আব্দুর রহমান

ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে ৯২ বছর হয়ে গেল। তবে এই ফুটবল বিশ্বকাপ কেবলই খেলা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিও। যেমন রাশিয়া বিশ্বকাপকে দেশটি ব্যবহার করেছে পশ্চিমা বিশ্বের অবরোধের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে, দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপকে ব্যবহার করেছে অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে। ব্রাজিল ব্যবহার করেছে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সরকারকে দেশের মানুষের চোখে ভালো সাজাতে। তবে ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনায় আয়োজিত বিশ্বকাপকে দেশটির তৎকালীন স্বৈরশাসক যেভাবে ব্যবহার করেছে, তা আর কোনো দেশের শাসকই পারেনি!
প্রায় এক যুগ আগেই নির্ধারিত ছিল যে, ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ হবে আর্জেন্টিনায়। কিন্তু তখন কেউই জানত না যে বিশ্বকাপের সময় দেশটির ক্ষমতা দখল করে থাকবে এক কুখ্যাত স্বৈরশাসক। সেই স্বৈরশাসক বিশ্বকাপকে হাতিয়ার করে দেশে চলমান দুর্নীতি, খুন-গুম, অর্থনৈতিক সংকট, গণতন্ত্রহীনতা ইত্যাদি থেকে দেশ ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি সরিয়ে দেবে, তা কেউই হয়তো সেভাবে অনুমান করতে পারেনি। কিন্তু এমনটাই হয়েছে।
ঘটনার শুরু ১৯৭৬ সালে। সেবারের মার্চে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইসাবেলা পেরনকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল জর্জ রাফায়েল ভিদেলা। ক্ষমতা দখলের পরপরই শুরু হয় দমন-পীড়ন। গুম-খুন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তাঁর শাসনামলে ৩০ হাজার মানুষ স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে। তারা আর কখনো ফেরেনি।
সাধারণ জনগণকে স্বাধীনভাবে রাস্তায় চলাফেরা করতেও দেওয়া হতো না। বের হলেই চলত জিজ্ঞাসাবাদ-গ্রেপ্তার। ছাড়া পেতে ঘুষ দিতে হতো জান্তা সদস্যদের। কেউ সামান্য প্রতিবাদ করলেই তুলে নিয়ে যাওয়া হতো, নির্যাতন করা হতো সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন কার্যালয়ে বন্দী করে। সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো কঠোর হাতে।
এত সব করেও দেশের অর্থনীতিকে বশে রাখতে পারছিলেন না ভিদেলা। এই সময়ই তাঁর হাতে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ধরা দেয় ১৯৭৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজন। এ বিষয়ে ভিদেলাকে উৎসাহিত করেন ১৯৭৬ সালের সেনা অভ্যুত্থানের অন্যতম কুশীলব অ্যাডমিরাল এমিলো মাসেরা। তিনি বলেন, ‘টুর্নামেন্টের আয়োজন বিশ্বকে দেখাবে যে আর্জেন্টিনা একটি বিশ্বস্ত দেশ, বড় ধরনের প্রকল্প পরিচালনায় সক্ষম।’
ঠান্ডা মাথার শীতল-ক্রূর চাহনির এই স্বৈরশাসক ফুটবল পছন্দ করতেন না। খেলা তো দূরের কথা, তিনি কখনো ফুটবল খেলা দেখেছেন—এমনটাও কেউ বলতে পারে না। যাহোক, এই অবস্থায় ফুটবল বিশ্বকাপকে তিনি তাঁর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা এবং জনগণসহ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর এক অনন্য সুযোগ হিসেবে দেখেন। তবে তাঁর এই ইচ্ছায় বাদ সাধে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা। প্রতিষ্ঠানটির নিয়ম অনুযায়ী কোনো দেশের সরকার সরাসরি বিশ্বকাপ আয়োজনে জড়িত থাকতে পারবে না। তাই রাতারাতি ভিদেলা একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন এবং দায়িত্ব দেন বিশ্বকাপ আয়োজনের। এমনকি তাঁকে সে সময় সতর্ক করা হয়েছিল—এই আয়োজনের ফলে দেশ দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ভিদেলা কারও কথায় কান দেননি।
শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। রাজধানী বুয়েনস এইরেসে নির্মাণ করা হয় এস্তাদিও মনুমেন্তাল। ৬৭ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার এই স্টেডিয়াম নির্মাণ করতে গিয়ে সেখানকার কয়েক হাজার বস্তিবাসীকে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ ছাড়াই উচ্ছেদ করা হয়। রাস্তাঘাট চওড়া করতে উচ্ছেদ করা হয় আরও কয়েক হাজার মানুষকে। খেলার ভেন্যুগুলোর আশপাশ থেকে গরিব লোকদের বিনা নোটিশে উচ্ছেদ করা হয়। এই নিপীড়িত মানুষগুলোর আওয়াজ বিশ্বের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। কারণ, ভিদেলা দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর গলাও চেপে ধরেছিলেন দৃঢ় হস্তে। সংবাদমাধ্যমগুলো কেবল সেটিই প্রকাশ করতে পারত, যা জান্তা বাহিনী অনুমোদন করত। সংবাদমাধ্যমগুলোকে ‘আপনার আর্জেন্টিনাকে রক্ষা করুন’, ‘বিশ্বকে সত্য দেখিয়ে দাও’—এমন স্লোগান ও মোটিফকে কেন্দ্র করে সংবাদ ছাপাতে বাধ্য করা হতো।
কেবল তা-ই নয়, ভিদেলা সরকার মার্কিন জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান বারসন-মার্স্টেলারকে ১০ লাখ ডলার চুক্তিতে নিয়োগ করেছিল। জান্তা সরকারের প্রত্যাশা ছিল—আর্জেন্টিনার বাইরে দেশ ও সরকারের প্রতি আস্থা ও সদিচ্ছার বিষয়টি প্রচারে সহায়তা করবে তারা। তাদের মূল কাজ ছিল ‘স্থিতিশীল’ ও ‘উন্নয়নশীল’ আর্জেন্টিনার একটি ‘নয়া চিত্র’ তুলে ধরা। যে পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিশ্বকাপ। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে ভিদেলা সরকারের বিরুদ্ধে চলমান বিভিন্ন নেতিবাচক প্রচারের জবাব দেওয়ার জন্যও দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে।
ভিদেলা যে শুধু বন্দুকের জোরে এমনটা করছিলেন, তা কিন্তু নয়। ফিফার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ব্রাজিলের নাগরিক জোয়াঁও হ্যাভেলঞ্জ এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারও তাল দিয়েছিলেন ভিদেলার সঙ্গে। বিশ্বকাপ শুরুর সপ্তাহখানেক আগে ২৩ মে ভিদেলার হয়ে ওকালতি করেন ফিফার প্রেসিডেন্ট। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি হতাশ নই, বরং আমি গর্বিত যে আর্জেন্টিনার সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো ছিল, তা দারুণভাবে সামলে নিয়েছে।’ আর হেনরি কিসিঞ্জার তো বিশ্বকাপ চলাকালে আর্জেন্টিনায় উপস্থিত হয়ে ভিদেলার সঙ্গে থেকে সেমি এবং ফাইনাল ম্যাচ উপভোগ করেন!
অবশ্য স্বৈরশাসকের বিশ্বকাপ আয়োজনের বিষয়টি ভালো চোখে দেখেনি অনেকেই। এ নিয়ে ১৯৭৭ সালের শেষ দিকে একদল ফরাসি সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপ আয়োজনের বিরোধিতা করে ‘অর্গানাইজিং কমিটি ফর দ্য বয়কট অব দ্য আর্জেন্টিনা ওয়ার্ল্ড কাপ’ প্রতিষ্ঠা করেন, যার ফরাসি নামের সংক্ষেপ ছিল সিওবিএ। সে সময় ফ্রান্স ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন মিশেল প্লাতিনি। সংগঠনটি প্লাতিনি এবং ফরাসি ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অনুরোধ করে, যেন তারা আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে না যায়। কেবল ফ্রান্সেই নয়, সংগঠনটি ইতালি, স্পেন, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, স্কটল্যান্ডকেও অনুরোধ করেছিল অংশ না নিতে। এমনকি একাধিক ব্যঙ্গাত্মক পোস্টারও ছড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপজুড়ে।
কিন্তু কোনো কিছুই বন্ধ করতে পারেনি ওই বিশ্বকাপ। সব প্রচারণা, আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ১৯৭৮ সালের ১ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় বিশ্বকাপের ১১তম আসর। আর্জেন্টিনার পাঁচটি শহরের ছয় ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হয় ম্যাচগুলো। ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেবারই টাইব্রেকার নিয়ম চালু হয়। ১৬ দেশের ওই বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় স্বাগতিক আর্জেন্টিনাই। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিদেলা বলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় অঞ্চলের এই দেশ সফরের জন্য হাজার হাজার নারী-পুরুষকে আমরা সম্মান জানাচ্ছি। আমরা আশা করব, এই উৎসব একটি ভালোবাসা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিবেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।’
কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি বিষয়টি। গুঞ্জন ছিল এবং এখনো রয়েছে—আর্জেন্টিনা তাদের সেমিফাইনালের প্রতিপক্ষ পেরুকে ভয় দেখিয়েছে, ঘুষ দিয়ে এবং দেশটির স্বৈরশাসক জেনারেল মোরালেস বারমুদেজের সঙ্গে ভিদেলা সরকারের গোপন আঁতাত হয়েছে। টুর্নামেন্টজুড়ে দুর্দান্ত খেলেছিল পেরু। নিয়ম অনুসারে ফাইনালে যেতে হলে অন্তত ৪ গোলের ব্যবধানে জিততে হবে। কিন্তু ভালো খেলা পেরু সেটি করতে পারেনি। তারা হেরে যায় ৬-০ গোলের ব্যবধানে।
সেমিফাইনাল ম্যাচের আগে নানাভাবে হয়রানি করা হয় পেরুর খেলোয়াড়দের। ম্যাচের আগের রাতে যে হোটেলে তাঁরা অবস্থান করছিলেন, সেখান থেকে পাহারায় থাকা সেনাবাহিনীর সদস্যরা হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যান। আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা হোটেলের বাইরে এসে চিৎকার-চেঁচামেচি এবং তীব্র স্বরে গাড়ির হর্ন বাজাতে থাকে। হোটেল থেকে স্টেডিয়ামে নেওয়ার রাস্তা যেখানে মাত্র ৩০ মিনিটের পথ, সেখানে নানা রাস্তা দিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা ঘুরিয়ে তাঁদের স্টেডিয়ামে নেওয়া হয়।
রাতে ঘুম না হওয়ায় এবং দীর্ঘ বাস জার্নিতে এমনিতেই ক্লান্ত ছিলেন পেরুর খেলোয়াড়েরা। এরপর তাঁদের জন্য আরও চমক অপেক্ষা করছিল। খেলা শুরুর মাত্র ৩০ মিনিট আগে রাফায়েল ভিদেলা পেরুর ড্রেসিংরুমে যান এবং খেলোয়াড়দের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ আলাপ করেন। আলাপকালে ভিদেলা বলেন, ‘আমি আপনাদের বলতে চাই যে, আজ রাতের এই ম্যাচ ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের। আমি এখানে লাতিন ভ্রাতৃত্বের দাবি নিয়ে হাজির হয়েছি। আশা করি, সবকিছু ঠিকঠাকভাবে শেষ হবে।’ ভাষণের পর ভিদেলা পেরুর ফুটবলারদের দেশটির প্রেসিডেন্ট জেনারেল মোরালেস বারমুদেজের একটি চিঠি পড়ে শোনান।
এখানেই শেষ নয়, গুজব শোনা যায়—আর্জেন্টিনা পেরু সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের তৎকালীন ৫ কোটি ডলার অর্থ ও খাদ্যসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এমনকি খাদ্যশস্য নিয়ে একটি চালান পেরুতে পর্যন্ত গিয়েছিল। এ ছাড়া পেরুর খেলোয়াড়দের নগদ অর্থ এবং উন্নত বাসস্থানের লোভও দেখানো হয়েছিল। খেলোয়াড়দের মধ্যে পেরুর ডিফেন্ডার রুদলফো মাঞ্জোকে ৫০ হাজার ডলার ঘুষ সাধা হয়েছিল বলেও শোনা যায়। এমনকি দলের অন্য খেলোয়াড়দের সব মিলিয়ে আড়াই লাখ ডলার সাধা হয়েছিল হারের বিপরীতে।
যা-ই হয়ে থাকুক, সেমিফাইনালে সেই ম্যাচে পেরু সুবিধা করতে পারেনি। বিশাল ব্যবধানে হেরেছিল। ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল নেদারল্যান্ডস। সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনা জিতে গিয়েছিল ৩-১ ব্যবধানে। ফাইনালে আর্জেন্টিনার জয়ে যখন ৬০ হাজারের বেশি মানুষ এস্তাদিও মনুমেন্তালে হর্ষধ্বনি দিচ্ছিল, ঠিক সেই সময়েই হয়তো স্টেডিয়াম থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের নেভি হেডকোয়ার্টার্সে নির্যাতনের শিকার হয়ে গোঙাচ্ছিলেন কোনো নিরপরাধ নাগরিক!
খেলা নিয়ে গুজব যা-ই থাক, ভিদেলা যে সেই বিশ্বকাপকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। বামপন্থী সশস্ত্র যোদ্ধাদের দমন, অর্থনীতির সংকট থেকে দৃষ্টি ফেরানোসহ স্বৈরশাসনের সব নেতিবাচক দিক ঢাকতে ভিদেলা বিশ্বকাপকে ব্যবহার করেছিলেন। আর্জেন্টিনার খেলা শেষে সরকার গুম করা ব্যক্তিদের হঠাৎ হাজির করত। তাদের নিয়ে বের হতো শহরে শহরে। দেখাত যে মানুষ কত আনন্দের মধ্যে রয়েছে।
যাহোক, সেই আগের পরিস্থিতি আবারও অনেকটাই যেন ফিরে এসেছে আর্জেন্টিনায়। দেশটিতে আবারও অর্থনৈতিক সংকট ফিরে এসেছে। এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন বেশ কয়েকজন মন্ত্রী। সংকট এতটাই গভীর যে, দেশটির অনেকেই চান না আর্জেন্টিনা এবার বিশ্বকাপ জিতুক। কারণ, তাতে পরিস্থিতি দীর্ঘ সময়ের জন্য আবারও চাপা পড়ে যাবে। এদেরই একজন হলেন লিওনেল মেসির ক্যারিয়ারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা চিকিৎসক দিয়েগো শোয়ার্জস্টাইন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি চান না আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতুক। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এমন কথাই স্পষ্ট করে বলেছেন।
যেসব উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল চালু হয়েছিল, তার কতটা অর্জিত হয়েছে, কত দূর মূল লক্ষ্য থেকে সরে গেছে, তা বিতর্কের বিষয়। তেমনি বিতর্কের বিষয় আর্জেন্টিনার ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপ আয়োজন। সেই বিশ্বকাপ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, স্বৈরশাসকেরা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে হেন কোনো কাজ নেই, যা করে না!
তথ্যসূত্র: এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, হিস্টোরি ডট কম, স্পোর্টস বাইবেল, দ্য টাইমস এবং পেপেলিতোস

ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে ৯২ বছর হয়ে গেল। তবে এই ফুটবল বিশ্বকাপ কেবলই খেলা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিও। যেমন রাশিয়া বিশ্বকাপকে দেশটি ব্যবহার করেছে পশ্চিমা বিশ্বের অবরোধের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে, দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপকে ব্যবহার করেছে অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে। ব্রাজিল ব্যবহার করেছে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সরকারকে দেশের মানুষের চোখে ভালো সাজাতে। তবে ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনায় আয়োজিত বিশ্বকাপকে দেশটির তৎকালীন স্বৈরশাসক যেভাবে ব্যবহার করেছে, তা আর কোনো দেশের শাসকই পারেনি!
প্রায় এক যুগ আগেই নির্ধারিত ছিল যে, ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ হবে আর্জেন্টিনায়। কিন্তু তখন কেউই জানত না যে বিশ্বকাপের সময় দেশটির ক্ষমতা দখল করে থাকবে এক কুখ্যাত স্বৈরশাসক। সেই স্বৈরশাসক বিশ্বকাপকে হাতিয়ার করে দেশে চলমান দুর্নীতি, খুন-গুম, অর্থনৈতিক সংকট, গণতন্ত্রহীনতা ইত্যাদি থেকে দেশ ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি সরিয়ে দেবে, তা কেউই হয়তো সেভাবে অনুমান করতে পারেনি। কিন্তু এমনটাই হয়েছে।
ঘটনার শুরু ১৯৭৬ সালে। সেবারের মার্চে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইসাবেলা পেরনকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল জর্জ রাফায়েল ভিদেলা। ক্ষমতা দখলের পরপরই শুরু হয় দমন-পীড়ন। গুম-খুন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তাঁর শাসনামলে ৩০ হাজার মানুষ স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে। তারা আর কখনো ফেরেনি।
সাধারণ জনগণকে স্বাধীনভাবে রাস্তায় চলাফেরা করতেও দেওয়া হতো না। বের হলেই চলত জিজ্ঞাসাবাদ-গ্রেপ্তার। ছাড়া পেতে ঘুষ দিতে হতো জান্তা সদস্যদের। কেউ সামান্য প্রতিবাদ করলেই তুলে নিয়ে যাওয়া হতো, নির্যাতন করা হতো সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন কার্যালয়ে বন্দী করে। সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো কঠোর হাতে।
এত সব করেও দেশের অর্থনীতিকে বশে রাখতে পারছিলেন না ভিদেলা। এই সময়ই তাঁর হাতে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ধরা দেয় ১৯৭৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজন। এ বিষয়ে ভিদেলাকে উৎসাহিত করেন ১৯৭৬ সালের সেনা অভ্যুত্থানের অন্যতম কুশীলব অ্যাডমিরাল এমিলো মাসেরা। তিনি বলেন, ‘টুর্নামেন্টের আয়োজন বিশ্বকে দেখাবে যে আর্জেন্টিনা একটি বিশ্বস্ত দেশ, বড় ধরনের প্রকল্প পরিচালনায় সক্ষম।’
ঠান্ডা মাথার শীতল-ক্রূর চাহনির এই স্বৈরশাসক ফুটবল পছন্দ করতেন না। খেলা তো দূরের কথা, তিনি কখনো ফুটবল খেলা দেখেছেন—এমনটাও কেউ বলতে পারে না। যাহোক, এই অবস্থায় ফুটবল বিশ্বকাপকে তিনি তাঁর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা এবং জনগণসহ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর এক অনন্য সুযোগ হিসেবে দেখেন। তবে তাঁর এই ইচ্ছায় বাদ সাধে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা। প্রতিষ্ঠানটির নিয়ম অনুযায়ী কোনো দেশের সরকার সরাসরি বিশ্বকাপ আয়োজনে জড়িত থাকতে পারবে না। তাই রাতারাতি ভিদেলা একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন এবং দায়িত্ব দেন বিশ্বকাপ আয়োজনের। এমনকি তাঁকে সে সময় সতর্ক করা হয়েছিল—এই আয়োজনের ফলে দেশ দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ভিদেলা কারও কথায় কান দেননি।
শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। রাজধানী বুয়েনস এইরেসে নির্মাণ করা হয় এস্তাদিও মনুমেন্তাল। ৬৭ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার এই স্টেডিয়াম নির্মাণ করতে গিয়ে সেখানকার কয়েক হাজার বস্তিবাসীকে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ ছাড়াই উচ্ছেদ করা হয়। রাস্তাঘাট চওড়া করতে উচ্ছেদ করা হয় আরও কয়েক হাজার মানুষকে। খেলার ভেন্যুগুলোর আশপাশ থেকে গরিব লোকদের বিনা নোটিশে উচ্ছেদ করা হয়। এই নিপীড়িত মানুষগুলোর আওয়াজ বিশ্বের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। কারণ, ভিদেলা দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর গলাও চেপে ধরেছিলেন দৃঢ় হস্তে। সংবাদমাধ্যমগুলো কেবল সেটিই প্রকাশ করতে পারত, যা জান্তা বাহিনী অনুমোদন করত। সংবাদমাধ্যমগুলোকে ‘আপনার আর্জেন্টিনাকে রক্ষা করুন’, ‘বিশ্বকে সত্য দেখিয়ে দাও’—এমন স্লোগান ও মোটিফকে কেন্দ্র করে সংবাদ ছাপাতে বাধ্য করা হতো।
কেবল তা-ই নয়, ভিদেলা সরকার মার্কিন জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান বারসন-মার্স্টেলারকে ১০ লাখ ডলার চুক্তিতে নিয়োগ করেছিল। জান্তা সরকারের প্রত্যাশা ছিল—আর্জেন্টিনার বাইরে দেশ ও সরকারের প্রতি আস্থা ও সদিচ্ছার বিষয়টি প্রচারে সহায়তা করবে তারা। তাদের মূল কাজ ছিল ‘স্থিতিশীল’ ও ‘উন্নয়নশীল’ আর্জেন্টিনার একটি ‘নয়া চিত্র’ তুলে ধরা। যে পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিশ্বকাপ। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে ভিদেলা সরকারের বিরুদ্ধে চলমান বিভিন্ন নেতিবাচক প্রচারের জবাব দেওয়ার জন্যও দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে।
ভিদেলা যে শুধু বন্দুকের জোরে এমনটা করছিলেন, তা কিন্তু নয়। ফিফার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ব্রাজিলের নাগরিক জোয়াঁও হ্যাভেলঞ্জ এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারও তাল দিয়েছিলেন ভিদেলার সঙ্গে। বিশ্বকাপ শুরুর সপ্তাহখানেক আগে ২৩ মে ভিদেলার হয়ে ওকালতি করেন ফিফার প্রেসিডেন্ট। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি হতাশ নই, বরং আমি গর্বিত যে আর্জেন্টিনার সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো ছিল, তা দারুণভাবে সামলে নিয়েছে।’ আর হেনরি কিসিঞ্জার তো বিশ্বকাপ চলাকালে আর্জেন্টিনায় উপস্থিত হয়ে ভিদেলার সঙ্গে থেকে সেমি এবং ফাইনাল ম্যাচ উপভোগ করেন!
অবশ্য স্বৈরশাসকের বিশ্বকাপ আয়োজনের বিষয়টি ভালো চোখে দেখেনি অনেকেই। এ নিয়ে ১৯৭৭ সালের শেষ দিকে একদল ফরাসি সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপ আয়োজনের বিরোধিতা করে ‘অর্গানাইজিং কমিটি ফর দ্য বয়কট অব দ্য আর্জেন্টিনা ওয়ার্ল্ড কাপ’ প্রতিষ্ঠা করেন, যার ফরাসি নামের সংক্ষেপ ছিল সিওবিএ। সে সময় ফ্রান্স ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন মিশেল প্লাতিনি। সংগঠনটি প্লাতিনি এবং ফরাসি ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অনুরোধ করে, যেন তারা আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে না যায়। কেবল ফ্রান্সেই নয়, সংগঠনটি ইতালি, স্পেন, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, স্কটল্যান্ডকেও অনুরোধ করেছিল অংশ না নিতে। এমনকি একাধিক ব্যঙ্গাত্মক পোস্টারও ছড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপজুড়ে।
কিন্তু কোনো কিছুই বন্ধ করতে পারেনি ওই বিশ্বকাপ। সব প্রচারণা, আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ১৯৭৮ সালের ১ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় বিশ্বকাপের ১১তম আসর। আর্জেন্টিনার পাঁচটি শহরের ছয় ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হয় ম্যাচগুলো। ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেবারই টাইব্রেকার নিয়ম চালু হয়। ১৬ দেশের ওই বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় স্বাগতিক আর্জেন্টিনাই। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিদেলা বলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় অঞ্চলের এই দেশ সফরের জন্য হাজার হাজার নারী-পুরুষকে আমরা সম্মান জানাচ্ছি। আমরা আশা করব, এই উৎসব একটি ভালোবাসা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিবেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।’
কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি বিষয়টি। গুঞ্জন ছিল এবং এখনো রয়েছে—আর্জেন্টিনা তাদের সেমিফাইনালের প্রতিপক্ষ পেরুকে ভয় দেখিয়েছে, ঘুষ দিয়ে এবং দেশটির স্বৈরশাসক জেনারেল মোরালেস বারমুদেজের সঙ্গে ভিদেলা সরকারের গোপন আঁতাত হয়েছে। টুর্নামেন্টজুড়ে দুর্দান্ত খেলেছিল পেরু। নিয়ম অনুসারে ফাইনালে যেতে হলে অন্তত ৪ গোলের ব্যবধানে জিততে হবে। কিন্তু ভালো খেলা পেরু সেটি করতে পারেনি। তারা হেরে যায় ৬-০ গোলের ব্যবধানে।
সেমিফাইনাল ম্যাচের আগে নানাভাবে হয়রানি করা হয় পেরুর খেলোয়াড়দের। ম্যাচের আগের রাতে যে হোটেলে তাঁরা অবস্থান করছিলেন, সেখান থেকে পাহারায় থাকা সেনাবাহিনীর সদস্যরা হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যান। আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা হোটেলের বাইরে এসে চিৎকার-চেঁচামেচি এবং তীব্র স্বরে গাড়ির হর্ন বাজাতে থাকে। হোটেল থেকে স্টেডিয়ামে নেওয়ার রাস্তা যেখানে মাত্র ৩০ মিনিটের পথ, সেখানে নানা রাস্তা দিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা ঘুরিয়ে তাঁদের স্টেডিয়ামে নেওয়া হয়।
রাতে ঘুম না হওয়ায় এবং দীর্ঘ বাস জার্নিতে এমনিতেই ক্লান্ত ছিলেন পেরুর খেলোয়াড়েরা। এরপর তাঁদের জন্য আরও চমক অপেক্ষা করছিল। খেলা শুরুর মাত্র ৩০ মিনিট আগে রাফায়েল ভিদেলা পেরুর ড্রেসিংরুমে যান এবং খেলোয়াড়দের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ আলাপ করেন। আলাপকালে ভিদেলা বলেন, ‘আমি আপনাদের বলতে চাই যে, আজ রাতের এই ম্যাচ ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের। আমি এখানে লাতিন ভ্রাতৃত্বের দাবি নিয়ে হাজির হয়েছি। আশা করি, সবকিছু ঠিকঠাকভাবে শেষ হবে।’ ভাষণের পর ভিদেলা পেরুর ফুটবলারদের দেশটির প্রেসিডেন্ট জেনারেল মোরালেস বারমুদেজের একটি চিঠি পড়ে শোনান।
এখানেই শেষ নয়, গুজব শোনা যায়—আর্জেন্টিনা পেরু সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের তৎকালীন ৫ কোটি ডলার অর্থ ও খাদ্যসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এমনকি খাদ্যশস্য নিয়ে একটি চালান পেরুতে পর্যন্ত গিয়েছিল। এ ছাড়া পেরুর খেলোয়াড়দের নগদ অর্থ এবং উন্নত বাসস্থানের লোভও দেখানো হয়েছিল। খেলোয়াড়দের মধ্যে পেরুর ডিফেন্ডার রুদলফো মাঞ্জোকে ৫০ হাজার ডলার ঘুষ সাধা হয়েছিল বলেও শোনা যায়। এমনকি দলের অন্য খেলোয়াড়দের সব মিলিয়ে আড়াই লাখ ডলার সাধা হয়েছিল হারের বিপরীতে।
যা-ই হয়ে থাকুক, সেমিফাইনালে সেই ম্যাচে পেরু সুবিধা করতে পারেনি। বিশাল ব্যবধানে হেরেছিল। ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল নেদারল্যান্ডস। সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনা জিতে গিয়েছিল ৩-১ ব্যবধানে। ফাইনালে আর্জেন্টিনার জয়ে যখন ৬০ হাজারের বেশি মানুষ এস্তাদিও মনুমেন্তালে হর্ষধ্বনি দিচ্ছিল, ঠিক সেই সময়েই হয়তো স্টেডিয়াম থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের নেভি হেডকোয়ার্টার্সে নির্যাতনের শিকার হয়ে গোঙাচ্ছিলেন কোনো নিরপরাধ নাগরিক!
খেলা নিয়ে গুজব যা-ই থাক, ভিদেলা যে সেই বিশ্বকাপকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। বামপন্থী সশস্ত্র যোদ্ধাদের দমন, অর্থনীতির সংকট থেকে দৃষ্টি ফেরানোসহ স্বৈরশাসনের সব নেতিবাচক দিক ঢাকতে ভিদেলা বিশ্বকাপকে ব্যবহার করেছিলেন। আর্জেন্টিনার খেলা শেষে সরকার গুম করা ব্যক্তিদের হঠাৎ হাজির করত। তাদের নিয়ে বের হতো শহরে শহরে। দেখাত যে মানুষ কত আনন্দের মধ্যে রয়েছে।
যাহোক, সেই আগের পরিস্থিতি আবারও অনেকটাই যেন ফিরে এসেছে আর্জেন্টিনায়। দেশটিতে আবারও অর্থনৈতিক সংকট ফিরে এসেছে। এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন বেশ কয়েকজন মন্ত্রী। সংকট এতটাই গভীর যে, দেশটির অনেকেই চান না আর্জেন্টিনা এবার বিশ্বকাপ জিতুক। কারণ, তাতে পরিস্থিতি দীর্ঘ সময়ের জন্য আবারও চাপা পড়ে যাবে। এদেরই একজন হলেন লিওনেল মেসির ক্যারিয়ারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা চিকিৎসক দিয়েগো শোয়ার্জস্টাইন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি চান না আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতুক। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এমন কথাই স্পষ্ট করে বলেছেন।
যেসব উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল চালু হয়েছিল, তার কতটা অর্জিত হয়েছে, কত দূর মূল লক্ষ্য থেকে সরে গেছে, তা বিতর্কের বিষয়। তেমনি বিতর্কের বিষয় আর্জেন্টিনার ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপ আয়োজন। সেই বিশ্বকাপ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, স্বৈরশাসকেরা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে হেন কোনো কাজ নেই, যা করে না!
তথ্যসূত্র: এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, হিস্টোরি ডট কম, স্পোর্টস বাইবেল, দ্য টাইমস এবং পেপেলিতোস
আব্দুর রহমান

ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে ৯২ বছর হয়ে গেল। তবে এই ফুটবল বিশ্বকাপ কেবলই খেলা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিও। যেমন রাশিয়া বিশ্বকাপকে দেশটি ব্যবহার করেছে পশ্চিমা বিশ্বের অবরোধের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে, দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপকে ব্যবহার করেছে অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে। ব্রাজিল ব্যবহার করেছে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সরকারকে দেশের মানুষের চোখে ভালো সাজাতে। তবে ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনায় আয়োজিত বিশ্বকাপকে দেশটির তৎকালীন স্বৈরশাসক যেভাবে ব্যবহার করেছে, তা আর কোনো দেশের শাসকই পারেনি!
প্রায় এক যুগ আগেই নির্ধারিত ছিল যে, ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ হবে আর্জেন্টিনায়। কিন্তু তখন কেউই জানত না যে বিশ্বকাপের সময় দেশটির ক্ষমতা দখল করে থাকবে এক কুখ্যাত স্বৈরশাসক। সেই স্বৈরশাসক বিশ্বকাপকে হাতিয়ার করে দেশে চলমান দুর্নীতি, খুন-গুম, অর্থনৈতিক সংকট, গণতন্ত্রহীনতা ইত্যাদি থেকে দেশ ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি সরিয়ে দেবে, তা কেউই হয়তো সেভাবে অনুমান করতে পারেনি। কিন্তু এমনটাই হয়েছে।
ঘটনার শুরু ১৯৭৬ সালে। সেবারের মার্চে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইসাবেলা পেরনকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল জর্জ রাফায়েল ভিদেলা। ক্ষমতা দখলের পরপরই শুরু হয় দমন-পীড়ন। গুম-খুন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তাঁর শাসনামলে ৩০ হাজার মানুষ স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে। তারা আর কখনো ফেরেনি।
সাধারণ জনগণকে স্বাধীনভাবে রাস্তায় চলাফেরা করতেও দেওয়া হতো না। বের হলেই চলত জিজ্ঞাসাবাদ-গ্রেপ্তার। ছাড়া পেতে ঘুষ দিতে হতো জান্তা সদস্যদের। কেউ সামান্য প্রতিবাদ করলেই তুলে নিয়ে যাওয়া হতো, নির্যাতন করা হতো সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন কার্যালয়ে বন্দী করে। সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো কঠোর হাতে।
এত সব করেও দেশের অর্থনীতিকে বশে রাখতে পারছিলেন না ভিদেলা। এই সময়ই তাঁর হাতে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ধরা দেয় ১৯৭৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজন। এ বিষয়ে ভিদেলাকে উৎসাহিত করেন ১৯৭৬ সালের সেনা অভ্যুত্থানের অন্যতম কুশীলব অ্যাডমিরাল এমিলো মাসেরা। তিনি বলেন, ‘টুর্নামেন্টের আয়োজন বিশ্বকে দেখাবে যে আর্জেন্টিনা একটি বিশ্বস্ত দেশ, বড় ধরনের প্রকল্প পরিচালনায় সক্ষম।’
ঠান্ডা মাথার শীতল-ক্রূর চাহনির এই স্বৈরশাসক ফুটবল পছন্দ করতেন না। খেলা তো দূরের কথা, তিনি কখনো ফুটবল খেলা দেখেছেন—এমনটাও কেউ বলতে পারে না। যাহোক, এই অবস্থায় ফুটবল বিশ্বকাপকে তিনি তাঁর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা এবং জনগণসহ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর এক অনন্য সুযোগ হিসেবে দেখেন। তবে তাঁর এই ইচ্ছায় বাদ সাধে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা। প্রতিষ্ঠানটির নিয়ম অনুযায়ী কোনো দেশের সরকার সরাসরি বিশ্বকাপ আয়োজনে জড়িত থাকতে পারবে না। তাই রাতারাতি ভিদেলা একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন এবং দায়িত্ব দেন বিশ্বকাপ আয়োজনের। এমনকি তাঁকে সে সময় সতর্ক করা হয়েছিল—এই আয়োজনের ফলে দেশ দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ভিদেলা কারও কথায় কান দেননি।
শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। রাজধানী বুয়েনস এইরেসে নির্মাণ করা হয় এস্তাদিও মনুমেন্তাল। ৬৭ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার এই স্টেডিয়াম নির্মাণ করতে গিয়ে সেখানকার কয়েক হাজার বস্তিবাসীকে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ ছাড়াই উচ্ছেদ করা হয়। রাস্তাঘাট চওড়া করতে উচ্ছেদ করা হয় আরও কয়েক হাজার মানুষকে। খেলার ভেন্যুগুলোর আশপাশ থেকে গরিব লোকদের বিনা নোটিশে উচ্ছেদ করা হয়। এই নিপীড়িত মানুষগুলোর আওয়াজ বিশ্বের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। কারণ, ভিদেলা দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর গলাও চেপে ধরেছিলেন দৃঢ় হস্তে। সংবাদমাধ্যমগুলো কেবল সেটিই প্রকাশ করতে পারত, যা জান্তা বাহিনী অনুমোদন করত। সংবাদমাধ্যমগুলোকে ‘আপনার আর্জেন্টিনাকে রক্ষা করুন’, ‘বিশ্বকে সত্য দেখিয়ে দাও’—এমন স্লোগান ও মোটিফকে কেন্দ্র করে সংবাদ ছাপাতে বাধ্য করা হতো।
কেবল তা-ই নয়, ভিদেলা সরকার মার্কিন জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান বারসন-মার্স্টেলারকে ১০ লাখ ডলার চুক্তিতে নিয়োগ করেছিল। জান্তা সরকারের প্রত্যাশা ছিল—আর্জেন্টিনার বাইরে দেশ ও সরকারের প্রতি আস্থা ও সদিচ্ছার বিষয়টি প্রচারে সহায়তা করবে তারা। তাদের মূল কাজ ছিল ‘স্থিতিশীল’ ও ‘উন্নয়নশীল’ আর্জেন্টিনার একটি ‘নয়া চিত্র’ তুলে ধরা। যে পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিশ্বকাপ। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে ভিদেলা সরকারের বিরুদ্ধে চলমান বিভিন্ন নেতিবাচক প্রচারের জবাব দেওয়ার জন্যও দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে।
ভিদেলা যে শুধু বন্দুকের জোরে এমনটা করছিলেন, তা কিন্তু নয়। ফিফার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ব্রাজিলের নাগরিক জোয়াঁও হ্যাভেলঞ্জ এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারও তাল দিয়েছিলেন ভিদেলার সঙ্গে। বিশ্বকাপ শুরুর সপ্তাহখানেক আগে ২৩ মে ভিদেলার হয়ে ওকালতি করেন ফিফার প্রেসিডেন্ট। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি হতাশ নই, বরং আমি গর্বিত যে আর্জেন্টিনার সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো ছিল, তা দারুণভাবে সামলে নিয়েছে।’ আর হেনরি কিসিঞ্জার তো বিশ্বকাপ চলাকালে আর্জেন্টিনায় উপস্থিত হয়ে ভিদেলার সঙ্গে থেকে সেমি এবং ফাইনাল ম্যাচ উপভোগ করেন!
অবশ্য স্বৈরশাসকের বিশ্বকাপ আয়োজনের বিষয়টি ভালো চোখে দেখেনি অনেকেই। এ নিয়ে ১৯৭৭ সালের শেষ দিকে একদল ফরাসি সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপ আয়োজনের বিরোধিতা করে ‘অর্গানাইজিং কমিটি ফর দ্য বয়কট অব দ্য আর্জেন্টিনা ওয়ার্ল্ড কাপ’ প্রতিষ্ঠা করেন, যার ফরাসি নামের সংক্ষেপ ছিল সিওবিএ। সে সময় ফ্রান্স ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন মিশেল প্লাতিনি। সংগঠনটি প্লাতিনি এবং ফরাসি ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অনুরোধ করে, যেন তারা আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে না যায়। কেবল ফ্রান্সেই নয়, সংগঠনটি ইতালি, স্পেন, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, স্কটল্যান্ডকেও অনুরোধ করেছিল অংশ না নিতে। এমনকি একাধিক ব্যঙ্গাত্মক পোস্টারও ছড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপজুড়ে।
কিন্তু কোনো কিছুই বন্ধ করতে পারেনি ওই বিশ্বকাপ। সব প্রচারণা, আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ১৯৭৮ সালের ১ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় বিশ্বকাপের ১১তম আসর। আর্জেন্টিনার পাঁচটি শহরের ছয় ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হয় ম্যাচগুলো। ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেবারই টাইব্রেকার নিয়ম চালু হয়। ১৬ দেশের ওই বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় স্বাগতিক আর্জেন্টিনাই। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিদেলা বলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় অঞ্চলের এই দেশ সফরের জন্য হাজার হাজার নারী-পুরুষকে আমরা সম্মান জানাচ্ছি। আমরা আশা করব, এই উৎসব একটি ভালোবাসা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিবেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।’
কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি বিষয়টি। গুঞ্জন ছিল এবং এখনো রয়েছে—আর্জেন্টিনা তাদের সেমিফাইনালের প্রতিপক্ষ পেরুকে ভয় দেখিয়েছে, ঘুষ দিয়ে এবং দেশটির স্বৈরশাসক জেনারেল মোরালেস বারমুদেজের সঙ্গে ভিদেলা সরকারের গোপন আঁতাত হয়েছে। টুর্নামেন্টজুড়ে দুর্দান্ত খেলেছিল পেরু। নিয়ম অনুসারে ফাইনালে যেতে হলে অন্তত ৪ গোলের ব্যবধানে জিততে হবে। কিন্তু ভালো খেলা পেরু সেটি করতে পারেনি। তারা হেরে যায় ৬-০ গোলের ব্যবধানে।
সেমিফাইনাল ম্যাচের আগে নানাভাবে হয়রানি করা হয় পেরুর খেলোয়াড়দের। ম্যাচের আগের রাতে যে হোটেলে তাঁরা অবস্থান করছিলেন, সেখান থেকে পাহারায় থাকা সেনাবাহিনীর সদস্যরা হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যান। আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা হোটেলের বাইরে এসে চিৎকার-চেঁচামেচি এবং তীব্র স্বরে গাড়ির হর্ন বাজাতে থাকে। হোটেল থেকে স্টেডিয়ামে নেওয়ার রাস্তা যেখানে মাত্র ৩০ মিনিটের পথ, সেখানে নানা রাস্তা দিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা ঘুরিয়ে তাঁদের স্টেডিয়ামে নেওয়া হয়।
রাতে ঘুম না হওয়ায় এবং দীর্ঘ বাস জার্নিতে এমনিতেই ক্লান্ত ছিলেন পেরুর খেলোয়াড়েরা। এরপর তাঁদের জন্য আরও চমক অপেক্ষা করছিল। খেলা শুরুর মাত্র ৩০ মিনিট আগে রাফায়েল ভিদেলা পেরুর ড্রেসিংরুমে যান এবং খেলোয়াড়দের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ আলাপ করেন। আলাপকালে ভিদেলা বলেন, ‘আমি আপনাদের বলতে চাই যে, আজ রাতের এই ম্যাচ ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের। আমি এখানে লাতিন ভ্রাতৃত্বের দাবি নিয়ে হাজির হয়েছি। আশা করি, সবকিছু ঠিকঠাকভাবে শেষ হবে।’ ভাষণের পর ভিদেলা পেরুর ফুটবলারদের দেশটির প্রেসিডেন্ট জেনারেল মোরালেস বারমুদেজের একটি চিঠি পড়ে শোনান।
এখানেই শেষ নয়, গুজব শোনা যায়—আর্জেন্টিনা পেরু সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের তৎকালীন ৫ কোটি ডলার অর্থ ও খাদ্যসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এমনকি খাদ্যশস্য নিয়ে একটি চালান পেরুতে পর্যন্ত গিয়েছিল। এ ছাড়া পেরুর খেলোয়াড়দের নগদ অর্থ এবং উন্নত বাসস্থানের লোভও দেখানো হয়েছিল। খেলোয়াড়দের মধ্যে পেরুর ডিফেন্ডার রুদলফো মাঞ্জোকে ৫০ হাজার ডলার ঘুষ সাধা হয়েছিল বলেও শোনা যায়। এমনকি দলের অন্য খেলোয়াড়দের সব মিলিয়ে আড়াই লাখ ডলার সাধা হয়েছিল হারের বিপরীতে।
যা-ই হয়ে থাকুক, সেমিফাইনালে সেই ম্যাচে পেরু সুবিধা করতে পারেনি। বিশাল ব্যবধানে হেরেছিল। ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল নেদারল্যান্ডস। সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনা জিতে গিয়েছিল ৩-১ ব্যবধানে। ফাইনালে আর্জেন্টিনার জয়ে যখন ৬০ হাজারের বেশি মানুষ এস্তাদিও মনুমেন্তালে হর্ষধ্বনি দিচ্ছিল, ঠিক সেই সময়েই হয়তো স্টেডিয়াম থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের নেভি হেডকোয়ার্টার্সে নির্যাতনের শিকার হয়ে গোঙাচ্ছিলেন কোনো নিরপরাধ নাগরিক!
খেলা নিয়ে গুজব যা-ই থাক, ভিদেলা যে সেই বিশ্বকাপকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। বামপন্থী সশস্ত্র যোদ্ধাদের দমন, অর্থনীতির সংকট থেকে দৃষ্টি ফেরানোসহ স্বৈরশাসনের সব নেতিবাচক দিক ঢাকতে ভিদেলা বিশ্বকাপকে ব্যবহার করেছিলেন। আর্জেন্টিনার খেলা শেষে সরকার গুম করা ব্যক্তিদের হঠাৎ হাজির করত। তাদের নিয়ে বের হতো শহরে শহরে। দেখাত যে মানুষ কত আনন্দের মধ্যে রয়েছে।
যাহোক, সেই আগের পরিস্থিতি আবারও অনেকটাই যেন ফিরে এসেছে আর্জেন্টিনায়। দেশটিতে আবারও অর্থনৈতিক সংকট ফিরে এসেছে। এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন বেশ কয়েকজন মন্ত্রী। সংকট এতটাই গভীর যে, দেশটির অনেকেই চান না আর্জেন্টিনা এবার বিশ্বকাপ জিতুক। কারণ, তাতে পরিস্থিতি দীর্ঘ সময়ের জন্য আবারও চাপা পড়ে যাবে। এদেরই একজন হলেন লিওনেল মেসির ক্যারিয়ারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা চিকিৎসক দিয়েগো শোয়ার্জস্টাইন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি চান না আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতুক। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এমন কথাই স্পষ্ট করে বলেছেন।
যেসব উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল চালু হয়েছিল, তার কতটা অর্জিত হয়েছে, কত দূর মূল লক্ষ্য থেকে সরে গেছে, তা বিতর্কের বিষয়। তেমনি বিতর্কের বিষয় আর্জেন্টিনার ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপ আয়োজন। সেই বিশ্বকাপ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, স্বৈরশাসকেরা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে হেন কোনো কাজ নেই, যা করে না!
তথ্যসূত্র: এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, হিস্টোরি ডট কম, স্পোর্টস বাইবেল, দ্য টাইমস এবং পেপেলিতোস

ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে ৯২ বছর হয়ে গেল। তবে এই ফুটবল বিশ্বকাপ কেবলই খেলা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিও। যেমন রাশিয়া বিশ্বকাপকে দেশটি ব্যবহার করেছে পশ্চিমা বিশ্বের অবরোধের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে, দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপকে ব্যবহার করেছে অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে। ব্রাজিল ব্যবহার করেছে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সরকারকে দেশের মানুষের চোখে ভালো সাজাতে। তবে ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনায় আয়োজিত বিশ্বকাপকে দেশটির তৎকালীন স্বৈরশাসক যেভাবে ব্যবহার করেছে, তা আর কোনো দেশের শাসকই পারেনি!
প্রায় এক যুগ আগেই নির্ধারিত ছিল যে, ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ হবে আর্জেন্টিনায়। কিন্তু তখন কেউই জানত না যে বিশ্বকাপের সময় দেশটির ক্ষমতা দখল করে থাকবে এক কুখ্যাত স্বৈরশাসক। সেই স্বৈরশাসক বিশ্বকাপকে হাতিয়ার করে দেশে চলমান দুর্নীতি, খুন-গুম, অর্থনৈতিক সংকট, গণতন্ত্রহীনতা ইত্যাদি থেকে দেশ ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি সরিয়ে দেবে, তা কেউই হয়তো সেভাবে অনুমান করতে পারেনি। কিন্তু এমনটাই হয়েছে।
ঘটনার শুরু ১৯৭৬ সালে। সেবারের মার্চে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইসাবেলা পেরনকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল জর্জ রাফায়েল ভিদেলা। ক্ষমতা দখলের পরপরই শুরু হয় দমন-পীড়ন। গুম-খুন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তাঁর শাসনামলে ৩০ হাজার মানুষ স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে। তারা আর কখনো ফেরেনি।
সাধারণ জনগণকে স্বাধীনভাবে রাস্তায় চলাফেরা করতেও দেওয়া হতো না। বের হলেই চলত জিজ্ঞাসাবাদ-গ্রেপ্তার। ছাড়া পেতে ঘুষ দিতে হতো জান্তা সদস্যদের। কেউ সামান্য প্রতিবাদ করলেই তুলে নিয়ে যাওয়া হতো, নির্যাতন করা হতো সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন কার্যালয়ে বন্দী করে। সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো কঠোর হাতে।
এত সব করেও দেশের অর্থনীতিকে বশে রাখতে পারছিলেন না ভিদেলা। এই সময়ই তাঁর হাতে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ধরা দেয় ১৯৭৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজন। এ বিষয়ে ভিদেলাকে উৎসাহিত করেন ১৯৭৬ সালের সেনা অভ্যুত্থানের অন্যতম কুশীলব অ্যাডমিরাল এমিলো মাসেরা। তিনি বলেন, ‘টুর্নামেন্টের আয়োজন বিশ্বকে দেখাবে যে আর্জেন্টিনা একটি বিশ্বস্ত দেশ, বড় ধরনের প্রকল্প পরিচালনায় সক্ষম।’
ঠান্ডা মাথার শীতল-ক্রূর চাহনির এই স্বৈরশাসক ফুটবল পছন্দ করতেন না। খেলা তো দূরের কথা, তিনি কখনো ফুটবল খেলা দেখেছেন—এমনটাও কেউ বলতে পারে না। যাহোক, এই অবস্থায় ফুটবল বিশ্বকাপকে তিনি তাঁর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা এবং জনগণসহ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর এক অনন্য সুযোগ হিসেবে দেখেন। তবে তাঁর এই ইচ্ছায় বাদ সাধে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা। প্রতিষ্ঠানটির নিয়ম অনুযায়ী কোনো দেশের সরকার সরাসরি বিশ্বকাপ আয়োজনে জড়িত থাকতে পারবে না। তাই রাতারাতি ভিদেলা একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন এবং দায়িত্ব দেন বিশ্বকাপ আয়োজনের। এমনকি তাঁকে সে সময় সতর্ক করা হয়েছিল—এই আয়োজনের ফলে দেশ দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ভিদেলা কারও কথায় কান দেননি।
শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। রাজধানী বুয়েনস এইরেসে নির্মাণ করা হয় এস্তাদিও মনুমেন্তাল। ৬৭ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার এই স্টেডিয়াম নির্মাণ করতে গিয়ে সেখানকার কয়েক হাজার বস্তিবাসীকে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ ছাড়াই উচ্ছেদ করা হয়। রাস্তাঘাট চওড়া করতে উচ্ছেদ করা হয় আরও কয়েক হাজার মানুষকে। খেলার ভেন্যুগুলোর আশপাশ থেকে গরিব লোকদের বিনা নোটিশে উচ্ছেদ করা হয়। এই নিপীড়িত মানুষগুলোর আওয়াজ বিশ্বের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। কারণ, ভিদেলা দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর গলাও চেপে ধরেছিলেন দৃঢ় হস্তে। সংবাদমাধ্যমগুলো কেবল সেটিই প্রকাশ করতে পারত, যা জান্তা বাহিনী অনুমোদন করত। সংবাদমাধ্যমগুলোকে ‘আপনার আর্জেন্টিনাকে রক্ষা করুন’, ‘বিশ্বকে সত্য দেখিয়ে দাও’—এমন স্লোগান ও মোটিফকে কেন্দ্র করে সংবাদ ছাপাতে বাধ্য করা হতো।
কেবল তা-ই নয়, ভিদেলা সরকার মার্কিন জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান বারসন-মার্স্টেলারকে ১০ লাখ ডলার চুক্তিতে নিয়োগ করেছিল। জান্তা সরকারের প্রত্যাশা ছিল—আর্জেন্টিনার বাইরে দেশ ও সরকারের প্রতি আস্থা ও সদিচ্ছার বিষয়টি প্রচারে সহায়তা করবে তারা। তাদের মূল কাজ ছিল ‘স্থিতিশীল’ ও ‘উন্নয়নশীল’ আর্জেন্টিনার একটি ‘নয়া চিত্র’ তুলে ধরা। যে পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিশ্বকাপ। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে ভিদেলা সরকারের বিরুদ্ধে চলমান বিভিন্ন নেতিবাচক প্রচারের জবাব দেওয়ার জন্যও দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে।
ভিদেলা যে শুধু বন্দুকের জোরে এমনটা করছিলেন, তা কিন্তু নয়। ফিফার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ব্রাজিলের নাগরিক জোয়াঁও হ্যাভেলঞ্জ এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারও তাল দিয়েছিলেন ভিদেলার সঙ্গে। বিশ্বকাপ শুরুর সপ্তাহখানেক আগে ২৩ মে ভিদেলার হয়ে ওকালতি করেন ফিফার প্রেসিডেন্ট। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি হতাশ নই, বরং আমি গর্বিত যে আর্জেন্টিনার সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো ছিল, তা দারুণভাবে সামলে নিয়েছে।’ আর হেনরি কিসিঞ্জার তো বিশ্বকাপ চলাকালে আর্জেন্টিনায় উপস্থিত হয়ে ভিদেলার সঙ্গে থেকে সেমি এবং ফাইনাল ম্যাচ উপভোগ করেন!
অবশ্য স্বৈরশাসকের বিশ্বকাপ আয়োজনের বিষয়টি ভালো চোখে দেখেনি অনেকেই। এ নিয়ে ১৯৭৭ সালের শেষ দিকে একদল ফরাসি সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপ আয়োজনের বিরোধিতা করে ‘অর্গানাইজিং কমিটি ফর দ্য বয়কট অব দ্য আর্জেন্টিনা ওয়ার্ল্ড কাপ’ প্রতিষ্ঠা করেন, যার ফরাসি নামের সংক্ষেপ ছিল সিওবিএ। সে সময় ফ্রান্স ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন মিশেল প্লাতিনি। সংগঠনটি প্লাতিনি এবং ফরাসি ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অনুরোধ করে, যেন তারা আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে না যায়। কেবল ফ্রান্সেই নয়, সংগঠনটি ইতালি, স্পেন, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, স্কটল্যান্ডকেও অনুরোধ করেছিল অংশ না নিতে। এমনকি একাধিক ব্যঙ্গাত্মক পোস্টারও ছড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপজুড়ে।
কিন্তু কোনো কিছুই বন্ধ করতে পারেনি ওই বিশ্বকাপ। সব প্রচারণা, আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ১৯৭৮ সালের ১ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় বিশ্বকাপের ১১তম আসর। আর্জেন্টিনার পাঁচটি শহরের ছয় ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হয় ম্যাচগুলো। ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেবারই টাইব্রেকার নিয়ম চালু হয়। ১৬ দেশের ওই বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় স্বাগতিক আর্জেন্টিনাই। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিদেলা বলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় অঞ্চলের এই দেশ সফরের জন্য হাজার হাজার নারী-পুরুষকে আমরা সম্মান জানাচ্ছি। আমরা আশা করব, এই উৎসব একটি ভালোবাসা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিবেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।’
কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি বিষয়টি। গুঞ্জন ছিল এবং এখনো রয়েছে—আর্জেন্টিনা তাদের সেমিফাইনালের প্রতিপক্ষ পেরুকে ভয় দেখিয়েছে, ঘুষ দিয়ে এবং দেশটির স্বৈরশাসক জেনারেল মোরালেস বারমুদেজের সঙ্গে ভিদেলা সরকারের গোপন আঁতাত হয়েছে। টুর্নামেন্টজুড়ে দুর্দান্ত খেলেছিল পেরু। নিয়ম অনুসারে ফাইনালে যেতে হলে অন্তত ৪ গোলের ব্যবধানে জিততে হবে। কিন্তু ভালো খেলা পেরু সেটি করতে পারেনি। তারা হেরে যায় ৬-০ গোলের ব্যবধানে।
সেমিফাইনাল ম্যাচের আগে নানাভাবে হয়রানি করা হয় পেরুর খেলোয়াড়দের। ম্যাচের আগের রাতে যে হোটেলে তাঁরা অবস্থান করছিলেন, সেখান থেকে পাহারায় থাকা সেনাবাহিনীর সদস্যরা হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যান। আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা হোটেলের বাইরে এসে চিৎকার-চেঁচামেচি এবং তীব্র স্বরে গাড়ির হর্ন বাজাতে থাকে। হোটেল থেকে স্টেডিয়ামে নেওয়ার রাস্তা যেখানে মাত্র ৩০ মিনিটের পথ, সেখানে নানা রাস্তা দিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা ঘুরিয়ে তাঁদের স্টেডিয়ামে নেওয়া হয়।
রাতে ঘুম না হওয়ায় এবং দীর্ঘ বাস জার্নিতে এমনিতেই ক্লান্ত ছিলেন পেরুর খেলোয়াড়েরা। এরপর তাঁদের জন্য আরও চমক অপেক্ষা করছিল। খেলা শুরুর মাত্র ৩০ মিনিট আগে রাফায়েল ভিদেলা পেরুর ড্রেসিংরুমে যান এবং খেলোয়াড়দের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ আলাপ করেন। আলাপকালে ভিদেলা বলেন, ‘আমি আপনাদের বলতে চাই যে, আজ রাতের এই ম্যাচ ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের। আমি এখানে লাতিন ভ্রাতৃত্বের দাবি নিয়ে হাজির হয়েছি। আশা করি, সবকিছু ঠিকঠাকভাবে শেষ হবে।’ ভাষণের পর ভিদেলা পেরুর ফুটবলারদের দেশটির প্রেসিডেন্ট জেনারেল মোরালেস বারমুদেজের একটি চিঠি পড়ে শোনান।
এখানেই শেষ নয়, গুজব শোনা যায়—আর্জেন্টিনা পেরু সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের তৎকালীন ৫ কোটি ডলার অর্থ ও খাদ্যসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এমনকি খাদ্যশস্য নিয়ে একটি চালান পেরুতে পর্যন্ত গিয়েছিল। এ ছাড়া পেরুর খেলোয়াড়দের নগদ অর্থ এবং উন্নত বাসস্থানের লোভও দেখানো হয়েছিল। খেলোয়াড়দের মধ্যে পেরুর ডিফেন্ডার রুদলফো মাঞ্জোকে ৫০ হাজার ডলার ঘুষ সাধা হয়েছিল বলেও শোনা যায়। এমনকি দলের অন্য খেলোয়াড়দের সব মিলিয়ে আড়াই লাখ ডলার সাধা হয়েছিল হারের বিপরীতে।
যা-ই হয়ে থাকুক, সেমিফাইনালে সেই ম্যাচে পেরু সুবিধা করতে পারেনি। বিশাল ব্যবধানে হেরেছিল। ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল নেদারল্যান্ডস। সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনা জিতে গিয়েছিল ৩-১ ব্যবধানে। ফাইনালে আর্জেন্টিনার জয়ে যখন ৬০ হাজারের বেশি মানুষ এস্তাদিও মনুমেন্তালে হর্ষধ্বনি দিচ্ছিল, ঠিক সেই সময়েই হয়তো স্টেডিয়াম থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের নেভি হেডকোয়ার্টার্সে নির্যাতনের শিকার হয়ে গোঙাচ্ছিলেন কোনো নিরপরাধ নাগরিক!
খেলা নিয়ে গুজব যা-ই থাক, ভিদেলা যে সেই বিশ্বকাপকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। বামপন্থী সশস্ত্র যোদ্ধাদের দমন, অর্থনীতির সংকট থেকে দৃষ্টি ফেরানোসহ স্বৈরশাসনের সব নেতিবাচক দিক ঢাকতে ভিদেলা বিশ্বকাপকে ব্যবহার করেছিলেন। আর্জেন্টিনার খেলা শেষে সরকার গুম করা ব্যক্তিদের হঠাৎ হাজির করত। তাদের নিয়ে বের হতো শহরে শহরে। দেখাত যে মানুষ কত আনন্দের মধ্যে রয়েছে।
যাহোক, সেই আগের পরিস্থিতি আবারও অনেকটাই যেন ফিরে এসেছে আর্জেন্টিনায়। দেশটিতে আবারও অর্থনৈতিক সংকট ফিরে এসেছে। এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন বেশ কয়েকজন মন্ত্রী। সংকট এতটাই গভীর যে, দেশটির অনেকেই চান না আর্জেন্টিনা এবার বিশ্বকাপ জিতুক। কারণ, তাতে পরিস্থিতি দীর্ঘ সময়ের জন্য আবারও চাপা পড়ে যাবে। এদেরই একজন হলেন লিওনেল মেসির ক্যারিয়ারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা চিকিৎসক দিয়েগো শোয়ার্জস্টাইন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি চান না আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতুক। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এমন কথাই স্পষ্ট করে বলেছেন।
যেসব উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল চালু হয়েছিল, তার কতটা অর্জিত হয়েছে, কত দূর মূল লক্ষ্য থেকে সরে গেছে, তা বিতর্কের বিষয়। তেমনি বিতর্কের বিষয় আর্জেন্টিনার ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপ আয়োজন। সেই বিশ্বকাপ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, স্বৈরশাসকেরা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে হেন কোনো কাজ নেই, যা করে না!
তথ্যসূত্র: এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, হিস্টোরি ডট কম, স্পোর্টস বাইবেল, দ্য টাইমস এবং পেপেলিতোস

গত কয়েক বছরে ভারতের আলোচনা ও বিশ্লেষণে প্রাধান্য পেয়েছে দেশটির বৈশ্বিক ভূমিকা ও পরাশক্তি হয়ে ওঠার উচ্চাভিলাষ। ২০২৩ সালে জি-২০ সম্মেলনে সভাপতিত্ব, মহাকাশ অভিযান, বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধির বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে অবস্থান এবং দশকের শেষে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা—এসব বিষয়ই অভ্যন্তরীণ..
৪ ঘণ্টা আগে
ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের পরিকল্পনার মাধ্যমে রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সৃষ্টির হুমকির মধ্যেই ভ্লাদিমির পুতিন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে টেলিফোনে আলাপ হয়। ফলাফল বুদাপেস্টে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণা। গত আগস্টেও একই নাটক দেখা গিয়েছিল। তখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন
৫ ঘণ্টা আগে
এক সপ্তাহ আগেও মনে হচ্ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কৌশলে ব্যবহার করে ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সমর্থন ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন পুতিন। কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাশিয়ার অর্থনীতির মূল খাত জ্বালানি তেল শিল্পের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে
১৭ ঘণ্টা আগে
দ্বিতীয় মেয়াদে পররাষ্ট্রনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এনে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটন এবার সরাসরি রাশিয়ার বৃহৎ দুই তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুকঅয়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই পদক্ষেপ ট্রাম্পের আগের কৌশলগুলো থেকে একটু ভিন্ন ও কঠোর।
১৮ ঘণ্টা আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে একধরনের অদ্ভুত মিল দেখা যাচ্ছে। জেনারেশন-জেড বা জেন-জি বিক্ষোভে গত সেপ্টেম্বরে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এটি অনেকটা গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া ‘মনসুন রেভল্যুশন’-এর মতো। সে সময় শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে, তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। আবার ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার ‘আরাগালায়া বা সংগ্রাম’ আন্দোলনও একই ধারায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে পদত্যাগে বাধ্য করে।
এ ধরনের একের পর এক গণ-আন্দোলন ইঙ্গিত দেয়, রাজনৈতিক অচলাবস্থা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও জনসংখ্যাগত চাপের মতো মৌলিক সংকটে ভুগছে গোটা দক্ষিণ এশিয়া। নেপালের কথাই ধরা যাক—রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়ার পর ২০০৮ থেকে গত ১৭ বছরে দেশটিতে ১৪টি সরকার গঠিত হয়েছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগের সঙ্গে সর্বশেষ যোগ হয়েছিল ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা। যার ফলে তরুণ প্রজন্ম রাস্তায় নামে। নেপালের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের বেশির বয়স ১৫ বছরের নিচে, দেশের জনগণের গড় বয়স মাত্র ২৫ বছর, আর প্রতি পাঁচজন তরুণের একজন বেকার।
এই ঘটনাগুলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। ভারতের চারপাশে যেন এক অস্থিরতার বৃত্ত তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাও বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তায় চলছে। আফগানিস্তান ও মিয়ানমার কার্যত ব্যর্থ বা প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আর চীন ও পাকিস্তান—দুই প্রতিবেশীই ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধে জড়িত, তাদের বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের ইতিহাস দীর্ঘ এবং দুটি দেশই পারমাণবিক শক্তিধর।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দুর্বল অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মোট বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ হয় পরস্পরের সঙ্গে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলন হয়েছে ২০১৪ সালে।
গত কয়েক বছরে ভারতের আলোচনা ও বিশ্লেষণে প্রাধান্য পেয়েছে দেশটির বৈশ্বিক ভূমিকা ও পরাশক্তি হয়ে ওঠার উচ্চাভিলাষ। ২০২৩ সালে জি-২০ সম্মেলনে সভাপতিত্ব, মহাকাশ অভিযান, বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধির বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে অবস্থান এবং দশকের শেষে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা—এসব বিষয়ই অভ্যন্তরীণ আলোচনায় এসেছে বেশি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের মতো শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়েও হয়েছে ব্যাপক আলোচনা। কিন্তু ভারতের মধ্যে এই আলোচনায় নিকট প্রতিবেশীরা যেন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
এটার একটা কারণ, নয়াদিল্লির নিজস্ব প্রবণতা—বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা এবং পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে পুরো অঞ্চলকে আলাদা নজরে দেখা। ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে সব দক্ষিণ এশীয় নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং প্রথম দফায় তিনি ‘সবার আগে প্রতিবেশী’ নীতি ঘোষণা করেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সরকার ভারতকে আঞ্চলিক পরিসর ছাড়িয়ে বৈশ্বিক মঞ্চে তুলতে বেশি মনোযোগ দিয়েছে।
এই প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে চলতি বছরের ‘রাইসিনা ডায়ালগে’। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত প্রধান কূটনৈতিক সম্মেলনে ইউক্রেন ও গাজা সংঘাত থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও মহাকাশে আধিপত্য—সব বিষয়ই সেখানে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাম্প্রতিক অস্থিরতা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কারণ, মাত্র ছয় মাস আগে বাংলাদেশের মনসুন রেভল্যুশনে ক্ষমতাচ্যুত হয় ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র সরকারগুলোর একটি।
রাইসিনা ডায়ালগের ঠিক এক মাস পর চলতি বছরের এপ্রিলে কাশ্মীরে প্রাণঘাতী হামলা হয়। এ হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দুই দশকের বেশি সময় পর বড় ধরনের যুদ্ধ হয়। ডায়ালগে ইউক্রেনে সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে ভারতীয় শান্তিরক্ষী মোতায়েনের বিষয়ে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা আলোচনা করলেও আফগানিস্তান বা মিয়ানমারকে স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা কী হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। এটিই ইঙ্গিত দেয় যে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি একধরনের ‘উদাসীনতা’ ধীরে ধীরে নীতি-কৌশলে পরিণত হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার বর্তমান অবস্থা নিয়ে যুক্তরাজ্য সফরে যাওয়ার ভারতীয় সংসদ সদস্যদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার আলোচনায় এক সদস্য বলেন, ভারত তার প্রতিবেশীকে ভৌগোলিক দূরত্বে নয়, বরং ‘পারস্পরিক স্বার্থ’ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করে। যদিও সত্য এই যে কোয়াড বা ব্রিকসের মতো ‘সমভাবাপন্ন রাষ্ট্রগুলোর’ জোট সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গতি পেয়েছে, কিন্তু এসব উদ্যোগ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দৃঢ় সম্পৃক্ততার বিকল্প হতে পারে না।
ভারতের অনেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার সংকটের দায় পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের টানাপোড়েনকে দেন। পাকিস্তান সার্কের সদস্যদেশ—এটি হয়তো সার্কের অচলাবস্থা ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু এতে ব্যাখ্যা মেলে না, কেন অন্যান্য আঞ্চলিক সংগঠনও প্রায় অকার্যকর হয়ে আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বঙ্গোপসাগর-ভিত্তিক আঞ্চলিক সংগঠন ‘বিমসটেক’-এর কথা। পাকিস্তান এর সদস্য নয়, তবু ১৯৯৭ সালে গঠনের পর থেকে সংগঠনটি মাত্র ছয়বার শীর্ষ সম্মেলন করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অস্থিরতার সঙ্গে আঞ্চলিক ঘটনাবলিকে নয়াদিল্লির গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা—গভীরভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কিন্তু ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির আলোচনায় এমন বিশ্লেষণ প্রায় অনুপস্থিত। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের বাইরের নিরাপত্তা হুমকি আসে তাদের সীমান্ত বা আশপাশের অঞ্চল থেকেই; যেমন ইউরোপের জন্য রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন এক অস্তিত্বের হুমকি বা স্নায়ুযুদ্ধকালে কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় হুমকি এসেছিল নিজের ‘পেছনের উঠান’ থেকেই। আবার অনুপ্রবেশের মতো বিষয়ও বহু দেশের রাজনীতিতে তীব্র আবেগের সৃষ্টি করে। তাই ভারতের পররাষ্ট্রনীতি যদি নিজেকে কেবল বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরে, কিন্তু আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজের দায়িত্বকে উপেক্ষা করে—তাহলে তা দীর্ঘ মেয়াদে টিকবে না।
এই ‘উদাসীনতা’ ভারতের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতেও স্পষ্ট। সম্প্রতি লাদাখ (যা চীন ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী বিতর্কিত অঞ্চল) ও মণিপুরে অস্থিরতার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। মণিপুর রাজ্যটি মিয়ানমারের সীমান্তে অবস্থিত। দুই ক্ষেত্রেই কেন্দ্র সরকার ধীর প্রতিক্রিয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মণিপুরে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ার দুই বছরের বেশি সময় পর নরেন্দ্র মোদি সেখানে সফরে যান।
নয়াদিল্লির দক্ষিণ এশিয়া নীতি ভারতের সামগ্রিক পররাষ্ট্রনীতিতেও প্রভাব ফেলছে। পূর্বমুখী নীতি বা ‘লুক ইস্ট’ নীতি মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নামে নতুনভাবে প্রচারে আনে, যা আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও বাংলাদেশে ভারতের প্রতি কম সহানুভূতিশীল সরকার ক্ষমতায় থাকায় ওই উদ্যোগ স্থবির হয়ে পড়েছে। এর ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে স্থলপথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা ভেস্তে গেছে।
ভারতের পশ্চিমমুখী নীতিও (যা নয়াদিল্লি ‘ওয়েস্ট এশিয়া’ বলে উল্লেখ করে) জটিল। পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বৈরী সম্পর্ক ও আফগানিস্তানে চলমান অস্থিরতা এতে বাধা সৃষ্টি করেছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তালেবান সরকারের সঙ্গে নয়াদিল্লির যোগাযোগ বাড়ানোর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে, যা এই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে এক নতুন উদ্যোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
ভারত এই অঞ্চলের (পাকিস্তানের পর পশ্চিম দিকে) সঙ্গে যোগাযোগ জোরদারের মাধ্যমে নানা বাধা কাটিয়ে উঠেছে। আকাশপথ, নৌপথ এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক বাড়াতে দেশটি উদ্যোগ নিয়েছে ইরানে নয়াদিল্লি পরিচালিত চাবাহার বন্দর এবং ২০২৩ সালে জি-২০ সভাপতিত্বের সময় ঘোষিত ‘ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ ইকোনমিক করিডর’-এর মতো প্রকল্পের মাধ্যমে। পাশাপাশি কাবুলের তালেবান সরকারের সঙ্গেও সাম্প্রতিক সময়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে নয়াদিল্লি। তবে মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের সম্পৃক্ততা এখনো নড়বড়ে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে ঘোষিত প্রতিরক্ষা চুক্তি বিবেচনায় নিলে সেই পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও আঞ্চলিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা দরকার, চীন বৈশ্বিক শক্তি হয়ে ওঠার আগে আঞ্চলিকভাবে নিজেদের অর্থনীতি ও অবকাঠামোকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে একীভূত করেছিল। এর মাধ্যমে তারা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ও আন্তর্দেশীয় উৎপাদন নেটওয়ার্কে নিজেদের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। ভারতকেও সেই পথ অনুসরণ করতে হবে, যদি দেশটি বৈশ্বিক উৎপাদনকেন্দ্র হওয়ার লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়।
পশ্চিমা দেশগুলোও অনেক সময় ভারতকে একা একটি দেশ হিসেবে দেখে—দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে নয়। এর পেছনে আংশিক কারণ প্রশাসনিক জটিলতা; যেমন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরে ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ওশান ডিরেক্টরেট’ আলাদা বিভাগ, আর আফগানিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ে কাজ করে আরেকটি বিভাগ— ‘আফগানিস্তান অ্যান্ড পাকিস্তান ডিরেক্টরেট।’
একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরে (ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স) ভারত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড’-এর অধীনে, আর আফগানিস্তান ও পাকিস্তান ‘সেন্ট্রাল কমান্ড’-এর অধীনে। এই প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক বিশেষ দূত সার্জিও গরকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নয়াদিল্লিতে নিয়োগ দেওয়া ইতিবাচক পদক্ষেপ। যদিও ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, এই নিয়োগ হয়তো যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও ভারত-পাকিস্তানকে একসঙ্গে বিবেচনা করতে উৎসাহিত করবে এবং ভারতকে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার শক্তি হিসেবেই দেখবে।
সর্বোপরি প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন, যেখানে পশ্চিমা দেশগুলোর ভারতনীতি আরও নিবিড়ভাবে দক্ষিণ এশিয়া নীতির সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারতকে বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পশ্চিমা দেশগুলোও এই অঞ্চলের অভিন্ন সংকট মোকাবিলায় আরও কার্যকরভাবে এগোতে পারবে।
এই সংকটগুলোর মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যার চাপ—দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষের বয়স এখনো ১৮ বছরের নিচে। রয়েছে জলবায়ু ঝুঁকি—এই অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জলবায়ু বিপর্যয়-সংবেদনশীল এলাকার একটি। আছে অভিবাসন সংকটও—অনেক পশ্চিমা দেশে অবৈধ অভিবাসীর বড় অংশ দক্ষিণ এশীয়।
এ অবস্থায় পশ্চিমা দেশগুলোরও ভাবতে হবে—কীভাবে তারা এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নতুনভাবে সাজাবে। কারণ, এখন দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসছে। দীর্ঘদিনের প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবার ও গোষ্ঠীকে সরিয়ে জনগণের শক্তিতে নতুন প্রজন্মের নেতারা উঠে আসছেন।
এটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা গেছে শ্রীলঙ্কায়। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়ে পরাজিত হয়েছেন পুরোনো রাজনৈতিক পরিবারের প্রার্থীরা। বিজয়ী হয়েছেন বামপন্থী জোটের নেতা অনুড়া কুমারা দিসানায়েকে, যার দল জনতা ভিমুক্তি পেরামুনা একসময় দেশজুড়ে সশস্ত্র আন্দোলন করেছিল। এই অপ্রত্যাশিত নির্বাচনী ফল শ্রীলঙ্কার অস্থির রাজনীতিকে যেমন তুলে ধরেছে, তেমনি দেশের মূলধারার রাজনীতির প্রতি জনগণের গভীর হতাশাও স্পষ্ট করেছে।
বাংলাদেশ ও নেপালে একই ধরনের কিছু রাজনৈতিক প্রবণতা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। দুই দেশই বর্তমানে সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আছে। বাংলাদেশে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস এবং নেপালে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি। ছাত্র ও যুবা নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে—বাংলাদেশের জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং নেপালের হামি নেপাল-এর মতো সংগঠনগুলো এখন প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
এই প্রবণতা দুই দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির প্রভাবকে দুর্বল করার সম্ভাবনা তৈরি করছে। ‘ব্যাটলিং বেগমস’-এর যুগে বাংলাদেশের রাজনীতি আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল হতো এবং নেপালের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলে (নেপালি কংগ্রেস ও দুটি কমিউনিস্ট পার্টি) ছিল পুরুষ নেতাদের আধিপত্য।
এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি। এই অঞ্চলের দেশগুলো প্রায়ই চীন ও ভারতের প্রতিযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের উন্নয়নের চাহিদা পূরণের জন্য উভয় রাষ্ট্র থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে, পাশাপাশি তাদের স্বাধীনতাও রক্ষা করে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ছে—দেশটি এই অঞ্চলের দেশগুলোর প্রধান বাণিজ্য অংশীদার, বৈদেশিক বিনিয়োগের উৎস এবং দেশগুলোর জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
অন্যদিকে এই অঞ্চলের দেশগুলো ভারতের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক বজায় রাখে। যেখানে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা প্রায়ই নির্বাচনে ভারতবিরোধী অবস্থান জানান দেওয়ার প্রতিযোগিতা করেন। এটি স্পষ্টভাবে দেখা গেছে মালদ্বীপ ও বাংলাদেশে, যেখানে সাম্প্রতিক নির্বাচনের প্রচারে ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
তবে বাস্তবতা হলো, প্রধান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারত এই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। নয়াদিল্লির কার্যক্রম; যেমন শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপকে সাম্প্রতিক আর্থিক সংকটের সময় অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া—ভারতকে ‘শেষ আশ্রয়’ হিসেবেই উপস্থাপন করেছে।
যা হোক, এখন এমন এক সময় যখন বৈশ্বিক নীতি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো চাপের মুখে—ঠিক তখনই আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলো নতুন করে গতি পাচ্ছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সংহতি ও সহযোগিতা শক্তিশালী করার তাগিদ আরও বাড়িয়ে দেয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে এই নিবন্ধের লেখক এই প্রস্তাব ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের কাছে তুলে ধরেন। সে সময় জয়শঙ্কর উদাহরণ দেন ভারত কীভাবে আঞ্চলিক সংযোগ শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে—অবকাঠামোগত প্রকল্প, আর্থিক সহায়তা, টিকা বিতরণ এবং খাদ্যশস্য সরবরাহের মাধ্যমে। তবে তিনি ব্যাখ্যা করেননি যে কেন ভারতের সঙ্গে অন্য দেশগুলোর আঞ্চলিক সংহতি ও আস্থা এখনো দুর্বল।
এটি পশ্চিমাদের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অভিবাসন, জলবায়ু ও চীনের বৈশ্বিক ভূমিকা সম্পর্কিত বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। যা হোক, এই অঞ্চলের দেশগুলো আঞ্চলিক সংহতি জোরদার করতে না পারলেও সমমনা দেশগুলো তাদের শক্তি ও সংযুক্তি সক্ষমতা ব্যবহার করে বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতা সহজতর করতে পারে; যেমন জলবায়ু সহনশীলতা, অভিবাসন এবং শারীরিক ও ডিজিটাল সংযোগের উন্নতি।
তবে ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে না। কারণ, বৈশ্বিক উন্নয়ন সহায়তা কমছে, বৈদেশিক নীতি এখন ‘অগ্রাধিকার’ নিয়ে প্রতিযোগিতা করছে এবং আর্থিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবু দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশের আবাসস্থল। তাই এই অঞ্চলে যা ঘটে, তার প্রভাব গোটা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে একধরনের অদ্ভুত মিল দেখা যাচ্ছে। জেনারেশন-জেড বা জেন-জি বিক্ষোভে গত সেপ্টেম্বরে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এটি অনেকটা গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া ‘মনসুন রেভল্যুশন’-এর মতো। সে সময় শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে, তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। আবার ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার ‘আরাগালায়া বা সংগ্রাম’ আন্দোলনও একই ধারায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে পদত্যাগে বাধ্য করে।
এ ধরনের একের পর এক গণ-আন্দোলন ইঙ্গিত দেয়, রাজনৈতিক অচলাবস্থা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও জনসংখ্যাগত চাপের মতো মৌলিক সংকটে ভুগছে গোটা দক্ষিণ এশিয়া। নেপালের কথাই ধরা যাক—রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়ার পর ২০০৮ থেকে গত ১৭ বছরে দেশটিতে ১৪টি সরকার গঠিত হয়েছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগের সঙ্গে সর্বশেষ যোগ হয়েছিল ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা। যার ফলে তরুণ প্রজন্ম রাস্তায় নামে। নেপালের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের বেশির বয়স ১৫ বছরের নিচে, দেশের জনগণের গড় বয়স মাত্র ২৫ বছর, আর প্রতি পাঁচজন তরুণের একজন বেকার।
এই ঘটনাগুলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। ভারতের চারপাশে যেন এক অস্থিরতার বৃত্ত তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাও বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তায় চলছে। আফগানিস্তান ও মিয়ানমার কার্যত ব্যর্থ বা প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আর চীন ও পাকিস্তান—দুই প্রতিবেশীই ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধে জড়িত, তাদের বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের ইতিহাস দীর্ঘ এবং দুটি দেশই পারমাণবিক শক্তিধর।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দুর্বল অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মোট বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ হয় পরস্পরের সঙ্গে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলন হয়েছে ২০১৪ সালে।
গত কয়েক বছরে ভারতের আলোচনা ও বিশ্লেষণে প্রাধান্য পেয়েছে দেশটির বৈশ্বিক ভূমিকা ও পরাশক্তি হয়ে ওঠার উচ্চাভিলাষ। ২০২৩ সালে জি-২০ সম্মেলনে সভাপতিত্ব, মহাকাশ অভিযান, বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধির বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে অবস্থান এবং দশকের শেষে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা—এসব বিষয়ই অভ্যন্তরীণ আলোচনায় এসেছে বেশি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের মতো শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়েও হয়েছে ব্যাপক আলোচনা। কিন্তু ভারতের মধ্যে এই আলোচনায় নিকট প্রতিবেশীরা যেন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
এটার একটা কারণ, নয়াদিল্লির নিজস্ব প্রবণতা—বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা এবং পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে পুরো অঞ্চলকে আলাদা নজরে দেখা। ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে সব দক্ষিণ এশীয় নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং প্রথম দফায় তিনি ‘সবার আগে প্রতিবেশী’ নীতি ঘোষণা করেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সরকার ভারতকে আঞ্চলিক পরিসর ছাড়িয়ে বৈশ্বিক মঞ্চে তুলতে বেশি মনোযোগ দিয়েছে।
এই প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে চলতি বছরের ‘রাইসিনা ডায়ালগে’। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত প্রধান কূটনৈতিক সম্মেলনে ইউক্রেন ও গাজা সংঘাত থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও মহাকাশে আধিপত্য—সব বিষয়ই সেখানে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাম্প্রতিক অস্থিরতা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কারণ, মাত্র ছয় মাস আগে বাংলাদেশের মনসুন রেভল্যুশনে ক্ষমতাচ্যুত হয় ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র সরকারগুলোর একটি।
রাইসিনা ডায়ালগের ঠিক এক মাস পর চলতি বছরের এপ্রিলে কাশ্মীরে প্রাণঘাতী হামলা হয়। এ হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দুই দশকের বেশি সময় পর বড় ধরনের যুদ্ধ হয়। ডায়ালগে ইউক্রেনে সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে ভারতীয় শান্তিরক্ষী মোতায়েনের বিষয়ে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা আলোচনা করলেও আফগানিস্তান বা মিয়ানমারকে স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা কী হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। এটিই ইঙ্গিত দেয় যে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি একধরনের ‘উদাসীনতা’ ধীরে ধীরে নীতি-কৌশলে পরিণত হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার বর্তমান অবস্থা নিয়ে যুক্তরাজ্য সফরে যাওয়ার ভারতীয় সংসদ সদস্যদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার আলোচনায় এক সদস্য বলেন, ভারত তার প্রতিবেশীকে ভৌগোলিক দূরত্বে নয়, বরং ‘পারস্পরিক স্বার্থ’ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করে। যদিও সত্য এই যে কোয়াড বা ব্রিকসের মতো ‘সমভাবাপন্ন রাষ্ট্রগুলোর’ জোট সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গতি পেয়েছে, কিন্তু এসব উদ্যোগ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দৃঢ় সম্পৃক্ততার বিকল্প হতে পারে না।
ভারতের অনেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার সংকটের দায় পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের টানাপোড়েনকে দেন। পাকিস্তান সার্কের সদস্যদেশ—এটি হয়তো সার্কের অচলাবস্থা ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু এতে ব্যাখ্যা মেলে না, কেন অন্যান্য আঞ্চলিক সংগঠনও প্রায় অকার্যকর হয়ে আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বঙ্গোপসাগর-ভিত্তিক আঞ্চলিক সংগঠন ‘বিমসটেক’-এর কথা। পাকিস্তান এর সদস্য নয়, তবু ১৯৯৭ সালে গঠনের পর থেকে সংগঠনটি মাত্র ছয়বার শীর্ষ সম্মেলন করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অস্থিরতার সঙ্গে আঞ্চলিক ঘটনাবলিকে নয়াদিল্লির গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা—গভীরভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কিন্তু ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির আলোচনায় এমন বিশ্লেষণ প্রায় অনুপস্থিত। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের বাইরের নিরাপত্তা হুমকি আসে তাদের সীমান্ত বা আশপাশের অঞ্চল থেকেই; যেমন ইউরোপের জন্য রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন এক অস্তিত্বের হুমকি বা স্নায়ুযুদ্ধকালে কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় হুমকি এসেছিল নিজের ‘পেছনের উঠান’ থেকেই। আবার অনুপ্রবেশের মতো বিষয়ও বহু দেশের রাজনীতিতে তীব্র আবেগের সৃষ্টি করে। তাই ভারতের পররাষ্ট্রনীতি যদি নিজেকে কেবল বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরে, কিন্তু আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজের দায়িত্বকে উপেক্ষা করে—তাহলে তা দীর্ঘ মেয়াদে টিকবে না।
এই ‘উদাসীনতা’ ভারতের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতেও স্পষ্ট। সম্প্রতি লাদাখ (যা চীন ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী বিতর্কিত অঞ্চল) ও মণিপুরে অস্থিরতার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। মণিপুর রাজ্যটি মিয়ানমারের সীমান্তে অবস্থিত। দুই ক্ষেত্রেই কেন্দ্র সরকার ধীর প্রতিক্রিয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মণিপুরে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ার দুই বছরের বেশি সময় পর নরেন্দ্র মোদি সেখানে সফরে যান।
নয়াদিল্লির দক্ষিণ এশিয়া নীতি ভারতের সামগ্রিক পররাষ্ট্রনীতিতেও প্রভাব ফেলছে। পূর্বমুখী নীতি বা ‘লুক ইস্ট’ নীতি মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নামে নতুনভাবে প্রচারে আনে, যা আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও বাংলাদেশে ভারতের প্রতি কম সহানুভূতিশীল সরকার ক্ষমতায় থাকায় ওই উদ্যোগ স্থবির হয়ে পড়েছে। এর ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে স্থলপথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা ভেস্তে গেছে।
ভারতের পশ্চিমমুখী নীতিও (যা নয়াদিল্লি ‘ওয়েস্ট এশিয়া’ বলে উল্লেখ করে) জটিল। পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বৈরী সম্পর্ক ও আফগানিস্তানে চলমান অস্থিরতা এতে বাধা সৃষ্টি করেছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তালেবান সরকারের সঙ্গে নয়াদিল্লির যোগাযোগ বাড়ানোর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে, যা এই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে এক নতুন উদ্যোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
ভারত এই অঞ্চলের (পাকিস্তানের পর পশ্চিম দিকে) সঙ্গে যোগাযোগ জোরদারের মাধ্যমে নানা বাধা কাটিয়ে উঠেছে। আকাশপথ, নৌপথ এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক বাড়াতে দেশটি উদ্যোগ নিয়েছে ইরানে নয়াদিল্লি পরিচালিত চাবাহার বন্দর এবং ২০২৩ সালে জি-২০ সভাপতিত্বের সময় ঘোষিত ‘ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ ইকোনমিক করিডর’-এর মতো প্রকল্পের মাধ্যমে। পাশাপাশি কাবুলের তালেবান সরকারের সঙ্গেও সাম্প্রতিক সময়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে নয়াদিল্লি। তবে মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের সম্পৃক্ততা এখনো নড়বড়ে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে ঘোষিত প্রতিরক্ষা চুক্তি বিবেচনায় নিলে সেই পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও আঞ্চলিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা দরকার, চীন বৈশ্বিক শক্তি হয়ে ওঠার আগে আঞ্চলিকভাবে নিজেদের অর্থনীতি ও অবকাঠামোকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে একীভূত করেছিল। এর মাধ্যমে তারা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ও আন্তর্দেশীয় উৎপাদন নেটওয়ার্কে নিজেদের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। ভারতকেও সেই পথ অনুসরণ করতে হবে, যদি দেশটি বৈশ্বিক উৎপাদনকেন্দ্র হওয়ার লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়।
পশ্চিমা দেশগুলোও অনেক সময় ভারতকে একা একটি দেশ হিসেবে দেখে—দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে নয়। এর পেছনে আংশিক কারণ প্রশাসনিক জটিলতা; যেমন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরে ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ওশান ডিরেক্টরেট’ আলাদা বিভাগ, আর আফগানিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ে কাজ করে আরেকটি বিভাগ— ‘আফগানিস্তান অ্যান্ড পাকিস্তান ডিরেক্টরেট।’
একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরে (ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স) ভারত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড’-এর অধীনে, আর আফগানিস্তান ও পাকিস্তান ‘সেন্ট্রাল কমান্ড’-এর অধীনে। এই প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক বিশেষ দূত সার্জিও গরকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নয়াদিল্লিতে নিয়োগ দেওয়া ইতিবাচক পদক্ষেপ। যদিও ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, এই নিয়োগ হয়তো যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও ভারত-পাকিস্তানকে একসঙ্গে বিবেচনা করতে উৎসাহিত করবে এবং ভারতকে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার শক্তি হিসেবেই দেখবে।
সর্বোপরি প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন, যেখানে পশ্চিমা দেশগুলোর ভারতনীতি আরও নিবিড়ভাবে দক্ষিণ এশিয়া নীতির সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারতকে বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পশ্চিমা দেশগুলোও এই অঞ্চলের অভিন্ন সংকট মোকাবিলায় আরও কার্যকরভাবে এগোতে পারবে।
এই সংকটগুলোর মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যার চাপ—দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষের বয়স এখনো ১৮ বছরের নিচে। রয়েছে জলবায়ু ঝুঁকি—এই অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জলবায়ু বিপর্যয়-সংবেদনশীল এলাকার একটি। আছে অভিবাসন সংকটও—অনেক পশ্চিমা দেশে অবৈধ অভিবাসীর বড় অংশ দক্ষিণ এশীয়।
এ অবস্থায় পশ্চিমা দেশগুলোরও ভাবতে হবে—কীভাবে তারা এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নতুনভাবে সাজাবে। কারণ, এখন দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসছে। দীর্ঘদিনের প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবার ও গোষ্ঠীকে সরিয়ে জনগণের শক্তিতে নতুন প্রজন্মের নেতারা উঠে আসছেন।
এটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা গেছে শ্রীলঙ্কায়। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়ে পরাজিত হয়েছেন পুরোনো রাজনৈতিক পরিবারের প্রার্থীরা। বিজয়ী হয়েছেন বামপন্থী জোটের নেতা অনুড়া কুমারা দিসানায়েকে, যার দল জনতা ভিমুক্তি পেরামুনা একসময় দেশজুড়ে সশস্ত্র আন্দোলন করেছিল। এই অপ্রত্যাশিত নির্বাচনী ফল শ্রীলঙ্কার অস্থির রাজনীতিকে যেমন তুলে ধরেছে, তেমনি দেশের মূলধারার রাজনীতির প্রতি জনগণের গভীর হতাশাও স্পষ্ট করেছে।
বাংলাদেশ ও নেপালে একই ধরনের কিছু রাজনৈতিক প্রবণতা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। দুই দেশই বর্তমানে সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আছে। বাংলাদেশে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস এবং নেপালে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি। ছাত্র ও যুবা নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে—বাংলাদেশের জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং নেপালের হামি নেপাল-এর মতো সংগঠনগুলো এখন প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
এই প্রবণতা দুই দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির প্রভাবকে দুর্বল করার সম্ভাবনা তৈরি করছে। ‘ব্যাটলিং বেগমস’-এর যুগে বাংলাদেশের রাজনীতি আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল হতো এবং নেপালের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলে (নেপালি কংগ্রেস ও দুটি কমিউনিস্ট পার্টি) ছিল পুরুষ নেতাদের আধিপত্য।
এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি। এই অঞ্চলের দেশগুলো প্রায়ই চীন ও ভারতের প্রতিযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের উন্নয়নের চাহিদা পূরণের জন্য উভয় রাষ্ট্র থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে, পাশাপাশি তাদের স্বাধীনতাও রক্ষা করে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ছে—দেশটি এই অঞ্চলের দেশগুলোর প্রধান বাণিজ্য অংশীদার, বৈদেশিক বিনিয়োগের উৎস এবং দেশগুলোর জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
অন্যদিকে এই অঞ্চলের দেশগুলো ভারতের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক বজায় রাখে। যেখানে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা প্রায়ই নির্বাচনে ভারতবিরোধী অবস্থান জানান দেওয়ার প্রতিযোগিতা করেন। এটি স্পষ্টভাবে দেখা গেছে মালদ্বীপ ও বাংলাদেশে, যেখানে সাম্প্রতিক নির্বাচনের প্রচারে ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
তবে বাস্তবতা হলো, প্রধান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারত এই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। নয়াদিল্লির কার্যক্রম; যেমন শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপকে সাম্প্রতিক আর্থিক সংকটের সময় অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া—ভারতকে ‘শেষ আশ্রয়’ হিসেবেই উপস্থাপন করেছে।
যা হোক, এখন এমন এক সময় যখন বৈশ্বিক নীতি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো চাপের মুখে—ঠিক তখনই আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলো নতুন করে গতি পাচ্ছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সংহতি ও সহযোগিতা শক্তিশালী করার তাগিদ আরও বাড়িয়ে দেয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে এই নিবন্ধের লেখক এই প্রস্তাব ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের কাছে তুলে ধরেন। সে সময় জয়শঙ্কর উদাহরণ দেন ভারত কীভাবে আঞ্চলিক সংযোগ শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে—অবকাঠামোগত প্রকল্প, আর্থিক সহায়তা, টিকা বিতরণ এবং খাদ্যশস্য সরবরাহের মাধ্যমে। তবে তিনি ব্যাখ্যা করেননি যে কেন ভারতের সঙ্গে অন্য দেশগুলোর আঞ্চলিক সংহতি ও আস্থা এখনো দুর্বল।
এটি পশ্চিমাদের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অভিবাসন, জলবায়ু ও চীনের বৈশ্বিক ভূমিকা সম্পর্কিত বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। যা হোক, এই অঞ্চলের দেশগুলো আঞ্চলিক সংহতি জোরদার করতে না পারলেও সমমনা দেশগুলো তাদের শক্তি ও সংযুক্তি সক্ষমতা ব্যবহার করে বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতা সহজতর করতে পারে; যেমন জলবায়ু সহনশীলতা, অভিবাসন এবং শারীরিক ও ডিজিটাল সংযোগের উন্নতি।
তবে ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে না। কারণ, বৈশ্বিক উন্নয়ন সহায়তা কমছে, বৈদেশিক নীতি এখন ‘অগ্রাধিকার’ নিয়ে প্রতিযোগিতা করছে এবং আর্থিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবু দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশের আবাসস্থল। তাই এই অঞ্চলে যা ঘটে, তার প্রভাব গোটা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

আর্জেন্টিনা পেরুর সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থ এবং খাদ্যসহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এমনকি খাদ্যশস্য নিয়ে একটি চালান পেরুতে পর্যন্ত গিয়েছিল। এ ছাড়া পেরুর খেলোয়াড়দের নগদ অর্থ এবং উন্নত বাসস্থানের লোভও দেখানো হয়েছিল। খেলোয়াড়দের মধ্যে পেরুর ডিফেন্ডার রুডলফো মাঞ্জোকে ৫০ হা
৩০ নভেম্বর ২০২২
ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের পরিকল্পনার মাধ্যমে রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সৃষ্টির হুমকির মধ্যেই ভ্লাদিমির পুতিন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে টেলিফোনে আলাপ হয়। ফলাফল বুদাপেস্টে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণা। গত আগস্টেও একই নাটক দেখা গিয়েছিল। তখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন
৫ ঘণ্টা আগে
এক সপ্তাহ আগেও মনে হচ্ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কৌশলে ব্যবহার করে ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সমর্থন ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন পুতিন। কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাশিয়ার অর্থনীতির মূল খাত জ্বালানি তেল শিল্পের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে
১৭ ঘণ্টা আগে
দ্বিতীয় মেয়াদে পররাষ্ট্রনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এনে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটন এবার সরাসরি রাশিয়ার বৃহৎ দুই তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুকঅয়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই পদক্ষেপ ট্রাম্পের আগের কৌশলগুলো থেকে একটু ভিন্ন ও কঠোর।
১৮ ঘণ্টা আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের পরিকল্পনার মাধ্যমে রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সৃষ্টির হুমকির মধ্যেই ভ্লাদিমির পুতিন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে টেলিফোনে আলাপ হয়। ফলাফল বুদাপেস্টে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণা। গত আগস্টেও একই নাটক দেখা গিয়েছিল। তখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই সময় পুতিন সাক্ষাৎ করেন ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে। ফলাফল আলাস্কায় যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া শীর্ষ বৈঠকের ঘোষণা।
এ যেন একধরনের ‘দেজাভ্যু’। তবে এবার মনে হচ্ছে পুনরাবৃত্তির দিন শেষ। কারণ, ন্যূনতম প্রস্তুতি নিয়ে অনুষ্ঠিত আলাস্কার বৈঠকটি ছিল ফলশূন্য। অন্যদিকে বুদাপেস্ট সম্মেলন বাতিল। বলা ভালো, এটি কার্যত ‘চালু’ হওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। ট্রাম্প নিজেই তা বাতিল করেছেন।
ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের যেখানে পৌঁছানোর কথা, সেখানে পৌঁছাতে পারব বলে আমার মনে হচ্ছিল না।’ তবে বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। এর আগে রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়ানোর হুমকি দিয়েও ট্রাম্প কখনো তা বাস্তবায়ন করেননি। বরং তিনি কূটনীতিতে ‘গাজর’ তথা প্রলুব্ধ করার কৌশল ব্যবহার করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।
তবে এবার তিনি সেই গাজর সরিয়ে রেখেছেন। রাশিয়ার দুই বড় তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুকঅয়েলের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এই পদক্ষেপ পুতিনকে যুদ্ধ থেকে সরে আসতে বাধ্য করবে না। তবে এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে ট্রাম্প ক্রেমলিনের অনমনীয় অবস্থানে ক্ষুব্ধ। ইউক্রেন যুদ্ধ সমাধানের জন্য রাশিয়া কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়।
কিন্তু আবার রুশরা ‘লাঠির রাজনীতি’ও পছন্দ করে না। বৃহস্পতিবার পুতিন সাংবাদিকদের বললেন, নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা একটি ‘অবন্ধুত্বসুলভ পদক্ষেপ’ এবং রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা। তিনি বলেন, ‘কোনো আত্মসম্মান বোধবিশিষ্ট দেশ বা জনগণ কখনো চাপের মুখে সিদ্ধান্ত নেয় না।’
তবে সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের ভাষা ছিল আরও কড়া। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের শত্রু, আর তাদের বাচাল শান্তির দূত (ট্রাম্প) এখন পুরোপুরি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের পথে নেমেছে। এই সিদ্ধান্তগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণারই সমান।’
তাহলে কী বদলেছে? প্রথম সম্মেলনের সময় যেমন হঠাৎ করে আলাস্কায় উড়ে গিয়েছিলেন ট্রাম্প, এবার তিনি কিছুটা সতর্ক ছিলেন। বুদাপেস্ট বৈঠকের আগে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে নির্দেশ দেন, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা করতে, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় এই শীর্ষ বৈঠকে সত্যিই কোনো সুফল আসবে কি না।
শিগগির স্পষ্ট হয়, কোনো ফল আসবে না। তাই বুদাপেস্টে নতুন বৈঠকের পরিকল্পনা বাতিল হয়। রাশিয়া ট্রাম্পের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি বা বর্তমান ফ্রন্টলাইন বা যুদ্ধ রেখা ‘ফ্রিজ বা স্থগিত’ করার ভাবনায় তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। ক্রেমলিন পুরো দোনবাস অঞ্চল দখলে নেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইতিমধ্যে তারা এর বড় অংশ দখল করেছে।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অটল—ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা দনবাসের অংশে রাশিয়াকে ছাড় দেবেন না। মস্কো অবশ্য দ্বিতীয় যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্মেলনকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ছিল। আলাস্কার প্রথম বৈঠকটি ক্রেমলিনের জন্য ছিল এক বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য। অ্যাঙ্কোরেজে পুতিনকে দেওয়া রাষ্ট্রীয় অভ্যর্থনা রাশিয়ার আন্তর্জাতিক মঞ্চে পুনরাবির্ভাবের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় এবং রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রে পশ্চিমা প্রচেষ্টা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়।
গত এক সপ্তাহ ধরে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বুদাপেস্টে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনায় উচ্ছ্বসিত ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে টেবিলের বাইরে রেখে ইউরোপে এই বৈঠককে তারা ব্রাসেলসের মুখে চপেটাঘাত হিসেবে উপস্থাপন করেছিল। তবে বেশির ভাগ রাশিয়ান বিশ্লেষক বিশ্বাস করছিলেন না যে বুদাপেস্ট সম্মেলন বাস্তবায়িত হলেও রাশিয়া কাঙ্ক্ষিত ফল পাবে।
রাশিয়ার কিছু পত্রিকা সরাসরি বলেছে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। মস্কভস্কি কোমসোমোলেতস লিখেছে, ‘মস্কোর যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার মতো একটি কারণও নেই।’ তবে এর মানে এই নয় যে ক্রেমলিন শান্তি চায় না। চায়, কিন্তু তাদের নিজস্ব শর্তে। আর সেই শর্তগুলো এখন কিয়েভ ও ওয়াশিংটনের কাছে অগ্রহণযোগ্য।
রাশিয়ার দাবিগুলো কেবল ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তারা দাবি করছে যুদ্ধের ‘মূল কারণগুলো’ সমাধান করতে হবে। এসব শব্দগুচ্ছের আড়ালে রাশিয়া কার্যত ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ বন্ধের শর্ত জুড়ে দিয়েছে। আরও গভীরভাবে ভাবলে বলা যায়, মস্কো এখনো ইউক্রেনকে নিজের প্রভাববলয়ে টেনে আনার লক্ষ্য ত্যাগ করেনি। তাহলে, ট্রাম্প কি রাশিয়ার ওপর আরও চাপ বাড়াতে প্রস্তুত? সম্ভবত। তবে আবারও সেই পুরোনো ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি দেখতে হতে পারে।
বুদাপেস্ট সম্মেলন ঘোষণা হওয়ার পর মস্কভস্কি কোমসোমোলেতস লিখেছিল, ‘ট্রাম্পের রশি টানাটানির খেলায় এখন আবার রাশিয়াই এগিয়ে। বৈঠকের আগের কয়েক সপ্তাহে ট্রাম্প ইউরোপীয় দেশগুলোর ফোনকল ও সফরের মাধ্যমে ট্রাম্প কিছুটা রাশি নিজের দিকে টেনে নেবেন, তারপর পুতিন আবার তাকে নিজের দিকে টেনে নেবেন।’
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের পরিকল্পনার মাধ্যমে রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সৃষ্টির হুমকির মধ্যেই ভ্লাদিমির পুতিন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে টেলিফোনে আলাপ হয়। ফলাফল বুদাপেস্টে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণা। গত আগস্টেও একই নাটক দেখা গিয়েছিল। তখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই সময় পুতিন সাক্ষাৎ করেন ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে। ফলাফল আলাস্কায় যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া শীর্ষ বৈঠকের ঘোষণা।
এ যেন একধরনের ‘দেজাভ্যু’। তবে এবার মনে হচ্ছে পুনরাবৃত্তির দিন শেষ। কারণ, ন্যূনতম প্রস্তুতি নিয়ে অনুষ্ঠিত আলাস্কার বৈঠকটি ছিল ফলশূন্য। অন্যদিকে বুদাপেস্ট সম্মেলন বাতিল। বলা ভালো, এটি কার্যত ‘চালু’ হওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। ট্রাম্প নিজেই তা বাতিল করেছেন।
ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের যেখানে পৌঁছানোর কথা, সেখানে পৌঁছাতে পারব বলে আমার মনে হচ্ছিল না।’ তবে বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। এর আগে রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়ানোর হুমকি দিয়েও ট্রাম্প কখনো তা বাস্তবায়ন করেননি। বরং তিনি কূটনীতিতে ‘গাজর’ তথা প্রলুব্ধ করার কৌশল ব্যবহার করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।
তবে এবার তিনি সেই গাজর সরিয়ে রেখেছেন। রাশিয়ার দুই বড় তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুকঅয়েলের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এই পদক্ষেপ পুতিনকে যুদ্ধ থেকে সরে আসতে বাধ্য করবে না। তবে এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে ট্রাম্প ক্রেমলিনের অনমনীয় অবস্থানে ক্ষুব্ধ। ইউক্রেন যুদ্ধ সমাধানের জন্য রাশিয়া কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়।
কিন্তু আবার রুশরা ‘লাঠির রাজনীতি’ও পছন্দ করে না। বৃহস্পতিবার পুতিন সাংবাদিকদের বললেন, নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা একটি ‘অবন্ধুত্বসুলভ পদক্ষেপ’ এবং রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা। তিনি বলেন, ‘কোনো আত্মসম্মান বোধবিশিষ্ট দেশ বা জনগণ কখনো চাপের মুখে সিদ্ধান্ত নেয় না।’
তবে সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের ভাষা ছিল আরও কড়া। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের শত্রু, আর তাদের বাচাল শান্তির দূত (ট্রাম্প) এখন পুরোপুরি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের পথে নেমেছে। এই সিদ্ধান্তগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণারই সমান।’
তাহলে কী বদলেছে? প্রথম সম্মেলনের সময় যেমন হঠাৎ করে আলাস্কায় উড়ে গিয়েছিলেন ট্রাম্প, এবার তিনি কিছুটা সতর্ক ছিলেন। বুদাপেস্ট বৈঠকের আগে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে নির্দেশ দেন, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা করতে, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় এই শীর্ষ বৈঠকে সত্যিই কোনো সুফল আসবে কি না।
শিগগির স্পষ্ট হয়, কোনো ফল আসবে না। তাই বুদাপেস্টে নতুন বৈঠকের পরিকল্পনা বাতিল হয়। রাশিয়া ট্রাম্পের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি বা বর্তমান ফ্রন্টলাইন বা যুদ্ধ রেখা ‘ফ্রিজ বা স্থগিত’ করার ভাবনায় তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। ক্রেমলিন পুরো দোনবাস অঞ্চল দখলে নেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইতিমধ্যে তারা এর বড় অংশ দখল করেছে।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অটল—ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা দনবাসের অংশে রাশিয়াকে ছাড় দেবেন না। মস্কো অবশ্য দ্বিতীয় যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্মেলনকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ছিল। আলাস্কার প্রথম বৈঠকটি ক্রেমলিনের জন্য ছিল এক বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য। অ্যাঙ্কোরেজে পুতিনকে দেওয়া রাষ্ট্রীয় অভ্যর্থনা রাশিয়ার আন্তর্জাতিক মঞ্চে পুনরাবির্ভাবের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় এবং রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রে পশ্চিমা প্রচেষ্টা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়।
গত এক সপ্তাহ ধরে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বুদাপেস্টে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনায় উচ্ছ্বসিত ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে টেবিলের বাইরে রেখে ইউরোপে এই বৈঠককে তারা ব্রাসেলসের মুখে চপেটাঘাত হিসেবে উপস্থাপন করেছিল। তবে বেশির ভাগ রাশিয়ান বিশ্লেষক বিশ্বাস করছিলেন না যে বুদাপেস্ট সম্মেলন বাস্তবায়িত হলেও রাশিয়া কাঙ্ক্ষিত ফল পাবে।
রাশিয়ার কিছু পত্রিকা সরাসরি বলেছে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। মস্কভস্কি কোমসোমোলেতস লিখেছে, ‘মস্কোর যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার মতো একটি কারণও নেই।’ তবে এর মানে এই নয় যে ক্রেমলিন শান্তি চায় না। চায়, কিন্তু তাদের নিজস্ব শর্তে। আর সেই শর্তগুলো এখন কিয়েভ ও ওয়াশিংটনের কাছে অগ্রহণযোগ্য।
রাশিয়ার দাবিগুলো কেবল ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তারা দাবি করছে যুদ্ধের ‘মূল কারণগুলো’ সমাধান করতে হবে। এসব শব্দগুচ্ছের আড়ালে রাশিয়া কার্যত ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ বন্ধের শর্ত জুড়ে দিয়েছে। আরও গভীরভাবে ভাবলে বলা যায়, মস্কো এখনো ইউক্রেনকে নিজের প্রভাববলয়ে টেনে আনার লক্ষ্য ত্যাগ করেনি। তাহলে, ট্রাম্প কি রাশিয়ার ওপর আরও চাপ বাড়াতে প্রস্তুত? সম্ভবত। তবে আবারও সেই পুরোনো ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি দেখতে হতে পারে।
বুদাপেস্ট সম্মেলন ঘোষণা হওয়ার পর মস্কভস্কি কোমসোমোলেতস লিখেছিল, ‘ট্রাম্পের রশি টানাটানির খেলায় এখন আবার রাশিয়াই এগিয়ে। বৈঠকের আগের কয়েক সপ্তাহে ট্রাম্প ইউরোপীয় দেশগুলোর ফোনকল ও সফরের মাধ্যমে ট্রাম্প কিছুটা রাশি নিজের দিকে টেনে নেবেন, তারপর পুতিন আবার তাকে নিজের দিকে টেনে নেবেন।’
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

আর্জেন্টিনা পেরুর সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থ এবং খাদ্যসহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এমনকি খাদ্যশস্য নিয়ে একটি চালান পেরুতে পর্যন্ত গিয়েছিল। এ ছাড়া পেরুর খেলোয়াড়দের নগদ অর্থ এবং উন্নত বাসস্থানের লোভও দেখানো হয়েছিল। খেলোয়াড়দের মধ্যে পেরুর ডিফেন্ডার রুডলফো মাঞ্জোকে ৫০ হা
৩০ নভেম্বর ২০২২
গত কয়েক বছরে ভারতের আলোচনা ও বিশ্লেষণে প্রাধান্য পেয়েছে দেশটির বৈশ্বিক ভূমিকা ও পরাশক্তি হয়ে ওঠার উচ্চাভিলাষ। ২০২৩ সালে জি-২০ সম্মেলনে সভাপতিত্ব, মহাকাশ অভিযান, বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধির বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে অবস্থান এবং দশকের শেষে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা—এসব বিষয়ই অভ্যন্তরীণ..
৪ ঘণ্টা আগে
এক সপ্তাহ আগেও মনে হচ্ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কৌশলে ব্যবহার করে ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সমর্থন ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন পুতিন। কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাশিয়ার অর্থনীতির মূল খাত জ্বালানি তেল শিল্পের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে
১৭ ঘণ্টা আগে
দ্বিতীয় মেয়াদে পররাষ্ট্রনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এনে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটন এবার সরাসরি রাশিয়ার বৃহৎ দুই তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুকঅয়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই পদক্ষেপ ট্রাম্পের আগের কৌশলগুলো থেকে একটু ভিন্ন ও কঠোর।
১৮ ঘণ্টা আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

এক সপ্তাহ আগেও মনে হচ্ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কৌশলে ব্যবহার করে ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সমর্থন ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন পুতিন। কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাশিয়ার অর্থনীতির মূল খাত জ্বালানি তেল শিল্পের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নেওয়া সবচেয়ে কঠোর পদক্ষেপ।
এর পরপরই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাশিয়ার বিরুদ্ধে ১৯তম নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ অনুমোদন করেছে। যেখানে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এলএনজি রাশিয়ার যুদ্ধ অর্থনীতির অন্যতম প্রধান উৎস বলে বিবেচিত।
তবে রুশ বিশ্লেষকদের মতে, এ পদক্ষেপ পুতিনের যুদ্ধনীতিতে খুব একটা পরিবর্তন আনবে না। রুশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাতিয়ানা স্তানোভায়া বলছেন, রুশ কোম্পানিগুলো অনেক আগেই এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। তাঁর ভাষায়, পুতিন যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে বড় ধরনের ক্ষতিও মেনে নিতে প্রস্তুত, আর ট্রাম্পের অবস্থানও সময়ের সঙ্গে বদলে যেতে পারে।
রুশ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে স্তানোভায়া বলেন, রাশিয়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলবে, ঠিক আছে, তিন মাস পর ট্রাম্প নিজেই নরম হয়ে যাবে। আর পুতিনের কাছে এই যুদ্ধ অস্তিত্বের প্রশ্ন, তাই তিনি সহ্য করেই যাবেন।
গতকাল বুধবার তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়, যা নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলোর প্রভাব শক্তিশালী হওয়ার ইঙ্গিত। তবে এর কার্যকারিতা শেষ পর্যন্ত নির্ভর করবে এই শাস্তিমূলক পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন এবং জ্বালানি ক্রেতাদের প্রতিক্রিয়ার ওপর। নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলো মূলত রাশিয়ার দুই বৃহত্তম তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুক অয়েল এবং সারা বিশ্বে তাদের সঙ্গে ব্যবসা করা যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর আরোপ করেছে।
রাশিয়ার মোট বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে তেল ও গ্যাস বিক্রি থেকে। তবে ইউক্রেনের উন্নত ড্রোন ও দীর্ঘপাল্লার হামলায় তেল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শিল্প খাত এরই মধ্যে চাপে রয়েছে। তবুও রুশ বিশ্লেষকেরা মনে করেন, নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সীমিতই থাকবে।
তাঁরা উল্লেখ করেন, রাশিয়া এরই মধ্যে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে যাওয়ার দক্ষতা অর্জন করেছে। দেশটি শত শত পুরোনো জাহাজ ব্যবহার করে, যেগুলোর কোনো পশ্চিমা বিমা নেই এবং তৃতীয় দেশের ছদ্ম কোম্পানির মাধ্যমে লেনদেন চালায়। তা ছাড়া বিশ্বের জ্বালানি তেলের বাজারের প্রায় ৯ শতাংশ রাশিয়ার। ফলে রুশ তেল বিশ্ববাজারে রপ্তানি না হলে সরবরাহও কমবে এবং দাম বাড়বে। এতে নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে পড়বে।
কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সের্গেই ভাকুলেনকো বলেন, লুকওয়েল সমস্যায় পড়বে বটে, কিন্তু সেটি লুকওয়েলের সমস্যা, রাশিয়ার নয়।
পুতিন প্রশাসন বহু আগেই জানত নিষেধাজ্ঞা আসছে। তাই রাশিয়া এখন বিকল্প রুট, পুরোনো জাহাজ বহর ও ফাটকা কোম্পানির জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তেল রপ্তানি চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও রাশিয়া তার প্রভাব আংশিকভাবে অকার্যকর করে দিতে পারবে, এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

এক সপ্তাহ আগেও মনে হচ্ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কৌশলে ব্যবহার করে ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সমর্থন ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন পুতিন। কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাশিয়ার অর্থনীতির মূল খাত জ্বালানি তেল শিল্পের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নেওয়া সবচেয়ে কঠোর পদক্ষেপ।
এর পরপরই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাশিয়ার বিরুদ্ধে ১৯তম নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ অনুমোদন করেছে। যেখানে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এলএনজি রাশিয়ার যুদ্ধ অর্থনীতির অন্যতম প্রধান উৎস বলে বিবেচিত।
তবে রুশ বিশ্লেষকদের মতে, এ পদক্ষেপ পুতিনের যুদ্ধনীতিতে খুব একটা পরিবর্তন আনবে না। রুশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাতিয়ানা স্তানোভায়া বলছেন, রুশ কোম্পানিগুলো অনেক আগেই এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। তাঁর ভাষায়, পুতিন যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে বড় ধরনের ক্ষতিও মেনে নিতে প্রস্তুত, আর ট্রাম্পের অবস্থানও সময়ের সঙ্গে বদলে যেতে পারে।
রুশ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে স্তানোভায়া বলেন, রাশিয়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলবে, ঠিক আছে, তিন মাস পর ট্রাম্প নিজেই নরম হয়ে যাবে। আর পুতিনের কাছে এই যুদ্ধ অস্তিত্বের প্রশ্ন, তাই তিনি সহ্য করেই যাবেন।
গতকাল বুধবার তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়, যা নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলোর প্রভাব শক্তিশালী হওয়ার ইঙ্গিত। তবে এর কার্যকারিতা শেষ পর্যন্ত নির্ভর করবে এই শাস্তিমূলক পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন এবং জ্বালানি ক্রেতাদের প্রতিক্রিয়ার ওপর। নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলো মূলত রাশিয়ার দুই বৃহত্তম তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুক অয়েল এবং সারা বিশ্বে তাদের সঙ্গে ব্যবসা করা যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর আরোপ করেছে।
রাশিয়ার মোট বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে তেল ও গ্যাস বিক্রি থেকে। তবে ইউক্রেনের উন্নত ড্রোন ও দীর্ঘপাল্লার হামলায় তেল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শিল্প খাত এরই মধ্যে চাপে রয়েছে। তবুও রুশ বিশ্লেষকেরা মনে করেন, নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সীমিতই থাকবে।
তাঁরা উল্লেখ করেন, রাশিয়া এরই মধ্যে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে যাওয়ার দক্ষতা অর্জন করেছে। দেশটি শত শত পুরোনো জাহাজ ব্যবহার করে, যেগুলোর কোনো পশ্চিমা বিমা নেই এবং তৃতীয় দেশের ছদ্ম কোম্পানির মাধ্যমে লেনদেন চালায়। তা ছাড়া বিশ্বের জ্বালানি তেলের বাজারের প্রায় ৯ শতাংশ রাশিয়ার। ফলে রুশ তেল বিশ্ববাজারে রপ্তানি না হলে সরবরাহও কমবে এবং দাম বাড়বে। এতে নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে পড়বে।
কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সের্গেই ভাকুলেনকো বলেন, লুকওয়েল সমস্যায় পড়বে বটে, কিন্তু সেটি লুকওয়েলের সমস্যা, রাশিয়ার নয়।
পুতিন প্রশাসন বহু আগেই জানত নিষেধাজ্ঞা আসছে। তাই রাশিয়া এখন বিকল্প রুট, পুরোনো জাহাজ বহর ও ফাটকা কোম্পানির জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তেল রপ্তানি চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও রাশিয়া তার প্রভাব আংশিকভাবে অকার্যকর করে দিতে পারবে, এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

আর্জেন্টিনা পেরুর সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থ এবং খাদ্যসহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এমনকি খাদ্যশস্য নিয়ে একটি চালান পেরুতে পর্যন্ত গিয়েছিল। এ ছাড়া পেরুর খেলোয়াড়দের নগদ অর্থ এবং উন্নত বাসস্থানের লোভও দেখানো হয়েছিল। খেলোয়াড়দের মধ্যে পেরুর ডিফেন্ডার রুডলফো মাঞ্জোকে ৫০ হা
৩০ নভেম্বর ২০২২
গত কয়েক বছরে ভারতের আলোচনা ও বিশ্লেষণে প্রাধান্য পেয়েছে দেশটির বৈশ্বিক ভূমিকা ও পরাশক্তি হয়ে ওঠার উচ্চাভিলাষ। ২০২৩ সালে জি-২০ সম্মেলনে সভাপতিত্ব, মহাকাশ অভিযান, বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধির বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে অবস্থান এবং দশকের শেষে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা—এসব বিষয়ই অভ্যন্তরীণ..
৪ ঘণ্টা আগে
ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের পরিকল্পনার মাধ্যমে রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সৃষ্টির হুমকির মধ্যেই ভ্লাদিমির পুতিন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে টেলিফোনে আলাপ হয়। ফলাফল বুদাপেস্টে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণা। গত আগস্টেও একই নাটক দেখা গিয়েছিল। তখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন
৫ ঘণ্টা আগে
দ্বিতীয় মেয়াদে পররাষ্ট্রনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এনে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটন এবার সরাসরি রাশিয়ার বৃহৎ দুই তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুকঅয়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই পদক্ষেপ ট্রাম্পের আগের কৌশলগুলো থেকে একটু ভিন্ন ও কঠোর।
১৮ ঘণ্টা আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

দ্বিতীয় মেয়াদে পররাষ্ট্রনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এনে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটন এবার সরাসরি রাশিয়ার বৃহৎ দুই তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুকঅয়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই পদক্ষেপ ট্রাম্পের আগের কৌশলগুলো থেকে একটু ভিন্ন ও কঠোর। এর আগে তিনি সরাসরি নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং বাণিজ্য ও শুল্কনীতির মাধ্যমে মস্কোর যুদ্ধনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিলেন। এবার তেলের নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ট্রাম্প বিশ্ব জ্বালানি রাজনীতির খেলায় আরও গভীরে প্রবেশ করেছেন, যেখানে তিনি রাশিয়ার যুদ্ধকালীন আয় বন্ধ করার পাশাপাশি ভারতের অবস্থানকেও চাপের মুখে ফেলেছেন।
মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, নতুন নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য হলো রাশিয়ার তেল রপ্তানি থেকে অর্জিত মুনাফা কমানো। তবে সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করা নয়। এটি জি-৭ জোটভুক্ত দেশগুলোর নির্ধারিত ৬০ ডলার ‘মূল্যসীমা নীতি’র বিকল্প হিসেবে এসেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বব্যাপী তেলের সরবরাহ শৃঙ্খল আরও চাপের মুখে পড়বে। নিউইয়র্কভিত্তিক বিনিয়োগ সংস্থা অ্যাগেইন ক্যাপিটালের জন কিলডাফ বলেন, ‘ওপেক বিশেষ করে সৌদি আরবের হাতে অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও, নিষেধাজ্ঞাবিহীন উৎসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম আরও বাড়বে।’
২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই কম দামে তেল কিনে রাশিয়ার অন্যতম শীর্ষ ক্রেতা হয়ে ওঠে ভারত। কিন্তু এখন রসনেফট ও লুকঅয়েল নিষিদ্ধ হওয়ায় ভারতীয় শোধনাগারগুলোকে তাদের সরবরাহকারী নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, গুজরাটের জামনগরে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম তেল শোধনাগার পরিচালনা করে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ। সম্প্রতি ভারতীয় এই প্রতিষ্ঠানটি রাশিয়ার তেল আমদানি কমানো বা সম্পূর্ণ বন্ধ করার পরিকল্পনা করেছে। প্রতিষ্ঠানটি রসনেফটের কাছ থেকে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ লাখ ব্যারেল তেল কেনার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করেছিল। নতুন নিষেধাজ্ঞা সেই সরবরাহ জটিল করে তুলেছে।
আরেক ভারতীয় প্রতিষ্ঠান নায়ারা এনার্জির বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডার রসনেফট, তারাও একই সংকটে পড়েছে। এ ছাড়া ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শোধনাগারগুলো, যেমন—ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন ও ভারত পেট্রোলিয়াম আগামী ২১ নভেম্বরের পর তাদের সব চালান যাচাই করছে, যাতে কোনো নিষিদ্ধ রুশ কোম্পানি থেকে সরাসরি তেল না আসে।
এ অবস্থায় ভারত পড়েছে এক কঠিন ভারসাম্যের খেলায়। একদিকে সাশ্রয়ী জ্বালানি, অন্যদিকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক রক্ষা। ট্রাম্প ইতিমধ্যে ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ শুধু রুশ তেল কেনার জরিমানা হিসেবে।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন, ভারত ধীরে ধীরে রুশ তেল কেনা বন্ধ করবে। গত বুধবার (১৫ অক্টোবর) হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন এবং রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করার আশ্বাস দিয়েছেন। ট্রাম্প বলেন, ‘এটি একটি বড় পদক্ষেপ। কারণ, এটি রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধে একঘরে করার প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
তবে নয়াদিল্লি এ দাবি সরাসরি অস্বীকার করেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, মোদির সঙ্গে এমন কোনো আলাপ হয়নি এবং দেশটি নিজেদের জ্বালানি নিরাপত্তা ও ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
এদিকে, ব্লুমবার্গ তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যচুক্তির আলোচনায় রয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় রপ্তানি পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক ১৫-১৬ শতাংশে নামানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু জ্বালানি-সংক্রান্ত মতবিরোধের কারণে অগ্রগতি ধীর। ট্রাম্পের দাবি অনুযায়ী মোদির ‘প্রতিশ্রুতি’ হয়তো বাস্তবের চেয়ে বেশি জনমত প্রভাবিত করার কৌশল, যাতে বোঝানো যায়—ভারত যুক্তরাষ্ট্রের চাপ মেনে রাশিয়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
দ্য এশিয়া গ্রুপের আশোক মালিক ব্লুমবার্গকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যচুক্তি প্রয়োজন, আবার একই সঙ্গে সাশ্রয়ী জ্বালানিও দরকার। এই দুই লক্ষ্য অর্জনে ভারতকে অর্থনৈতিক কূটনীতি প্রয়োগ করতে হবে।’ এর অংশ হিসেবে নয়াদিল্লি মার্কিন তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ও ক্রুড তেল আমদানি বাড়ানোর সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে, যার পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
তবে এর মানে এই নয় যে ভারত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছে। বরং, নিষেধাজ্ঞা ঝুঁকি কমিয়ে জ্বালানি উৎসে বৈচিত্র্য আনাই ভারতের লক্ষ্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞা একসঙ্গে ভারতের জন্য নতুন জটিলতা তৈরি করেছে।
এই টানাপোড়েনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী মোদি ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ৪৭তম আসিয়ান সম্মেলনে ভার্চুয়ালি অংশ নেবেন। এর মাধ্যমে তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ এড়িয়ে যাবেন। বিশ্লেষকদের মতে, এটি উত্তেজনা কমানোর একটি কূটনৈতিক ইঙ্গিত। আবার যোগাযোগের দ্বার খোলা রাখারও কৌশল বটে।
এদিকে, ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার পরেই বৈশ্বিক বাজারে তেলের দাম বেড়েছে এবং ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিতর্ক আরও গভীর হয়েছে। কিন্তু এখানে সব দিক থেকেই চাপে আছে ভারত। কারণ, ভারতের জন্য ট্রাম্পের এই তেলের খেলা এমন এক শুরু হয়েছে, যখন তাদের অর্থনীতি সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং জ্বালানির চাহিদা বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে, ব্যয়-সাশ্রয়ী বিকল্প ছাড়া রুশ তেল আমদানি কমালে অভ্যন্তরীণ জ্বালানির দাম বাড়তে পারে, যা ভোক্তা ও শিল্প উভয়কেই প্রভাবিত করবে।
অর্থাৎ, ভারতের সামনে এখন দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ—একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি নিশ্চিত করা, অন্যদিকে নিজের কৌশলগত স্বাধীনতা ও জ্বালানি নিরাপত্তা বজায় রেখে দীর্ঘদিনের মিত্র পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা। এ থেকে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয়, আর তাহলো—তেল নিয়ে ট্রাম্পের এই খেলা শুধু রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি নয়, বরং এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা, যেন বড় দেশগুলো কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ না করে।
তথ্যসূত্র: ইকোনমিকস টাইম, রয়টার্স, ব্লুমবার্গ

দ্বিতীয় মেয়াদে পররাষ্ট্রনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এনে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটন এবার সরাসরি রাশিয়ার বৃহৎ দুই তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুকঅয়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই পদক্ষেপ ট্রাম্পের আগের কৌশলগুলো থেকে একটু ভিন্ন ও কঠোর। এর আগে তিনি সরাসরি নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং বাণিজ্য ও শুল্কনীতির মাধ্যমে মস্কোর যুদ্ধনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিলেন। এবার তেলের নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ট্রাম্প বিশ্ব জ্বালানি রাজনীতির খেলায় আরও গভীরে প্রবেশ করেছেন, যেখানে তিনি রাশিয়ার যুদ্ধকালীন আয় বন্ধ করার পাশাপাশি ভারতের অবস্থানকেও চাপের মুখে ফেলেছেন।
মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, নতুন নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য হলো রাশিয়ার তেল রপ্তানি থেকে অর্জিত মুনাফা কমানো। তবে সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করা নয়। এটি জি-৭ জোটভুক্ত দেশগুলোর নির্ধারিত ৬০ ডলার ‘মূল্যসীমা নীতি’র বিকল্প হিসেবে এসেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বব্যাপী তেলের সরবরাহ শৃঙ্খল আরও চাপের মুখে পড়বে। নিউইয়র্কভিত্তিক বিনিয়োগ সংস্থা অ্যাগেইন ক্যাপিটালের জন কিলডাফ বলেন, ‘ওপেক বিশেষ করে সৌদি আরবের হাতে অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও, নিষেধাজ্ঞাবিহীন উৎসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম আরও বাড়বে।’
২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই কম দামে তেল কিনে রাশিয়ার অন্যতম শীর্ষ ক্রেতা হয়ে ওঠে ভারত। কিন্তু এখন রসনেফট ও লুকঅয়েল নিষিদ্ধ হওয়ায় ভারতীয় শোধনাগারগুলোকে তাদের সরবরাহকারী নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, গুজরাটের জামনগরে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম তেল শোধনাগার পরিচালনা করে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ। সম্প্রতি ভারতীয় এই প্রতিষ্ঠানটি রাশিয়ার তেল আমদানি কমানো বা সম্পূর্ণ বন্ধ করার পরিকল্পনা করেছে। প্রতিষ্ঠানটি রসনেফটের কাছ থেকে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ লাখ ব্যারেল তেল কেনার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করেছিল। নতুন নিষেধাজ্ঞা সেই সরবরাহ জটিল করে তুলেছে।
আরেক ভারতীয় প্রতিষ্ঠান নায়ারা এনার্জির বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডার রসনেফট, তারাও একই সংকটে পড়েছে। এ ছাড়া ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শোধনাগারগুলো, যেমন—ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন ও ভারত পেট্রোলিয়াম আগামী ২১ নভেম্বরের পর তাদের সব চালান যাচাই করছে, যাতে কোনো নিষিদ্ধ রুশ কোম্পানি থেকে সরাসরি তেল না আসে।
এ অবস্থায় ভারত পড়েছে এক কঠিন ভারসাম্যের খেলায়। একদিকে সাশ্রয়ী জ্বালানি, অন্যদিকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক রক্ষা। ট্রাম্প ইতিমধ্যে ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ শুধু রুশ তেল কেনার জরিমানা হিসেবে।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন, ভারত ধীরে ধীরে রুশ তেল কেনা বন্ধ করবে। গত বুধবার (১৫ অক্টোবর) হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন এবং রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করার আশ্বাস দিয়েছেন। ট্রাম্প বলেন, ‘এটি একটি বড় পদক্ষেপ। কারণ, এটি রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধে একঘরে করার প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
তবে নয়াদিল্লি এ দাবি সরাসরি অস্বীকার করেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, মোদির সঙ্গে এমন কোনো আলাপ হয়নি এবং দেশটি নিজেদের জ্বালানি নিরাপত্তা ও ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
এদিকে, ব্লুমবার্গ তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যচুক্তির আলোচনায় রয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় রপ্তানি পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক ১৫-১৬ শতাংশে নামানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু জ্বালানি-সংক্রান্ত মতবিরোধের কারণে অগ্রগতি ধীর। ট্রাম্পের দাবি অনুযায়ী মোদির ‘প্রতিশ্রুতি’ হয়তো বাস্তবের চেয়ে বেশি জনমত প্রভাবিত করার কৌশল, যাতে বোঝানো যায়—ভারত যুক্তরাষ্ট্রের চাপ মেনে রাশিয়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
দ্য এশিয়া গ্রুপের আশোক মালিক ব্লুমবার্গকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যচুক্তি প্রয়োজন, আবার একই সঙ্গে সাশ্রয়ী জ্বালানিও দরকার। এই দুই লক্ষ্য অর্জনে ভারতকে অর্থনৈতিক কূটনীতি প্রয়োগ করতে হবে।’ এর অংশ হিসেবে নয়াদিল্লি মার্কিন তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ও ক্রুড তেল আমদানি বাড়ানোর সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে, যার পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
তবে এর মানে এই নয় যে ভারত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছে। বরং, নিষেধাজ্ঞা ঝুঁকি কমিয়ে জ্বালানি উৎসে বৈচিত্র্য আনাই ভারতের লক্ষ্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞা একসঙ্গে ভারতের জন্য নতুন জটিলতা তৈরি করেছে।
এই টানাপোড়েনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী মোদি ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ৪৭তম আসিয়ান সম্মেলনে ভার্চুয়ালি অংশ নেবেন। এর মাধ্যমে তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ এড়িয়ে যাবেন। বিশ্লেষকদের মতে, এটি উত্তেজনা কমানোর একটি কূটনৈতিক ইঙ্গিত। আবার যোগাযোগের দ্বার খোলা রাখারও কৌশল বটে।
এদিকে, ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার পরেই বৈশ্বিক বাজারে তেলের দাম বেড়েছে এবং ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিতর্ক আরও গভীর হয়েছে। কিন্তু এখানে সব দিক থেকেই চাপে আছে ভারত। কারণ, ভারতের জন্য ট্রাম্পের এই তেলের খেলা এমন এক শুরু হয়েছে, যখন তাদের অর্থনীতি সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং জ্বালানির চাহিদা বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে, ব্যয়-সাশ্রয়ী বিকল্প ছাড়া রুশ তেল আমদানি কমালে অভ্যন্তরীণ জ্বালানির দাম বাড়তে পারে, যা ভোক্তা ও শিল্প উভয়কেই প্রভাবিত করবে।
অর্থাৎ, ভারতের সামনে এখন দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ—একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি নিশ্চিত করা, অন্যদিকে নিজের কৌশলগত স্বাধীনতা ও জ্বালানি নিরাপত্তা বজায় রেখে দীর্ঘদিনের মিত্র পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা। এ থেকে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয়, আর তাহলো—তেল নিয়ে ট্রাম্পের এই খেলা শুধু রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি নয়, বরং এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা, যেন বড় দেশগুলো কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ না করে।
তথ্যসূত্র: ইকোনমিকস টাইম, রয়টার্স, ব্লুমবার্গ

আর্জেন্টিনা পেরুর সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থ এবং খাদ্যসহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এমনকি খাদ্যশস্য নিয়ে একটি চালান পেরুতে পর্যন্ত গিয়েছিল। এ ছাড়া পেরুর খেলোয়াড়দের নগদ অর্থ এবং উন্নত বাসস্থানের লোভও দেখানো হয়েছিল। খেলোয়াড়দের মধ্যে পেরুর ডিফেন্ডার রুডলফো মাঞ্জোকে ৫০ হা
৩০ নভেম্বর ২০২২
গত কয়েক বছরে ভারতের আলোচনা ও বিশ্লেষণে প্রাধান্য পেয়েছে দেশটির বৈশ্বিক ভূমিকা ও পরাশক্তি হয়ে ওঠার উচ্চাভিলাষ। ২০২৩ সালে জি-২০ সম্মেলনে সভাপতিত্ব, মহাকাশ অভিযান, বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধির বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে অবস্থান এবং দশকের শেষে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা—এসব বিষয়ই অভ্যন্তরীণ..
৪ ঘণ্টা আগে
ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের পরিকল্পনার মাধ্যমে রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সৃষ্টির হুমকির মধ্যেই ভ্লাদিমির পুতিন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে টেলিফোনে আলাপ হয়। ফলাফল বুদাপেস্টে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণা। গত আগস্টেও একই নাটক দেখা গিয়েছিল। তখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন
৫ ঘণ্টা আগে
এক সপ্তাহ আগেও মনে হচ্ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কৌশলে ব্যবহার করে ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সমর্থন ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন পুতিন। কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাশিয়ার অর্থনীতির মূল খাত জ্বালানি তেল শিল্পের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে
১৭ ঘণ্টা আগে