঠে আবৃত্তি শুনেই ছেলেবেলা পার করেছেন সৌমিত্র। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার আবৃত্তি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কবিতা পড়লে তিনি দেখিয়ে দিতেন কীভাবে পড়তে হয়। কীভাবে সঠিক ও শুদ্ধ উচ্চারণ করতে হয়।’
আড্ডা-আলাপচারিতায় একে একে চলতে থাকে কৌতূহলোদ্দীপক নানা প্রশ্ন। আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাট্যজন সৈয়দ হাসান ইমাম, নাট্যজন কেরামত মওলা, অভিনেতা ও নাট্যজন ড. ইনামুল হকসহ অনেকেই।
অভিনয়ের প্রেমে কীভাবে পড়লেন জানতে চাইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কলকাতায় বিখ্যাতদের অভিনয় দেখতাম ছোটবেলা থেকেই। শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। তারপর তাঁর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল। প্রায় তিন বছর তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। থিয়েটার নিয়ে আমার চিন্তাভাবনার ভিত তৈরি হয়েছিল তাঁর কাছ থেকেই। সত্যজিৎ রায় তখন ‘পথের পাঁচালী’ তৈরি করেছেন। এর সিক্যুয়াল ‘অপরাজিতা’ তৈরি করবেন তিনি। তাঁর এক সহকারীর কাছে শুনেছিলাম এসব। শিশিরকুমার ভাদুড়ি একদিন সত্যজিৎ রায়ের বাসায় নিয়ে যান। তখনই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে খানিকটা আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। তিনি যেন সারাক্ষণ মনে মনে অভিনেতাকে খুঁজতেন। চলচ্চিত্রের সঙ্গে মানানসই মুখ খুঁজতেন। আমি তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজ করি।’
কিছুক্ষণ পর হাসতে হাসতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘সামান্য পরিচয় ও দেখা-সাক্ষাতে আমাকে যে সত্যজিৎ রায় মনে রেখেছিলেন, সেটা ভাবতে পারিনি। তার পরের ছবি ছিল তৃতীয় সিক্যুয়াল ‘অপুর সংসার’। সেই চলচ্চিত্রের জন্য খুঁজছিলেন অভিনেতা। হঠাৎ একদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। নিজের গাড়ি করে নিয়ে গেলেন তাঁর অন্য একটি ছবির শুটিং দেখাতে। সেখানেই সত্যজিৎ রায় নামকরা অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যান। তাঁকে বলেন, এ হচ্ছে অপুর সংসারের অপু। এর আগ পর্যন্ত জানতাম না যে আমিই অপুর সংসারের অপু হব।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সবিনয়ে আমি জানতে চাই প্রথম ক্যামেরার সামনে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা। স্মৃতিচারণ করে সৌমিত্র বলেন, ‘মঞ্চে টুকটাক কাজ করলেও ক্যামেরার সামনে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। শিশিরকুমার ভাদুড়ির কাছেই প্রথম শুনেছিলাম যে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের কাজে কিছু তফাত থাকে। অবশ্য শিশিরকুমার নিজে চিত্রাভিনয়ে তেমন আকৃষ্ট হননি। তাঁর ভালো লাগেনি, মঞ্চেই চলে এসেছিলেন। চিত্রাভিনয়ের খুঁটিনাটি দিক নিয়ে তখন ভাবতাম। নিয়মিত চলচ্চিত্র দেখতাম। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিতা’ দেখলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম সত্যজিৎ রায়ের অভিনয়ের ধারা। বোঝার চেষ্টা করলাম তাঁর পরিচালনা ও ক্যামেরার কাজ। ফলে ‘অপুর সংসার’ করার আগে থেকেই সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কীভাবে কাজ করতে হবে, আমার ভেতরে তার একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়েছিল। ‘অপুর সংসার’-এর শুটিংয়ের অনেক আগে থেকেই সত্যজিৎ রায় আমাকে নিয়ে যেতেন নানা জায়গায়, বিভিন্ন বই পড়তে দিতেন, চলচ্চিত্র দেখতে বলতেন। তখন চিত্রনাট্যের খসড়াও আমাকে দিয়েছিলেন। চিত্রনাট্য পড়ে নিজের মতো প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। সত্যজিৎ রায় আগে থেকেই সব বোঝাচ্ছিলেন যেন ক্যামেরার সামনে আমার কোনো আড়ষ্টতা না থাকে। তখন তিনি আমার কিছু ক্যামেরার টেস্ট নিয়েছিলেন। ক্যামেরা জিনিসটা কী, চিনতে শিখিয়েছিলেন। ক্যামেরায় কীভাবে কাজ করতে হয় তা বুঝিয়েছিলেন। ফলে প্রথম শুটিং করতে গিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়নি।’
স্মৃতিময় আড্ডায় ও আলাপে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। আড্ডায় উঠে এল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কথাও। আলাপচারিতার এক ফাঁকে রামেন্দু মজুমদার বলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাট্যকার ও সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকার সম্পাদকও। কলকাতার বিখ্যাত ‘এক্ষণ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কবিতার চর্চা করছেন সেই ছোটবেলা থেকেই।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেকে আড়াল করার জন্য অভিনয়ে এসেছিলেন, কিন্তু কবিতায় কীভাবে এলেন—আমার এরকম প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র বলেন, ‘কবিতায় নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ এল কিশোর বয়সে। তখন মেয়েদের প্রতি ভালো লাগার ব্যাপারটা শুরু হয়। বিশেষ মেয়েকে ভালো লাগার বিষয়টা তো থাকে। তখন তো একটু হাত ধরতেও কত অপেক্ষা করতে হতো! নিজের কথা যেখানে বলা যাচ্ছে না, তার একটা উপায় হিসেবেই কবিতা লেখার শুরু। গোপন প্রেমিকার উদ্দেশ্যেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায় যেন হাসির ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায় সেমিনার হলে। একজন হাসতে হাসতে জানতে চান, যাকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লেখা শুরু, তাকে জীবনে পেয়েছিলেন কি?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও হাসির দীর্ঘ আভা ছড়িয়ে বলেন, যাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলাম, তাকে পেয়েছিলাম। তাঁর কথায় ও রসিকতায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলাম সবাই।
আমার এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে অতীতসাগরে ডুব দেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ডুবুরির মতো গভীর থেকে যেন তুলে আনেন তাঁর স্মৃতিগুচ্ছ। কবিতা লেখা ও বই পড়ার প্রতি নিজের ভালো লাগার কথা প্রকাশ করে সৌমিত্র বলেন, ‘আমার ভেতরে কবিতা লেখার তাগিদ টের পাই ছোটবেলায়। অভিনয়, আবৃত্তি, কবিতা—এসব শুরু করেছিলাম পারিবারিক সুন্দর একটা আবহে। কবিতা লেখার আগে থেকেই অভিনয়টার প্রতি টান ছিল। আবৃত্তির প্রতি অনুরাগ ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি অভিনয় করছি, আবৃত্তি করছি। কেননা, আমাদের বাড়িতে থিয়েটারের চর্চা ছিল। আবৃত্তির চর্চাও ছিল। কিশোর বয়সে আমার মধ্যে কবিতা লেখার ঝোঁক এসেছিল। মোটামুটি ষোলো বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। বেশির ভাগ বাঙালি ছেলে যেমন কিশোর বয়সে কবিতা লেখে, তেমনই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। কিশোর বয়সে অধিকাংশ বাঙালি ছেলেই প্রেমে পড়লে কবিতা লেখে, আমিও তেমনভাবে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। অবশ্য এটার পেছনেও অনুপ্রেরণা ছিল পরিবার। আমাদের বাড়িতে সাহিত্যের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা ছিল। আমার দাদু সাহিত্যচর্চা করতেন। আমার বাবা-মা সাহিত্য খুব ভালোবাসতেন। ছোটবেলা থেকে আমাদের বইটই পড়ার কোনো বাধানিষেধ ছিল না। অনেক বাঙালির বাড়িতে নানা রকম বাধা থাকে বাইরের বই পড়ার।আমাদের বাড়িতে তা ছিল না। বলা যায়, আমাকে বেশ উৎসাহ দিতেন বাবা-মা। ছোটবেলা থেকেই আমি বইয়ের পোকা ছিলাম। প্রচুর ছড়া ও কবিতা পড়তাম।’
আলাপের এক ফাঁকে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নাটক সম্পর্কে বলতে গিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কলকাতার নাটকের অবনমন হয়েছে। মান কমে গেছে। সিনেমারও একই অবস্থা। কলকাতায় এখন সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার রাজনীতিতে নোংরা জৌলুশ আছে। তরুণেরা বাংলা ভুলে যাচ্ছে, মিশ্র ভাষায় কথা বলছে। বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে কথা বলছে। বাঙালি জাতিটাকে টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশই। বাংলা ভাষাকে গৌরব দিয়েছে বাংলাদেশই।’
নাট্যজন কেরামত মওলার এক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিনয় ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না। অভিনয়ই তো আমাকে রুটি-রুজি দিয়েছে। আমাকে খ্যাতি ও সম্মান দিয়েছে, বিপুল মানুষের ভালোবাসা দিয়েছে।’
অভিনয়ের পাশাপাশি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাটকও লিখেছেন। নাটক লেখার বিষয়ে প্রশ্ন রামেন্দু মজুমদারের। উত্তরে গুণী এই অভিনেতা বলেন, ‘আসলে প্রয়োজনের তাগিদে নাটক লেখা শুরু করেছিলাম। নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিল রেখে জীবনের সঞ্চিত খাতায় অনেক নাটক লিখেছিলাম। কমবেশি অনেক নাটকই দর্শক ও শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে, মানুষের প্রশংসা পেয়েছে।’
নাটকের ভবিষ্যৎ কী—এমন প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিজ্ঞতা ও ত্যাগ কখনো বিফলে যায় না; যায়নি অতীতে, ভবিষ্যতেও যাবে না হয়তো। সেই সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের জীবনের সঙ্গে মিল রেখে কতটুকু প্রাসঙ্গিক আমাদের নাটক, সেটার ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করে। ভালো নাটক সব সময়ই বেঁচে থাকবে। ভালো নাটক মানুষ গ্রহণ করবেই।
একজন ভালো অভিনেতার গুণাবলি সম্পর্কে জানতে চাইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিনেতা হওয়া সহজ নয়। বড় সাধনার বিষয়। ভালো অভিনেতার কাছে মানুষ বিষয়, সমাজ বিষয়, রাষ্ট্রও বিষয়। যে অভিনেতা শুধু আত্মপ্রদর্শন করে, তাকে আমার বড় অভিনেতা মনে হয় না। বড় অভিনেতা তার অভিনয়ে সমাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গ দেখায়, মানুষকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি ভাবতে শেখায়।’
টিভি, চলচ্চিত্র ও মঞ্চ—এসব জায়গায় অভিনয় করতে গিয়ে নিজেকে কি আলাদা করে তৈরি করতে হয়—নাট্যব্যক্তিত্ব কেরামত মওলার প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রথমত অভিনয়, তারপর পরিবেশ বুঝে উপস্থাপন। এতে আমি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। যিনি ছবি আঁকেন, তিনি ছোট ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন, বড় ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন। সে-ই সত্যিকার অভিনেতা, যে সমাজের ভাবনাচিন্তা, অবস্থা অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারে।’
আমাদের আলাপে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নানা দিকও। উঠে এসেছিল দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের কথাও। পাশাপাশি দুই দেশ, পাশাপাশি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। ভাষা এক, সংস্কৃতিও এক। তার পরও দূরত্ব রয়ে গেছে অনেক জায়গায়। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর পথে আরও একটি বিষয় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারত, তা হলো বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে দেখার ব্যবস্থা করা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে সেটি নেই। এ বিষয়ে আমার এক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলাদেশের নাটক, চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতিকে খুব মিস করি। সাংঘাতিকভাবে মিস করি। এ দেশের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকলেও এ রকম একটি প্রতিবন্ধকতার কারণে সেটা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। এটার উত্তরণ জরুরি।’
আড্ডার এক ফাঁকে আবৃত্তিশিল্পী ও নাট্যনির্দেশক গোলাম সারোয়ার জানতে চান অভিনয়ে আবৃত্তিচর্চার প্রয়োজন আছে কি না। সৌমিত্রের জবাব, ‘অভিনয়ের জন্য আবৃত্তিরও ভীষণ দরকার। যাঁরা এটা বোঝেন না, তাঁরা এখনো চোখ বুজে আছেন। অভিনয়ের প্রারম্ভিক কাজ হলো কথা বলা, সেটা আবৃত্তিচর্চা ছাড়া হয় না। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আবৃত্তি ও গান করি। প্রতিদিন রেওয়াজ করি, সাধনা করি। জীবনে সফল হতে হলে তার কাজকে সাধনার পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটা অভিনয় হোক, আর আবৃত্তি হোক কিংবা যেকোনো মাধ্যমই হোক। একজন অভিনেতাকে চার অক্ষরের একটি শব্দ আঁকড়ে রাখতে হয়, সেটা হলো ভালোবাসা। নিজের কাজের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা থাকতে হবে। নিজের কাজ ও দায়িত্বের প্রতি ভালোবাসাই মানুষকে সাফল্য এনে দেয়, পৌঁছে দেয় সঠিক অবস্থানে। ভালোবাসা ছাড়া কিচ্ছু হয় না, হবেও না।’

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৬ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১১ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৬ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

সেই দিনের কথা, সেই সকালের কথা মাঝেমধ্যেই জ্বলজ্বল করে মনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টায় আসার কথা তাঁর। তবে এর আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে।
১৫ নভেম্বর ২০২২
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১১ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৬ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৭ দিন আগেনিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

সেই দিনের কথা, সেই সকালের কথা মাঝেমধ্যেই জ্বলজ্বল করে মনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টায় আসার কথা তাঁর। তবে এর আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে।
১৫ নভেম্বর ২০২২
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৬ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৬ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

সেই দিনের কথা, সেই সকালের কথা মাঝেমধ্যেই জ্বলজ্বল করে মনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টায় আসার কথা তাঁর। তবে এর আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে।
১৫ নভেম্বর ২০২২
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৬ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১১ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

সেই দিনের কথা, সেই সকালের কথা মাঝেমধ্যেই জ্বলজ্বল করে মনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টায় আসার কথা তাঁর। তবে এর আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে।
১৫ নভেম্বর ২০২২
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৬ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১১ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৬ দিন আগে