Ajker Patrika

আবুল মনসুর আহমদ: প্রিয় পূর্বসূরি

মারুফ ইসলাম
আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৩, ১২: ৩৪
আবুল মনসুর আহমদ: প্রিয় পূর্বসূরি

নিদানের কালে পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক তালাশ করতে হয়, তাতে কখনো কখনো সঠিক পথের দিশা পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা এমনই এক নিদানের কালের নাদান বাচ্চা যে, কত অনায়াসে প্রিয় পূর্বসূরিদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছি। একজন আবুল মনসুর আহমদ, আমাদের সেরকমই এক প্রিয় পূর্বসূরি, যাঁকে আমরা স্রেফ বিসিএস পরীক্ষার্থীদের ঠোঁটের আগায় বন্দী করে ফেলেছি। আমাদের প্রজন্মের প্রায় প্রতিটি ‘বিসিএস-তরুণ’ তাঁর নাম ও ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ের নাম মুখস্থ করে ফেলেছে শুধু বিসিএস পরীক্ষায় একটি নম্বর পাওয়ার আশায়। এর বাইরে আবুল মনসুর আহমদ সম্পর্কে তাঁরা আর কিছুই জানে না! কী দুর্দৈব! কত হতভাগ্য এই প্রজন্ম!

আবুল মনসুর আহমদের নানা পরিচয়। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী ও সমাজ সংস্কারক। কোনো পরিচয়ের চেয়ে কোনো পরিচয় ছোট নয়। প্রতিটি পরিচয় স্বতন্ত্র মহিমায় ভাস্বর। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি জ্বলজ্বলে তারকা। তবু কবুল করতেই হয়, এসব পরিচয়ের মধ্যে তাঁর সাহিত্যিক পরিচয়ই সব থেকে উজ্জ্বল। এবং অতি অবশ্যই আরও একবার স্বীকার করে নিতে হবে যে, সাহিত্যিক পরিচয়ের মধ্যে তিনি আবার ‘ব্যঙ্গ সাহিত্যিক’ হিসেবে বিরল, ব্যতিক্রম। 

বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম ব্যঙ্গ সাহিত্যের সূত্রপাত বোধ করি বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে। তিনি তাঁর কালোত্তীর্ণ চরিত্র কমলাকান্তকে তৈরি করেছিলেন বিদেশি স্যাটায়ার সাহিত্যের আদলে। কমলাকান্ত প্রভূত রস বিলিয়েছে বাঙালি পাঠক মনে, সন্দেহ নেই। এরপর যদ্দুর জানা যায়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য মহোদয় ও বীরবল নামে খ্যাত সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যভুবনে রম্য লেখক হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনিও সাহিত্যের এ ধারায় বেশ মেধার স্বাক্ষর রাখেন। প্রমথ চৌধুরীর পর বাংলা রম্য সাহিত্যে আলোচিত হয়ে ওঠেন রাজশেখর বসু, যিনি পরশুরাম নামেই সমধিক পরিচিত। এরপর অবধারিতভাবে নাম চলে আসে ‘প্রণাবি’র অর্থাৎ প্রমথনাথ বিশীর। ধারণা করা হয়, ইংরেজি সাহিত্যের স্যাটায়ার গুরু জর্জ বার্নার্ড শ যেহেতু সংক্ষেপে নিজের নাম ‘জিবিএস’ লিখতেন, সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রমথনাথ বিশীও লিখতে শুরু করেন প্রণাবি। সে যা হোক, রম্য সাহিত্যে এরপর যিনি চিরস্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠা করলেন, তিনি আবুল মনসুর আহমদ। তাঁর রচিত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক রচনা ‘আয়না’ ও ‘ফুড কনফারেন্স’ তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের এক অসামান্য দলিল হয়ে রয়েছে। সন্দেহ নেই, একটি সোনার দোয়াত-কলম ছিল আবুল মনসুর আহমদের হাতে। 

আবুল মনসুর আহমদের সেই সোনার দোয়াত-কলম থেকে যেসব অনবদ্য রচনার জন্ম হতো, সেসব রচনার শৈলী সম্পর্কে বন্ধুবর কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বাংলা ভাষার ব্যঙ্গ সাহিত্য খুব উন্নত হয়নি। তার কারণ, ব্যঙ্গ সাহিত্য সৃষ্টির জন্য অসাধারণ মেধার প্রয়োজন। এ যেন সেতারের কান মলে সুর বের করা। সুরও বেরোবে, তারও ছিঁড়বে না। আমি একবার এক ওস্তাদকে লাঠি দিয়ে স্বরোদ বাজাতে দেখেছিলুম। সেবার সেই ওস্তাদের হাত সাফাই দেখে আশ্চর্য হয়েছিলুম। আর আজ বন্ধু মনসুরের হাত সাফাই দেখে বিস্মিত হলুম। ভাষার কান মলে রস সৃষ্টির ক্ষমতা মনসুরের অসাধারণ। এ যেন পাকা ওস্তাদি হাত। আবুল মনসুরের ব্যঙ্গের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, ব্যঙ্গ যখন হাসায় তখন সে হয় ব্যঙ্গ; কিন্তু কামড়ায় যখন, তখন সে হয় সাপ। আর সেই কামড় গিয়ে যার গায়ে বাজে, তার ভাব হয় সাপের মুখের ব্যাঙের মতোই করুণ।’ 

 নজরুল প্রদত্ত এই সনদকে অবিশ্বাস্য মনে হলে বারবার ফিরে যেতে হবে আবুল মনসুর আহমদের রঙ্গ-ব্যঙ্গ রচনাগুলোর কাছে। অন্তর্দৃষ্টি উন্মীলন করে পাঠ করতে হবে আয়না ও ফুড কনফারেন্স বই দুখানি। তাহলেই উপলব্ধি করা যাবে ভাষার কান মলে কী সুর তিনি সৃষ্টি করেছেন। আয়না গল্পগ্রন্থে রয়েছে মোটে সাতটি গল্প। গল্পগুলো হচ্ছে: হুজুর কেবলা, গো দেওতা কা দেশ, নায়েবে নবী, লিডারে কওম, মুজাহেদীন, বিদ্রোহী সংঘ ও ধর্মরাজ্য। প্রতিটি গল্পেই ধরা আছে সমাজবাস্তবতা। পাঠককে কখনো হাসিয়ে, কখনো চাবুকপেটা করে দেখিয়েছেন সমাজের নানা অসংগতি। 

প্রসঙ্গত আলোচনা করা যেতে পারে হুজুর কেবলা গল্পের সারসংক্ষেপ। গল্পটি অতিবিখ্যাত। বিশ্বসাহিত্যের অংশ হওয়ার দাবিদার। এই গল্পে রয়েছে একজন ভণ্ড পীর। নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য জঘন্য ভণ্ডামির আশ্রয় নেয় সে। গ্রামের শিক্ষার আলোবঞ্চিত অসহায় সহজ-সরল মানুষগুলোকে বোকা বানিয়ে সে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের খাসমহলে পৌঁছে যায়। গল্পের ঘটনা এমন: এই ভণ্ড পীর তারই এক বিশ্বস্ত মুরিদের যুবতী স্ত্রীর রূপে আকৃষ্ট হয়ে তাকে কাছে পাওয়ার লালসায় বহুবিধ ফন্দি আঁটতে থাকে। ছলনার আশ্রয় নিয়ে মুরিদ ও তার স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করে। এবং একসময় সম্পর্ক ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। অতঃপর ভণ্ড পীর ওই সুন্দরী যুবতী নারীকে বিয়ে করে। অথচ ইতিপূর্বে এই ভণ্ডের আরও তিন-তিনটি স্ত্রী বহাল তবিয়তেই রয়েছে। 

এই গল্প মোড় নেয় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এমদাদের মাধ্যমে। এমদাদ একদা পীর মহাশয়ের ভণ্ডামি ধরে ফেলে। সে প্রবল উত্তেজিত হয়ে পীরকে শারীরিক আক্রমণ করে বসে। এই আক্রমণের সুযোগ কাজে লাগায় ভণ্ড পীর। সে এমদাদকে পাগল আখ্যা দেয়। এভাবে লেখক আবুল মনসুর আহমদ হুজুর কেবলার চরিত্রের কলুষতা আয়নার মতো করেই পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। 

এই হুজুর কেবলারা এখনো আমাদের সমাজে রয়ে গেছে। নানাভাবে ভোল পাল্টে তারা তাদের কৃতকার্য এখনো সম্পাদন করে যাচ্ছে। কিন্তু সমাজে নেই কোনো আবুল মনসুর আহমদ, যিনি কলমের আঁচড়ে আঁকবেন তাদের বীভৎস মুখ। তাই তো ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘পরশুরাম হিন্দু দেবতাদের নিয়ে অনেক কিছু বলেছেন, হিন্দু সম্প্রদায় তা সহ্য করেছে। আবুল মনসুর আহমদের দুঃসাহসও সেদিন সমাজ সহ্য করেছিল। কিন্তু আজ কোনো সম্পাদক এমন গল্প ছাপতে সাহস করবেন কি না এবং সমাজ তা সহ্য করবে কি না, সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে।’ 

এই সন্দেহ থেকেই কি বাংলার বর্তমান লেখককুল কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অসংগতি নিয়ে কোনো ব্যঙ্গ করেন না? প্রশ্ন সহজ, উত্তর কঠিন। তার চেয়ে আবার আবুল মনসুর আহমদের গল্পের দিকে নজর ফেরানো যাক। ‘হুজুর কেবলা’ যেমন ইসলাম ধর্মের অপব্যবহার কেন্দ্রিক অন্ধকার নিয়ে লেখা গল্প, তেমনি ‘গো দেওতা কা দেশ’ গল্পটি হিন্দু ধর্মের অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে লেখা। হিন্দু সমাজে গো হত্যা নিয়ে যে প্রথা প্রচলিত রয়েছে, তার গোড়া ধরে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছেন আবুল মনসুর আহমদ। এ ছাড়া হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াতে ইংরেজরা যে কৌশল অবলম্বন করেছিল, তারও যৎসামান্য নমুনা পাওয়া যায় এই গল্পে। বলার অপেক্ষা রাখে না, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাই এই গল্পের প্রধান উপজীব্য। 

 শুধু ধর্মের এসব অসংগতিই নয়, সমাজপতি, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী যেখানেই তিনি কোনো অন্যায়-অসংগতির দেখা পেয়েছেন, সেখানেই তাঁর কলমকে চাবুক বানিয়ে শপাৎ শপাৎ আওয়াজ তুলেছেন। তাঁর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের রসাঘাত ও কশাঘাত মূলত ছাঁকনি হয়ে সমাজকে পরিশোধিত করত। আবুল মনসুর আহমদের লেখার আঘাত শুধু ক্ষয়প্রবণ সমাজের মুমূর্ষু মূল্যবোধ ও লৌকিক আচারকেই আক্রমণ করেনি, অধিকন্তু যারা এসব অনুষঙ্গ নিয়ে মিথ্যার ফুলঝুড়ি সাজাত, তাদের তিনি নাকা-নিচুবানি খাইয়েছেন। 

তো, অস্বীকার করার আর উপায় কী যে তিনি সমকাল, সমাজ, মানুষ ও রাজনীতিসচেতন সাহিত্যিক ছিলেন? তাঁর আরেক অমর কীর্তি ফুড কনফারেন্সে কী অসম্ভব দ্যুতি নিয়ে জ্বলজ্বল করছে বাংলার সমাজ-সংসার। এ বই যখন আবুল মনসুর আহমদ লেখেন, তখন বইটি পড়ে কালজয়ী লেখক অন্নদাশংকর রায় বলেছেন, ‘“আয়না” লিখিয়া আবুল মনসুর আহমদ প্রাতঃস্মরণীয় হইয়াছিলেন। “ফুড কনফারেন্স” লিখিয়া তিনি অমর হইলেন।’ 

সত্যিই আবুল মনসুর আহমদ অমর হয়েছেন। বাংলা রম্য সাহিত্যের ইতিহাস লিখতে গেলে তাঁর নাম এবং ‘ফুড কনফারেন্স’-এর নাম বাদ দেওয়া সত্যিই অসম্ভব। বাংলা ভাষার সাহিত্য যারা এখনো টুকটাক পড়ে, তাদের বইয়ের শেলফে অবধারিতভাবে নাক উঁচু করে রয়েছে ‘ফুড কনফারেন্স’। ফুড কনফারেন্সের এক একটি গল্প যেন এক একটি সময়ের খতিয়ান। এই গল্পগন্থের রিলিফ ওয়ার্ক গল্পের শেষাংশে একটু চোখ বুলানো যাক: 

 ‘সূর্যোদয়ের পূর্বেই মধুপুর গ্রামের শতাধিক ছেলে বুড়োকে হাতকড়া পরা অবস্থায় রিলিফ কমিটির তাম্বুর সম্মুখে জড়ো করা হইল। দারোগা সাহেব সাড়ম্বরে হামিদদের সকলের জবানবন্দি গ্রহণ করিলেন। জবানবন্দি শেষ করিয়া একপাল অভুক্ত অর্ধনগ্ন নরকঙ্কালকে ভেড়ার পালের মতো খেদাইয়া থানায় লইয়া গেলেন।’ 

কী নির্মম দৃশ্যকল্প! অথচ কী বাস্তব। 

আবুল মনসুর আহমদের আরেকটি জনপ্রিয় রম্য গল্পের নাম ‘গালিভরের সফর নামা’। এই গল্পে তিনি নীতিকথার দিকগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন অম্লমধুর ব্যঙ্গের মাধ্যমে। এই গল্পের একটি অংশ এ রকম: 

‘আলিম: শরিয়ত-বিরোধী বিজ্ঞান-দর্শন ও ভূগোল পড়ান হৈব না। 

ডিপিআই: আচ্ছা, তারপর? 

আলিম: মেয়েদের স্কুল কলেজে পড়ান হৈব না। 

সেক্রেটারি: কিন্তু ডাক্তারি ও নার্সিং না শিখালে হাসপাতাল চলবে কেমনে? আওরতদের চিকিৎসা করবে কে? 

আলিম: আওরতদের আবরু-ইজ্জত নষ্ট কৈরা ডাক্তারি ও নার্সিং শিক্ষা দিতে হৈব? চিকিৎসার জন্য? শুইনা হাসি পায়। হায়াত, মউত, রিজিক, দৌলত এই চারটি চিজ আল্লা নিজের হাতে রাখছেন। চিকিৎসকেরা কেউ কারও হায়াত দিছেন, এ কথা আপনার কোনো দিন শুনছেন?’ 

বিষয়বস্তু তো বটেই, ভাষাও তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র। তাঁর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিনি ময়মনসিংহের কথ্য ভাষাকে সাহিত্যে স্থান দিতে চেয়েছেন। এটা তাঁর জাতীয়তাবাদেরই বহিঃপ্রকাশ তাতে সন্দেহ নেই। এ প্রসঙ্গে ড. রফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারিকে আবুল মনসুর আহমদ একুশ দফায় পরিণত করেছিলেন। আমরা জাতীয়তাবোধের একটা মহান চেতনা তাঁর মধ্যে পেয়েছি।’ 

আজ, এই নিদানের কালে আবুল মনসুর আহমদের মতো জাতীয়তাবোধে জাগ্রত হয়ে কলম ধরার মতো কেউ নেই। তাঁর মতো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে সমাজের নিদ্রাভঙ্গ করার মতোও কেউ নেই। তাই এই দুর্দিনে আপনাকে বড্ড বেশি দরকার, প্রিয় পূর্বসূরি আবুল মনসুর আহমদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

গবেষণায় বেরিয়ে এল আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’র গল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’

গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।

ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’

মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’

মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।

রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।

মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’

১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। ছবি: সংগৃহীত

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।

মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।

নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।

বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল যেন তাঁর দীর্ঘ কোনো বাক্যের সমাপ্তি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ছবি: সংগৃহীত
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ছবি: সংগৃহীত

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।

সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।

১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।

তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।

ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।

তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।

২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।

চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।

তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের কলম

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ০০: ১০
সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের কলম

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।

লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।

লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।

১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।

লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।

‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।

এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত