ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের প্রচেষ্টা এবং দেশটির ইসলামি প্রশাসনকে পশ্চিমা দুনিয়ায় যেভাবে ‘অতিরঞ্জিত’ করে তুলে ধরা হয়—তার বিরুদ্ধে অবস্থান প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কেনেথ নি’ল ওয়াল্টজের। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ছিলেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যয়নে তিনি অন্যতম খ্যাতনামা গবেষক। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং কোরিয়া যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ‘নিওরিয়ালিজমের’ জনক হিসেবে পরিচিত কেনেথ ওয়াল্টজ মারা যান ২০১৩ সালে। মৃত্যুর আগের বছর ২০১২ সালে তাঁর একটি নিবন্ধ ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের এই প্রেক্ষাপটে তাঁর পর্যবেক্ষণটি খুবই প্রাসঙ্গিক। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান।
কেনেথ এন. ওয়াল্টজ
কয়েক মাস ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের করণীয় কী হওয়া উচিত—তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। এই তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আগের কঠোর নিষেধাজ্ঞাকে আরও জোরালো করেছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গত জানুয়ারিতে ঘোষণা দিয়েছে, তারা আগামী ১ জুলাই থেকে ইরানি তেলে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করবে। যদিও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং ইরান আবারও আলোচনার টেবিলে ফিরেছে। এরপরও গোটা বিষয়টি নিয়ে একটি উৎকট সংকটের কালো ছায়া ঘনিয়ে আসছে।
কিন্তু এমনটা হওয়া উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং ইসরায়েলের বেশির ভাগ বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারক মনে করেন, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তবে সেটিই হবে এই সংকটের সবচেয়ে খারাপ পরিণতি। কিন্তু বাস্তবতা হতে পারে উল্টো—সেটিই হয়তো হবে সবচেয়ে ভালো পরিণতি, যেটি মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঘিরে চলমান সংকট তিনটি পথে শেষ হতে পারে। প্রথমত, কূটনৈতিক তৎপরতা ও কঠোর নিষেধাজ্ঞার সম্মিলিত চাপে ইরান তার পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে পারে। কিন্তু এটি খুব একটা সম্ভাবনাময় দিক নয়। ইতিহাস বলছে, কোনো দেশ যদি পরমাণু অস্ত্র অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, তবে তাকে ফেরানো খুবই কঠিন।
কেবল নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোনো দেশের পারমাণবিক কর্মসূচিকে থামানো যায় না। উত্তর কোরিয়ার কথাই ধরুন—অসংখ্য নিষেধাজ্ঞা আর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও তারা পরমাণু অস্ত্র নির্মাণে সফল হয়েছে। যদি তেহরান মনে করে, তাদের নিরাপত্তার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র জরুরি, তবে নিষেধাজ্ঞা তাদের মত বদলাবে না। বরং, নতুন করে আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে ইরান নিজেকে আরও অনিরাপদ মনে করতে পারে এবং এই আতঙ্ক থেকেই তারা ‘চূড়ান্ত প্রতিরোধের’ পথ হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দিকে আরও বেশি ঝুঁকে যেতে পারে।
দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি হলো—ইরান সরাসরি পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা না করে একটি ‘ব্রেকআউট সক্ষমতা’ অর্জন করবে। অর্থাৎ, তারা চাইলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষা করতে পারে—এমন অবস্থানে পৌঁছে যাবে। আর যদি, ইরান সেটি না করে, তবে তারাই প্রথম কোনো দেশ হবে না, যারা ব্যাপক পরমাণু কর্মসূচি গড়ে তুলেও সরাসরি বোমা তৈরি করবে না। জাপানের কথাই ধরুন, তাদের বিস্তৃত বেসামরিক পরমাণু অবকাঠামো আছে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, তারা চাইলে খুব অল্প সময়েই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে। কিন্তু তারা এখনো সেই পথে যায়নি।
ইরানের বর্তমান শাসকদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রয়োজন মেটাতে ‘ব্রেকআউট সক্ষমতা’ বা চাইলেই দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা পর্যন্ত পৌঁছানো একটি কৌশল হতে পারে। এতে করে তাঁরা ‘কট্টরপন্থীদের’ আশ্বস্ত করতে পারবেন যে, তারা বোমা থাকার নিরাপত্তাসহ নানা সুবিধা পাবে, আবার এই সুবিধা ব্যবহার না করায় আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা বা নিন্দার ঝুঁকিও এড়ানো যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো—এই কৌশল সব সময় পরিকল্পনামতো কাজ নাও করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের প্রধান উদ্বেগ হলো—অস্ত্রায়ন বা অস্ত্র তৈরির পর্যায়। তাই, যদি ইরান সরাসরি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত থাকে, তাহলে তারা হয়তো এই পরিস্থিতিকে মেনে নেবে। কিন্তু ইসরায়েল অনেক আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তাদের দৃষ্টিতে ইরানের উল্লেখযোগ্য সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতাও অগ্রহণযোগ্য হুমকি। ফলে এমন এক বাস্তবতা তৈরি হতে পারে যে, যেখানে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি না করার ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য অঙ্গীকার দিলেও পশ্চিমা শক্তিগুলো সন্তুষ্ট হবে, কিন্তু ইসরায়েল তা মানবে না। ‘ভার্চুয়াল পারমাণবিক অস্ত্র’ ইসরায়েলকে অতটা ভীত করবে না, যতটা আসল অস্ত্র করবে। সে কারণে তারা হয়তো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নস্যাৎ করতে ঝুঁকিপূর্ণ গুপ্ত হামলা, নাশকতা কিংবা বিজ্ঞানীদের হত্যা চালিয়ে যেতে থাকবে, যা ইরানকে বুঝিয়ে দিতে পারে যে, শুধু ব্রেকআউট সক্ষমতা যথেষ্ট নয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে অস্ত্রায়নই একমাত্র পথ।
তৃতীয় সম্ভাবনাটি হলো—ইরান তার বর্তমান পথেই এগিয়ে গিয়ে প্রকাশ্যে পারমাণবিক পরীক্ষা চালাবে এবং নিজেকে পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে ঘোষণা করবে। মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, এ ধরনের পরিণতি তাঁদের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তাঁদের ভাষায়, পারমাণবিক শক্তিধর ইরান হবে ভয়াবহ, অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। যখনই দেখে কোনো দেশ পরমাণু অস্ত্রের দিকে এগোচ্ছে, তখনই এ ধরনের ভাষা পরাশক্তিগুলো সাধারণত ব্যবহার করে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, যতবারই কোনো দেশ সফলভাবে পরমাণু শক্তিধর হয়েছে, বাকি সদস্যরা শেষ পর্যন্ত তাদের মেনে নিয়েছে। বরং সামরিক শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি হওয়ায় নতুন পারমাণবিক রাষ্ট্রগুলো অনেক সময় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাড়িয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে গত চার দশক ধরে ইসরায়েলের একক পারমাণবিক আধিপত্য বিরাজ করছে, সেটিই মূলত এই অঞ্চলের অস্থিরতার বড় উৎস। পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে এমন কোনো একক ও অনিয়ন্ত্রিত পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র নেই। বর্তমান সংকটের জন্য ইরানের পরমাণু আকাঙ্ক্ষার চেয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রভান্ডারই বেশি দায়ী। কারণ, ক্ষমতা থাকলে কেউ না কেউ সেটি প্রতিরোধ করতে চাইবেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এত দিনে কেবল একজন প্রতিদ্বন্দ্বীই মাঠে নেমেছে।
অবশ্য, এটি সহজেই বোঝা যায় যে, কেন ইসরায়েল এই অঞ্চলের একমাত্র পারমাণবিক শক্তি হিসেবে থেকে যেতে চায় এবং কেন তারা সেই অবস্থান রক্ষায় প্রয়োজনে বলপ্রয়োগেও প্রস্তুত। ইরাক পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠবে, এই আশঙ্কায় ১৯৮১ সালে ইসরায়েল দেশটির ওসিরাক পারমাণবিক স্থাপনায় বোমাবর্ষণ করেছিল। ২০০৭ সালে একই ধরনের হামলা চালানো হয়েছিল সিরিয়ায়। এখন ইরানের ক্ষেত্রেও তেমন একটি পদক্ষেপ বিবেচনা করছে তারা। কিন্তু এসব পদক্ষেপ, স্বল্পমেয়াদে ইসরায়েলকে পারমাণবিক আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করলেও এবং দীর্ঘ মেয়াদে একটি অসম সামরিক ভারসাম্যকে টিকিয়ে রাখলেও সেটি শেষ পর্যন্ত টেকসই হবে না।
ইসরায়েল তার সম্ভাব্য পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালাতে পারে—এই প্রমাণিত বাস্তবতা ইসরায়েলের প্রতিপক্ষদের এমন এক মানসিকতায় পৌঁছে দিয়েছে, যেখানে তারা নিজেরাই এমন প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে তুলতে আগ্রহী, যাতে ভবিষ্যতে ইসরায়েলের হাতে আরেকটি আকস্মিক হামলার শিকার হতে না হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সাম্প্রতিক উত্তেজনা আসলে কোনো নতুন সংকটের সূচনা নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে বহু দশক ধরে চলতে থাকা পারমাণবিক টানাপোড়েনের শেষ অধ্যায়—যার অবসান ঘটবে কেবল তখনই, যখন এই অঞ্চলে সামরিক ভারসাম্য ফিরে আসবে।
ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারে—এই আশঙ্কা অনেক বেশি মাত্রায় অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরা হয়েছে। এর একটা বড় কারণ হলো—এই বিতর্ক নিয়ে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলো সাধারণত যেভাবে আচরণ করে, সে সম্পর্কে মৌলিক ভুল ধারণা। সবচেয়ে প্রচলিত এবং গভীর উদ্বেগগুলোর একটি হলো—ইরানি শাসকগোষ্ঠী নাকি ‘স্বভাবগতভাবে অযৌক্তিক বা উন্মাদ’! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—ইরানি নীতিনির্ধারকেরা ‘পাগল মৌলবাদী’ নয়, বরং সম্পূর্ণ সচেতন এবং বাস্তববাদী আয়াতুল্লাহরা নিজেদের টিকে থাকার ব্যাপারে অন্য যেকোনো দেশের নেতার মতোই চিন্তিত।
তাঁরা উসকানিমূলক ও ঘৃণামূলক বক্তব্য দিলেও, আত্মঘাতী কোনো প্রবণতা তাঁদের মধ্যে নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকেরা যদি ধরে নেন যে, ইরানের নেতারা আত্মবিনাশের দিকে এগোচ্ছে, তাহলে সেটি হবে ভয়াবহ একটি ভুল হিসাব। তবুও, মার্কিন ও ইসরায়েলি অনেক বিশ্লেষক এবং কর্মকর্তা ইরানকে ‘বিচারবুদ্ধিহীন’ হিসেবে তুলে ধরেন। এর ফলে তারা এমন যুক্তি দাঁড় করাতে পারেন যে, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিরোধমূলক ভারসাম্য নাকি ইরানের ক্ষেত্রে কাজ করবে না। তাঁদের মতে, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র পায়, তাহলে তাঁরা দ্বিধা না করেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম হামলা চালাবে। এমনকি, যদি তাতে ইরান ভয়াবহ পাল্টা হামলার শিকার হয় এবং নিজেও ধ্বংস হয়ে যায় এরপরও নাকি তারা হামলা চালাবে!
ইরানের আসল অভিপ্রায় নিয়ে নিশ্চিত কিছু বলা না গেলেও, এটি অনেক বেশি বাস্তবসম্মত যে, তারা যদি পারমাণবিক অস্ত্র চায়ও, তাহলে সেটি নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে, আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্যে নয়। ইরান হয়তো আলোচনায় অনমনীয় এবং নিষেধাজ্ঞার মুখে জেদি আচরণ করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের আচরণ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লক্ষ্যেই আবর্তিত হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তেল নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করার পর ইরান প্রচুর হুমকি দিলেও, শেষ পর্যন্ত হরমুজ প্রণালি বন্ধ করেনি। কারণ, তারা জানে—এমন পদক্ষেপ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক এবং ধ্বংসাত্মক জবাব আসত। এর মানে হচ্ছে, ইরানি নেতৃত্ব কথায় যতটা আগ্রাসী, কাজে ঠিক ততটাই হিসাবি।
তবুও, অনেক পর্যবেক্ষক ও নীতিনির্ধারক—যাঁরা মনে করেন ইরানি সরকার যুক্তিসংগতভাবে কাজ করে—আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, পারমাণবিক অস্ত্র পেলে ইরান আরও সাহসী হয়ে উঠবে। তেহরানের হাতে একটি পরমাণু অস্ত্র চলে আসবে, যা তাকে আরও আগ্রাসী আচরণ করতে এবং সন্ত্রাসবাদে সহায়তা বাড়াতে উৎসাহিত করতে পারে। কিছু বিশ্লেষক তো এমনটাও আশঙ্কা করেন যে, ইরান সরাসরি সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেবে!
তবে এসব আশঙ্কার একটা বড় সমস্যা হলো—এগুলো ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৯৪৫ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যেসব দেশ পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করেছে, তাদের আচরণে এসব আশঙ্কার প্রমাণ মেলে না। ইতিহাস বলছে, কোনো দেশ যখন পারমাণবিক বোমা বানায়, তখন তারা নিজেরাই আরও সতর্ক হয়ে পড়ে। কারণ তারা বুঝে যায়, এখন তারা বড় শক্তিধর দেশগুলোর নজরে একটি সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে। এই উপলব্ধি তাদের আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করে।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬৪ সালে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পর মাওবাদী চীন অনেক কম উগ্র হয়ে ওঠে। একইভাবে, ভারত ও পাকিস্তানও পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার পর থেকে অনেক বেশি সতর্ক আচরণ করে আসছে। ফলে ইরান এই ইতিহাসের বিপরীতে হাঁটবে—এমন সম্ভাবনা খুব কম।
আর সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেওয়ার যে আশঙ্কা, সেটিও বাস্তবে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও দুরূহ। কোনো দেশ চাইলে পারমাণবিক অস্ত্র স্থানান্তর করতে পারবে না, কারণ তাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারির ক্ষমতা এবং পারমাণবিক উপাদানের উৎস শনাক্ত করার প্রযুক্তি এখন এতটাই উন্নত যে, কোনো গোপন হস্তান্তর নজর এড়ানোর সুযোগ নেই। এ ছাড়া, যেসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে কোনো রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, তাদের আচরণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ বা পূর্বাভাস দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। ফলে, কোনো রাষ্ট্র যখন একবার পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেলে, তখন তার পক্ষে সেই অস্ত্র নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে দেওয়ার মতো বোকামি করার সম্ভাবনা থাকে না। কারণ এটি বানানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ—যা এমন কোনো পক্ষের হাতে তুলে দেওয়া বোকামি হবে, যাদের বিশ্বাস করা যায় না কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
আরেকটি বহুল চর্চিত আশঙ্কা হলো, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র পেলে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশও একে একে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পথে হাঁটবে এবং এতে পুরো অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পারমাণবিক যুগ প্রায় ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও এই আশঙ্কা সত্যি হয়নি। ‘প্রোলিফারেশন’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলো—দ্রুত ও অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার। এমন কিছু এখনো পর্যন্ত হয়নি। বরং ১৯৭০ সালের পর থেকে নতুন পারমাণবিক শক্তিধর দেশের আবির্ভাবের হার অনেক কমে গেছে।
এই ধারা এখন হঠাৎ করে পাল্টে যাবে, এমন কোনো যুক্তি নেই। ইরান যদি ১৯৪৫ সালের পর মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়, সেটি মোটেও ভয়াবহ ধারাবাহিকতার সূচনা হবে না। ইসরায়েল ১৯৬০-এর দশকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তখন তারা আশপাশের বহু দেশের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত ছিল। ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র আরব বিশ্বের জন্য অনেক বড় হুমকি ছিল, যা ইরানের বর্তমান কর্মসূচির চেয়ে বহুগুণ ভয়ানক। যদি সেই সময় একটি পারমাণবিক ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু না করতে পারে, তবে এখন একটি পারমাণবিক ইরান তার করবে—এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
১৯৯১ সালে ঐতিহাসিক বৈরী ভারত ও পাকিস্তান একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যেখানে তারা একে অপরের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা না করার অঙ্গীকার করে। তারা বুঝতে পেরেছিল, প্রতিপক্ষের পারমাণবিক সক্ষমতা যতটা ভয়ংকর, তার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক হলো সেই সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো থেকে উদ্ভূত অস্থিরতা।
তখন থেকে, চরম উত্তেজনা ও ঝুঁকিপূর্ণ উসকানির মুখেও এই দুই দেশ সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। ইসরায়েল ও ইরান এই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। যদি ইরান পারমাণবিক শক্তিধর হয়, তাহলে ইসরায়েল ও ইরান পরস্পরকে প্রতিহত করবে, যেভাবে সব পারমাণবিক শক্তিধর দেশ একে অপরকে প্রতিহত করে এসেছে। ইতিহাসে কখনো দুটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হয়নি। ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্রের দোরগোড়া পেরিয়ে যায়, তাহলে সেই পারমাণবিক প্রতিরোধ কাজ করবে, এমনকি ইরানের অস্ত্রাগার ছোট হলেও। তখন আর মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের নিজস্ব পারমাণবিক শক্তি অর্জনের তাগিদ থাকবে না, এবং চলমান সংকটও প্রশমিত হবে। ফলাফল হিসেবে, আজকের তুলনায় সেই মধ্যপ্রাচ্য আরও স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
এই কারণেই, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই। ইরান ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সংলাপ চলতে থাকা উচিত, কারণ খোলামেলা যোগাযোগ পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি পারমাণবিক ইরানের সঙ্গে সহাবস্থান সহজ করে তুলবে। তবে ইরানের ওপর আরোপিত বর্তমান নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া উচিত—এই নিষেধাজ্ঞাগুলো সাধারণ ইরানিদের কষ্ট দিচ্ছে, কিন্তু কার্যকর কোনো উদ্দেশ্য সাধন করছে না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আরব বিশ্ব, ইউরোপ, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ নাগরিকদের আশ্বস্ত হওয়া উচিত—ইতিহাস দেখিয়েছে, যেখানে পারমাণবিক শক্তি এসেছে, সেখানেই এসেছে স্থিতিশীলতা। পারমাণবিক অস্ত্রের বেলায়, অতীতের মতো এখনো সত্য—অস্ত্র বেশি মানেই বেশি স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা!
অনুবাদক: আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক
কয়েক মাস ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের করণীয় কী হওয়া উচিত—তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। এই তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আগের কঠোর নিষেধাজ্ঞাকে আরও জোরালো করেছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গত জানুয়ারিতে ঘোষণা দিয়েছে, তারা আগামী ১ জুলাই থেকে ইরানি তেলে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করবে। যদিও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং ইরান আবারও আলোচনার টেবিলে ফিরেছে। এরপরও গোটা বিষয়টি নিয়ে একটি উৎকট সংকটের কালো ছায়া ঘনিয়ে আসছে।
কিন্তু এমনটা হওয়া উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং ইসরায়েলের বেশির ভাগ বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারক মনে করেন, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তবে সেটিই হবে এই সংকটের সবচেয়ে খারাপ পরিণতি। কিন্তু বাস্তবতা হতে পারে উল্টো—সেটিই হয়তো হবে সবচেয়ে ভালো পরিণতি, যেটি মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঘিরে চলমান সংকট তিনটি পথে শেষ হতে পারে। প্রথমত, কূটনৈতিক তৎপরতা ও কঠোর নিষেধাজ্ঞার সম্মিলিত চাপে ইরান তার পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে পারে। কিন্তু এটি খুব একটা সম্ভাবনাময় দিক নয়। ইতিহাস বলছে, কোনো দেশ যদি পরমাণু অস্ত্র অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, তবে তাকে ফেরানো খুবই কঠিন।
কেবল নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোনো দেশের পারমাণবিক কর্মসূচিকে থামানো যায় না। উত্তর কোরিয়ার কথাই ধরুন—অসংখ্য নিষেধাজ্ঞা আর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও তারা পরমাণু অস্ত্র নির্মাণে সফল হয়েছে। যদি তেহরান মনে করে, তাদের নিরাপত্তার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র জরুরি, তবে নিষেধাজ্ঞা তাদের মত বদলাবে না। বরং, নতুন করে আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে ইরান নিজেকে আরও অনিরাপদ মনে করতে পারে এবং এই আতঙ্ক থেকেই তারা ‘চূড়ান্ত প্রতিরোধের’ পথ হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দিকে আরও বেশি ঝুঁকে যেতে পারে।
দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি হলো—ইরান সরাসরি পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা না করে একটি ‘ব্রেকআউট সক্ষমতা’ অর্জন করবে। অর্থাৎ, তারা চাইলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষা করতে পারে—এমন অবস্থানে পৌঁছে যাবে। আর যদি, ইরান সেটি না করে, তবে তারাই প্রথম কোনো দেশ হবে না, যারা ব্যাপক পরমাণু কর্মসূচি গড়ে তুলেও সরাসরি বোমা তৈরি করবে না। জাপানের কথাই ধরুন, তাদের বিস্তৃত বেসামরিক পরমাণু অবকাঠামো আছে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, তারা চাইলে খুব অল্প সময়েই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে। কিন্তু তারা এখনো সেই পথে যায়নি।
ইরানের বর্তমান শাসকদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রয়োজন মেটাতে ‘ব্রেকআউট সক্ষমতা’ বা চাইলেই দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা পর্যন্ত পৌঁছানো একটি কৌশল হতে পারে। এতে করে তাঁরা ‘কট্টরপন্থীদের’ আশ্বস্ত করতে পারবেন যে, তারা বোমা থাকার নিরাপত্তাসহ নানা সুবিধা পাবে, আবার এই সুবিধা ব্যবহার না করায় আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা বা নিন্দার ঝুঁকিও এড়ানো যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো—এই কৌশল সব সময় পরিকল্পনামতো কাজ নাও করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের প্রধান উদ্বেগ হলো—অস্ত্রায়ন বা অস্ত্র তৈরির পর্যায়। তাই, যদি ইরান সরাসরি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত থাকে, তাহলে তারা হয়তো এই পরিস্থিতিকে মেনে নেবে। কিন্তু ইসরায়েল অনেক আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তাদের দৃষ্টিতে ইরানের উল্লেখযোগ্য সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতাও অগ্রহণযোগ্য হুমকি। ফলে এমন এক বাস্তবতা তৈরি হতে পারে যে, যেখানে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি না করার ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য অঙ্গীকার দিলেও পশ্চিমা শক্তিগুলো সন্তুষ্ট হবে, কিন্তু ইসরায়েল তা মানবে না। ‘ভার্চুয়াল পারমাণবিক অস্ত্র’ ইসরায়েলকে অতটা ভীত করবে না, যতটা আসল অস্ত্র করবে। সে কারণে তারা হয়তো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নস্যাৎ করতে ঝুঁকিপূর্ণ গুপ্ত হামলা, নাশকতা কিংবা বিজ্ঞানীদের হত্যা চালিয়ে যেতে থাকবে, যা ইরানকে বুঝিয়ে দিতে পারে যে, শুধু ব্রেকআউট সক্ষমতা যথেষ্ট নয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে অস্ত্রায়নই একমাত্র পথ।
তৃতীয় সম্ভাবনাটি হলো—ইরান তার বর্তমান পথেই এগিয়ে গিয়ে প্রকাশ্যে পারমাণবিক পরীক্ষা চালাবে এবং নিজেকে পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে ঘোষণা করবে। মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, এ ধরনের পরিণতি তাঁদের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তাঁদের ভাষায়, পারমাণবিক শক্তিধর ইরান হবে ভয়াবহ, অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। যখনই দেখে কোনো দেশ পরমাণু অস্ত্রের দিকে এগোচ্ছে, তখনই এ ধরনের ভাষা পরাশক্তিগুলো সাধারণত ব্যবহার করে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, যতবারই কোনো দেশ সফলভাবে পরমাণু শক্তিধর হয়েছে, বাকি সদস্যরা শেষ পর্যন্ত তাদের মেনে নিয়েছে। বরং সামরিক শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি হওয়ায় নতুন পারমাণবিক রাষ্ট্রগুলো অনেক সময় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাড়িয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে গত চার দশক ধরে ইসরায়েলের একক পারমাণবিক আধিপত্য বিরাজ করছে, সেটিই মূলত এই অঞ্চলের অস্থিরতার বড় উৎস। পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে এমন কোনো একক ও অনিয়ন্ত্রিত পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র নেই। বর্তমান সংকটের জন্য ইরানের পরমাণু আকাঙ্ক্ষার চেয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রভান্ডারই বেশি দায়ী। কারণ, ক্ষমতা থাকলে কেউ না কেউ সেটি প্রতিরোধ করতে চাইবেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এত দিনে কেবল একজন প্রতিদ্বন্দ্বীই মাঠে নেমেছে।
অবশ্য, এটি সহজেই বোঝা যায় যে, কেন ইসরায়েল এই অঞ্চলের একমাত্র পারমাণবিক শক্তি হিসেবে থেকে যেতে চায় এবং কেন তারা সেই অবস্থান রক্ষায় প্রয়োজনে বলপ্রয়োগেও প্রস্তুত। ইরাক পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠবে, এই আশঙ্কায় ১৯৮১ সালে ইসরায়েল দেশটির ওসিরাক পারমাণবিক স্থাপনায় বোমাবর্ষণ করেছিল। ২০০৭ সালে একই ধরনের হামলা চালানো হয়েছিল সিরিয়ায়। এখন ইরানের ক্ষেত্রেও তেমন একটি পদক্ষেপ বিবেচনা করছে তারা। কিন্তু এসব পদক্ষেপ, স্বল্পমেয়াদে ইসরায়েলকে পারমাণবিক আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করলেও এবং দীর্ঘ মেয়াদে একটি অসম সামরিক ভারসাম্যকে টিকিয়ে রাখলেও সেটি শেষ পর্যন্ত টেকসই হবে না।
ইসরায়েল তার সম্ভাব্য পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালাতে পারে—এই প্রমাণিত বাস্তবতা ইসরায়েলের প্রতিপক্ষদের এমন এক মানসিকতায় পৌঁছে দিয়েছে, যেখানে তারা নিজেরাই এমন প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে তুলতে আগ্রহী, যাতে ভবিষ্যতে ইসরায়েলের হাতে আরেকটি আকস্মিক হামলার শিকার হতে না হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সাম্প্রতিক উত্তেজনা আসলে কোনো নতুন সংকটের সূচনা নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে বহু দশক ধরে চলতে থাকা পারমাণবিক টানাপোড়েনের শেষ অধ্যায়—যার অবসান ঘটবে কেবল তখনই, যখন এই অঞ্চলে সামরিক ভারসাম্য ফিরে আসবে।
ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারে—এই আশঙ্কা অনেক বেশি মাত্রায় অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরা হয়েছে। এর একটা বড় কারণ হলো—এই বিতর্ক নিয়ে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলো সাধারণত যেভাবে আচরণ করে, সে সম্পর্কে মৌলিক ভুল ধারণা। সবচেয়ে প্রচলিত এবং গভীর উদ্বেগগুলোর একটি হলো—ইরানি শাসকগোষ্ঠী নাকি ‘স্বভাবগতভাবে অযৌক্তিক বা উন্মাদ’! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—ইরানি নীতিনির্ধারকেরা ‘পাগল মৌলবাদী’ নয়, বরং সম্পূর্ণ সচেতন এবং বাস্তববাদী আয়াতুল্লাহরা নিজেদের টিকে থাকার ব্যাপারে অন্য যেকোনো দেশের নেতার মতোই চিন্তিত।
তাঁরা উসকানিমূলক ও ঘৃণামূলক বক্তব্য দিলেও, আত্মঘাতী কোনো প্রবণতা তাঁদের মধ্যে নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকেরা যদি ধরে নেন যে, ইরানের নেতারা আত্মবিনাশের দিকে এগোচ্ছে, তাহলে সেটি হবে ভয়াবহ একটি ভুল হিসাব। তবুও, মার্কিন ও ইসরায়েলি অনেক বিশ্লেষক এবং কর্মকর্তা ইরানকে ‘বিচারবুদ্ধিহীন’ হিসেবে তুলে ধরেন। এর ফলে তারা এমন যুক্তি দাঁড় করাতে পারেন যে, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিরোধমূলক ভারসাম্য নাকি ইরানের ক্ষেত্রে কাজ করবে না। তাঁদের মতে, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র পায়, তাহলে তাঁরা দ্বিধা না করেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম হামলা চালাবে। এমনকি, যদি তাতে ইরান ভয়াবহ পাল্টা হামলার শিকার হয় এবং নিজেও ধ্বংস হয়ে যায় এরপরও নাকি তারা হামলা চালাবে!
ইরানের আসল অভিপ্রায় নিয়ে নিশ্চিত কিছু বলা না গেলেও, এটি অনেক বেশি বাস্তবসম্মত যে, তারা যদি পারমাণবিক অস্ত্র চায়ও, তাহলে সেটি নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে, আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্যে নয়। ইরান হয়তো আলোচনায় অনমনীয় এবং নিষেধাজ্ঞার মুখে জেদি আচরণ করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের আচরণ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লক্ষ্যেই আবর্তিত হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তেল নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করার পর ইরান প্রচুর হুমকি দিলেও, শেষ পর্যন্ত হরমুজ প্রণালি বন্ধ করেনি। কারণ, তারা জানে—এমন পদক্ষেপ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক এবং ধ্বংসাত্মক জবাব আসত। এর মানে হচ্ছে, ইরানি নেতৃত্ব কথায় যতটা আগ্রাসী, কাজে ঠিক ততটাই হিসাবি।
তবুও, অনেক পর্যবেক্ষক ও নীতিনির্ধারক—যাঁরা মনে করেন ইরানি সরকার যুক্তিসংগতভাবে কাজ করে—আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, পারমাণবিক অস্ত্র পেলে ইরান আরও সাহসী হয়ে উঠবে। তেহরানের হাতে একটি পরমাণু অস্ত্র চলে আসবে, যা তাকে আরও আগ্রাসী আচরণ করতে এবং সন্ত্রাসবাদে সহায়তা বাড়াতে উৎসাহিত করতে পারে। কিছু বিশ্লেষক তো এমনটাও আশঙ্কা করেন যে, ইরান সরাসরি সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেবে!
তবে এসব আশঙ্কার একটা বড় সমস্যা হলো—এগুলো ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৯৪৫ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যেসব দেশ পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করেছে, তাদের আচরণে এসব আশঙ্কার প্রমাণ মেলে না। ইতিহাস বলছে, কোনো দেশ যখন পারমাণবিক বোমা বানায়, তখন তারা নিজেরাই আরও সতর্ক হয়ে পড়ে। কারণ তারা বুঝে যায়, এখন তারা বড় শক্তিধর দেশগুলোর নজরে একটি সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে। এই উপলব্ধি তাদের আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করে।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬৪ সালে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পর মাওবাদী চীন অনেক কম উগ্র হয়ে ওঠে। একইভাবে, ভারত ও পাকিস্তানও পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার পর থেকে অনেক বেশি সতর্ক আচরণ করে আসছে। ফলে ইরান এই ইতিহাসের বিপরীতে হাঁটবে—এমন সম্ভাবনা খুব কম।
আর সন্ত্রাসীদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেওয়ার যে আশঙ্কা, সেটিও বাস্তবে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও দুরূহ। কোনো দেশ চাইলে পারমাণবিক অস্ত্র স্থানান্তর করতে পারবে না, কারণ তাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারির ক্ষমতা এবং পারমাণবিক উপাদানের উৎস শনাক্ত করার প্রযুক্তি এখন এতটাই উন্নত যে, কোনো গোপন হস্তান্তর নজর এড়ানোর সুযোগ নেই। এ ছাড়া, যেসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে কোনো রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, তাদের আচরণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ বা পূর্বাভাস দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। ফলে, কোনো রাষ্ট্র যখন একবার পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেলে, তখন তার পক্ষে সেই অস্ত্র নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে দেওয়ার মতো বোকামি করার সম্ভাবনা থাকে না। কারণ এটি বানানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ—যা এমন কোনো পক্ষের হাতে তুলে দেওয়া বোকামি হবে, যাদের বিশ্বাস করা যায় না কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
আরেকটি বহুল চর্চিত আশঙ্কা হলো, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র পেলে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশও একে একে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পথে হাঁটবে এবং এতে পুরো অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পারমাণবিক যুগ প্রায় ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও এই আশঙ্কা সত্যি হয়নি। ‘প্রোলিফারেশন’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলো—দ্রুত ও অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার। এমন কিছু এখনো পর্যন্ত হয়নি। বরং ১৯৭০ সালের পর থেকে নতুন পারমাণবিক শক্তিধর দেশের আবির্ভাবের হার অনেক কমে গেছে।
এই ধারা এখন হঠাৎ করে পাল্টে যাবে, এমন কোনো যুক্তি নেই। ইরান যদি ১৯৪৫ সালের পর মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়, সেটি মোটেও ভয়াবহ ধারাবাহিকতার সূচনা হবে না। ইসরায়েল ১৯৬০-এর দশকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তখন তারা আশপাশের বহু দেশের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত ছিল। ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র আরব বিশ্বের জন্য অনেক বড় হুমকি ছিল, যা ইরানের বর্তমান কর্মসূচির চেয়ে বহুগুণ ভয়ানক। যদি সেই সময় একটি পারমাণবিক ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু না করতে পারে, তবে এখন একটি পারমাণবিক ইরান তার করবে—এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
১৯৯১ সালে ঐতিহাসিক বৈরী ভারত ও পাকিস্তান একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যেখানে তারা একে অপরের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা না করার অঙ্গীকার করে। তারা বুঝতে পেরেছিল, প্রতিপক্ষের পারমাণবিক সক্ষমতা যতটা ভয়ংকর, তার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক হলো সেই সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো থেকে উদ্ভূত অস্থিরতা।
তখন থেকে, চরম উত্তেজনা ও ঝুঁকিপূর্ণ উসকানির মুখেও এই দুই দেশ সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। ইসরায়েল ও ইরান এই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। যদি ইরান পারমাণবিক শক্তিধর হয়, তাহলে ইসরায়েল ও ইরান পরস্পরকে প্রতিহত করবে, যেভাবে সব পারমাণবিক শক্তিধর দেশ একে অপরকে প্রতিহত করে এসেছে। ইতিহাসে কখনো দুটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হয়নি। ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্রের দোরগোড়া পেরিয়ে যায়, তাহলে সেই পারমাণবিক প্রতিরোধ কাজ করবে, এমনকি ইরানের অস্ত্রাগার ছোট হলেও। তখন আর মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের নিজস্ব পারমাণবিক শক্তি অর্জনের তাগিদ থাকবে না, এবং চলমান সংকটও প্রশমিত হবে। ফলাফল হিসেবে, আজকের তুলনায় সেই মধ্যপ্রাচ্য আরও স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
এই কারণেই, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই। ইরান ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সংলাপ চলতে থাকা উচিত, কারণ খোলামেলা যোগাযোগ পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটি পারমাণবিক ইরানের সঙ্গে সহাবস্থান সহজ করে তুলবে। তবে ইরানের ওপর আরোপিত বর্তমান নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া উচিত—এই নিষেধাজ্ঞাগুলো সাধারণ ইরানিদের কষ্ট দিচ্ছে, কিন্তু কার্যকর কোনো উদ্দেশ্য সাধন করছে না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আরব বিশ্ব, ইউরোপ, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ নাগরিকদের আশ্বস্ত হওয়া উচিত—ইতিহাস দেখিয়েছে, যেখানে পারমাণবিক শক্তি এসেছে, সেখানেই এসেছে স্থিতিশীলতা। পারমাণবিক অস্ত্রের বেলায়, অতীতের মতো এখনো সত্য—অস্ত্র বেশি মানেই বেশি স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা!
অনুবাদক: আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক
বিদেশি কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি তত্ত্ব হলো—প্রথম দিন ভারত রাফাল বিমানগুলোতে দূরপাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য মিটিওর ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করেনি (সম্ভবত এই ভেবে যে, সেগুলো পাকিস্তানের যুদ্ধবিমানের নাগালের বাইরে থাকবে অথবা পাকিস্তানের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ততটা তীব্র হবে না)।
২১ ঘণ্টা আগেতুরস্কে গণতন্ত্র আজ ভয়াবহ হুমকির মুখে। চলতি মাসের (জুলাই) শুরুতেই বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) অন্তত ১৭ জন মেয়রকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তাঁদের সবাই দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
৩ দিন আগেউপমহাদেশের চিরবৈরী দুই পক্ষ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়টি যখন অনিষ্পন্ন, তখন সেখানে নীরবে ঢুকেছে তৃতীয় আরেক পক্ষ চীন। ৬৫ বছর ধরে এই সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু ও এর শাখা নদীগুলোর পানি ভাগাভাগির ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে কাজ করেছে। এই চুক্তি সিন্ধু নদ অববাহিকা
৩ দিন আগেযেকোনো পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিমাত্রই জানেন মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লেখার চেষ্টা করা মানে হচ্ছে, প্রচুর মানসিক শক্তি খরচ করা। কিন্তু, নিবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের পূর্ণ সহায়তা পাওয়া যায়, তাহলে এই মানসিক চাপ অনেকটাই কমে আসে।
৩ দিন আগে