Ajker Patrika

ইমরানের পতনের পেছনে কি সেনাবাহিনীর ভূমিকা আছে? 

মারুফ ইসলাম
আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০২২, ১৪: ০২
ইমরানের পতনের পেছনে কি সেনাবাহিনীর ভূমিকা আছে? 

শেষ বল অবধি খেলা হলো না ইমরান খানের। অবশেষে তাঁকে সাজঘরে ফিরতেই হলো। গতকাল শনিবার মধ্যরাতে নানা সিনেম্যাটিক ঘটনার পর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে ইমরানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়। ফলে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার ছাড়তে হলো আনপ্রেডিকটেবল খানকে। 

বলা হয়ে থাকে, কারণ বিনা কার্যে ঘটে না। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ইমরানের এই পতনের পেছনে দায়ী কে? শুধুই কি অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব? নাকি আরও কিছু? 

বাতাসে নানা গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছে। এখন পর্যন্ত দৃশ্যপটে দেখা গেছে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) সভাপতি শাহবাজ শরিফ, পাকিস্তান পিপলস পার্টির সহসভাপতি আসিফ আলি জারদারি, পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি এবং পাকিস্তানের জমিয়ত উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মাওলানা ফজলুর রহমানকে। তবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই দৃশ্যপটের অন্তরালে থেকে ইমরানের পতনের পেছনে খানিকটা কলকাঠি নেড়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। 

সত্যিই কি তাই? এমন অনুমানের পেছনে ভিত্তি কী? বিশ্লেষকেরা বলছেন, জেদি ইমরান খানই পাকিস্তানের শেষ প্রধানমন্ত্রী, যিনি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদে নিয়োগ ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়েছিলেন। 

ইমরান খান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সবচেয়ে বড় বিরোধে জড়িয়েছিলেন সম্ভবত গত বছরের অক্টোবরে। তখন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান কামার বাজওয়া সেনাবাহিনীর গোয়েন্দাপ্রধান হিসেবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আঞ্জুমকে মনোনীত করেন। কিন্তু ইমরান খান সেনাপ্রধানের মনোনীত প্রার্থীকে প্রত্যাখ্যান করে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদকে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দাপ্রধান হিসেবে বহাল রাখেন। আর জেনারেল নাদিম আঞ্জুমকে ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) নতুন মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন। এর তিন সপ্তাহ পর অবশ্য বাজওয়া মনোনীত নাদিম আঞ্জুমকেই আবার গোয়েন্দাপ্রধান করতে বাধ্য হন ইমরান; স্বাক্ষর করেন নিয়োগপত্রে। 

এসব ঘটনায় মনোক্ষুণ্ন হন সেনাপ্রধান বাজওয়া। তখনই বোঝা যায়, বীণার তার ছিঁড়ে গেছে। আগের সুরে আর রাগিণী বাজবে না। সেনাবাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়তে থাকে। 

সেই উত্তেজনায় ঘি ঢালেন ইমরানেরই নিজ দলের এক সদস্য। তাঁর নাম লিয়াকত হুসেইন। তিনি সম্প্রতি ইমরানের দল থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা এক ভিডিওতে বলেন, ‘ইমরান খান সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়াকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।’ 

ঘটনার সত্যাসত্য এখনো প্রমাণিত নয়। তবে ‘যা কিছু রটে, কিছুটা বটে’ থিওরি মেনে যদি এ ঘটনার সামান্যতমও সত্যতা মেলে, তবে তা সহজভাবে না নেওয়ারই কথা সেনাপ্রধানের। 

এদিকে গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার খানিক আগে একটি বাণিজ্য চুক্তির উদ্দেশ্যে রাশিয়া সফরে গিয়েছিলেন ইমরান খান। আর ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরুর কয়েক ঘণ্টা পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বিদায় নেন তিনি। 

ইমরানের এই মস্কো সফরও ভীষণ বাঁকা চোখে দেখেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। তাঁর এই সফরের কারণে পাকিস্তানের নিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতি নিয়ে সেনাবাহিনী ও ইমরানের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়। 

এই মতপার্থক্যের স্বীকারোক্তি মেলে স্বয়ং ইমরান খানেরই বয়ানে। ইমরান খান বলেন, তাঁর মস্কো সফরে রুষ্ট হয়েছে কয়েকটি ক্ষমতাধর দেশ। এর মধ্যে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করেন তিনি। ইমরান খান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে তাঁকে অপসারণের চক্রান্ত করা হয়েছে।’ 

চক্রান্তের দাবি হিসেবে গত ২৭ মার্চ ইমরান খান ইসলামাবাদের এক জনসভায় একটি চিঠি দেখিয়ে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণের জন্য পাকিস্তানকে একটি কূটনৈতিক সতর্কবার্তা দিয়েছে।’ 

মার্কিন সরকারের মদদে পাকিস্তানি জেনারেলদের প্রায়ই প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায়। এটি পাকিস্তানের এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা। কাজেই ইমরানের অভিযোগকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়ারও উপায় নেই। 

তাই বলার অপেক্ষা রাখে না, এই কূটনৈতিক সতর্কবার্তা, কথিত মার্কিন হুমকি এবং বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাবের কারণে পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। 

এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আতহার আব্বাস। তিনি ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ইউক্রেনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সাবেক এই সামরিক মুখপাত্র বলেছেন, ‘চিঠিটির ব্যাপারে বেশ শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সেনাবাহিনী। অনাস্থা ভোটে হস্তক্ষেপের জন্য চিঠিটি ব্যবহার করা হবে কি না, তা নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল।’ 

জেনারেল বাজওয়াপাকিস্তানের সরকারকাঠামোতে সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। দেশটির ৭৫ বছরের ইতিহাসে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে নানাভাবে ভূমিকা রেখেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। বলা হয়ে থাকে, ২০১৮ সালে ইমরানের উত্থানের পেছনেও সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল। ইমরান ছিলেন সেনাবাহিনীর পছন্দের ব্যক্তি। তখন সেনাবাহিনী ও বেসামরিক সরকার মিলেমিশে পারস্পরিক স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখার অঙ্গীকার করেছিল। 

সেই পছন্দের ব্যক্তির সঙ্গে কীভাবে দূরত্ব তৈরি হলো সেনাবাহিনীর? ২০১৯ সালে সেনাপ্রধান হিসেবে বাজওয়ার দায়িত্বের মেয়াদ প্রথমবারের মতো বাড়লে সেনাবাহিনীর ওই উদ্যোগ সমর্থন করেননি ইমরান। সম্পর্কের ফাটল শুরু মূলত তখনই। 

তারপর দিন যত গড়িয়েছে, ফাটল তত বেড়েছে। জেনারেল আব্বাস বলেছেন, ‘ইমরান খান যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তাঁর রাজনৈতিক দুর্বলতা ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে বলে মনে করে সেনাবাহিনী।’ 

ঘটনা আরও আছে। ‘নাইন ইলেভেনের হামলার পর থেকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সামরিক অভিযান এবং আন্তর্জাতিকভাবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ ভালো চোখে দেখেননি ইমরান খান’—এমন মন্তব্যও করেছেন জেনারেল আব্বাস। তিনি জানান, সেনাবাহিনীর সমালোচনায় মুখর ছিলেন ইমরান। এমনকি ইমরান এটাও বলেছেন, আমরা মার্কিনিদের যুদ্ধে সহায়তা করে নিজেদের ক্ষতি করেছি। 

সেনাবাহিনী সম্পর্কে এসব মন্তব্য হজম করা কঠিন সেনাবাহিনীর পক্ষে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী শুধু বলেছে, ‘আমাদের হাতে কোনো বিকল্প ছিল না।’ 

একের পর এক সেনাবাহিনীবিরোধী বক্তব্য এবং অবস্থান ইমরান খানকে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তাঁর সম্পর্কে আরেক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা এয়ার ভাইস-মার্শাল শাহজাদ চৌধুরী বলেছেন, ‘ইমরান খানের জনপ্রিয়তাই কাল হয়েছে। তাঁর প্রধান দুর্বলতা, তিনি একজন জনপ্রিয় নেতা। তাঁর সম্পর্কে কিছুই পূর্বানুমান করা যায় না। সংগত কারণে সেনাবাহিনী তাঁর ওপর ভরসা করতে পারছিল না।’ 

এদিকে জেনারেল হামিদ মোটামুটি নিশ্চিত যে, তিনি হবেন পরবর্তী সেনাপ্রধান। তিনি এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে, আফগানিস্তান সফরে গিয়ে বলছিলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরবর্তী দায়িত্ব তিনিই নিতে যাচ্ছেন। 

সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল বাজওয়ার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হবে আসছে নভেম্বরে। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন হয়তো জেনারেল হামিদ। তাঁকেই এখন অবধি সেনাপ্রধান হিসেবে যোগ্য মনে করা হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী পাকিস্তানের সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন প্রধানমন্ত্রী। আগামীকাল রোববার পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের কথা রয়েছে। সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে নাম শোনা যাচ্ছে বিরোধী দলীয় নেতা শাহবাজ শরিফের। 

দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়! 

সূত্র: আল-জাজিরা, জিও নিউজ, বিবিসি, এএফপি, দ্য ডিপ্লোম্যাট ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

বিশ্লেষণ সম্পর্কিত পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখামাত্র পুতিনকে গ্রেপ্তারের আহ্বান

জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে উচ্চপদস্থ বোর্ড গঠন: আইএসপিআর

ফেসবুকে ছাত্রলীগ নেতার ‘হুমকি’, রাবিতে ১৫ আগস্টের কনসার্টে যাচ্ছে না আর্টসেল

পাবনায় প্রবাসীর স্ত্রীকে নিয়ে এএসআই উধাও, থানায় শ্বশুরের জিডি

সিঙ্গাপুরে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ, আবেদন ফি মাত্র ৭ হাজার টাকা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত