Ajker Patrika

পুতিন-বাইডেনের যুদ্ধের আশ, তোমার-আমার প্রাপ্তি বাঁশ

গোলাম ওয়াদুদ
আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২২: ৫৮
পুতিন-বাইডেনের যুদ্ধের আশ, তোমার-আমার প্রাপ্তি বাঁশ

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়ে তা কার্যকর করাও শুরু করে দিয়েছেন। ঠিক যখনই আলোচনার টেবিলে বসার জন্য সব পক্ষ চেয়ার খোঁজা শুরু করে দিয়েছে, তখনই পুতিন ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু এই যুদ্ধ কি শুধুই অস্ত্রের ঝনঝনানি? পুরো বিশ্ববাসী এতে ভুগবে কোন প্রক্রিয়ায়? 

নিরুপায় হয়ে ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের অনুমোদন দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। করোনা মহামারিতে যখন পুরো বিশ্ব বিপর্যস্ত, তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি আরও টালমাটাল হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়েছে। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিউইয়র্ক মার্কেন্টাইল এক্সচেঞ্জে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি বেড়ে ৯৮ ডলার এবং ইন্টারন্যাশনাল এক্সচেঞ্জ ইউরোপে প্রায় ১০৪ ডলার হয়েছে। এই দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে বিশ্বের সবগুলো শেয়ারবাজারে দরপতন শুরু হয়েছে। এটি কত দূর যায়, তা এখনো অনিশ্চিত।

ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের ঘোষণা দিয়ে পুতিন বলেছেন, ইউক্রেন থেকে আসা হুমকির প্রতিক্রিয়ায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে ইউক্রেন দখল করার কোনো ইচ্ছা রাশিয়ার নেই। এই রক্তপাতের দায় ইউক্রেনীয় সরকারের। ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগদান থেকে বিরত রাখার জন্য রাশিয়ার দাবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা উপেক্ষা করছে বলেও অভিযোগ করেন পুতিন। 

এদিকে পুতিনের যুদ্ধের ঘোষণার পর জাতিসংঘে ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রদূত সের্গেই কিসলাইতসা নিশ্চিত করেছেন যে, তাঁর প্রেসিডেন্টও যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনইউক্রেনে হামলার কারণে রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এটি হুমকিতে আর থেমে থাকেনি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের পর বাইডেন এমনটি বলেছেন। এক বিবৃতিতে বাইডেন ইউক্রেনে রুশ হামলার নিন্দা জানান। এই হামলাকে অন্যায় বলেও আখ্যায়িত করেন তিনি। 

বিবৃতিতে বাইডেন বলেছেন, ‘জেলেনস্কি আমাকে বিশ্বের নেতাদের কাছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের স্পষ্ট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে কথা বলতে এবং ইউক্রেনের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা ইউক্রেন এবং ইউক্রেনের জনগণকে সমর্থন ও সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখব।’ 

এরই মধ্যে আক্রমণ শুরুর প্রথম এক ঘণ্টায় ইউক্রেনের ৪০ জনের বেশি সৈন্য এবং ১০ বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানি ঘটেছে। অন্যদিকে ইউক্রেন বলছে, পাল্টা প্রতিরোধে রাশিয়ার অন্তত ৫০ দখলদার সৈন্য নিহত হয়েছে। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে শুধু তাদের ক্ষতি হবে না, বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর প্রভাব পড়তে পারে। যুদ্ধে জ্বালানি এবং খাদ্যের দাম চমকপ্রদ বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ হুমকির মুখে ফেলতে পারে। 

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিএমনিতেই করোনা মহামারিতে বিশ্ব অর্থনীতি অনেকটা স্থবির। এরই মধ্যে এই যুদ্ধ বিশ্বের জন্য হতে পারে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। 

তেল, গ্যাস সরবরাহ করে বিশ্বের কারখানাগুলোকে সচল রাখে রাশিয়া। ইউরোপ তার প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৪০ শতাংশ এবং তার তেলের ২৫ শতাংশ রাশিয়া থেকে পায়। এরই মধ্যে ইউরোপীয় নেতারা রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে সরবরাহ কমানোর অভিযোগ করেছেন। 

এ ছাড়া খাদ্যের দামেও প্রভাব পড়তে পারে। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, রাশিয়া হলো বিশ্বের বৃহত্তম গম সরবরাহকারী দেশ। বিশ্বব্যাপী মোট গম রপ্তানির প্রায় এক-চতুর্থাংশ সরবরাহ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন যৌথভাবে। রাশিয়ার ওপর কিছু দেশের নির্ভরতা অনেক বেশি। শস্যের এই প্রবাহ মিসর এবং তুরস্কের মোট গম আমদানির ৭০ শতাংশেরও বেশি। এরই মধ্যে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে থাকা তুরস্কের ওপর তাই এই যুদ্ধ আরও চাপ সৃষ্টি করবে। খাদ্য, জ্বালানি এবং বিদ্যুতের দামও বাড়তে পারে। 

যথারীতি, সবচেয়ে বেশি বোঝা চাপতে যাচ্ছে দুর্বলের ওপর। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বায়ন ও উন্নয়ন বিষয়ের অধ্যাপক ইয়ান গোল্ডিন নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘গরিব মানুষ খাবার কেনা ও শরীর উষ্ণ করতে আয়ের তুলনায় বেশি ব্যয় করে।’ 

রাজধানী কিয়েভ ছাড়ছে আতংকিত মানুষইউক্রেন, দীর্ঘদিন ধরে ‘ইউরোপের খাবারের ঝুড়ি’ হিসেবে পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে তার গম এবং ভুট্টা রপ্তানির ৪০ শতাংশেরও বেশি মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকায় পাঠায়। এখানে উদ্বেগ রয়েছে যে, খাদ্যঘাটতি এবং এর ফলে খাবারের মূল্য বৃদ্ধি সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। 

উদাহরণস্বরূপ, লেবাননের কথা উল্লেখ করা যায়, যা এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। দেশটি অর্ধেকেরও বেশি গম ইউক্রেন থেকে পায়। আবার ইউক্রেন সূর্যমুখী ও সরিষা তেল রপ্তানিতেও সারা বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে।  

মহামারি থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, একটি অঞ্চলে ছোটখাটো বাধা অনেক বড় বাধার সৃষ্টি করতে পারে। ঘাটতি এবং দামের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস, গম, অ্যালুমিনিয়াম বা নিকেল সরবরাহে সমস্যা বাড়াতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, কোভিড মহামারি থেকে বিশ্ব এখনো মুক্তি পায়নি। এখনো আগের স্বাভাবিকতায় সবকিছু ফেরেনি। এখনো মহামারি থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম করছে বিশ্ব। ফলে এ ধরনের একটি আগ্রাসন দুটি প্রভাব ফেলতে পারে—অর্থনৈতিক কার্যকলাপ মন্থর করা এবং দাম বাড়ানো। 

এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল রিজার্ভ ইতিমধ্যেই ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মুখোমুখি হচ্ছে। এর মধ্যে ইউরোপে অস্থিরতা এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। 

আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং ফেলো এবং টাফ্টস ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ক্রিস্টোফার মিলার বলেছেন, ‘আমরা মুদ্রাস্ফীতির একটি নতুন বিস্ফোরণ দেখছি।’ 

এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে প্যালাডিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম ও নিকেলের মতো প্রয়োজনীয় ধাতুগুলোর সম্ভাব্য ঘাটতি। এরই মধ্যে মহামারি বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে। এখন এই যুদ্ধ এই সংকটকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যাবে সন্দেহ নেই। 

উদাহরণস্বরূপ, প্যালাডিয়ামের দাম বৃদ্ধির ফলে মোবাইল ফোন, এমনকি ডেন্টাল ফিলিংয়ের খরচ বেড়ে যাবে। এমন একটি যুদ্ধের ফলে এই ধাতুর দাম যে বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, বিশ্বের বৃহত্তম ধাতু রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া। এ ছাড়া ইস্পাত ও বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহৃত নিকেলের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। 

 এরই মধ্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ২০১৪ সালের পর সর্বোচ্চ মাত্রায় গিয়ে ঠেকেছে। এটি আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। মনে রাখা দরকার, রাশিয়া হলো বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতি ১০ ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মধ্যে প্রায় একটি আসে রাশিয়া থেকে। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশেও। এর আগে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে দেশেও এর দাম বাড়ানো হয়েছিল। এর প্রভাবে বেড়ে যায় পরিবহন ব্যয়। এটি একেবারে প্রত্যক্ষ প্রভাব হলেও এর প্রভাবে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে এবং এখনো বাড়ছে। ফলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে জ্বালানি তেলের দামে যে প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে, তাতে এই বাজার পরিস্থিতি আরও বাজে আকার ধারণ করতে পারে। রয়েছে অন্য শঙ্কাও। বিশ্বের বৃহত্তম গম সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া থেকে বাংলাদেশও গম আমদানি করে। 

এ ছাড়া বাংলাদেশের বেশ কিছু বড় প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রাশিয়া। এদিক দিয়েও বাংলাদেশের ওপর বড় প্রভাব পড়তে পারে। মূলত ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু সরাসরি যুক্ত, সেহেতু যুদ্ধক্ষেত্রে না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সামলানোসহ নানামুখী সংকটে পড়তে পারে ঢাকা। যুক্তরাষ্ট্রের যুক্ত থাকা এবং জ্বালানি তেলের অন্যতম উৎপাদক এলাকা হিসেবে সমীকরণে মধ্যপ্রাচ্য ঢুকে পড়তে পারে সংকটের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে। ফলে এই সময়ে কূটনৈতিক দক্ষতা যেমন তেমনি অভ্যন্তরীণ নানা বিষয় সামাল দিতেও বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে বাংলাদেশকে। 

কথায় বলে—রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এক অর্থে শুধু বাংলাদেশ নয় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, রাশিয়া ও চীনের মধ্যে কোনো এক বা একাধিককে বেছে নেওয়ার ক্ষমতা না রাখা প্রতিটি দেশকেই উলুখাগড়ায় পরিণত করেছে। 

তথ্যসূত্র: 
নিউইয়র্ক টাইমস,মার্কেট ওয়াচ,এক্সিওস ডটকম ,বিবিসি, লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস, সিএসআইএস ডট ওআরজি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

গাজায় শিগগির ২০ হাজার সদস্যের আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন, থাকছে কোন কোন দেশ

‘জাহানারা মুখ খুলেছে, জুনিয়ররা অ্যাবিউজ হলে কি মুখ খুলতে পারবে’

চট্টগ্রামে বিএনপি প্রার্থীর গণসংযোগে গুলিতে বাবলা নিহতের ঘটনায় দুজন গ্রেপ্তার

পোড়া কার্গো ভিলেজ থেকে মোবাইল ফোন চুরি, আনসার সদস্য বরখাস্ত

উচ্চতা ‘কম’ বলে ডেটিং অ্যাপে মামদানিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, এখন আফসোস হচ্ছে

এলাকার খবর
Loading...