Ajker Patrika

আওয়ামী লীগকে একতরফা সমর্থনের ভারতীয় নীতি বদলে যেতে পারে : ভারতীয় সাময়িকীর অভিমত

আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১: ০৯
আওয়ামী লীগকে একতরফা সমর্থনের ভারতীয় নীতি বদলে যেতে পারে : ভারতীয় সাময়িকীর অভিমত

বাংলাদেশের সরকার ও আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে ভারতের অবস্থান নিয়ে ভারতীয় সাময়িকী দ্য ডিপ্লোম্যাটে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের অবস্থান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে সেটির একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে এই নিবন্ধে। নিবন্ধটি আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন পরাগ মাঝি

বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে দেশীয় মানদণ্ডগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সে বিষয়টি দেখা গেছে। অতীতে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এক মন্ত্রী দেশটির নতুন পার্লামেন্ট ভবনের একটি ম্যুরালকে ‘অখণ্ড ভারত’ হিসেবে চিহ্ণিত করেছিলেন। পরে বাংলাদেশ সরকার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে তার ব্যাখ্যা চেয়েছিল। ওই ম্যুরাল আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। 
একইভাবে, গত ১৫ আগস্ট ভারতের ৭৭তম স্বাধীনতা দিবসে লাল কেল্লায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর ভাষণে ‘পারিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি’কে গণতন্ত্রের তিনটি অসুখের একটি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। যদিও ভারতের অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটকে লক্ষ্যবস্তু করেই তিনি এ মন্তব্য করেছিলেন।

মোদির এই মন্তব্য বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অস্বস্তির কারণ হতে পারে। অবশ্য এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। শেখ হাসিনা সরকার আগামি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচন নিয়ে একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। 
নির্বাচনকে সামনে রেখে এ বছর বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেছে। গত মার্চে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার সঙ্গে দেখা করা ছাড়াও জাতীয় পার্টির একটি প্রতিনিধি দল আগস্টের শুরুর দিকে ভারত সফর করে। এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে ভারত এবং বাংলাদেশের বিরোধী দলের মধ্যে এই ধরনের কর্মকাণ্ড প্রথম দেখা গেছে। 

বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে ভারত যদি নিয়ম রক্ষার খাতিরেও বৈঠক করে থাকে, তারপরও এটিকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের প্রতি ভারতের আচরণ থেকে একটি পরিবর্তন হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য বলেছে যে, ‘নয়াদিল্লির প্রতি বিএনপির নীতিতে কোনও স্পষ্ট পরিবর্তনের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দেখতে পাচ্ছে না ভারত।’ 

আরেকটি বিষয় হলো—গত জুলাইয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন অনুসন্ধান মিশন ভারত–বিরোধী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে একটি সংলাপ শুরু করলেও প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষেত্রে ভারতকে সংযত থাকতে দেখা গেছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এই বৈঠকের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও বিবৃতি দেয়নি।

মজার বিষয় হলো—বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্যগুলোর অনেক আঞ্চলিক পত্রিকায় জামায়াতের সঙ্গে বৈঠকের সমালোচনা করে নিবন্ধ প্রকাশ করলেও ভারতের নেতৃস্থানীয় জাতীয় গণমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। এটা অনুমান করা ভুল হবে না যে, ইইউ—জামায়াত মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে মন্তব্য না করে বরং নীরবে সয়ে যাচ্ছে ভারত! 

এসব উদাহরণগুলো ইঙ্গিত করছে যে, ভারত অতীতের মতো আওয়ামী লীগকে একতরফাভাবে সমর্থনের বদলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নে অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করছে। বিষয়টি আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য চিন্তার কারণ হতে পারে। তবে নানা বিষয় থেকে আওয়ামী লীগ হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মোদির মন্তব্যের বিষয়ে প্রশ্ন তোলাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। শেখ হাসিনা ভারতের বিরোধী দল জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখেন। ভারত সফরে গেলে কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে তিনি দেখাও করেন। 

গত ৩ আগস্ট ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন সহিংসতামুক্ত এবং যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত করতে ভারত আগ্রহ দেখিয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি মার্কিন অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো নির্বাচনের বিষয়ে বৃহত্তর ঐকমত্য তৈরির জন্য যে বৈঠক করেছে তারও প্রতিফলন রয়েছে। 

বলা যায়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের সময় ভারত যে নীতি গ্রহণ করেছিল, এবার তাতে অনেকটা পরিবর্তন আসতে পারে। সে সময় নির্বাচন নিয়ে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মনোভবে বড় পার্থক্য ছিল। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন এবং সহিংসতাসহ নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে মোদির দ্রুত অভিনন্দন জানানো বিষয়টিকে অনেকখানি হালকা করে দিয়েছিল। ফলে আওয়ামী লীগও আন্তর্জাতিক ধাক্কা থেকে বেঁচে গিয়েছিল।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, মোদি–হাসিনার বন্ধুত্বের কারণেই ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্ককে ‘সোনালী অধ্যায়’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে ভারত প্রতিবেশী দেশে এমন একটি সরকার খুঁজে পেয়েছে যা সন্ত্রাস–বিরোধী, ভারত–বিরোধী নয় এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পরিস্থিতির উন্নতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, আবার দুশ্চিন্তারও কারণ হতে পারে। সম্প্রতি ভারতের মণিপুর রাজ্যে চলমান সংঘাতের পটভূমিতে মেইতেই সম্প্রদায় বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসীদের অনুপ্রবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ পরিস্থিতিতে বলা যায়, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার ভারতকে যেসব সুবিধা দিয়েছে, তা নিরঙ্কুশ নয়। 

এই অবস্থায় এসে মনে করা হচ্ছে, ২০১৮ সালের তুলনায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের আচরণে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। বিষয়টি শেখ হাসিনা সরকারের জন্য চিন্তার কারণ হতেও পারে। তবে এটা সঠিক যে, এটা শুধু ২০২৪ সালের নির্বাচনের জন্যই নয়, এর পরবর্তী নির্বাচনগুলোর জন্যও বটে।

নিবন্ধটির লেখক অর্কপ্রভো হাজরা ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে যোগাযোগ এবং কৌশল নির্ধারণে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত