Ajker Patrika

মধ্যপ্রাচ্যে কি ২০০৩ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৮ জুন ২০২৫, ১৬: ৩২
২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের ঠিক আগে দেশটিতে প্রবেশে কুয়েতের ক্যাম্প শৌপে প্রস্তুতি নিচ্ছে মার্কিন মেরিন সেনারা। ছবি: এএফপি
২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের ঠিক আগে দেশটিতে প্রবেশে কুয়েতের ক্যাম্প শৌপে প্রস্তুতি নিচ্ছে মার্কিন মেরিন সেনারা। ছবি: এএফপি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র যুক্ত হবে কি না সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে, তখন মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে পড়েছে—এর ফলাফল কী হতে পারে। বিশেষ করে, ইরানে কি ২০০৩ সালের ইরাকে হামলার পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে জল্পনা বাড়ছে।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত সোমবার ইরানের প্রতি তাঁর দাবির পরিধি আরও বাড়িয়েছেন। আগে তিনি কেবল পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের কথা বললেও এবার তিনি চাচ্ছেন, ইরান যেন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কার্যক্রমও পুরোপুরি বন্ধ করে এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের মিত্রদের সমর্থন করা বন্ধ করে।

নেতানিয়াহুর এই বাড়তি দাবির সঙ্গে আরও আগ্রাসী বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যাই হতে পারে যুদ্ধ থামানোর উপায়। সেই সঙ্গে তিনি ইরানিদেরও আহ্বান জানিয়েছেন, যেন তাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।

মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকদের মতে, নেতানিয়াহুর এসব বক্তব্য আসলে ইরানে সরকার পরিবর্তনের উদ্দেশ্যকে সামনে এনে দিয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, তিনি ইরানি রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দিতে চাইছেন। তবে বিশ্লেষকেরা একমত যে, ইসরায়েলের একার পক্ষে ইরান সরকারকে এমনভাবে দুর্বল করা সম্ভব নয় এবং যতক্ষণ না ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে নামানোর সিদ্ধান্ত নেন, ততক্ষণ ইসরায়েল এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না।

মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান কুইন্সি ইনস্টিটিউটের মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ আনেল রদ্রিগেজ শেলাইন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া ইসরায়েল ইরানি সরকারকে এতটা দুর্বল করতে পারবে না যে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।’ তিনি আরও বলেন, এ জন্যই ইসরায়েল ও ওয়াশিংটনে তাদের মিত্ররা ট্রাম্পকে আহ্বান জানাচ্ছেন—ইরানে হামলা চালাতে। তারা একই কৌশল নিচ্ছে, যেমনটা ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় করেছিল। তখনো বলা হয়েছিল, যুদ্ধ দুই সপ্তাহেই শেষ হয়ে যাবে।

অনেকে এই পরিস্থিতির সঙ্গে ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের সময় ভুয়া ‘অস্ত্রের মজুত থাকার’ দাবি ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্যের মিল খুঁজে পাচ্ছেন। মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড মার্চে বলেছিলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে না। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার ট্রাম্প বলেন, ‘আমি তাঁর কথায় গুরুত্ব দিচ্ছি না। আমার মনে হয়, তারা খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছে।’

ট্রাম্পসহ হোয়াইট হাউসের অনেকে সরাসরি ইরানে সরকার পরিবর্তনের পক্ষে কথা না বললেও মার্কিন সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামের মতো নেতারা ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সমর্থনের কথা বলছেন। গতকাল সামাজিক মাধ্যমে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘আমরা জানি, (ইরানের) সর্বোচ্চ নেতা কোথায় লুকিয়ে আছেন। তাঁকে টার্গেট করা খুব সহজ। কিন্তু আপাতত আমরা তাঁকে হত্যা করছি না।’

এদিকে ইসরায়েল গত শুক্রবার থেকে আক্রমণ শুরু করার পর ইরানের ভেতরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ভিন্নমতাবলম্বী ও সাধারণ মানুষ সবাই সরকারের পক্ষে একত্র হয়ে গেছেন। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টিমসন সেন্টারের মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ বারবারা স্লাভিন বলেন, ‘অনেক ইরানিই চান সরকার বদলাক, তবে সেটি যেন বাইরের দেশের হস্তক্ষেপে না হয়। উপরন্তু, বেসামরিক মানুষের প্রাণহানিতে জনমত আরও ক্ষুব্ধ হয়েছে।’

স্লাভিন বলেন, ইসরায়েল ট্রাম্পকে কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই এই যুদ্ধে টেনে আনার চেষ্টা করছে। তারা চায়, এর মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম এবং সম্ভব হলে সরকারের পতন ঘটানো হোক। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমরা আগেও দেখেছি, যুদ্ধ শুরু হলে তা শেষ করা সহজ নয়।’

আবার অনেক বিশ্লেষক বলছেন, নেতানিয়াহুর এই বক্তব্য মূলত ইরানিদের জন্য নয়, বরং বাইরের দুনিয়াকে দেখানোর জন্য। ওয়াশিংটনের আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র স্কলার হুসেইন ইবিশ বলেন, এসব কথা মূলত যুদ্ধকালীন প্রচারণা।

ইউরোপের প্রতিক্রিয়া মিশ্র। জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস বলেছেন, ইসরায়েল তাদের পশ্চিমা মিত্রদের হয়ে ‘নোংরা কাজটি’ করে দিচ্ছে। কিন্তু তিনি স্বীকার করেছেন, ইসরায়েলের নেই শক্তি—ইরানের সুরক্ষিত ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করার। তাঁর মতে, এই অস্ত্র শুধুই যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আছে।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ অবশ্য বলেছেন, ‘যুদ্ধের মাধ্যমে সরকার বদলানো সবচেয়ে বড় ভুল হবে। এতে বিশৃঙ্খলা বাড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘২০০৩ সালে ইরাকে কিংবা পরে লিবিয়ায় যেটা হয়েছে, কেউ কি মনে করে তা সঠিক ছিল? মোটেই না!’

এরই মধ্যে ইরানও দীর্ঘদিনের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ইসরায়েল যেভাবে দিনের বেলায় বিমান হামলা চালিয়ে আকাশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, তার পাল্টা হিসেবে ইরান নিয়মিত রাতের বেলায় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে।

গত রোববারের পর থেকে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা কিছুটা কমলেও যেদিন প্রায় ২০০টি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ইসরায়েলের দিকে ছোড়া হয়েছিল—দেশটির সামরিক কর্মকর্তারা বলছেন, এটি মাপা প্রতিক্রিয়া। তারা যুদ্ধ না বাড়ানোর চেষ্টা করছে এবং মূল সেনাশক্তি ও উন্নত অস্ত্রশস্ত্র এখনো ব্যবহার করেনি। এ বিষয়ে ইবিশ বলেন, ‘ইরান চাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র যেন এই যুদ্ধে না নামে। কারণ, তখন ইরানের ওপর আরও মারাত্মক আঘাত আসবে।’

জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক আবদুলরসুল দিবসাল্লার জানান, ইরানের বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের ভেতরে রাখা। প্রতিটি ঘাঁটিতে একাধিক সুড়ঙ্গ যুক্ত থাকে, যেখানে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ও হাজারো ওয়ারহেড রাখা হয়।

তাঁর মতে, যদি ইসরায়েলের হামলা এই সুড়ঙ্গগুলোতে সফল হতো, তাহলে কয়েক টন বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যেত। কিন্তু এখনো তেমন কোনো বড় বিস্ফোরণের খবর নেই। তিনি বলেন, এর মানে, ইসরায়েল এখনো সুড়ঙ্গগুলোতে ঢুকতে পারেনি। ভেতরের অস্ত্র মজুতও ধ্বংস হয়নি। দিবসাল্লার মনে করেন, ইরানি প্রকৌশলীরা আগেই এমন পরিস্থিতির জন্য বিকল্প ব্যবস্থা রেখেছেন। তাঁর ভাষায়, ইরানের বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনী অক্ষতই আছে এবং দ্রুত তা ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় আনা সম্ভব।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই বাস্তবতা মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর জন্য চিন্তার বিষয়। কারণ, যেসব দেশে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দেশগুলোর ঘাঁটি আছে, যুদ্ধ হলে ইরান সেগুলোর ওপর হামলার হুমকি দিয়েছে। এ বিষয়ে শেলাইন বলেন, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়, তাহলে এই হামলা হবেই। আর এতে আরব উপসাগরের রাজতন্ত্রগুলো মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপদের মুখে পড়বে। কারণ, তারা এখন নিজেদের অর্থনীতি তেল-গ্যাস থেকে সরিয়ে নিতে চায়।’

স্লাভিন বলেন, আরব দেশগুলো ইরানকে খুব একটা পছন্দ করে না, তারা ইরানের হস্তক্ষেপেও বিরক্ত। কিন্তু তারা এটাও চায় না, ইসরায়েল যেন নতুন আঞ্চলিক কর্তৃত্বে পরিণত হয়। তিনি আরও বলেন, গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা নিয়ে আরবদের ক্ষোভও বাস্তব। সবচেয়ে বড় কথা, এই যুদ্ধ যদি বাড়ে, তাহলে বিনিয়োগ, পর্যটন আর বিকল্প শিল্পে যে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা তারা করছিল, তা ভেস্তে যাবে। স্লাভিনের মতে, এই কারণেই ২০২৩ সালে সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল চীনের মধ্যস্থতায়। কিন্তু এখন তাদের পুরো কৌশলটাই হুমকির মুখে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত