Ajker Patrika

ইরানের ফোরদো পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলায় প্রাণ-প্রকৃতির ক্ষতির ঝুঁকি কতটা

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৯ জুন ২০২৫, ১৭: ১৭
ম্যাক্সার স্যাটেলাইটে তোলা ফোরদো পারমাণবিক কেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত
ম্যাক্সার স্যাটেলাইটে তোলা ফোরদো পারমাণবিক কেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত

ইরানের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্ট পাহাড়ের গভীরে স্থাপন করা হয়েছে। এই কেন্দ্রের নাম ফোরদো। এটি ইরানের ঐতিহাসিক কৌম শহর থেকে ২০ মাইল দূরে অবস্থিত এবং এমন প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত যে বিশ্বের একমাত্র একটি অস্ত্রই এটি ধ্বংস করতে পারে বলে মনে করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ৩০ হাজার পাউন্ডের জিবিইউ-৫৭ এফ/বি ‘ম্যাসিভ অর্ডিন্যান্স পেনিট্রেটর’ বা ‘মপ’ নামের বোমাটি প্রায় ৬০ মিটার গভীর পর্যন্ত মাটির নিচে ঢুকে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর হামলায় যোগ দেন এবং এই মপ ব্যবহার করেন, তাহলে কী হতে পারে?

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ফোরদোতে অস্ত্র তৈরির যোগ্য ইউরেনিয়াম উৎপাদিত হচ্ছে এবং সেখানে বিপজ্জনক কাঁচামালও রয়েছে, তাই হামলা মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। ফোরদোর সরকারি নাম শাহিদ আলি মোহাম্মাদি পারমাণবিক স্থাপনা। এটি পাহাড়ের ভেতরে আধা মাইল গভীরে স্থাপন করা হয়েছে, যেন কোনোভাবেই সহজে ধ্বংস করা না যায়।

মপ বোমাটি প্রায় ৬১ মিটার কংক্রিট ভেদ করতে পারে এবং একে একমাত্র অস্ত্র হিসেবে ধরা হয়, যেটি এই সাইটের ওপর সরাসরি হুমকি তৈরি করতে পারে। শুধু বি-টু স্টেলথ বোমা থেকে এটি ফেলা সম্ভব, যেটি একবারে দুটি করে মপ বহন করতে পারে। এই বোমা এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যেন এটি মাটির গভীরে ঢুকে বিস্ফোরণের মাধ্যমে বাংকার বা ভূগর্ভস্থ যেকোনো হুমকি ধ্বংস করতে পারে।

ছোটখাটো হামলার মাধ্যমে প্রবেশপথ কিংবা বাতাস চলাচলের টানেল ভেঙে ফেললেও পুরো স্থাপনাকে একেবারে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। সে কাজটি কেবল মপই করতে পারে। ফোরদো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্র হলেও ইরান বরাবরই বলে আসছে, তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না। অথচ পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে হলে প্রায় ৯০ শতাংশ ইউরেনিয়াম-২৩৫ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম দরকার।

ইউরেনিয়াম-২৩৫ বিভিন্ন মৌলে বিভক্ত হয়ে বিক্রিয়া ঘটায়, যা থেকে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয় এবং তা বোমা তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। তবে প্রকৃতিতে ইউরেনিয়ামের মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশই ইউ-২৩৫। বাকি অংশ মূলত ইউরেনিয়াম-২৩৮, যেটি তেমন কার্যকর নয়।

পরিবেশবিজ্ঞানের অধ্যাপক জিম স্মিথ ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফকে জানান, ফোরদোতে ইউরেনিয়ামের এই দুই রূপ আলাদা করতে সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহার করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম তৈরি করা যায়। ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লোরাইড (ইউএফ-৬) গ্যাসকে ঘূর্ণায়মান সেন্ট্রিফিউজে রেখে ওজন অনুযায়ী পৃথক করলেই ইউ-২৩৫ পাওয়া যায়।

সম্প্রতি ইরান প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম তৈরি করেছে। এক বিজ্ঞানী বলেছেন, এই অবস্থা থেকে ৯০ শতাংশে পৌঁছাতে খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না—এটাই বোমা তৈরির জন্য সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়। এই ‘আশঙ্কার’ ভিত্তিতেই ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মনে করেন, তাঁর দেশ যেকোনো সময় ইরানের পারমাণবিক হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।

১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র হিরোশিমায় ইউ-২৩৫ পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল, যার বিস্ফোরণশক্তি ছিল ১৫ হাজার টন টিএনটির সমান। পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটে যখন ফিশন বিক্রিয়া পুরোপুরি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। তত্ত্ব অনুযায়ী, ফোরদোতে এমন একটি বোমা ফেললে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ, তাতে যথেষ্ট পরিমাণ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম এক জায়গায় থাকতে হবে, যাতে তা ‘ক্রিটিক্যাল ম্যাস’-এ পৌঁছায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্রিটিশ সরকারি বিজ্ঞানী টেলিগ্রাফকে বলেন, ‘এ রকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই।’ এই বিষয়ে জিম স্মিথ বলেন, কেউ এতটা বোকা হবে না যে, সব ইউরেনিয়াম এক জায়গায় জড়ো করে রাখবে। তাই পারমাণবিক বিস্ফোরণের কোনো আশঙ্কা নেই।

তবে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়া নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ থেকেই যায়। যেমন, ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ‘বর্জনযোগ্য’ এলাকা ঘোষণা করতে হয়েছিল। তখন ইউরেনিয়াম ভেঙে আরও বিপজ্জনক মৌল তৈরি করেছিল—যেমন স্ট্রনটিয়াম, সিজিয়াম ও আয়োডিন। যা বাতাসে মিশে আশপাশের অঞ্চলকে দূষিত করেছিল।

তবুও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফোরদোতে এমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা খুব কম। ব্রিটিশ থিংকট্যাংক ‘BASIC’-এর পরমাণু বিশেষজ্ঞ ড. ডেভ কুলেন জানান, সেন্ট্রিফিউজে ব্যবহৃত ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লোরাইড গ্যাস (ইউএফ-৬) কঠিন ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ। কারণ, এটা সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে।

তবে কতটা বিপদ হবে, তা নির্ভর করে সাইটে কত পরিমাণ ইউএফ-৬ আছে, তা বিস্ফোরণে ছড়িয়ে পড়ে কি না, সেটা পাহাড় ভেদ করে বাইরে আসে কি না এবং বিস্ফোরণের ফলে তার রাসায়নিক গঠন বদলে যায় কি না—এসব বিষয়ের ওপর। যদি ইউরেনিয়াম ও ইউএফ-৬ গ্যাস বাইরে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে কিছু তেজস্ক্রিয় পদার্থও বাইরে আসার সম্ভাবনা থাকবে।

একই সঙ্গে হামলা হলে ফোরদো সাইট নিজেও দূষিত হয়ে পড়বে এবং আশপাশের এলাকাও আক্রান্ত হবে। তবে ইউএফ-৬ বাতাসে বেরিয়ে পড়লেও তা দ্রুত রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কম ক্ষতিকর পদার্থে পরিণত হয়ে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত