Ajker Patrika

ট্রাম্পের পরিকল্পনা কি গাজা যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: সংগৃহীত

দুই বছর আগে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের সশস্ত্র বাহিনী ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা চালায়। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয় এবং ২৫০ জনকে জিম্মি করা হয়। জবাবে ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক বিমান হামলা ও স্থল অভিযান চালিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে অঞ্চলটিকে তারা তিন ভাগে বিভক্ত করে হামাসের ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ধ্বংস করে দিয়েছে।

২০২৪ সালের মাঝামাঝি ইসরায়েল উত্তর গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়, কিন্তু যুদ্ধের তীব্রতা কমেনি। চলতি বছর তথা ২০২৫ সালের জানুয়ারি-মার্চে ৪২ দিনের যুদ্ধবিরতি ব্যর্থ হয়। তবে দুই পক্ষই জিম্মি বিনিময় ও যুদ্ধবিরতির শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়।

ইসরায়েল একই সময়ে হামাসের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে টার্গেট হামলার কৌশল নেয়। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে তেহরানে নিহত হন হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া, অক্টোবর মাসে খুন হন ইয়াহিয়া সিনওয়ার, আর ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে নিহত হন সংগঠনের দুজন শীর্ষ সামরিক কমান্ডার। একই সময়ে ইসরায়েল ইরানের ভেতরে ‘ডেজ অব এটোনমেন্ট’ নামের একটি অভিযানে ১০০ টিরও বেশি স্থাপনায় হামলা চালায় ইসরায়েল। এসব স্থাপনার মধ্যে ছিল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্র ও সামরিক ঘাঁটিও।

এদিকে গাজায় মানবিক বিপর্যয় ভয়াবহ রূপ নেয়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে—এর মধ্যে ১৮ হাজার ৫০০ শিশু ও ৯ হাজার ৭০০ নারী। আর মোট হতাহতের ৭০-৭৫ শতাংশই সাধারণ নাগরিক। গত আগস্টে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েছে, গাজায় প্রথমবারের মতো পূর্ণমাত্রার দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। পাঁচ লাখের বেশি মানুষ তীব্র খাদ্যসংকটে ভুগছে এবং ১১ লাখেরও বেশি মানুষ খাদ্যসংকটের কিনারায় রয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব একে ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক ব্যর্থতা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতারের মধ্যস্থতায় বহুবার আলোচনা হলেও পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে প্রতিবারই তা ভেঙে পড়ে। তবে ২০২৫ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০ তম অধিবেশনে এক নাটকীয় মোড় আসে। মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, বেলজিয়ামসহ একাধিক পশ্চিমা দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়।

এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উপস্থাপন করেন নতুন ‘গাজা শান্তি পরিকল্পনা’। এতে অংশ নেয় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, মিসর, জর্ডান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হামাস জীবিত সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে এবং নিহতদের দেহ ফেরত দেবে। বিনিময়ে ইসরায়েল মুক্তি দেবে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে, যার মধ্যে ২৫০ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত।

এ ছাড়া ২০০৭ সাল থেকে গাজায় হামাসের প্রশাসন বিলুপ্ত করে সেখানে গঠন করা হবে অরাজনৈতিক ও প্রযুক্তিনির্ভর ফিলিস্তিনি প্রশাসন। এই অন্তর্বর্তীকালীন সময় পর্যবেক্ষণ করবে ‘পিস কাউন্সিল’, যার নেতৃত্বে থাকবেন ট্রাম্প এবং উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন টনি ব্লেয়ার। অস্ত্র সমর্পণকারীদের জন্য থাকবে সাধারণ ক্ষমা এবং যারা গাজা ছাড়তে চাইবে তাদের নিরাপদ পথ দেওয়া হবে। এরপর ইসরায়েলি বাহিনী ধীরে ধীরে গাজা থেকে সরে যাবে এবং আরব-ইসলামিক দেশগুলোর একটি যৌথ বাহিনী সেখানে নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক দায়িত্ব নেবে।

হামাস অবশ্য ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, তারা পরিকল্পনার মূল শর্তগুলো বাস্তবায়নে রাজি—যেমন জিম্মিদের মুক্তি ও প্রশাসন হস্তান্তর। তবে তারা নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে নীরব রয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু প্রথম ধাপ বাস্তবায়নে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে ইসরায়েলি ডানপন্থীরা ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাটিকে ‘ভুল’ ও ‘ঐতিহাসিক সুযোগ নষ্ট বলে সমালোচনা করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের পরিকল্পনার শক্তি হলো—এটি ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর শর্ত আরোপ করেছে এবং আরব দেশগুলোকে গাজা পুনর্গঠনে যুক্ত করেছে। তবে দুর্বলতাও কম নয়; হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং নতুন প্রশাসনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবু এত রক্তপাতের পর, এই পরিকল্পনাই হতে পারে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার মানুষের জন্য বহুল প্রত্যাশিত শান্তির প্রথম আলোকরেখা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত