Ajker Patrika

শিল্পচর্চার সামাজিকীকরণে দাগ শিল্পী-গোষ্ঠীর একটি উদ্যোগ

দীপ্তি দত্ত
আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২২, ১৪: ২৭
শিল্পচর্চার সামাজিকীকরণে দাগ শিল্পী-গোষ্ঠীর একটি উদ্যোগ

পুরাতন বন্দর নগরী, পুরাতন শহর, পুরাতন শীতলক্ষ্যা, জামদানির পুরাতন সূতিকাগার, পুরাতন কাঠের ঘোড়া—এই সকল পুরাতনের গল্পের রাজ্যে নারায়ণগঞ্জের বাস। সেখানে ঐতিহ্য, সেখানে জাদুঘর সব জমজমাট। টিকিট কেটে আমরা ভিড় করি এই সকল পুরাতনের দিকে একবার চোখ দিতে। অথচ সত্য হলো নারায়ণগঞ্জ পুরাতন শহর, কিন্তু মৃত নয়। সেখানে বাস প্রায় বাইশ লাখ লোকের। শীতলক্ষ্যা অসুস্থ; কিন্তু মৃত নয়। জামদানি শীতলক্ষার দিকেই তাকিয়ে আছে। জাদুঘরের দিকে নয়। ঢাকার বাইরে, ঢাকার গ্যালারিগুলোর বাইরে দাগ আর্ট স্টেশন-এর প্রদর্শনীতে গিয়ে কেবল এই ভালো লাগার অনুরণনই মনে জেগেছে। 

ঐতিহ্য, লোকশিল্পের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রয়াসে নিজেদের ক্লান্ত না করে নারায়ণগঞ্জের এই শিল্পী দল বেঁচে থাকা ও বাঁচিয়ে রাখার কথা বলছে, বুনছে প্রাণের গল্প। এই গল্পে বিদ্রোহের রূপবাদী প্রবণতা লঘু হয়েছে শিল্পীদের নিজেদের জীবনঘনিষ্ঠ রূপ নির্মাণ প্রবণতার কারণে। অমল আকাশ যেমন পটগানে ও পটছবিতে যখন বলে ‘হাশেম ফুডে ঝলসানো প্রাণ’ বা শ্রমিক বিদ্রোহের গল্প, তখন তা কেবল আঙ্গিকের দুর্দান্তপনায় আক্রান্ত হয় না, শিল্পীর সহজাত অবস্থানকেও স্পষ্ট করে। এই অবস্থাটি পুরো প্রদর্শনী, তথা উদ্যোগের মূল শক্তি। শিল্পী খন্দকার নাছির বরাবরের মতোই অরগানিক ফর্মে মুগ্ধ করেছেন। তবে কাঠ মাধ্যমে তিনি সময়সাপেক্ষ এবং শ্রমসাধ্য যে রীতিতে কাজ করে থাকেন, তা এখানে ছিল না। আয়াসহীন ভাস্কর্যের বাজারের সঙ্গে যুদ্ধ করার পরও কাঠের কাজ তিনি জারি রেখেছেন। একই সঙ্গে প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছেন ম্যাটেরিয়াল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এই নিরীক্ষা শীতলক্ষার প্রাণ টিকিয়ে রাখার সাথে ক্রমেই সম্পর্কিত হয়েছে নানাভাবে।

প্রদর্শনীতে থাকা খন্দকার নাছির আহাম্মদের ভাস্কর্যগুলো ভাবনার জোগান দেয়।নাছির এই প্রদর্শনীতে কাঠের বদলে কাজ করেছেন কাগজের কাদামাটিতে (পেপার ক্লে)। মাধ্যম হিসেবে কাগজের কাদামাটি নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু প্রথাগত কাঠ, পাথর, তামা ইত্যাদির বদলে নাছির তাঁর ভাস্কর্যের উপকরণ হিসেবে যেভাবে একে নিজের জন্য প্রাসঙ্গিক করে তোলেন তা আমাদের ভাস্কর্য চর্চার জন্য জরুরি। রামকিঙ্কর তাঁর অবস্থার চাপে যেমন খোঁজ করেছিলেন একটি মাধ্যমের, শিল্পী ইমাম হোসেন সুমনও চমকে দেওয়া সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনীতে। ভাবনা ও মাধ্যমের সমন্বয় ছিল যথাযথ। কাগজের কাদামাটিকে সুমন ভাবনার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। প্রদর্শনী কক্ষে প্রবেশের পথে মাথার ওপরে ঝুলছে 'জগদ্দল' নামে এক পাথর। শহীদ আহমেদ মিঠুর এই কাজেও উপকরণ-ভাবনার সহায় হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। পাথরের রূপক হয়ে চিন্তা বা উত্তেজনার উদ্দীপক হয়ে আছে দর্শকের জন্য। 

কিন্তু নাছির ভাবনার স্বার্থে ম্যাটেরিয়ালের দিকে যাননি। অর্থনৈতিক শর্তগুলো যাপনের প্রয়োজনে, অবস্থার চাপে নাছির বিকল্প খোঁজেন। সেই বিকল্প থেকে ক্ষণিক কাজের জন্য ব্যবহার করা থার্মোকলের মতো ম্যাটেরিয়ালের সঙ্গে কাগজের কাদামাটির যোগে প্রথমে নিজের সন্তানের জন্য খেলনা পুতুল এবং ক্রমে তা ভাস্কর্যে যুক্ত করেছেন। মাধ্যমের এই নিরীক্ষা স্থানিক সকল প্রসঙ্গ বিবেচনায় অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্যকে ঐশ্বর্যের ভারিক্কিপনা থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে।

শিল্পী সুমনা আক্তার গার্মেন্টসের শহর নারায়ণগঞ্জ থেকে ওয়েস্টেজ গার্মেন্টস ম্যাটেরিয়াল দিয়ে যৌথভাবে নির্মাণ করেছেন একটি নান্দনিক দেয়াল কাঁথামাধ্যমের এই নিরীক্ষা-দাগ-গোষ্ঠী তার স্থানিক পরিসর ও পরিজন লক্ষ্যার দিকে নজর রেখে অব্যাহত রাখলে ভাস্কর্যকে গণমুখী করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। নাছিরের মতো একই মাধ্যমে কাজ করেছেন শিল্পী রঞ্জিত সরকার। কিন্তু অভিব্যক্তিতে দুজনের কাজ আলাদা হয়ে গেছে পুরোপুরি। 

শিল্পী সুমনা আক্তার গার্মেন্টসের শহর নারায়ণগঞ্জ থেকে ওয়েস্টেজ গার্মেন্টস ম্যাটেরিয়াল দিয়ে যৌথভাবে নির্মাণ করেছেন একটি নান্দনিক দেয়াল কাঁথা। এই কাঁথাও গার্মেন্টসের ওয়েস্টেজকে কেন্দ্র করে একটি বাজার ভাবনাকে উসকে দেয়, যার সম্ভাবনা ও বাজার ইতিমধ্যেই পরীক্ষিত নানাভাবে।

প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া শিল্পী লিটন সরকারের শিল্পকর্ম।শিল্পী লিটন সরকারের শিল্পকর্মের শিরোনাম নিজেই ইতিহাসের জটিলতা ও সংকটের প্রতীকী ভাষা হয়ে ওঠে। ‘পানিজল’ কাজে শীতলক্ষার সমৃদ্ধি, যা লিখিত বা মৌখিক সাহিত্যে ছড়িয়ে আছে, তাকেই আবার সামনে এনেছেন শীতলক্ষ্যাকে ফিরে পাওয়ার আশায়। এই আশা জাগার পেছনে নারায়ণগঞ্জ চারুকলা ইনস্টিটিউটের নবনির্মিত ভবন তার পাশের লেকের সংস্কার অনেক বড় প্রভাবক। এই লেকটি গিয়ে মিশেছে শীতলক্ষার সাথে। ফলে লক্ষ্যা পাড়ের চিত্রকথা এককভাবে দৃশ্যায়িত নয়। চারুকলা ইনস্টিটিউটকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে চলা আন্দোলন, তার একটি সফল পরিবেশকেন্দ্রিক রূপায়ণকে পাশে রেখে এই প্রদর্শনী দেখলে বোঝা যাবে, কোনো ঐতিহ্য-পিপাসা নয়, বরং বর্তমানকে বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ‘লক্ষ্যাপাড়ের চিত্রকথা-১ ’-এ উপলব্ধ হচ্ছে। 

শিল্পী খন্দকার নাছির আহাম্মদের তত্ত্বাবধানে ‘এই শহরে’ শিরোনামের এই ত্রিমাত্রিক স্থাপত্যিক স্পেস তৈরির কাজটা করেছেন নয়জন শিক্ষার্থীশিল্পী মুনতাসীর মঈন ইতিহাসের স্মারক হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে পাঠ করেন তাঁর ছবি ও টেক্সটের মধ্য দিয়ে। তারই একটি আংশিক উপস্থাপনা এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। ভীখন লাল-নারায়ণগঞ্জের নাম যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন-এঁকেছেন, তাঁর কল্পিত ছবি, ইতিহাস থেকে দৃশ্যরূপে দর্শকের সামনে এনেছেন সমাজ সেবক ফারুক মঈন, সংগীত শিল্পী আবুল সরকার, ব্যবসায়ী রণদা প্রসাদ সাহা, ক্রীড়াবিদ মোনেম মুন্না, শিল্পী মঞ্জুশ্রী নিয়োগী, চিত্রশিল্পী মাহবুব কামরান, বংশীবাদক ওস্তাদ শামসুল হক, ভাষাসৈনিক মমতাজ বেগম, শিক্ষাবিদ খগেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর মতো নানা গুণীজনকে। শিল্পীদের ইতিহাস পাঠের এই প্রকরণ ইতিহাসকে সহজভাবে পাঠ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে জোরালোভাবে।

প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া একটি শিল্পকর্ম। শিল্পী অমল আকাশ।এই প্রদর্শনীর আরেকটি চমৎকার দিক হচ্ছে দ্বিমাত্রিকতা ও ত্রিমাত্রিকতার একাডেমিক চর্চার যে সীমানা, তা ভেদ করে অগ্রসর হয়েছে। ‘এই শহরে’ শিরোনামের একটি দলীয় কাজ রয়েছে। মোট নয়জন শিক্ষার্থী মিলে কিউরেটর নাছিরের তত্ত্বাবধানে ত্রিমাত্রিক স্থাপত্যিক স্পেস তৈরির কাজটা করেছে। তাঁদের মধ্যে তামান্না লিজা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএফএ প্রথম পর্বের শিক্ষার্থী। সুমিত দাস, সজীব ঘোষ, সজীব মণ্ডল, শিব শংকর, সানন্দা সাহা, দিপা পোদ্দার, নুর মোহাম্মদ সান্ত, মেইবু অং মারমা চারুকলার প্রি-ডিগ্রির শিক্ষার্থী। তাঁরা নারায়ণগঞ্জ শহরকে করোগেডেট বোর্ডে ত্রিমাত্রিক ফর্মে উপস্থাপন করেছেন। যা চারুকলার প্রথাগত বিশেষায়িত শিক্ষার যে স্কুলিং, তার বিপরীত প্রবণতাকে উদ্দীপ্ত করে। রয়েছে শিল্পী বদরুল আলমের উপস্থাপিত লক্ষ্যার নির্যাতনের ইতিহাস। সর্বোপরি প্রদর্শনীতে অবজেক্ট, স্পেস ও ডিসপ্লের মধ্যে যে একটা সমন্বয় ও পরিমিতিবোধ কাজ করেছে, তা দর্শককে প্রশান্তি দেয়। আর এ কারণেই কিউরেটর হিসেবেও খন্দকার নাছির আমাদের ভাবনার জোগান দেন নানা কারণে। শিল্পচর্চার সামাজিকীকরণের ভাবনা মাথায় রেখে নেওয়া এই উদ্যোগ নারায়ণগঞ্জের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে সম্প্রসারিত করে নিঃসন্দেহে।

প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া দাগ শিল্প-গোষ্ঠীর সদস্যরা।দাগ আর্ট স্টেশন তাদের ‘সামাজিক শিল্পচর্চা’র স্লোগান নিয়ে ২০১৮ সালে ‘নারায়ণগঞ্জ আলী আহাম্মদ চুনকা নগর মিলনায়তন ও পাঠাগার’ একটি দলীয় প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, এই প্রদর্শনী সেই আশাবাদকে জিইয়ে রাখে। জিইয়ে রাখে ‘ছবির হাট’-এর মতো গোষ্ঠীগত সাংস্কৃতিক উদ্যোগের প্রসারমান সম্ভাবনাগুলোকে। আলী আহাম্মদ পৌর মিলনায়তন ও পাঠাগার গ্যালারিতে চলমান এ প্রদর্শনী শেষ হচ্ছে আগামীকাল শুক্রবার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পদত্যাগ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আমিনুল ইসলাম

পাগল বেশে রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা কন্টেন্ট ক্রিয়েটর সম্পর্কে যা জানা গেল

প্রধান উপদেষ্টার নতুন বিশেষ সহকারী কে এই আনিসুজ্জামান চৌধুরী

সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জাতিসংঘের ফলকার তুর্কের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাল আইএসপিআর

সিএমএইচে মাগুরার শিশুটির অবস্থা অপরিবর্তিত: আইএসপিআর

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত