
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ২০ বছর পূর্ণ হলো আজ। শুরুতে প্ল্যাটফর্মটি যে প্রত্যাশা দেখিয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় তা কেবলই বিবর্ণ হয়েছে। বিতর্ক ছড়ানো ও অর্থ উপার্জনের চুম্বকে পরিণত হয়েছে এটি। কেবল তাই নয়, ব্যবহারকারীর ওপর প্ল্যাটফর্মটির সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
সর্বশেষ, গত ৩১ জানুয়ারি ক্ষতিকর কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু প্রচারের অভিযোগে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গকে তলব করে মার্কিন কংগ্রেস। সেখানে তাঁর প্ল্যাটফর্মে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে শিশু-কিশোরদের মৃত্যুর জন্য তাঁদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চান তিনি। তবে কোনো কিছুই তাঁর প্রতিষ্ঠান মেটার আর্থিকভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠা ঠেকাতে পারেনি। কংগ্রেসের শুনানির পরদিনই মেটার ব্যাপক মুনাফার তথ্য প্রকাশ পায় এবং তার প্রভাবে শেয়ারবাজারে কোম্পানির পুঁজি বেড়ে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারে দাঁড়ায়।
সম্পত্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেটা বিরুদ্ধে বিতর্কও বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় থাকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর (ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম) মধ্যে ফেসবুকের আসক্ত ও সমালোচকদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধছে বিগত কয়েক বছর ধরেই। তাদের দাবি, এই প্ল্যাটফর্মের কারণে তাঁরা ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তবে এই পরিবর্তন খুব একটা চোখে পড়ছে না।
বলা চলে, গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করেছিল ফেসবুক। ব্যক্তিকে গণযোগাযোগের ধারায় আরও বেশি, সহজভাবে একীভূত করেছিল প্ল্যাটফর্মটি। কিন্তু বর্তমানে ব্যক্তি ও গণের মধ্যকার বিভাজন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আগে যেখানে প্ল্যাটফর্মটিতে বন্ধুদের বিষয়বস্তুই ব্যক্তির ওয়ালে প্রদর্শিত হতো, সেখানে বর্তমানে তার জায়গা করে নিয়েছে অপরিচিত ব্যবহারকারীর ভিডিও, রিলস। যেন ফেসবুক এক হাইপার অ্যাকটিভ টিভি।
আগে যেখানে ব্যক্তির ‘পাবলিক’ পোস্টগুলো সবার কাছেই পৌঁছাত, ইদানীং সেই জায়গা অনেকটাই সংকুচিত হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সুবিধা এতটাই সংকুচিত হয়েছে যে, এখনকার পাবলিক পোস্টগুলো ইমেইলের মতো। স্রেফ হাতে গোনা মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে। মার্ক জাকারবার্গ একসময় তাঁর প্ল্যাটফর্মকে ডিজিটাল স্কয়ার বা ‘ডিজিটাল নগরচত্বর’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মানুষের হারিয়ে যাওয়া ‘নগরচত্বর’ পুনর্নির্মাণ করছেন তিনি। ২০ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, তাঁর ‘নগরচত্বর’ প্রতিশ্রুত দাবি থেকে অনেক দূরে এবং কেবল একের পর এক সমস্যা সৃষ্টি করছে।
বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ব্যক্তি কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তাঁর অভিজ্ঞতা কেমন তা ফুটে উঠে তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের মাধ্যমে। ফেসবুকের ব্যবহারকারী অন্তত ৩০০ কোটি। ব্যক্তির মোবাইলে কাটানো সময়ের অর্ধেকরও বেশি খেয়ে নিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। হিসাব অনুসারে, মানুষের কর্মঘণ্টার প্রায় এক-চতুর্থাংশই ব্যয় হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ইন্টারনেটের ব্যবহার এতটাই বেড়েছে যে, ২০২৩ সালে মানুষ যে পরিমাণ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করেছে তা ২০২০ সালের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, কোভিড মহামারির সময়ে মানুষ অলস বসে থেকেও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেছে।
ওপেন নেটওয়ার্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ‘আচরণভিত্তিক অ্যালগরিদমের’ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। চলতি বছরে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষই কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। এ কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও সক্রিয় হয়ে উঠবেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বর্তমান যে প্রবণতা, তা কোনোভাবেই প্রকৃত সামাজিক স্তরে নেই। টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্ম থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে ফেসবুকের মতো বড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও ব্যবহারকারীর পছন্দ অনুসারে ভিডিও ক্লিপ হাজির করছে তাঁর সামনে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। এটি স্পষ্ট যে, ব্যক্তির ‘আচরণগত পছন্দকে’ প্রাধান্য দিচ্ছে ফেসবুক, ‘সামাজিক সংযোগকে’ নয়। ব্যবহারকারীরাও আগের মতো সামাজিক সংযোগমূলক কনটেন্ট শেয়ার করছেন না।
ফেসবুকে ব্যবহারকারীরা আগের মতো তাদের জীবনের ঘটনা, চিন্তা নিয়মিত শেয়ার করছেন না। এক হিসাব অনুসারে, ২০২০ সালে ৪০ শতাংশ মার্কিন নাগরিক তাদের ব্যক্তিগত গল্প, মতামত, চিন্তা ফেসবুকে শেয়ার করতেন। ২০২৩ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশে। ফেসবুকের পরিবর্তে মানুষ এখন বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামের মতো ক্লোজড গ্রুপভিত্তিক ম্যাসেজিং প্ল্যাটফর্মকে বেছে নিচ্ছেন।
সব মিলিয়ে জাকারবার্গ প্রতিশ্রুত ‘ডিজিটাল নগরচত্বরের’ আশার বাতি নিভে গেছে। বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য বিবেচনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সব সময়ই একটি অস্পষ্ট প্ল্যাটফর্ম। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চরিত্র বোঝার জন্য টিকটক গবেষকদের কাছে ‘ব্ল্যাক বক্স’ হিসেবে হাজির হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সও (সাবেক টুইটার) তার কিছু কোড উন্মুক্ত করেছে। কিন্তু কোন টুইট দেখা যাবে, আর কোনটা দেখা যাবে না—তার নিয়ন্ত্রণ রেখেছে নিজের হাতেই। বিভিন্ন প্রাইভেট ম্যাসেজিং অ্যাপগুলোও এনক্রিপশন ব্যবস্থা রেখেছে।
এ ধরনের ব্যবস্থাগুলো অবশ্য স্বাগত জানাতে হবে। কারণ, রাজনৈতিক নেতাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট কমিউনিটিকে লক্ষ্য করে নির্দিষ্ট বার্তা পাঠানোর সুবিধা এটি দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে, এক্সে পোস্ট করা কোনো একটি উসকানিপূর্ণ টুইটকে। কোনো একটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ একটিমাত্র বিতর্কিত ‘টুইটের’ কারণে ভেঙে যেতে পারে।
বিপরীতে, এনক্রিপটেড ম্যাসেজিং অ্যাপগুলোতে ট্র্যাডিশনাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে প্রত্যেক ব্যবহারকারীর বার্তা সময় অনুসারে সাজানো থাকে, এনগেজমেন্ট-ম্যাক্সিমাইজিং অ্যালগরিদমে নয়। এসব ম্যাসেজিং অ্যাপে কোনো একটি বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, এখন পর্যন্ত সেরকম চেষ্টাও করা হয়নি। ফলে এ ধরনের ম্যাসেজিং অ্যাপগুলো ব্যবহারকারী মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখা দিতে পারে।
হাইপার অ্যাকটিভ সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর অর্ধেকই আচরণভিত্তিক অ্যালগরিদম দিয়ে পরিচালিত হয়। এ ধরনের প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তির পোস্ট নিজস্ব ‘কমিউনিটির’ বাইরে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে, তেমনি গণ্ডির বাইরে থেকেও কোনো ইস্যু ব্যক্তির কাছে পৌঁছাতে পারে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘নিজ শক্তিতে পরিচালিত ইকো চেম্বার’ হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ, একই ধরনের কনটেন্ট ব্যক্তির কাছে আনতে পারে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো যেহেতু কমিউনিটির বাইরের কনটেন্ট ব্যক্তির সামনে আনতে পারে, তাহলে এর পক্ষে ব্যক্তির চিন্তা, ধারণা তাঁর সম্প্রদায়ের বাইরেও পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে।
যাই হোক, নতুন দুনিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো নিজস্ব কিছু সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছে। যেমন, অধিকাংশ ম্যাসেজিং অ্যাপেই কোনো মডারেশন বা নিয়ন্ত্রণ নেই। ছোট গ্রুপের ক্ষেত্রে এটি খুবই ভালো। কিন্তু যখনই একটি গ্রুপ বড় হয়ে যায় তখনই বাড়ে বিপত্তি। ধরা যাক, ২০ হাজার সদস্যের কোনো একটি গ্রুপ আছে। সেখানে বার্তা আদান-প্রদানের চরিত্র ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি নয় বরং টিভি সম্প্রচারের মতোই। যে কেউ চাইলে এর বিষয়বস্তু ফাঁস করে দিতে পারে। ফায়দা নিতে পারে অন্যভাবেও। যেমন, ভারতের রাজনীতিকেরা মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন। কিন্তু ফেসবুকের মতো ওপেন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মে এমনটা সম্ভব না। কারণ যে কেউ চাইলে এর সত্যতা যাচাই করতে পারে।
ওপেন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মের বর্তমান আচরণভিত্তিক অ্যালগরিদমের কারণে সামাজিক যোগাযোগের জন্য মানুষ ক্লোজড গ্রুপ ম্যাসেজিং অ্যাপে ঢুকে যাচ্ছে। ব্যক্তির কম পোস্ট শেয়ারের কারণে ওপেন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মগুলো ক্রমেই কম উপকারী হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে। কোভিড মহামারির সময় ডাক্তার, বিশেষজ্ঞদের নামে ব্যাপক ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের শুরুর দিকেও ব্যাপক হারে ভুয়া গোয়েন্দা তথ্য ছড়ানো হয়েছে। এর ফলে, ওপেন নেটওয়ার্কে আর বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক হচ্ছে না, নতুন আইডিয়াও সামনে আসছে না। তারপরও এখনো কিছু মানুষ ওপেন নেটওয়ার্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা বলে যাচ্ছেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এরা মূলত কট্টর ডান বা কট্টর বাম কিংবা খুবই নীরস লোকজন।
ওপেন নেটওয়ার্কে আচরণভিত্তিক অ্যালগরিদম নির্দিষ্ট ধরনের ভিডিও ছড়িয়ে দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আগে যেটা হতো, কোনো একটি বিষয় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহারকারীদের তা শেয়ার করতে হতো। কিন্তু এখন আর তার প্রয়োজন নেই। এখন স্রেফ কোনো একজন ব্যবহারকারী নির্দিষ্ট কোনো একটি ভিডিও দেখলেই এর পর থেকে সে ধরনের ভিডিওগুলো তাঁর টাইমলাইনে আসতে থাকবে। এ ধরনের অ্যালগরিদমের কারণে মিথ্যা ছড়ানোর বিষয়টি আরও দ্রুত গতির হয়ে উঠেছে এবং রাজনৈতিক নেতাদের জন্য ফায়দা হাসিলের সুযোগ করে দিচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া সংবাদের উত্থানের চেয়েও বেশি জরুরি প্রকৃত বিষয় চিহ্নিত করা। মার্ক জাকারবার্গ একবার বলেছিলেন, তিনি ফেসবুককে ‘পারসোনালাইজড’ সংবাদপত্র হিসেবে গড়ে তুলতে চান। কিন্তু তাঁর সেই কথা কথাই রয়ে গেছে। বর্তমানে ফেসবুকের কনটেন্টের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ হলো সংবাদ, বাকি সবই বিনোদনের কনটেন্ট। ২০১৮ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ২৬ শতাংশ ব্যবহারকারী সংবাদ শেয়ার করতেন। ২০২৩ সালে সেই হার কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৯ শতাংশে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক সংবাদ শেয়ার করা প্রতিষ্ঠান ‘বাজফিড নিউজ’ করতে গিয়ে টিকতে না পেরে ২০২৩ সালে কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। এবং এটিই হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই আসল চিত্র (এবং হয়তো আমাদেরও)—যেখানে সংবাদের সেই অর্থে কোনো মূল্যই নেই। কিন্তু এখানে একটা বৈপরীত্য আছে। যেমন অধিকাংশ তরুণই সংবাদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভর করেন। কিন্তু প্ল্যাটফর্মগুলো ঠিক তার উল্টো পথে হাঁটছে। তারা মনে করছে, সংবাদ আর মজাদার কোনো কনটেন্ট নয় ব্যবহারকারীদের কাছে।
অনেকেই যুক্ত দেখান, বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেসব ত্রুটি রয়েছে তা ‘সুশাসন’ বা ভালোভাবে পরিচালনার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে বুদ্ধিদীপ্ত কোডিং ও ভিন্নধর্মী ব্যবসায় মডেল। কিন্তু নতুন যুগের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাপগুলো যে সমস্যা তৈরি করেছে তা মানবীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভারসাম্য নষ্ট করার ক্ষমতা রাখে।
মানুষ যখন কোনো প্রাইভেট গ্রুপে নিজেদের আবদ্ধ করে যোগাযোগ করছে তখন তাদের ক্ষেত্রে তদারকি থাকছে না। আবার ওপেন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মে বিশাল ডোমেইনে নিজস্ব ইকো চেম্বারের বাইরে গিয়ে মানুষ কট্টর কোনো কনটেন্টের মুখোমুখি হতে পারে। যা তার বা তাদের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। আবার যখন বিনোদনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে তখন সংবাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, মানুষের কাছে এক সময়ের সতেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ক্রমেই যেন শুকিয়ে যাচ্ছে।
দ্য ইকোনমিস্ট থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ২০ বছর পূর্ণ হলো আজ। শুরুতে প্ল্যাটফর্মটি যে প্রত্যাশা দেখিয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় তা কেবলই বিবর্ণ হয়েছে। বিতর্ক ছড়ানো ও অর্থ উপার্জনের চুম্বকে পরিণত হয়েছে এটি। কেবল তাই নয়, ব্যবহারকারীর ওপর প্ল্যাটফর্মটির সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
সর্বশেষ, গত ৩১ জানুয়ারি ক্ষতিকর কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু প্রচারের অভিযোগে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গকে তলব করে মার্কিন কংগ্রেস। সেখানে তাঁর প্ল্যাটফর্মে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে শিশু-কিশোরদের মৃত্যুর জন্য তাঁদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চান তিনি। তবে কোনো কিছুই তাঁর প্রতিষ্ঠান মেটার আর্থিকভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠা ঠেকাতে পারেনি। কংগ্রেসের শুনানির পরদিনই মেটার ব্যাপক মুনাফার তথ্য প্রকাশ পায় এবং তার প্রভাবে শেয়ারবাজারে কোম্পানির পুঁজি বেড়ে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারে দাঁড়ায়।
সম্পত্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেটা বিরুদ্ধে বিতর্কও বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় থাকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর (ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম) মধ্যে ফেসবুকের আসক্ত ও সমালোচকদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধছে বিগত কয়েক বছর ধরেই। তাদের দাবি, এই প্ল্যাটফর্মের কারণে তাঁরা ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তবে এই পরিবর্তন খুব একটা চোখে পড়ছে না।
বলা চলে, গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করেছিল ফেসবুক। ব্যক্তিকে গণযোগাযোগের ধারায় আরও বেশি, সহজভাবে একীভূত করেছিল প্ল্যাটফর্মটি। কিন্তু বর্তমানে ব্যক্তি ও গণের মধ্যকার বিভাজন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আগে যেখানে প্ল্যাটফর্মটিতে বন্ধুদের বিষয়বস্তুই ব্যক্তির ওয়ালে প্রদর্শিত হতো, সেখানে বর্তমানে তার জায়গা করে নিয়েছে অপরিচিত ব্যবহারকারীর ভিডিও, রিলস। যেন ফেসবুক এক হাইপার অ্যাকটিভ টিভি।
আগে যেখানে ব্যক্তির ‘পাবলিক’ পোস্টগুলো সবার কাছেই পৌঁছাত, ইদানীং সেই জায়গা অনেকটাই সংকুচিত হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সুবিধা এতটাই সংকুচিত হয়েছে যে, এখনকার পাবলিক পোস্টগুলো ইমেইলের মতো। স্রেফ হাতে গোনা মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে। মার্ক জাকারবার্গ একসময় তাঁর প্ল্যাটফর্মকে ডিজিটাল স্কয়ার বা ‘ডিজিটাল নগরচত্বর’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মানুষের হারিয়ে যাওয়া ‘নগরচত্বর’ পুনর্নির্মাণ করছেন তিনি। ২০ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, তাঁর ‘নগরচত্বর’ প্রতিশ্রুত দাবি থেকে অনেক দূরে এবং কেবল একের পর এক সমস্যা সৃষ্টি করছে।
বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ব্যক্তি কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তাঁর অভিজ্ঞতা কেমন তা ফুটে উঠে তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের মাধ্যমে। ফেসবুকের ব্যবহারকারী অন্তত ৩০০ কোটি। ব্যক্তির মোবাইলে কাটানো সময়ের অর্ধেকরও বেশি খেয়ে নিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। হিসাব অনুসারে, মানুষের কর্মঘণ্টার প্রায় এক-চতুর্থাংশই ব্যয় হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ইন্টারনেটের ব্যবহার এতটাই বেড়েছে যে, ২০২৩ সালে মানুষ যে পরিমাণ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করেছে তা ২০২০ সালের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, কোভিড মহামারির সময়ে মানুষ অলস বসে থেকেও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেছে।
ওপেন নেটওয়ার্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ‘আচরণভিত্তিক অ্যালগরিদমের’ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। চলতি বছরে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষই কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। এ কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও সক্রিয় হয়ে উঠবেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বর্তমান যে প্রবণতা, তা কোনোভাবেই প্রকৃত সামাজিক স্তরে নেই। টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্ম থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে ফেসবুকের মতো বড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও ব্যবহারকারীর পছন্দ অনুসারে ভিডিও ক্লিপ হাজির করছে তাঁর সামনে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। এটি স্পষ্ট যে, ব্যক্তির ‘আচরণগত পছন্দকে’ প্রাধান্য দিচ্ছে ফেসবুক, ‘সামাজিক সংযোগকে’ নয়। ব্যবহারকারীরাও আগের মতো সামাজিক সংযোগমূলক কনটেন্ট শেয়ার করছেন না।
ফেসবুকে ব্যবহারকারীরা আগের মতো তাদের জীবনের ঘটনা, চিন্তা নিয়মিত শেয়ার করছেন না। এক হিসাব অনুসারে, ২০২০ সালে ৪০ শতাংশ মার্কিন নাগরিক তাদের ব্যক্তিগত গল্প, মতামত, চিন্তা ফেসবুকে শেয়ার করতেন। ২০২৩ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশে। ফেসবুকের পরিবর্তে মানুষ এখন বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামের মতো ক্লোজড গ্রুপভিত্তিক ম্যাসেজিং প্ল্যাটফর্মকে বেছে নিচ্ছেন।
সব মিলিয়ে জাকারবার্গ প্রতিশ্রুত ‘ডিজিটাল নগরচত্বরের’ আশার বাতি নিভে গেছে। বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য বিবেচনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সব সময়ই একটি অস্পষ্ট প্ল্যাটফর্ম। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চরিত্র বোঝার জন্য টিকটক গবেষকদের কাছে ‘ব্ল্যাক বক্স’ হিসেবে হাজির হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সও (সাবেক টুইটার) তার কিছু কোড উন্মুক্ত করেছে। কিন্তু কোন টুইট দেখা যাবে, আর কোনটা দেখা যাবে না—তার নিয়ন্ত্রণ রেখেছে নিজের হাতেই। বিভিন্ন প্রাইভেট ম্যাসেজিং অ্যাপগুলোও এনক্রিপশন ব্যবস্থা রেখেছে।
এ ধরনের ব্যবস্থাগুলো অবশ্য স্বাগত জানাতে হবে। কারণ, রাজনৈতিক নেতাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট কমিউনিটিকে লক্ষ্য করে নির্দিষ্ট বার্তা পাঠানোর সুবিধা এটি দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে, এক্সে পোস্ট করা কোনো একটি উসকানিপূর্ণ টুইটকে। কোনো একটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ একটিমাত্র বিতর্কিত ‘টুইটের’ কারণে ভেঙে যেতে পারে।
বিপরীতে, এনক্রিপটেড ম্যাসেজিং অ্যাপগুলোতে ট্র্যাডিশনাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে প্রত্যেক ব্যবহারকারীর বার্তা সময় অনুসারে সাজানো থাকে, এনগেজমেন্ট-ম্যাক্সিমাইজিং অ্যালগরিদমে নয়। এসব ম্যাসেজিং অ্যাপে কোনো একটি বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, এখন পর্যন্ত সেরকম চেষ্টাও করা হয়নি। ফলে এ ধরনের ম্যাসেজিং অ্যাপগুলো ব্যবহারকারী মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখা দিতে পারে।
হাইপার অ্যাকটিভ সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর অর্ধেকই আচরণভিত্তিক অ্যালগরিদম দিয়ে পরিচালিত হয়। এ ধরনের প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তির পোস্ট নিজস্ব ‘কমিউনিটির’ বাইরে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে, তেমনি গণ্ডির বাইরে থেকেও কোনো ইস্যু ব্যক্তির কাছে পৌঁছাতে পারে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘নিজ শক্তিতে পরিচালিত ইকো চেম্বার’ হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ, একই ধরনের কনটেন্ট ব্যক্তির কাছে আনতে পারে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো যেহেতু কমিউনিটির বাইরের কনটেন্ট ব্যক্তির সামনে আনতে পারে, তাহলে এর পক্ষে ব্যক্তির চিন্তা, ধারণা তাঁর সম্প্রদায়ের বাইরেও পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে।
যাই হোক, নতুন দুনিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো নিজস্ব কিছু সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছে। যেমন, অধিকাংশ ম্যাসেজিং অ্যাপেই কোনো মডারেশন বা নিয়ন্ত্রণ নেই। ছোট গ্রুপের ক্ষেত্রে এটি খুবই ভালো। কিন্তু যখনই একটি গ্রুপ বড় হয়ে যায় তখনই বাড়ে বিপত্তি। ধরা যাক, ২০ হাজার সদস্যের কোনো একটি গ্রুপ আছে। সেখানে বার্তা আদান-প্রদানের চরিত্র ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি নয় বরং টিভি সম্প্রচারের মতোই। যে কেউ চাইলে এর বিষয়বস্তু ফাঁস করে দিতে পারে। ফায়দা নিতে পারে অন্যভাবেও। যেমন, ভারতের রাজনীতিকেরা মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন। কিন্তু ফেসবুকের মতো ওপেন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মে এমনটা সম্ভব না। কারণ যে কেউ চাইলে এর সত্যতা যাচাই করতে পারে।
ওপেন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মের বর্তমান আচরণভিত্তিক অ্যালগরিদমের কারণে সামাজিক যোগাযোগের জন্য মানুষ ক্লোজড গ্রুপ ম্যাসেজিং অ্যাপে ঢুকে যাচ্ছে। ব্যক্তির কম পোস্ট শেয়ারের কারণে ওপেন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মগুলো ক্রমেই কম উপকারী হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে। কোভিড মহামারির সময় ডাক্তার, বিশেষজ্ঞদের নামে ব্যাপক ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের শুরুর দিকেও ব্যাপক হারে ভুয়া গোয়েন্দা তথ্য ছড়ানো হয়েছে। এর ফলে, ওপেন নেটওয়ার্কে আর বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক হচ্ছে না, নতুন আইডিয়াও সামনে আসছে না। তারপরও এখনো কিছু মানুষ ওপেন নেটওয়ার্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা বলে যাচ্ছেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এরা মূলত কট্টর ডান বা কট্টর বাম কিংবা খুবই নীরস লোকজন।
ওপেন নেটওয়ার্কে আচরণভিত্তিক অ্যালগরিদম নির্দিষ্ট ধরনের ভিডিও ছড়িয়ে দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আগে যেটা হতো, কোনো একটি বিষয় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহারকারীদের তা শেয়ার করতে হতো। কিন্তু এখন আর তার প্রয়োজন নেই। এখন স্রেফ কোনো একজন ব্যবহারকারী নির্দিষ্ট কোনো একটি ভিডিও দেখলেই এর পর থেকে সে ধরনের ভিডিওগুলো তাঁর টাইমলাইনে আসতে থাকবে। এ ধরনের অ্যালগরিদমের কারণে মিথ্যা ছড়ানোর বিষয়টি আরও দ্রুত গতির হয়ে উঠেছে এবং রাজনৈতিক নেতাদের জন্য ফায়দা হাসিলের সুযোগ করে দিচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া সংবাদের উত্থানের চেয়েও বেশি জরুরি প্রকৃত বিষয় চিহ্নিত করা। মার্ক জাকারবার্গ একবার বলেছিলেন, তিনি ফেসবুককে ‘পারসোনালাইজড’ সংবাদপত্র হিসেবে গড়ে তুলতে চান। কিন্তু তাঁর সেই কথা কথাই রয়ে গেছে। বর্তমানে ফেসবুকের কনটেন্টের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ হলো সংবাদ, বাকি সবই বিনোদনের কনটেন্ট। ২০১৮ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ২৬ শতাংশ ব্যবহারকারী সংবাদ শেয়ার করতেন। ২০২৩ সালে সেই হার কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৯ শতাংশে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক সংবাদ শেয়ার করা প্রতিষ্ঠান ‘বাজফিড নিউজ’ করতে গিয়ে টিকতে না পেরে ২০২৩ সালে কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। এবং এটিই হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই আসল চিত্র (এবং হয়তো আমাদেরও)—যেখানে সংবাদের সেই অর্থে কোনো মূল্যই নেই। কিন্তু এখানে একটা বৈপরীত্য আছে। যেমন অধিকাংশ তরুণই সংবাদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভর করেন। কিন্তু প্ল্যাটফর্মগুলো ঠিক তার উল্টো পথে হাঁটছে। তারা মনে করছে, সংবাদ আর মজাদার কোনো কনটেন্ট নয় ব্যবহারকারীদের কাছে।
অনেকেই যুক্ত দেখান, বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেসব ত্রুটি রয়েছে তা ‘সুশাসন’ বা ভালোভাবে পরিচালনার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে বুদ্ধিদীপ্ত কোডিং ও ভিন্নধর্মী ব্যবসায় মডেল। কিন্তু নতুন যুগের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাপগুলো যে সমস্যা তৈরি করেছে তা মানবীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভারসাম্য নষ্ট করার ক্ষমতা রাখে।
মানুষ যখন কোনো প্রাইভেট গ্রুপে নিজেদের আবদ্ধ করে যোগাযোগ করছে তখন তাদের ক্ষেত্রে তদারকি থাকছে না। আবার ওপেন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মে বিশাল ডোমেইনে নিজস্ব ইকো চেম্বারের বাইরে গিয়ে মানুষ কট্টর কোনো কনটেন্টের মুখোমুখি হতে পারে। যা তার বা তাদের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। আবার যখন বিনোদনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে তখন সংবাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, মানুষের কাছে এক সময়ের সতেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ক্রমেই যেন শুকিয়ে যাচ্ছে।
দ্য ইকোনমিস্ট থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ২০ বছর পূর্ণ হলো আজ। শুরুতে প্ল্যাটফর্মটি যে প্রত্যাশা দেখিয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় তা কেবলই বিবর্ণ হয়েছে। বিতর্ক ছড়ানো ও অর্থ উপার্জনের চুম্বকে পরিণত হয়েছে এটি। কেবল তাই নয়, ব্যবহারকারীর ওপর প্ল্যাটফর্মটির সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
সর্বশেষ, গত ৩১ জানুয়ারি ক্ষতিকর কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু প্রচারের অভিযোগে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গকে তলব করে মার্কিন কংগ্রেস। সেখানে তাঁর প্ল্যাটফর্মে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে শিশু-কিশোরদের মৃত্যুর জন্য তাঁদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চান তিনি। তবে কোনো কিছুই তাঁর প্রতিষ্ঠান মেটার আর্থিকভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠা ঠেকাতে পারেনি। কংগ্রেসের শুনানির পরদিনই মেটার ব্যাপক মুনাফার তথ্য প্রকাশ পায় এবং তার প্রভাবে শেয়ারবাজারে কোম্পানির পুঁজি বেড়ে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারে দাঁড়ায়।
সম্পত্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেটা বিরুদ্ধে বিতর্কও বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় থাকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর (ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম) মধ্যে ফেসবুকের আসক্ত ও সমালোচকদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধছে বিগত কয়েক বছর ধরেই। তাদের দাবি, এই প্ল্যাটফর্মের কারণে তাঁরা ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তবে এই পরিবর্তন খুব একটা চোখে পড়ছে না।
বলা চলে, গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করেছিল ফেসবুক। ব্যক্তিকে গণযোগাযোগের ধারায় আরও বেশি, সহজভাবে একীভূত করেছিল প্ল্যাটফর্মটি। কিন্তু বর্তমানে ব্যক্তি ও গণের মধ্যকার বিভাজন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আগে যেখানে প্ল্যাটফর্মটিতে বন্ধুদের বিষয়বস্তুই ব্যক্তির ওয়ালে প্রদর্শিত হতো, সেখানে বর্তমানে তার জায়গা করে নিয়েছে অপরিচিত ব্যবহারকারীর ভিডিও, রিলস। যেন ফেসবুক এক হাইপার অ্যাকটিভ টিভি।
আগে যেখানে ব্যক্তির ‘পাবলিক’ পোস্টগুলো সবার কাছেই পৌঁছাত, ইদানীং সেই জায়গা অনেকটাই সংকুচিত হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সুবিধা এতটাই সংকুচিত হয়েছে যে, এখনকার পাবলিক পোস্টগুলো ইমেইলের মতো। স্রেফ হাতে গোনা মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে। মার্ক জাকারবার্গ একসময় তাঁর প্ল্যাটফর্মকে ডিজিটাল স্কয়ার বা ‘ডিজিটাল নগরচত্বর’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মানুষের হারিয়ে যাওয়া ‘নগরচত্বর’ পুনর্নির্মাণ করছেন তিনি। ২০ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, তাঁর ‘নগরচত্বর’ প্রতিশ্রুত দাবি থেকে অনেক দূরে এবং কেবল একের পর এক সমস্যা সৃষ্টি করছে।
বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ব্যক্তি কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তাঁর অভিজ্ঞতা কেমন তা ফুটে উঠে তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের মাধ্যমে। ফেসবুকের ব্যবহারকারী অন্তত ৩০০ কোটি। ব্যক্তির মোবাইলে কাটানো সময়ের অর্ধেকরও বেশি খেয়ে নিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। হিসাব অনুসারে, মানুষের কর্মঘণ্টার প্রায় এক-চতুর্থাংশই ব্যয় হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ইন্টারনেটের ব্যবহার এতটাই বেড়েছে যে, ২০২৩ সালে মানুষ যে পরিমাণ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করেছে তা ২০২০ সালের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, কোভিড মহামারির সময়ে মানুষ অলস বসে থেকেও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেছে।
ওপেন নেটওয়ার্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ‘আচরণভিত্তিক অ্যালগরিদমের’ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। চলতি বছরে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষই কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। এ কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও সক্রিয় হয়ে উঠবেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বর্তমান যে প্রবণতা, তা কোনোভাবেই প্রকৃত সামাজিক স্তরে নেই। টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্ম থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে ফেসবুকের মতো বড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও ব্যবহারকারীর পছন্দ অনুসারে ভিডিও ক্লিপ হাজির করছে তাঁর সামনে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। এটি স্পষ্ট যে, ব্যক্তির ‘আচরণগত পছন্দকে’ প্রাধান্য দিচ্ছে ফেসবুক, ‘সামাজিক সংযোগকে’ নয়। ব্যবহারকারীরাও আগের মতো সামাজিক সংযোগমূলক কনটেন্ট শেয়ার করছেন না।
ফেসবুকে ব্যবহারকারীরা আগের মতো তাদের জীবনের ঘটনা, চিন্তা নিয়মিত শেয়ার করছেন না। এক হিসাব অনুসারে, ২০২০ সালে ৪০ শতাংশ মার্কিন নাগরিক তাদের ব্যক্তিগত গল্প, মতামত, চিন্তা ফেসবুকে শেয়ার করতেন। ২০২৩ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশে। ফেসবুকের পরিবর্তে মানুষ এখন বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামের মতো ক্লোজড গ্রুপভিত্তিক ম্যাসেজিং প্ল্যাটফর্মকে বেছে নিচ্ছেন।
সব মিলিয়ে জাকারবার্গ প্রতিশ্রুত ‘ডিজিটাল নগরচত্বরের’ আশার বাতি নিভে গেছে। বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য বিবেচনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সব সময়ই একটি অস্পষ্ট প্ল্যাটফর্ম। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চরিত্র বোঝার জন্য টিকটক গবেষকদের কাছে ‘ব্ল্যাক বক্স’ হিসেবে হাজির হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সও (সাবেক টুইটার) তার কিছু কোড উন্মুক্ত করেছে। কিন্তু কোন টুইট দেখা যাবে, আর কোনটা দেখা যাবে না—তার নিয়ন্ত্রণ রেখেছে নিজের হাতেই। বিভিন্ন প্রাইভেট ম্যাসেজিং অ্যাপগুলোও এনক্রিপশন ব্যবস্থা রেখেছে।
এ ধরনের ব্যবস্থাগুলো অবশ্য স্বাগত জানাতে হবে। কারণ, রাজনৈতিক নেতাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট কমিউনিটিকে লক্ষ্য করে নির্দিষ্ট বার্তা পাঠানোর সুবিধা এটি দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে, এক্সে পোস্ট করা কোনো একটি উসকানিপূর্ণ টুইটকে। কোনো একটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ একটিমাত্র বিতর্কিত ‘টুইটের’ কারণে ভেঙে যেতে পারে।
বিপরীতে, এনক্রিপটেড ম্যাসেজিং অ্যাপগুলোতে ট্র্যাডিশনাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে প্রত্যেক ব্যবহারকারীর বার্তা সময় অনুসারে সাজানো থাকে, এনগেজমেন্ট-ম্যাক্সিমাইজিং অ্যালগরিদমে নয়। এসব ম্যাসেজিং অ্যাপে কোনো একটি বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, এখন পর্যন্ত সেরকম চেষ্টাও করা হয়নি। ফলে এ ধরনের ম্যাসেজিং অ্যাপগুলো ব্যবহারকারী মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখা দিতে পারে।
হাইপার অ্যাকটিভ সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর অর্ধেকই আচরণভিত্তিক অ্যালগরিদম দিয়ে পরিচালিত হয়। এ ধরনের প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তির পোস্ট নিজস্ব ‘কমিউনিটির’ বাইরে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে, তেমনি গণ্ডির বাইরে থেকেও কোনো ইস্যু ব্যক্তির কাছে পৌঁছাতে পারে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘নিজ শক্তিতে পরিচালিত ইকো চেম্বার’ হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ, একই ধরনের কনটেন্ট ব্যক্তির কাছে আনতে পারে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো যেহেতু কমিউনিটির বাইরের কনটেন্ট ব্যক্তির সামনে আনতে পারে, তাহলে এর পক্ষে ব্যক্তির চিন্তা, ধারণা তাঁর সম্প্রদায়ের বাইরেও পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে।
যাই হোক, নতুন দুনিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো নিজস্ব কিছু সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছে। যেমন, অধিকাংশ ম্যাসেজিং অ্যাপেই কোনো মডারেশন বা নিয়ন্ত্রণ নেই। ছোট গ্রুপের ক্ষেত্রে এটি খুবই ভালো। কিন্তু যখনই একটি গ্রুপ বড় হয়ে যায় তখনই বাড়ে বিপত্তি। ধরা যাক, ২০ হাজার সদস্যের কোনো একটি গ্রুপ আছে। সেখানে বার্তা আদান-প্রদানের চরিত্র ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি নয় বরং টিভি সম্প্রচারের মতোই। যে কেউ চাইলে এর বিষয়বস্তু ফাঁস করে দিতে পারে। ফায়দা নিতে পারে অন্যভাবেও। যেমন, ভারতের রাজনীতিকেরা মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন। কিন্তু ফেসবুকের মতো ওপেন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মে এমনটা সম্ভব না। কারণ যে কেউ চাইলে এর সত্যতা যাচাই করতে পারে।
ওপেন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মের বর্তমান আচরণভিত্তিক অ্যালগরিদমের কারণে সামাজিক যোগাযোগের জন্য মানুষ ক্লোজড গ্রুপ ম্যাসেজিং অ্যাপে ঢুকে যাচ্ছে। ব্যক্তির কম পোস্ট শেয়ারের কারণে ওপেন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মগুলো ক্রমেই কম উপকারী হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে। কোভিড মহামারির সময় ডাক্তার, বিশেষজ্ঞদের নামে ব্যাপক ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের শুরুর দিকেও ব্যাপক হারে ভুয়া গোয়েন্দা তথ্য ছড়ানো হয়েছে। এর ফলে, ওপেন নেটওয়ার্কে আর বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক হচ্ছে না, নতুন আইডিয়াও সামনে আসছে না। তারপরও এখনো কিছু মানুষ ওপেন নেটওয়ার্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা বলে যাচ্ছেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এরা মূলত কট্টর ডান বা কট্টর বাম কিংবা খুবই নীরস লোকজন।
ওপেন নেটওয়ার্কে আচরণভিত্তিক অ্যালগরিদম নির্দিষ্ট ধরনের ভিডিও ছড়িয়ে দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আগে যেটা হতো, কোনো একটি বিষয় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহারকারীদের তা শেয়ার করতে হতো। কিন্তু এখন আর তার প্রয়োজন নেই। এখন স্রেফ কোনো একজন ব্যবহারকারী নির্দিষ্ট কোনো একটি ভিডিও দেখলেই এর পর থেকে সে ধরনের ভিডিওগুলো তাঁর টাইমলাইনে আসতে থাকবে। এ ধরনের অ্যালগরিদমের কারণে মিথ্যা ছড়ানোর বিষয়টি আরও দ্রুত গতির হয়ে উঠেছে এবং রাজনৈতিক নেতাদের জন্য ফায়দা হাসিলের সুযোগ করে দিচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া সংবাদের উত্থানের চেয়েও বেশি জরুরি প্রকৃত বিষয় চিহ্নিত করা। মার্ক জাকারবার্গ একবার বলেছিলেন, তিনি ফেসবুককে ‘পারসোনালাইজড’ সংবাদপত্র হিসেবে গড়ে তুলতে চান। কিন্তু তাঁর সেই কথা কথাই রয়ে গেছে। বর্তমানে ফেসবুকের কনটেন্টের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ হলো সংবাদ, বাকি সবই বিনোদনের কনটেন্ট। ২০১৮ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ২৬ শতাংশ ব্যবহারকারী সংবাদ শেয়ার করতেন। ২০২৩ সালে সেই হার কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৯ শতাংশে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক সংবাদ শেয়ার করা প্রতিষ্ঠান ‘বাজফিড নিউজ’ করতে গিয়ে টিকতে না পেরে ২০২৩ সালে কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। এবং এটিই হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই আসল চিত্র (এবং হয়তো আমাদেরও)—যেখানে সংবাদের সেই অর্থে কোনো মূল্যই নেই। কিন্তু এখানে একটা বৈপরীত্য আছে। যেমন অধিকাংশ তরুণই সংবাদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভর করেন। কিন্তু প্ল্যাটফর্মগুলো ঠিক তার উল্টো পথে হাঁটছে। তারা মনে করছে, সংবাদ আর মজাদার কোনো কনটেন্ট নয় ব্যবহারকারীদের কাছে।
অনেকেই যুক্ত দেখান, বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেসব ত্রুটি রয়েছে তা ‘সুশাসন’ বা ভালোভাবে পরিচালনার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে বুদ্ধিদীপ্ত কোডিং ও ভিন্নধর্মী ব্যবসায় মডেল। কিন্তু নতুন যুগের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাপগুলো যে সমস্যা তৈরি করেছে তা মানবীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভারসাম্য নষ্ট করার ক্ষমতা রাখে।
মানুষ যখন কোনো প্রাইভেট গ্রুপে নিজেদের আবদ্ধ করে যোগাযোগ করছে তখন তাদের ক্ষেত্রে তদারকি থাকছে না। আবার ওপেন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মে বিশাল ডোমেইনে নিজস্ব ইকো চেম্বারের বাইরে গিয়ে মানুষ কট্টর কোনো কনটেন্টের মুখোমুখি হতে পারে। যা তার বা তাদের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। আবার যখন বিনোদনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে তখন সংবাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, মানুষের কাছে এক সময়ের সতেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ক্রমেই যেন শুকিয়ে যাচ্ছে।
দ্য ইকোনমিস্ট থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ২০ বছর পূর্ণ হলো আজ। শুরুতে প্ল্যাটফর্মটি যে প্রত্যাশা দেখিয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় তা কেবলই বিবর্ণ হয়েছে। বিতর্ক ছড়ানো ও অর্থ উপার্জনের চুম্বকে পরিণত হয়েছে এটি। কেবল তাই নয়, ব্যবহারকারীর ওপর প্ল্যাটফর্মটির সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
সর্বশেষ, গত ৩১ জানুয়ারি ক্ষতিকর কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু প্রচারের অভিযোগে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গকে তলব করে মার্কিন কংগ্রেস। সেখানে তাঁর প্ল্যাটফর্মে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে শিশু-কিশোরদের মৃত্যুর জন্য তাঁদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চান তিনি। তবে কোনো কিছুই তাঁর প্রতিষ্ঠান মেটার আর্থিকভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠা ঠেকাতে পারেনি। কংগ্রেসের শুনানির পরদিনই মেটার ব্যাপক মুনাফার তথ্য প্রকাশ পায় এবং তার প্রভাবে শেয়ারবাজারে কোম্পানির পুঁজি বেড়ে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারে দাঁড়ায়।
সম্পত্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেটা বিরুদ্ধে বিতর্কও বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় থাকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর (ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম) মধ্যে ফেসবুকের আসক্ত ও সমালোচকদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধছে বিগত কয়েক বছর ধরেই। তাদের দাবি, এই প্ল্যাটফর্মের কারণে তাঁরা ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তবে এই পরিবর্তন খুব একটা চোখে পড়ছে না।
বলা চলে, গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করেছিল ফেসবুক। ব্যক্তিকে গণযোগাযোগের ধারায় আরও বেশি, সহজভাবে একীভূত করেছিল প্ল্যাটফর্মটি। কিন্তু বর্তমানে ব্যক্তি ও গণের মধ্যকার বিভাজন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আগে যেখানে প্ল্যাটফর্মটিতে বন্ধুদের বিষয়বস্তুই ব্যক্তির ওয়ালে প্রদর্শিত হতো, সেখানে বর্তমানে তার জায়গা করে নিয়েছে অপরিচিত ব্যবহারকারীর ভিডিও, রিলস। যেন ফেসবুক এক হাইপার অ্যাকটিভ টিভি।
আগে যেখানে ব্যক্তির ‘পাবলিক’ পোস্টগুলো সবার কাছেই পৌঁছাত, ইদানীং সেই জায়গা অনেকটাই সংকুচিত হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সুবিধা এতটাই সংকুচিত হয়েছে যে, এখনকার পাবলিক পোস্টগুলো ইমেইলের মতো। স্রেফ হাতে গোনা মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে। মার্ক জাকারবার্গ একসময় তাঁর প্ল্যাটফর্মকে ডিজিটাল স্কয়ার বা ‘ডিজিটাল নগরচত্বর’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মানুষের হারিয়ে যাওয়া ‘নগরচত্বর’ পুনর্নির্মাণ করছেন তিনি। ২০ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, তাঁর ‘নগরচত্বর’ প্রতিশ্রুত দাবি থেকে অনেক দূরে এবং কেবল একের পর এক সমস্যা সৃষ্টি করছে।
বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ব্যক্তি কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তাঁর অভিজ্ঞতা কেমন তা ফুটে উঠে তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের মাধ্যমে। ফেসবুকের ব্যবহারকারী অন্তত ৩০০ কোটি। ব্যক্তির মোবাইলে কাটানো সময়ের অর্ধেকরও বেশি খেয়ে নিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। হিসাব অনুসারে, মানুষের কর্মঘণ্টার প্রায় এক-চতুর্থাংশই ব্যয় হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ইন্টারনেটের ব্যবহার এতটাই বেড়েছে যে, ২০২৩ সালে মানুষ যে পরিমাণ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করেছে তা ২০২০ সালের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, কোভিড মহামারির সময়ে মানুষ অলস বসে থেকেও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেছে।
ওপেন নেটওয়ার্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ‘আচরণভিত্তিক অ্যালগরিদমের’ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। চলতি বছরে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষই কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। এ কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও সক্রিয় হয়ে উঠবেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বর্তমান যে প্রবণতা, তা কোনোভাবেই প্রকৃত সামাজিক স্তরে নেই। টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্ম থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে ফেসবুকের মতো বড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও ব্যবহারকারীর পছন্দ অনুসারে ভিডিও ক্লিপ হাজির করছে তাঁর সামনে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। এটি স্পষ্ট যে, ব্যক্তির ‘আচরণগত পছন্দকে’ প্রাধান্য দিচ্ছে ফেসবুক, ‘সামাজিক সংযোগকে’ নয়। ব্যবহারকারীরাও আগের মতো সামাজিক সংযোগমূলক কনটেন্ট শেয়ার করছেন না।
ফেসবুকে ব্যবহারকারীরা আগের মতো তাদের জীবনের ঘটনা, চিন্তা নিয়মিত শেয়ার করছেন না। এক হিসাব অনুসারে, ২০২০ সালে ৪০ শতাংশ মার্কিন নাগরিক তাদের ব্যক্তিগত গল্প, মতামত, চিন্তা ফেসবুকে শেয়ার করতেন। ২০২৩ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশে। ফেসবুকের পরিবর্তে মানুষ এখন বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামের মতো ক্লোজড গ্রুপভিত্তিক ম্যাসেজিং প্ল্যাটফর্মকে বেছে নিচ্ছেন।
সব মিলিয়ে জাকারবার্গ প্রতিশ্রুত ‘ডিজিটাল নগরচত্বরের’ আশার বাতি নিভে গেছে। বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য বিবেচনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সব সময়ই একটি অস্পষ্ট প্ল্যাটফর্ম। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চরিত্র বোঝার জন্য টিকটক গবেষকদের কাছে ‘ব্ল্যাক বক্স’ হিসেবে হাজির হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সও (সাবেক টুইটার) তার কিছু কোড উন্মুক্ত করেছে। কিন্তু কোন টুইট দেখা যাবে, আর কোনটা দেখা যাবে না—তার নিয়ন্ত্রণ রেখেছে নিজের হাতেই। বিভিন্ন প্রাইভেট ম্যাসেজিং অ্যাপগুলোও এনক্রিপশন ব্যবস্থা রেখেছে।
এ ধরনের ব্যবস্থাগুলো অবশ্য স্বাগত জানাতে হবে। কারণ, রাজনৈতিক নেতাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট কমিউনিটিকে লক্ষ্য করে নির্দিষ্ট বার্তা পাঠানোর সুবিধা এটি দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে, এক্সে পোস্ট করা কোনো একটি উসকানিপূর্ণ টুইটকে। কোনো একটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ একটিমাত্র বিতর্কিত ‘টুইটের’ কারণে ভেঙে যেতে পারে।
বিপরীতে, এনক্রিপটেড ম্যাসেজিং অ্যাপগুলোতে ট্র্যাডিশনাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে প্রত্যেক ব্যবহারকারীর বার্তা সময় অনুসারে সাজানো থাকে, এনগেজমেন্ট-ম্যাক্সিমাইজিং অ্যালগরিদমে নয়। এসব ম্যাসেজিং অ্যাপে কোনো একটি বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, এখন পর্যন্ত সেরকম চেষ্টাও করা হয়নি। ফলে এ ধরনের ম্যাসেজিং অ্যাপগুলো ব্যবহারকারী মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখা দিতে পারে।
হাইপার অ্যাকটিভ সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর অর্ধেকই আচরণভিত্তিক অ্যালগরিদম দিয়ে পরিচালিত হয়। এ ধরনের প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তির পোস্ট নিজস্ব ‘কমিউনিটির’ বাইরে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে, তেমনি গণ্ডির বাইরে থেকেও কোনো ইস্যু ব্যক্তির কাছে পৌঁছাতে পারে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘নিজ শক্তিতে পরিচালিত ইকো চেম্বার’ হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ, একই ধরনের কনটেন্ট ব্যক্তির কাছে আনতে পারে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো যেহেতু কমিউনিটির বাইরের কনটেন্ট ব্যক্তির সামনে আনতে পারে, তাহলে এর পক্ষে ব্যক্তির চিন্তা, ধারণা তাঁর সম্প্রদায়ের বাইরেও পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে।
যাই হোক, নতুন দুনিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো নিজস্ব কিছু সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছে। যেমন, অধিকাংশ ম্যাসেজিং অ্যাপেই কোনো মডারেশন বা নিয়ন্ত্রণ নেই। ছোট গ্রুপের ক্ষেত্রে এটি খুবই ভালো। কিন্তু যখনই একটি গ্রুপ বড় হয়ে যায় তখনই বাড়ে বিপত্তি। ধরা যাক, ২০ হাজার সদস্যের কোনো একটি গ্রুপ আছে। সেখানে বার্তা আদান-প্রদানের চরিত্র ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি নয় বরং টিভি সম্প্রচারের মতোই। যে কেউ চাইলে এর বিষয়বস্তু ফাঁস করে দিতে পারে। ফায়দা নিতে পারে অন্যভাবেও। যেমন, ভারতের রাজনীতিকেরা মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন। কিন্তু ফেসবুকের মতো ওপেন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মে এমনটা সম্ভব না। কারণ যে কেউ চাইলে এর সত্যতা যাচাই করতে পারে।
ওপেন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মের বর্তমান আচরণভিত্তিক অ্যালগরিদমের কারণে সামাজিক যোগাযোগের জন্য মানুষ ক্লোজড গ্রুপ ম্যাসেজিং অ্যাপে ঢুকে যাচ্ছে। ব্যক্তির কম পোস্ট শেয়ারের কারণে ওপেন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মগুলো ক্রমেই কম উপকারী হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে। কোভিড মহামারির সময় ডাক্তার, বিশেষজ্ঞদের নামে ব্যাপক ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের শুরুর দিকেও ব্যাপক হারে ভুয়া গোয়েন্দা তথ্য ছড়ানো হয়েছে। এর ফলে, ওপেন নেটওয়ার্কে আর বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক হচ্ছে না, নতুন আইডিয়াও সামনে আসছে না। তারপরও এখনো কিছু মানুষ ওপেন নেটওয়ার্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা বলে যাচ্ছেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এরা মূলত কট্টর ডান বা কট্টর বাম কিংবা খুবই নীরস লোকজন।
ওপেন নেটওয়ার্কে আচরণভিত্তিক অ্যালগরিদম নির্দিষ্ট ধরনের ভিডিও ছড়িয়ে দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আগে যেটা হতো, কোনো একটি বিষয় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহারকারীদের তা শেয়ার করতে হতো। কিন্তু এখন আর তার প্রয়োজন নেই। এখন স্রেফ কোনো একজন ব্যবহারকারী নির্দিষ্ট কোনো একটি ভিডিও দেখলেই এর পর থেকে সে ধরনের ভিডিওগুলো তাঁর টাইমলাইনে আসতে থাকবে। এ ধরনের অ্যালগরিদমের কারণে মিথ্যা ছড়ানোর বিষয়টি আরও দ্রুত গতির হয়ে উঠেছে এবং রাজনৈতিক নেতাদের জন্য ফায়দা হাসিলের সুযোগ করে দিচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া সংবাদের উত্থানের চেয়েও বেশি জরুরি প্রকৃত বিষয় চিহ্নিত করা। মার্ক জাকারবার্গ একবার বলেছিলেন, তিনি ফেসবুককে ‘পারসোনালাইজড’ সংবাদপত্র হিসেবে গড়ে তুলতে চান। কিন্তু তাঁর সেই কথা কথাই রয়ে গেছে। বর্তমানে ফেসবুকের কনটেন্টের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ হলো সংবাদ, বাকি সবই বিনোদনের কনটেন্ট। ২০১৮ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ২৬ শতাংশ ব্যবহারকারী সংবাদ শেয়ার করতেন। ২০২৩ সালে সেই হার কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৯ শতাংশে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক সংবাদ শেয়ার করা প্রতিষ্ঠান ‘বাজফিড নিউজ’ করতে গিয়ে টিকতে না পেরে ২০২৩ সালে কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। এবং এটিই হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই আসল চিত্র (এবং হয়তো আমাদেরও)—যেখানে সংবাদের সেই অর্থে কোনো মূল্যই নেই। কিন্তু এখানে একটা বৈপরীত্য আছে। যেমন অধিকাংশ তরুণই সংবাদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভর করেন। কিন্তু প্ল্যাটফর্মগুলো ঠিক তার উল্টো পথে হাঁটছে। তারা মনে করছে, সংবাদ আর মজাদার কোনো কনটেন্ট নয় ব্যবহারকারীদের কাছে।
অনেকেই যুক্ত দেখান, বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেসব ত্রুটি রয়েছে তা ‘সুশাসন’ বা ভালোভাবে পরিচালনার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে বুদ্ধিদীপ্ত কোডিং ও ভিন্নধর্মী ব্যবসায় মডেল। কিন্তু নতুন যুগের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাপগুলো যে সমস্যা তৈরি করেছে তা মানবীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভারসাম্য নষ্ট করার ক্ষমতা রাখে।
মানুষ যখন কোনো প্রাইভেট গ্রুপে নিজেদের আবদ্ধ করে যোগাযোগ করছে তখন তাদের ক্ষেত্রে তদারকি থাকছে না। আবার ওপেন নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্মে বিশাল ডোমেইনে নিজস্ব ইকো চেম্বারের বাইরে গিয়ে মানুষ কট্টর কোনো কনটেন্টের মুখোমুখি হতে পারে। যা তার বা তাদের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। আবার যখন বিনোদনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে তখন সংবাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, মানুষের কাছে এক সময়ের সতেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ক্রমেই যেন শুকিয়ে যাচ্ছে।
দ্য ইকোনমিস্ট থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

বেইজিংয়ে এ সপ্তাহে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছেন চীনের শীর্ষ নেতারা। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে উত্তাল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশটির ক্ষমতা ধরে রাখা এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু এই বৈঠকের আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচির বাইরে রয়েছে এমন দুটি প্রশ্ন, যা চীনের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করছে...
১১ ঘণ্টা আগে
বিশ্বের তিন মহাদেশে এখন এক জটিল ভূরাজনৈতিক খেলা চলছে। এ খেলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হাতে রেখেছেন সবচেয়ে শক্তিশালী কার্ড। তুলনামূলক দুর্বল অবস্থানে থেকেও খেলার মধ্যে টিকে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং চাইছেন পুরো বাজি জিততে।
২ দিন আগে
গাজায় স্থল অভিযানের শুরু থেকে ইসরায়েল জোর দিয়ে বলেছে, তারা ‘চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’। টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে অবিরাম বিমান হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সময়ও একই অবস্থান ছিল নেতানিয়াহুর সরকারের। এমনকি গত সপ্তাহে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষরের পরও একই কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে।
২ দিন আগে
ভারতে আজকাল দিন শুরু হয় দুই ধরনের সংবাদ দিয়ে: একদিকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়—পাকিস্তানবিরোধী বিতর্ক, হিন্দুদের গৌরবগাথা আর নতুন ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা; অন্যদিকে অন্ধকার এক বাস্তবতা—প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কোনো মুসলমান নিগৃহীত হচ্ছে, পিটিয়ে মারা হচ্ছে, মিথ্যা মামলায় বন্দী করা হচ্ছে, অথবা দেশদ্রোহী..
২ দিন আগেদ্য নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধ
আজকের পত্রিকা ডেস্ক

বেইজিংয়ে এ সপ্তাহে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছেন চীনের শীর্ষ নেতারা। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে উত্তাল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশটির ক্ষমতা ধরে রাখা এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু এই বৈঠকের আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচির বাইরে রয়েছে এমন দুটি প্রশ্ন, যা চীনের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করছে, অথচ কেউ উচ্চারণ করতেও সাহস পাচ্ছে না। প্রশ্নটি হলো, সি চিন পিং আর কত দিন ক্ষমতায় থাকবেন? আর তিনি না থাকলে চীনকে নেতৃত্ব দেবেন কে?
টানা ১৩ বছর ধরে চীনের ক্ষমতা সি চিন পিংয়ের হাতে। এই সময়ে তিনি এমন এক প্রভাব প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা মাও সে-তুংয়ের পর আর কেউ পারেননি। এখনো তাঁর পদত্যাগের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তবে তাঁর এই ক্ষমতা যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তবে তা রাজনৈতিক অস্থিরতার বীজ বপন করতে পারে। কারণ, সির হাতে এখনো কোনো উত্তরসূরি নেই, এমনকি নেই কাউকে মনোনীত করার স্পষ্ট সময়সূচিও।
প্রতিটি বছর পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সির অনুপস্থিতিতে চীনের ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও গভীর হচ্ছে। যদি তাঁর শারীরিক অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে নেতৃত্বে শূন্যতা দেখা দেয়, তবে নতুন নেতা কি সির কঠোর নীতিতেই অবিচল থাকবেন, নাকি কিছুটা নমনীয় পথে হাঁটবেন; এই প্রশ্ন এখনই ভাবাচ্ছে চীনের নীতিনির্ধারকদের।
সি চিন পিং আসলে সেই পরিচিত দোটানার মুখে; যা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা অনেক কর্তৃত্ববাদী নেতার ক্ষেত্রেই দেখা যায়। উত্তরসূরি মনোনয়ন মানে এক প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাকেন্দ্র তৈরি করা, যা নিজের প্রভাব দুর্বল করতে পারে। আবার উত্তরসূরি নির্ধারণে বিলম্ব করলে তার উত্তরাধিকার ও দলীয় ঐক্য দুটিই বিপদের মুখে পড়তে পারে। সির বয়স এখন ৭২, অর্থাৎ সম্ভাব্য উত্তরসূরি খুঁজতে হলে তাকাতে হবে আরও তরুণ প্রজন্মের দিকে; যাদের এখনো নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে এবং সির আস্থা অর্জন করতে হবে।
যদি শেষ পর্যন্ত সি কোনো উত্তরসূরি বেছে নেন, তবে একটি বিষয় প্রায় নিশ্চিত। আর তা হলো তাঁর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য। কারণ, সি একাধিকবার বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মূল কারণ ছিল ‘ভুল উত্তরসূরি বাছাই’। তাঁর মতে, সংস্কারপন্থী মিখাইল গর্বাচেভকে মনোনয়ন দিয়েই সোভিয়েত নেতৃত্ব নিজের অস্তিত্ব ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছিল।
গত শুক্রবারও সেই বার্তাই যেন নতুন করে উচ্চারণ করলেন সি, যখন চীনের সেনাবাহিনী ৯ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়। স্পষ্টত এটি ছিল আনুগত্যহীনতার প্রতি সির ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিরই বহিঃপ্রকাশ।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের চায়না অ্যানালাইসিস সেন্টারের ফেলো নিল থমাস বলেন, ‘সি নিশ্চয়ই উত্তরাধিকার নির্ধারণের গুরুত্ব জানেন, কিন্তু তিনিও বোঝেন যে এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যা ইঙ্গিত দিলেই নিজের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। তাঁকে ঘিরে এখনকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটগুলো হয়তো এতটাই অগ্রাধিকার পাচ্ছে যে উত্তরসূরি নির্ধারণের মতো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে।’
চীনে সি চিন পিংয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা খুবই স্পর্শকাতর এবং সেন্সরশিপের আওতাভুক্ত। শুধু হাতে গোনা কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা হয়তো জানেন, তিনি নিজে এই বিষয়ে কী ভাবছেন।
কিন্তু বিদেশি কূটনীতিক, বিশ্লেষক ও বিনিয়োগকারীরা এখন চেয়ে আছেন বেইজিংয়ের চলমান চার দিনের এই বৈঠকের দিকে। উল্লেখ্য, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এই অধিবেশন শুরু হয়েছে সোমবার থেকে, যেখানে শত শত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অংশ নিচ্ছেন।
বৈঠকটি সাধারণত বেইজিংয়ে জিংসি হোটেলে গোপনে অনুষ্ঠিত হয়। এবারও সেখানে আগামী পাঁচ বছরের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুমোদনের আশা করা হচ্ছে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও উন্নত উৎপাদনে বৈশ্বিক নেতৃত্ব অর্জনকে সি চিন পিং তাঁর প্রধান লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ নীতিকে পরাস্ত করার বিষয়ে সি ও তাঁর সহযোগীরা এখনো দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী।
গত মাসে প্রস্তাবিত পরিকল্পনাটির ওপর পার্লামেন্ট সদস্যদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘পরাশক্তিগুলোর মধ্যে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল বিষয় হলো সামগ্রিক সক্ষমতার প্রতিযোগিতা। শুধু নিজেদের অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত ও সামগ্রিক জাতীয় শক্তি দ্রুত বৃদ্ধি করেই আমরা কৌশলগত সুবিধা অর্জন করতে পারি।’
তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে, এই সপ্তাহের বৈঠকটি হতে পারত চীনের পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্বের ইঙ্গিত পাওয়ার একটি সুযোগ; যদি সি তরুণ কর্মকর্তাদের মধ্যে কাউকে আরও দৃশ্যমান ভূমিকায় আনতে চাইতেন। তবে বেশির ভাগ বিশ্লেষকের ধারণা, তিনি এখনই কোনো বড় পদক্ষেপ নেবেন না। অন্তত ২০২৭ সালে তাঁর সম্ভাব্য চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী মেয়াদ শুরু হওয়ার আগে তেমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম।
সি চিন পিং ভালোভাবেই জানেন, নেতৃত্বের উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্ব কীভাবে কমিউনিস্ট পার্টিকে নাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ, এই অভিজ্ঞতা তাঁর পারিবারিক ইতিহাসেই আছে। তাঁর বাবা, একসময়কার জ্যেষ্ঠ নেতা, মাও সে-তুংয়ের হাতে অপসারিত হয়েছিলেন। আর ১৯৮৯ সালের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের সময় স্থানীয় কর্মকর্তা হিসেবে সি প্রত্যক্ষ করেছেন, কীভাবে শীর্ষ পর্যায়ের মতবিরোধ দেশকে অস্থিরতার দিকে টেনে নিয়েছিল। সেই সময় দেং সিয়াওপিং দল থেকে সাধারণ সম্পাদক ঝাও জিয়াংকে সরিয়ে দিয়ে নতুন উত্তরসূরি হিসেবে জিয়াং জেমিনকে বেছে নেন।
চায়না স্ট্র্যাটেজিস গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ক্রিস্টোফার কে. জনসন বলেন, ‘চীনের রাজবংশীয় ইতিহাস আর সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান-পতনের পাঠে যিনি এতটা নিমগ্ন, তাঁর কাছে উত্তরাধিকার প্রশ্নটা নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সি জানেন, নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা নিয়ে ভাবা তাঁর জন্য অপরিহার্য।’
তবে আপাতত সি চিন পিং নিজেই বিশ্বাস করেন, চীনের উত্থান অব্যাহত রাখতে হলে নেতৃত্ব তাঁর হাতে থাকাটাই সবচেয়ে জরুরি। তিনি আগের নেতা হু জিনতাওয়ের স্বেচ্ছা অবসরের নজির ভেঙে দিয়েছেন। বরং ২০১৮ সালে তিনি সংবিধান পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্ট পদে দুই মেয়াদের সীমা বাতিল করেছেন। ফলে এখন তিনি অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত রাষ্ট্র, দল ও সেনাবাহিনীর শীর্ষে থাকতে পারেন।
কিন্তু সি যত বছর ক্ষমতায় থাকবেন, ততই এমন একজন উত্তরাধিকারী খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়বে, যিনি একই সঙ্গে কয়েক দশক ধরে শাসন করার মতো যথেষ্ট তরুণ হবেন এবং সির ছায়ায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার মতো পর্যাপ্ত অভিজ্ঞ।
সি তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নিয়োগ দিয়েছেন পার্টির সর্বোচ্চ ক্ষমতাকেন্দ্র; সাত সদস্যবিশিষ্ট পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটিতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাঁদের সবার বয়স এখন ৬০-এর ওপরে, ফলে তাঁরা নিজেরাই উত্তরসূরি হওয়ার পথে বার্ধক্যে পড়েছেন। সি নিজে ২০০৭ সালে ৫৪ বছর বয়সে এই কমিটিতে যোগ দিয়েছিলেন, যা তাঁকে পরবর্তী নেতা হওয়ার অন্যতম প্রধান ইঙ্গিত দিয়েছিল।
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি সান ডিয়েগোর অধ্যাপক ও চীনের অভিজাত রাজনীতি-বিশেষজ্ঞ ভিক্টর সি বলেন, ‘এমনকি ২০২৭ সালের পরবর্তী কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে উন্নীত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা কর্মকর্তারাও সির উত্তরসূরি হওয়ার জন্য বয়সে অনেকটাই এগিয়ে। অর্থাৎ, সির পরবর্তী উত্তরসূরি হওয়ার মতো তরুণ নন।’
ভিক্টর সির মতে, যদি সি আরও একটি মেয়াদ বা তারও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকেন, তবে পরবর্তী নেতা হতে পারেন ১৯৭০-এর দশকে জন্ম নেওয়া কেউ; যিনি এখন প্রাদেশিক প্রশাসনে বা কোনো কেন্দ্রীয় দপ্তরে কাজ করছেন। তাইওয়ানের ন্যাশনাল চেংচি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও কমিউনিস্ট পার্টি-বিশ্লেষক ওয়াং হসিন-হসিয়েন বলেন, ‘পার্টি ইতিমধ্যে এমন কিছু তরুণ কর্মকর্তাকে উন্নীত করছে, যাদের সঙ্গে এই প্রোফাইল মেলে।’
তবে সি তরুণ কর্মকর্তাদের নিয়েও সতর্ক। তিনি বারবার বলেছেন, কর্মকর্তাদের সামান্য দুর্বলতাও সংকটের মুহূর্তে ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। তাঁর ভাষায়, ‘একটি বাঁধে ছোট ফাটলই শেষ পর্যন্ত ভয়াবহ ধস নামাতে পারে।’
অধ্যাপক ওয়াং বলেন, ‘সি অন্যদের প্রতি অত্যন্ত অবিশ্বাসী, বিশেষ করে যেসব কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। বয়স যত বাড়ছে, সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের প্রজন্মের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ততই কমে আসছে। আর বিষয়টি ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী বছরগুলোতে পার্টির শীর্ষ পর্যায় আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। কারণ সি সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের পরীক্ষা করবেন, আবার অনেককে বাদও দেবেন। আর এর ফাঁকে তাঁর আশপাশের কর্মকর্তারা নিজেদের প্রভাব ও টিকে থাকার জন্য আরও তীব্র প্রতিযোগিতায় নামতে পারেন।
অধ্যাপক ভিক্টর সি বলেন, ‘এই পরিস্থিতি উত্তরসূরি নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে আরও খণ্ডিত করে তুলবে। কারণ সি একক কাউকে মনোনীত করতে পারবেন না। বরং একদল সম্ভাব্য উত্তরসূরিকে বেছে নিতে হবে, আর সেটি মানেই তাঁদের মধ্যে নিচু মানের ক্ষমতার লড়াই অনিবার্য।’

বেইজিংয়ে এ সপ্তাহে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছেন চীনের শীর্ষ নেতারা। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে উত্তাল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশটির ক্ষমতা ধরে রাখা এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু এই বৈঠকের আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচির বাইরে রয়েছে এমন দুটি প্রশ্ন, যা চীনের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করছে, অথচ কেউ উচ্চারণ করতেও সাহস পাচ্ছে না। প্রশ্নটি হলো, সি চিন পিং আর কত দিন ক্ষমতায় থাকবেন? আর তিনি না থাকলে চীনকে নেতৃত্ব দেবেন কে?
টানা ১৩ বছর ধরে চীনের ক্ষমতা সি চিন পিংয়ের হাতে। এই সময়ে তিনি এমন এক প্রভাব প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা মাও সে-তুংয়ের পর আর কেউ পারেননি। এখনো তাঁর পদত্যাগের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তবে তাঁর এই ক্ষমতা যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তবে তা রাজনৈতিক অস্থিরতার বীজ বপন করতে পারে। কারণ, সির হাতে এখনো কোনো উত্তরসূরি নেই, এমনকি নেই কাউকে মনোনীত করার স্পষ্ট সময়সূচিও।
প্রতিটি বছর পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সির অনুপস্থিতিতে চীনের ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও গভীর হচ্ছে। যদি তাঁর শারীরিক অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে নেতৃত্বে শূন্যতা দেখা দেয়, তবে নতুন নেতা কি সির কঠোর নীতিতেই অবিচল থাকবেন, নাকি কিছুটা নমনীয় পথে হাঁটবেন; এই প্রশ্ন এখনই ভাবাচ্ছে চীনের নীতিনির্ধারকদের।
সি চিন পিং আসলে সেই পরিচিত দোটানার মুখে; যা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা অনেক কর্তৃত্ববাদী নেতার ক্ষেত্রেই দেখা যায়। উত্তরসূরি মনোনয়ন মানে এক প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাকেন্দ্র তৈরি করা, যা নিজের প্রভাব দুর্বল করতে পারে। আবার উত্তরসূরি নির্ধারণে বিলম্ব করলে তার উত্তরাধিকার ও দলীয় ঐক্য দুটিই বিপদের মুখে পড়তে পারে। সির বয়স এখন ৭২, অর্থাৎ সম্ভাব্য উত্তরসূরি খুঁজতে হলে তাকাতে হবে আরও তরুণ প্রজন্মের দিকে; যাদের এখনো নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে এবং সির আস্থা অর্জন করতে হবে।
যদি শেষ পর্যন্ত সি কোনো উত্তরসূরি বেছে নেন, তবে একটি বিষয় প্রায় নিশ্চিত। আর তা হলো তাঁর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য। কারণ, সি একাধিকবার বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মূল কারণ ছিল ‘ভুল উত্তরসূরি বাছাই’। তাঁর মতে, সংস্কারপন্থী মিখাইল গর্বাচেভকে মনোনয়ন দিয়েই সোভিয়েত নেতৃত্ব নিজের অস্তিত্ব ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছিল।
গত শুক্রবারও সেই বার্তাই যেন নতুন করে উচ্চারণ করলেন সি, যখন চীনের সেনাবাহিনী ৯ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়। স্পষ্টত এটি ছিল আনুগত্যহীনতার প্রতি সির ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিরই বহিঃপ্রকাশ।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের চায়না অ্যানালাইসিস সেন্টারের ফেলো নিল থমাস বলেন, ‘সি নিশ্চয়ই উত্তরাধিকার নির্ধারণের গুরুত্ব জানেন, কিন্তু তিনিও বোঝেন যে এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যা ইঙ্গিত দিলেই নিজের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। তাঁকে ঘিরে এখনকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটগুলো হয়তো এতটাই অগ্রাধিকার পাচ্ছে যে উত্তরসূরি নির্ধারণের মতো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে।’
চীনে সি চিন পিংয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা খুবই স্পর্শকাতর এবং সেন্সরশিপের আওতাভুক্ত। শুধু হাতে গোনা কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা হয়তো জানেন, তিনি নিজে এই বিষয়ে কী ভাবছেন।
কিন্তু বিদেশি কূটনীতিক, বিশ্লেষক ও বিনিয়োগকারীরা এখন চেয়ে আছেন বেইজিংয়ের চলমান চার দিনের এই বৈঠকের দিকে। উল্লেখ্য, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এই অধিবেশন শুরু হয়েছে সোমবার থেকে, যেখানে শত শত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অংশ নিচ্ছেন।
বৈঠকটি সাধারণত বেইজিংয়ে জিংসি হোটেলে গোপনে অনুষ্ঠিত হয়। এবারও সেখানে আগামী পাঁচ বছরের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুমোদনের আশা করা হচ্ছে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও উন্নত উৎপাদনে বৈশ্বিক নেতৃত্ব অর্জনকে সি চিন পিং তাঁর প্রধান লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ নীতিকে পরাস্ত করার বিষয়ে সি ও তাঁর সহযোগীরা এখনো দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী।
গত মাসে প্রস্তাবিত পরিকল্পনাটির ওপর পার্লামেন্ট সদস্যদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘পরাশক্তিগুলোর মধ্যে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল বিষয় হলো সামগ্রিক সক্ষমতার প্রতিযোগিতা। শুধু নিজেদের অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত ও সামগ্রিক জাতীয় শক্তি দ্রুত বৃদ্ধি করেই আমরা কৌশলগত সুবিধা অর্জন করতে পারি।’
তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে, এই সপ্তাহের বৈঠকটি হতে পারত চীনের পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্বের ইঙ্গিত পাওয়ার একটি সুযোগ; যদি সি তরুণ কর্মকর্তাদের মধ্যে কাউকে আরও দৃশ্যমান ভূমিকায় আনতে চাইতেন। তবে বেশির ভাগ বিশ্লেষকের ধারণা, তিনি এখনই কোনো বড় পদক্ষেপ নেবেন না। অন্তত ২০২৭ সালে তাঁর সম্ভাব্য চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী মেয়াদ শুরু হওয়ার আগে তেমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম।
সি চিন পিং ভালোভাবেই জানেন, নেতৃত্বের উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্ব কীভাবে কমিউনিস্ট পার্টিকে নাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ, এই অভিজ্ঞতা তাঁর পারিবারিক ইতিহাসেই আছে। তাঁর বাবা, একসময়কার জ্যেষ্ঠ নেতা, মাও সে-তুংয়ের হাতে অপসারিত হয়েছিলেন। আর ১৯৮৯ সালের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের সময় স্থানীয় কর্মকর্তা হিসেবে সি প্রত্যক্ষ করেছেন, কীভাবে শীর্ষ পর্যায়ের মতবিরোধ দেশকে অস্থিরতার দিকে টেনে নিয়েছিল। সেই সময় দেং সিয়াওপিং দল থেকে সাধারণ সম্পাদক ঝাও জিয়াংকে সরিয়ে দিয়ে নতুন উত্তরসূরি হিসেবে জিয়াং জেমিনকে বেছে নেন।
চায়না স্ট্র্যাটেজিস গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ক্রিস্টোফার কে. জনসন বলেন, ‘চীনের রাজবংশীয় ইতিহাস আর সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান-পতনের পাঠে যিনি এতটা নিমগ্ন, তাঁর কাছে উত্তরাধিকার প্রশ্নটা নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সি জানেন, নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা নিয়ে ভাবা তাঁর জন্য অপরিহার্য।’
তবে আপাতত সি চিন পিং নিজেই বিশ্বাস করেন, চীনের উত্থান অব্যাহত রাখতে হলে নেতৃত্ব তাঁর হাতে থাকাটাই সবচেয়ে জরুরি। তিনি আগের নেতা হু জিনতাওয়ের স্বেচ্ছা অবসরের নজির ভেঙে দিয়েছেন। বরং ২০১৮ সালে তিনি সংবিধান পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্ট পদে দুই মেয়াদের সীমা বাতিল করেছেন। ফলে এখন তিনি অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত রাষ্ট্র, দল ও সেনাবাহিনীর শীর্ষে থাকতে পারেন।
কিন্তু সি যত বছর ক্ষমতায় থাকবেন, ততই এমন একজন উত্তরাধিকারী খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়বে, যিনি একই সঙ্গে কয়েক দশক ধরে শাসন করার মতো যথেষ্ট তরুণ হবেন এবং সির ছায়ায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার মতো পর্যাপ্ত অভিজ্ঞ।
সি তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নিয়োগ দিয়েছেন পার্টির সর্বোচ্চ ক্ষমতাকেন্দ্র; সাত সদস্যবিশিষ্ট পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটিতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাঁদের সবার বয়স এখন ৬০-এর ওপরে, ফলে তাঁরা নিজেরাই উত্তরসূরি হওয়ার পথে বার্ধক্যে পড়েছেন। সি নিজে ২০০৭ সালে ৫৪ বছর বয়সে এই কমিটিতে যোগ দিয়েছিলেন, যা তাঁকে পরবর্তী নেতা হওয়ার অন্যতম প্রধান ইঙ্গিত দিয়েছিল।
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি সান ডিয়েগোর অধ্যাপক ও চীনের অভিজাত রাজনীতি-বিশেষজ্ঞ ভিক্টর সি বলেন, ‘এমনকি ২০২৭ সালের পরবর্তী কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে উন্নীত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা কর্মকর্তারাও সির উত্তরসূরি হওয়ার জন্য বয়সে অনেকটাই এগিয়ে। অর্থাৎ, সির পরবর্তী উত্তরসূরি হওয়ার মতো তরুণ নন।’
ভিক্টর সির মতে, যদি সি আরও একটি মেয়াদ বা তারও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকেন, তবে পরবর্তী নেতা হতে পারেন ১৯৭০-এর দশকে জন্ম নেওয়া কেউ; যিনি এখন প্রাদেশিক প্রশাসনে বা কোনো কেন্দ্রীয় দপ্তরে কাজ করছেন। তাইওয়ানের ন্যাশনাল চেংচি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও কমিউনিস্ট পার্টি-বিশ্লেষক ওয়াং হসিন-হসিয়েন বলেন, ‘পার্টি ইতিমধ্যে এমন কিছু তরুণ কর্মকর্তাকে উন্নীত করছে, যাদের সঙ্গে এই প্রোফাইল মেলে।’
তবে সি তরুণ কর্মকর্তাদের নিয়েও সতর্ক। তিনি বারবার বলেছেন, কর্মকর্তাদের সামান্য দুর্বলতাও সংকটের মুহূর্তে ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। তাঁর ভাষায়, ‘একটি বাঁধে ছোট ফাটলই শেষ পর্যন্ত ভয়াবহ ধস নামাতে পারে।’
অধ্যাপক ওয়াং বলেন, ‘সি অন্যদের প্রতি অত্যন্ত অবিশ্বাসী, বিশেষ করে যেসব কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। বয়স যত বাড়ছে, সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের প্রজন্মের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ততই কমে আসছে। আর বিষয়টি ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী বছরগুলোতে পার্টির শীর্ষ পর্যায় আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। কারণ সি সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের পরীক্ষা করবেন, আবার অনেককে বাদও দেবেন। আর এর ফাঁকে তাঁর আশপাশের কর্মকর্তারা নিজেদের প্রভাব ও টিকে থাকার জন্য আরও তীব্র প্রতিযোগিতায় নামতে পারেন।
অধ্যাপক ভিক্টর সি বলেন, ‘এই পরিস্থিতি উত্তরসূরি নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে আরও খণ্ডিত করে তুলবে। কারণ সি একক কাউকে মনোনীত করতে পারবেন না। বরং একদল সম্ভাব্য উত্তরসূরিকে বেছে নিতে হবে, আর সেটি মানেই তাঁদের মধ্যে নিচু মানের ক্ষমতার লড়াই অনিবার্য।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ২০ বছর পূর্ণ হলো আজ। শুরুতে প্ল্যাটফর্মটি যে প্রত্যাশা দেখিয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় তা কেবলই বিবর্ণ হয়েছে। বিতর্ক ছড়ানো ও অর্থ উপার্জনের চুম্বকে পরিণত হয়েছে এটি। কেবল তাই নয়, ব্যবহারকারীর ওপর প্ল্যাটফর্মটির সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
বিশ্বের তিন মহাদেশে এখন এক জটিল ভূরাজনৈতিক খেলা চলছে। এ খেলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হাতে রেখেছেন সবচেয়ে শক্তিশালী কার্ড। তুলনামূলক দুর্বল অবস্থানে থেকেও খেলার মধ্যে টিকে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং চাইছেন পুরো বাজি জিততে।
২ দিন আগে
গাজায় স্থল অভিযানের শুরু থেকে ইসরায়েল জোর দিয়ে বলেছে, তারা ‘চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’। টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে অবিরাম বিমান হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সময়ও একই অবস্থান ছিল নেতানিয়াহুর সরকারের। এমনকি গত সপ্তাহে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষরের পরও একই কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে।
২ দিন আগে
ভারতে আজকাল দিন শুরু হয় দুই ধরনের সংবাদ দিয়ে: একদিকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়—পাকিস্তানবিরোধী বিতর্ক, হিন্দুদের গৌরবগাথা আর নতুন ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা; অন্যদিকে অন্ধকার এক বাস্তবতা—প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কোনো মুসলমান নিগৃহীত হচ্ছে, পিটিয়ে মারা হচ্ছে, মিথ্যা মামলায় বন্দী করা হচ্ছে, অথবা দেশদ্রোহী..
২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

বিশ্বের তিন মহাদেশে এখন এক জটিল ভূরাজনৈতিক খেলা চলছে। এ খেলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হাতে রেখেছেন সবচেয়ে শক্তিশালী কার্ড। তুলনামূলক দুর্বল অবস্থানে থেকেও খেলার মধ্যে টিকে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং চাইছেন পুরো বাজি জিততে। আর রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছেন সবার চালচলন।
এ খেলার মূল বাজি রুশ অপরিশোধিত তেল। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এ তেল যাচ্ছে ভারত ও চীনে। ট্রাম্প এখন সেটা বন্ধ করতে চান এবং বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে ওয়াশিংটনের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চান।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পরে থেকে তেলের বাজারে ভারত মস্কোর অন্যতম বড় ক্রেতায় পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো এড়িয়ে গেলেও ভারত সস্তা দামে রুশ তেল কিনছে—যা ঘরোয়া জ্বালানির দাম স্থিতিশীল রাখতে ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হয়েছে। বাইডেন প্রশাসন এ নিয়ে মাঝেমধ্যে সমালোচনা করলেও বৈশ্বিক জ্বালানি স্থিতিশীলতার স্বার্থে বিষয়টি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে বেশ নড়েচড়ে বসেছে। রুশ তেল কেনার অপরাধে তারা ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বেশ উত্তেজনাও চলছে। অনেকে বলছেন, এতে ট্রাম্প-মোদির বন্ধুত্ব হয়তো শেষ হয়ে গেছে।
অবশ্য ট্রাম্প দাবি করেছেন, ভারত আর রুশ তেল কিনবে না। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—ট্রাম্প কি ‘ব্লাফ’ দিচ্ছেন, না সত্যিই মোদির কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছেন যে, ভারত রুশ তেল কেনা বন্ধ করবে? ট্রাম্প দাবি করেছেন, ‘ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনছে, এটার জন্য আমি অসন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু মোদি আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন, তাঁরা আর রুশ তেল কিনবেন না। এটা বড় পদক্ষেপ। এখন আমরা চীনকেও একই কাজ করাতে যাচ্ছি।’
তবে প্রশ্ন দুটি থেকেই যায়—প্রথমত, মোদি কি সত্যিই এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন? দ্বিতীয়ত, বিশ্বের সবচেয়ে বড় রুশ তেল আমদানিকারক চীন কি যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশ মেনে চলবে?
চীন প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ব্যারেল তেল আমদানি করে, যার বড় অংশই আসে রাশিয়া থেকে। ২০২৩ সালে রাশিয়া সৌদি আরবকে ছাড়িয়ে চীনের সবচেয়ে বড় জ্বালানি সরবরাহকারী হয়। এটিই প্রমাণ করে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মস্কো-বেইজিং সম্পর্ককে আরও শক্ত করেছে। চীন ট্রাম্পের বক্তব্যকে ‘একতরফা ও অর্থনৈতিক জবরদস্তি’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে পাল্টাব্যবস্থার হুমকি দিয়েছে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল অনেকটা সতর্ক। দিল্লি জানিয়েছে, রুশ তেল আমদানি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও দামের ভারসাম্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে ট্রাম্প ও মোদির মধ্যে সত্যিই ফোনালাপ হয়েছিল কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই গেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘জ্বালানির দাম স্থিতিশীল রাখা ও সরবরাহ নিশ্চিত করাই আমাদের নীতির মূল লক্ষ্য। এ জন্য আমরা উৎস বৈচিত্র্য বজায় রেখে বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী তেল আমদানি করি।’
এই অস্পষ্ট মন্তব্যের পর অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন—ফোনালাপ আদৌ হয়েছিল কি না এবং হয়ে থাকলে মোদি সত্যিই কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কি না।
মস্কো অবশ্য স্পষ্ট জানিয়েছে, ভারত তাদের জ্বালানি নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। রুশ সরকার বলেছে, ‘ভারতের অর্থনীতির জন্য রুশ তেল অপরিহার্য। আমরা ভারত সরকারের নীতিকে সম্মান করি এবং তেল ও গ্যাস খাতে সহযোগিতা চালিয়ে যাব।’
উল্লেখ্য, একসময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ নিজেরাই চেয়েছিল ভারত রুশ তেল কিনুক, যাতে বৈশ্বিক তেলের দাম বেড়ে না যায়। ভারতে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা রুশ তেল কেনা নিষিদ্ধ করিনি, বরং মূল্যসীমা নির্ধারণে ভারতকে সহায়তা করতে বলেছিলাম। ভারত ঠিক তা-ই করেছে। এখন এই প্রশাসন বলছে, ভারত নাকি রাশিয়ার যুদ্ধ যন্ত্রে অর্থ জোগাচ্ছে। এটা একধরনের নীতিগত দ্বিচারিতা।’
পশ্চিমা বাজার হারানোর ক্ষতি পোষাতে রাশিয়া ইতিমধ্যে এশীয় ক্রেতাদের আকৃষ্ট করেছে। ভারত ও চীন এখন রাশিয়ার জন্য প্রধান বৈদেশিক মুদ্রার উৎস। একই সঙ্গে ইউরোপও রাশিয়া থেকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে।
ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক বহু পুরোনো। সেই স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মস্কো ছিল ভারতের কূটনৈতিক ও সামরিক মিত্র। এখনো প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, পারমাণবিক প্রকল্প, জ্বালানি বিনিয়োগ ও যৌথ উদ্যোগ—সব ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক অটুট।
এ দীর্ঘ সম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সত্ত্বেও ভারত সহজে রুশ তেল থেকে সরে আসবে না। তবে দিল্লির জন্য ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত বাণিজ্য ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। অনেকের মতে, ওয়াশিংটন হয়তো কৃষিপণ্য ও শুল্কে ছাড় দিয়ে ভারতকে রুশ তেল আমদানি কমানোর প্রস্তাব দেবে।
তবে বর্তমানে ভারতের রুশ তেল আমদানি কমার কোনো ইঙ্গিত নেই। সেপ্টেম্বর মাসে ভারত দৈনিক ১৬ লাখ ব্যারেল তেল কিনেছে, যা অক্টোবরে বেড়ে ১৮ লাখ ব্যারেল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব তেল পরিবহন হচ্ছে পশ্চিমাদের নজরদারির বাইরে থাকা ‘শ্যাডো ফ্লিট’ বা তেলবাহী গোপন জাহাজের মাধ্যমে।
বিশ্লেষকেরা সতর্ক করছেন, ভারত হঠাৎ রুশ তেল কেনা কমালে বিশ্ববাজারে সরবরাহ ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে, দাম পড়ে যেতে পারে এবং রাশিয়া আরও বেশি চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।
২০২২ সালে যখন রাশিয়ার কারণে বিশ্বে তেলের দাম বেড়ে যায়, তখন বাইডেন প্রশাসন ভারতকে ছাড় দিয়েছিল, যেন বিশ্বে ঘাটতি না হয়। সে সময় ক্রুড অয়েলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮০–৯০ ডলার। এখন তা নেমে এসেছে প্রায় ৬১ ডলারে, যা মার্কিন শেল তেল উৎপাদকদের জন্য উদ্বেগের কারণ।
ট্রাম্প হয়তো ভাবছেন, ভারত ও চীনকে রুশ তেল কেনা কমাতে বাধ্য করলে সরবরাহ কমে যাবে, ফলে দাম কিছুটা বাড়বে। কিন্তু তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে, এতে যেন তাঁর নিজ দেশের ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত না হন।
তবে এই ‘গেম’ অত্যন্ত সূক্ষ্ম। কারণ, বেশি চাপ দিলে দাম উল্টো বেড়ে যেতে পারে আর কম চাপ দিলে রাশিয়া বিপুল অর্থ উপার্জন চালিয়ে যাবে। যেকোনো ভুল হিসাব মার্কিন কৌশলকে দুর্বল করতে পারে বা মস্কোর অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে। তাই এ মুহূর্তে ট্রাম্পের বাজি সফল হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। আর মোদির জন্য এটি নিঃসন্দেহে সূক্ষ্ম ভারসাম্যের খেলা। তবে ভারসাম্য রক্ষা করা এত সহজ নয়। রাশিয়া থেকে সরে আসা মানে পুরোনো জোট দুর্বল করা; আবার যুক্তরাষ্ট্রকে উপেক্ষা করা মানে নতুন বাণিজ্য সম্পর্ককে ঝুঁকিতে ফেলা। তাই অর্থনৈতিক বাস্তবতা, ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব ও অনিশ্চিত মার্কিন রাজনীতির দাবার বোর্ডে মোদিকে একসঙ্গে চাল দিতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে।
টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া থেকে অনূদিত

বিশ্বের তিন মহাদেশে এখন এক জটিল ভূরাজনৈতিক খেলা চলছে। এ খেলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হাতে রেখেছেন সবচেয়ে শক্তিশালী কার্ড। তুলনামূলক দুর্বল অবস্থানে থেকেও খেলার মধ্যে টিকে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং চাইছেন পুরো বাজি জিততে। আর রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছেন সবার চালচলন।
এ খেলার মূল বাজি রুশ অপরিশোধিত তেল। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এ তেল যাচ্ছে ভারত ও চীনে। ট্রাম্প এখন সেটা বন্ধ করতে চান এবং বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে ওয়াশিংটনের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চান।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পরে থেকে তেলের বাজারে ভারত মস্কোর অন্যতম বড় ক্রেতায় পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো এড়িয়ে গেলেও ভারত সস্তা দামে রুশ তেল কিনছে—যা ঘরোয়া জ্বালানির দাম স্থিতিশীল রাখতে ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হয়েছে। বাইডেন প্রশাসন এ নিয়ে মাঝেমধ্যে সমালোচনা করলেও বৈশ্বিক জ্বালানি স্থিতিশীলতার স্বার্থে বিষয়টি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে বেশ নড়েচড়ে বসেছে। রুশ তেল কেনার অপরাধে তারা ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বেশ উত্তেজনাও চলছে। অনেকে বলছেন, এতে ট্রাম্প-মোদির বন্ধুত্ব হয়তো শেষ হয়ে গেছে।
অবশ্য ট্রাম্প দাবি করেছেন, ভারত আর রুশ তেল কিনবে না। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—ট্রাম্প কি ‘ব্লাফ’ দিচ্ছেন, না সত্যিই মোদির কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছেন যে, ভারত রুশ তেল কেনা বন্ধ করবে? ট্রাম্প দাবি করেছেন, ‘ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনছে, এটার জন্য আমি অসন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু মোদি আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন, তাঁরা আর রুশ তেল কিনবেন না। এটা বড় পদক্ষেপ। এখন আমরা চীনকেও একই কাজ করাতে যাচ্ছি।’
তবে প্রশ্ন দুটি থেকেই যায়—প্রথমত, মোদি কি সত্যিই এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন? দ্বিতীয়ত, বিশ্বের সবচেয়ে বড় রুশ তেল আমদানিকারক চীন কি যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশ মেনে চলবে?
চীন প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ব্যারেল তেল আমদানি করে, যার বড় অংশই আসে রাশিয়া থেকে। ২০২৩ সালে রাশিয়া সৌদি আরবকে ছাড়িয়ে চীনের সবচেয়ে বড় জ্বালানি সরবরাহকারী হয়। এটিই প্রমাণ করে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মস্কো-বেইজিং সম্পর্ককে আরও শক্ত করেছে। চীন ট্রাম্পের বক্তব্যকে ‘একতরফা ও অর্থনৈতিক জবরদস্তি’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে পাল্টাব্যবস্থার হুমকি দিয়েছে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল অনেকটা সতর্ক। দিল্লি জানিয়েছে, রুশ তেল আমদানি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও দামের ভারসাম্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে ট্রাম্প ও মোদির মধ্যে সত্যিই ফোনালাপ হয়েছিল কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই গেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘জ্বালানির দাম স্থিতিশীল রাখা ও সরবরাহ নিশ্চিত করাই আমাদের নীতির মূল লক্ষ্য। এ জন্য আমরা উৎস বৈচিত্র্য বজায় রেখে বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী তেল আমদানি করি।’
এই অস্পষ্ট মন্তব্যের পর অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন—ফোনালাপ আদৌ হয়েছিল কি না এবং হয়ে থাকলে মোদি সত্যিই কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কি না।
মস্কো অবশ্য স্পষ্ট জানিয়েছে, ভারত তাদের জ্বালানি নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। রুশ সরকার বলেছে, ‘ভারতের অর্থনীতির জন্য রুশ তেল অপরিহার্য। আমরা ভারত সরকারের নীতিকে সম্মান করি এবং তেল ও গ্যাস খাতে সহযোগিতা চালিয়ে যাব।’
উল্লেখ্য, একসময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ নিজেরাই চেয়েছিল ভারত রুশ তেল কিনুক, যাতে বৈশ্বিক তেলের দাম বেড়ে না যায়। ভারতে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা রুশ তেল কেনা নিষিদ্ধ করিনি, বরং মূল্যসীমা নির্ধারণে ভারতকে সহায়তা করতে বলেছিলাম। ভারত ঠিক তা-ই করেছে। এখন এই প্রশাসন বলছে, ভারত নাকি রাশিয়ার যুদ্ধ যন্ত্রে অর্থ জোগাচ্ছে। এটা একধরনের নীতিগত দ্বিচারিতা।’
পশ্চিমা বাজার হারানোর ক্ষতি পোষাতে রাশিয়া ইতিমধ্যে এশীয় ক্রেতাদের আকৃষ্ট করেছে। ভারত ও চীন এখন রাশিয়ার জন্য প্রধান বৈদেশিক মুদ্রার উৎস। একই সঙ্গে ইউরোপও রাশিয়া থেকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে।
ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক বহু পুরোনো। সেই স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মস্কো ছিল ভারতের কূটনৈতিক ও সামরিক মিত্র। এখনো প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, পারমাণবিক প্রকল্প, জ্বালানি বিনিয়োগ ও যৌথ উদ্যোগ—সব ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক অটুট।
এ দীর্ঘ সম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সত্ত্বেও ভারত সহজে রুশ তেল থেকে সরে আসবে না। তবে দিল্লির জন্য ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত বাণিজ্য ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। অনেকের মতে, ওয়াশিংটন হয়তো কৃষিপণ্য ও শুল্কে ছাড় দিয়ে ভারতকে রুশ তেল আমদানি কমানোর প্রস্তাব দেবে।
তবে বর্তমানে ভারতের রুশ তেল আমদানি কমার কোনো ইঙ্গিত নেই। সেপ্টেম্বর মাসে ভারত দৈনিক ১৬ লাখ ব্যারেল তেল কিনেছে, যা অক্টোবরে বেড়ে ১৮ লাখ ব্যারেল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব তেল পরিবহন হচ্ছে পশ্চিমাদের নজরদারির বাইরে থাকা ‘শ্যাডো ফ্লিট’ বা তেলবাহী গোপন জাহাজের মাধ্যমে।
বিশ্লেষকেরা সতর্ক করছেন, ভারত হঠাৎ রুশ তেল কেনা কমালে বিশ্ববাজারে সরবরাহ ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে, দাম পড়ে যেতে পারে এবং রাশিয়া আরও বেশি চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।
২০২২ সালে যখন রাশিয়ার কারণে বিশ্বে তেলের দাম বেড়ে যায়, তখন বাইডেন প্রশাসন ভারতকে ছাড় দিয়েছিল, যেন বিশ্বে ঘাটতি না হয়। সে সময় ক্রুড অয়েলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮০–৯০ ডলার। এখন তা নেমে এসেছে প্রায় ৬১ ডলারে, যা মার্কিন শেল তেল উৎপাদকদের জন্য উদ্বেগের কারণ।
ট্রাম্প হয়তো ভাবছেন, ভারত ও চীনকে রুশ তেল কেনা কমাতে বাধ্য করলে সরবরাহ কমে যাবে, ফলে দাম কিছুটা বাড়বে। কিন্তু তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে, এতে যেন তাঁর নিজ দেশের ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত না হন।
তবে এই ‘গেম’ অত্যন্ত সূক্ষ্ম। কারণ, বেশি চাপ দিলে দাম উল্টো বেড়ে যেতে পারে আর কম চাপ দিলে রাশিয়া বিপুল অর্থ উপার্জন চালিয়ে যাবে। যেকোনো ভুল হিসাব মার্কিন কৌশলকে দুর্বল করতে পারে বা মস্কোর অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে। তাই এ মুহূর্তে ট্রাম্পের বাজি সফল হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। আর মোদির জন্য এটি নিঃসন্দেহে সূক্ষ্ম ভারসাম্যের খেলা। তবে ভারসাম্য রক্ষা করা এত সহজ নয়। রাশিয়া থেকে সরে আসা মানে পুরোনো জোট দুর্বল করা; আবার যুক্তরাষ্ট্রকে উপেক্ষা করা মানে নতুন বাণিজ্য সম্পর্ককে ঝুঁকিতে ফেলা। তাই অর্থনৈতিক বাস্তবতা, ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব ও অনিশ্চিত মার্কিন রাজনীতির দাবার বোর্ডে মোদিকে একসঙ্গে চাল দিতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে।
টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া থেকে অনূদিত

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ২০ বছর পূর্ণ হলো আজ। শুরুতে প্ল্যাটফর্মটি যে প্রত্যাশা দেখিয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় তা কেবলই বিবর্ণ হয়েছে। বিতর্ক ছড়ানো ও অর্থ উপার্জনের চুম্বকে পরিণত হয়েছে এটি। কেবল তাই নয়, ব্যবহারকারীর ওপর প্ল্যাটফর্মটির সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
বেইজিংয়ে এ সপ্তাহে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছেন চীনের শীর্ষ নেতারা। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে উত্তাল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশটির ক্ষমতা ধরে রাখা এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু এই বৈঠকের আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচির বাইরে রয়েছে এমন দুটি প্রশ্ন, যা চীনের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করছে...
১১ ঘণ্টা আগে
গাজায় স্থল অভিযানের শুরু থেকে ইসরায়েল জোর দিয়ে বলেছে, তারা ‘চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’। টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে অবিরাম বিমান হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সময়ও একই অবস্থান ছিল নেতানিয়াহুর সরকারের। এমনকি গত সপ্তাহে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষরের পরও একই কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে।
২ দিন আগে
ভারতে আজকাল দিন শুরু হয় দুই ধরনের সংবাদ দিয়ে: একদিকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়—পাকিস্তানবিরোধী বিতর্ক, হিন্দুদের গৌরবগাথা আর নতুন ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা; অন্যদিকে অন্ধকার এক বাস্তবতা—প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কোনো মুসলমান নিগৃহীত হচ্ছে, পিটিয়ে মারা হচ্ছে, মিথ্যা মামলায় বন্দী করা হচ্ছে, অথবা দেশদ্রোহী..
২ দিন আগেদ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের নিবন্ধ
আজকের পত্রিকা ডেস্ক

গাজায় স্থল অভিযানের শুরু থেকে ইসরায়েল জোর দিয়ে বলেছে, তারা ‘চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’। টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে অবিরাম বিমান হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সময়ও একই অবস্থান ছিল নেতানিয়াহুর সরকারের। এমনকি গত সপ্তাহে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষরের পরও একই কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখাচ্ছে। গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে আনুমানিক ১৫ হাজার হামাস যোদ্ধা আবারও সংগঠিত হয়ে উঠে এসেছে। তাদের অনেকে পূর্ণ সশস্ত্র এবং এরই মধ্যে গাজায় প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করেছে। গাজা থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদন বলছে, তারা সন্দেহভাজন সহযোগীদের খুঁজে বের করে প্রকাশ্যে হত্যা করছে। অর্থাৎ হামাস ধ্বংস হয়নি, রক্তাক্ত ও বিভক্ত হলেও সংগঠনটি টিকে গেছে।
এ ফলাফল আসলে অপ্রত্যাশিত নয়। বিশ্বের সব প্রভাবশালী সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষজ্ঞ বহু আগে সতর্ক করেছিলেন, হামাসকে কেবল সামরিক শক্তি দিয়ে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। হামাস শুধু একটি সশস্ত্র নেটওয়ার্ক বা সুড়ঙ্গ ব্যবস্থা নয়, এটি ফিলিস্তিনি সমাজের গভীরে শিকড় গেড়ে বসা একটি রাজনৈতিক ও আদর্শিক আন্দোলন। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্র আল-কায়েদা বা ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ক্ষেত্রে দেখেছে, নেতা হত্যা করা যায়, অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়, এলাকা দখল করা যায়, কিন্তু কোনো আদর্শকে বোমা মেরে ধ্বংস করা যায় না।
ইসরায়েলের ঘোষিত ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ শুরু থেকে ছিল এক মরীচিকা। হামাসের নেতৃত্বকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সংগঠনটি এখনো স্থানীয় সেল ও মিলিশিয়া আকারে সক্রিয়। ইসরায়েলি অভিযানে গাজার অসংখ্য সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে, লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত, আবাসিক এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু যেসব মূল কারণ হামাসের উত্থান ঘটিয়েছিল (বঞ্চনা, রাষ্ট্রহীনতা ও হতাশা), সেগুলো আজও বহাল ও আরও তীব্র।
২০০০-এর দশকের শুরুতে ফাতাহ নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অদক্ষতার প্রতীকে পরিণত হয়। কয়েক বছরের ব্যর্থ শান্তি আলোচনা, অর্থনৈতিক পতন ও ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণে সাধারণ ফিলিস্তিনিরা পিএর প্রতি আস্থা হারায়। হামাস এ ক্ষোভকে রাজনৈতিক পুঁজি বানায়, নিজেদের পরিচয় দেয় দুর্নীতিমুক্ত, শৃঙ্খলাবদ্ধ, ন্যায় ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে।
২০০৬ সালে গাজায় হামাস নির্বাচনে জয় পায় মূলত ফাতাহর স্থবিরতার কারণে; উগ্র ইসলামপন্থার প্রতি সমর্থন হিসেবে নয়। কিন্তু বিজয়ী হয়ে হামাস ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার চিরাচরিত একনায়কতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের গাজা থেকে উৎখাত করে, নির্বাচন বাতিল করে আর জনগণের কল্যাণে ব্যয় না করে বিপুল অর্থ ব্যয় করে সুড়ঙ্গ, রকেট তৈরি ও সশস্ত্র বাহিনীর পেছনে।
তবে এখানে ইসরায়েলের নীতির ভূমিকাও উপেক্ষা করা যায় না। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজাকে বিভক্ত রাখার নীতি হাতে নেয়। নেতানিয়াহু জানতেন, একটি ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব দ্বিরাষ্ট্র বাস্তবায়নের প্রস্তাবকে শক্তিশালী করত আর বিভক্ত নেতৃত্ব সেই সম্ভাবনাকে দুর্বল করেছে। এ কৌশলের অর্থ দাঁড়ায়, পশ্চিম তীর পিএকে দুর্বল করার পাশাপাশি গাজায় হামাসের শাসনকে পরোক্ষভাবে মেনে নেওয়া।
এ স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ দীর্ঘ মেয়াদে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে। হামাসকে শক্তিশালী হতে দিয়ে নেতানিয়াহু কার্যত দ্বিরাষ্ট্র সমাধানকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রেখেছেন। হামাসের অস্তিত্ব ইসরায়েলের জন্য রাজনৈতিক আপসে না গিয়ে বসতি সম্প্রসারণ ও দখল চালিয়ে যাওয়ার পথে এক সহজ অজুহাত ছিল।
কিন্তু এ নীতি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় ভয়াবহভাবে উল্টো ফল দিয়েছে। হামাসের হামলা ইসরায়েলের নিরাপত্তাবোধ ভেঙে দিয়েছে, ভয়াবহ এক যুদ্ধের সূচনা করেছে এবং শান্তিপ্রক্রিয়াকে পুরো এক প্রজন্ম পিছিয়ে দিয়েছে।
গাজার জনগণের মধ্যে হামাসের প্রতি গভীর ভালোবাসা নেই। অনেক ফিলিস্তিনি হামাসকেই দোষারোপ করছে ধ্বংস ও রক্তপাত ডেকে আনার জন্য। কিন্তু বিকল্প রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা বিশ্বাসযোগ্য শান্তির রূপরেখা না থাকায় হামাসের বয়ান টিকে আছে। চরমপন্থা বাঁচে হতাশার ওপর আর গাজায় এখন হতাশার প্রাচুর্য।
হামাসকে প্রকৃত অর্থে পরাজিত করার একমাত্র উপায় অস্ত্র নয়, বরং আদর্শিক লড়াই। হামাস যে বক্তব্যের ওপর টিকে আছে—তা হলো, রাষ্ট্রহীন মানুষের জন্য সম্মানের একমাত্র পথ হচ্ছে সহিংসতা। এ বক্তব্য ভেঙে দেওয়ার একমাত্র উপায় হলো ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি বাস্তব, আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত ও বিশ্বাসযোগ্য দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পথ তৈরি করা।
এর অর্থ হলো, ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈধতা ফিরিয়ে আনা ও একটি নতুন প্রযুক্তিগত বা বহুপক্ষীয় প্রশাসনের মাধ্যমে গাজাকে পুনর্গঠন করা। শহীদ হওয়ার বাসন নয়, শাসন ও উন্নয়নের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নেতৃত্বকে ক্ষমতায় আনা। গাজার রাজনৈতিক সংস্কার ও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমার শর্তে যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোকে তহবিল পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া। ইসরায়েলকেও বুঝতে হবে, স্থায়ী অবরোধ ও দখলদারত্ব নিরাপত্তা বাড়ায় না; প্রকৃত নিরাপত্তা আসে সহাবস্থান থেকে।
ইসরায়েলের অভিযান প্রমাণ করেছে, যেমনটা বিশেষজ্ঞরা বহু আগে বলেছেন, আপনি একটি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারেন, কিন্তু একটি আদর্শকে নয়। হামাসকে সত্যিকার অর্থে পরাজিত করতে হলে ফিলিস্তিনের নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে ও চিন্তায় বিশ্বাসযোগ্য শান্তি ও সমৃদ্ধির ভবিষ্যৎ দেখাতে হবে।
ন্যাশনাল ইন্টারেস্টে বিশ্লেষণটি লিখেছেন ড. আজিম ইব্রাহিম। তিনি নিউ লাইনস ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসির সিনিয়র ডিরেক্টর এবং ‘অথরিটেরিয়ান সেঞ্চুরি: উইমেনস অব আ পোস্ট-লিবারাল ফিউচার’ বইটির লেখক। অনুবাদ করেছেন আবদুল বাছেদ।

গাজায় স্থল অভিযানের শুরু থেকে ইসরায়েল জোর দিয়ে বলেছে, তারা ‘চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’। টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে অবিরাম বিমান হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সময়ও একই অবস্থান ছিল নেতানিয়াহুর সরকারের। এমনকি গত সপ্তাহে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষরের পরও একই কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখাচ্ছে। গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে আনুমানিক ১৫ হাজার হামাস যোদ্ধা আবারও সংগঠিত হয়ে উঠে এসেছে। তাদের অনেকে পূর্ণ সশস্ত্র এবং এরই মধ্যে গাজায় প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করেছে। গাজা থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদন বলছে, তারা সন্দেহভাজন সহযোগীদের খুঁজে বের করে প্রকাশ্যে হত্যা করছে। অর্থাৎ হামাস ধ্বংস হয়নি, রক্তাক্ত ও বিভক্ত হলেও সংগঠনটি টিকে গেছে।
এ ফলাফল আসলে অপ্রত্যাশিত নয়। বিশ্বের সব প্রভাবশালী সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষজ্ঞ বহু আগে সতর্ক করেছিলেন, হামাসকে কেবল সামরিক শক্তি দিয়ে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। হামাস শুধু একটি সশস্ত্র নেটওয়ার্ক বা সুড়ঙ্গ ব্যবস্থা নয়, এটি ফিলিস্তিনি সমাজের গভীরে শিকড় গেড়ে বসা একটি রাজনৈতিক ও আদর্শিক আন্দোলন। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্র আল-কায়েদা বা ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ক্ষেত্রে দেখেছে, নেতা হত্যা করা যায়, অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়, এলাকা দখল করা যায়, কিন্তু কোনো আদর্শকে বোমা মেরে ধ্বংস করা যায় না।
ইসরায়েলের ঘোষিত ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ শুরু থেকে ছিল এক মরীচিকা। হামাসের নেতৃত্বকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সংগঠনটি এখনো স্থানীয় সেল ও মিলিশিয়া আকারে সক্রিয়। ইসরায়েলি অভিযানে গাজার অসংখ্য সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে, লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত, আবাসিক এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু যেসব মূল কারণ হামাসের উত্থান ঘটিয়েছিল (বঞ্চনা, রাষ্ট্রহীনতা ও হতাশা), সেগুলো আজও বহাল ও আরও তীব্র।
২০০০-এর দশকের শুরুতে ফাতাহ নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অদক্ষতার প্রতীকে পরিণত হয়। কয়েক বছরের ব্যর্থ শান্তি আলোচনা, অর্থনৈতিক পতন ও ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণে সাধারণ ফিলিস্তিনিরা পিএর প্রতি আস্থা হারায়। হামাস এ ক্ষোভকে রাজনৈতিক পুঁজি বানায়, নিজেদের পরিচয় দেয় দুর্নীতিমুক্ত, শৃঙ্খলাবদ্ধ, ন্যায় ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে।
২০০৬ সালে গাজায় হামাস নির্বাচনে জয় পায় মূলত ফাতাহর স্থবিরতার কারণে; উগ্র ইসলামপন্থার প্রতি সমর্থন হিসেবে নয়। কিন্তু বিজয়ী হয়ে হামাস ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার চিরাচরিত একনায়কতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের গাজা থেকে উৎখাত করে, নির্বাচন বাতিল করে আর জনগণের কল্যাণে ব্যয় না করে বিপুল অর্থ ব্যয় করে সুড়ঙ্গ, রকেট তৈরি ও সশস্ত্র বাহিনীর পেছনে।
তবে এখানে ইসরায়েলের নীতির ভূমিকাও উপেক্ষা করা যায় না। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজাকে বিভক্ত রাখার নীতি হাতে নেয়। নেতানিয়াহু জানতেন, একটি ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব দ্বিরাষ্ট্র বাস্তবায়নের প্রস্তাবকে শক্তিশালী করত আর বিভক্ত নেতৃত্ব সেই সম্ভাবনাকে দুর্বল করেছে। এ কৌশলের অর্থ দাঁড়ায়, পশ্চিম তীর পিএকে দুর্বল করার পাশাপাশি গাজায় হামাসের শাসনকে পরোক্ষভাবে মেনে নেওয়া।
এ স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ দীর্ঘ মেয়াদে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে। হামাসকে শক্তিশালী হতে দিয়ে নেতানিয়াহু কার্যত দ্বিরাষ্ট্র সমাধানকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রেখেছেন। হামাসের অস্তিত্ব ইসরায়েলের জন্য রাজনৈতিক আপসে না গিয়ে বসতি সম্প্রসারণ ও দখল চালিয়ে যাওয়ার পথে এক সহজ অজুহাত ছিল।
কিন্তু এ নীতি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় ভয়াবহভাবে উল্টো ফল দিয়েছে। হামাসের হামলা ইসরায়েলের নিরাপত্তাবোধ ভেঙে দিয়েছে, ভয়াবহ এক যুদ্ধের সূচনা করেছে এবং শান্তিপ্রক্রিয়াকে পুরো এক প্রজন্ম পিছিয়ে দিয়েছে।
গাজার জনগণের মধ্যে হামাসের প্রতি গভীর ভালোবাসা নেই। অনেক ফিলিস্তিনি হামাসকেই দোষারোপ করছে ধ্বংস ও রক্তপাত ডেকে আনার জন্য। কিন্তু বিকল্প রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা বিশ্বাসযোগ্য শান্তির রূপরেখা না থাকায় হামাসের বয়ান টিকে আছে। চরমপন্থা বাঁচে হতাশার ওপর আর গাজায় এখন হতাশার প্রাচুর্য।
হামাসকে প্রকৃত অর্থে পরাজিত করার একমাত্র উপায় অস্ত্র নয়, বরং আদর্শিক লড়াই। হামাস যে বক্তব্যের ওপর টিকে আছে—তা হলো, রাষ্ট্রহীন মানুষের জন্য সম্মানের একমাত্র পথ হচ্ছে সহিংসতা। এ বক্তব্য ভেঙে দেওয়ার একমাত্র উপায় হলো ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি বাস্তব, আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত ও বিশ্বাসযোগ্য দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পথ তৈরি করা।
এর অর্থ হলো, ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈধতা ফিরিয়ে আনা ও একটি নতুন প্রযুক্তিগত বা বহুপক্ষীয় প্রশাসনের মাধ্যমে গাজাকে পুনর্গঠন করা। শহীদ হওয়ার বাসন নয়, শাসন ও উন্নয়নের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নেতৃত্বকে ক্ষমতায় আনা। গাজার রাজনৈতিক সংস্কার ও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমার শর্তে যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোকে তহবিল পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া। ইসরায়েলকেও বুঝতে হবে, স্থায়ী অবরোধ ও দখলদারত্ব নিরাপত্তা বাড়ায় না; প্রকৃত নিরাপত্তা আসে সহাবস্থান থেকে।
ইসরায়েলের অভিযান প্রমাণ করেছে, যেমনটা বিশেষজ্ঞরা বহু আগে বলেছেন, আপনি একটি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারেন, কিন্তু একটি আদর্শকে নয়। হামাসকে সত্যিকার অর্থে পরাজিত করতে হলে ফিলিস্তিনের নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে ও চিন্তায় বিশ্বাসযোগ্য শান্তি ও সমৃদ্ধির ভবিষ্যৎ দেখাতে হবে।
ন্যাশনাল ইন্টারেস্টে বিশ্লেষণটি লিখেছেন ড. আজিম ইব্রাহিম। তিনি নিউ লাইনস ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসির সিনিয়র ডিরেক্টর এবং ‘অথরিটেরিয়ান সেঞ্চুরি: উইমেনস অব আ পোস্ট-লিবারাল ফিউচার’ বইটির লেখক। অনুবাদ করেছেন আবদুল বাছেদ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ২০ বছর পূর্ণ হলো আজ। শুরুতে প্ল্যাটফর্মটি যে প্রত্যাশা দেখিয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় তা কেবলই বিবর্ণ হয়েছে। বিতর্ক ছড়ানো ও অর্থ উপার্জনের চুম্বকে পরিণত হয়েছে এটি। কেবল তাই নয়, ব্যবহারকারীর ওপর প্ল্যাটফর্মটির সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
বেইজিংয়ে এ সপ্তাহে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছেন চীনের শীর্ষ নেতারা। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে উত্তাল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশটির ক্ষমতা ধরে রাখা এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু এই বৈঠকের আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচির বাইরে রয়েছে এমন দুটি প্রশ্ন, যা চীনের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করছে...
১১ ঘণ্টা আগে
বিশ্বের তিন মহাদেশে এখন এক জটিল ভূরাজনৈতিক খেলা চলছে। এ খেলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হাতে রেখেছেন সবচেয়ে শক্তিশালী কার্ড। তুলনামূলক দুর্বল অবস্থানে থেকেও খেলার মধ্যে টিকে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং চাইছেন পুরো বাজি জিততে।
২ দিন আগে
ভারতে আজকাল দিন শুরু হয় দুই ধরনের সংবাদ দিয়ে: একদিকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়—পাকিস্তানবিরোধী বিতর্ক, হিন্দুদের গৌরবগাথা আর নতুন ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা; অন্যদিকে অন্ধকার এক বাস্তবতা—প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কোনো মুসলমান নিগৃহীত হচ্ছে, পিটিয়ে মারা হচ্ছে, মিথ্যা মামলায় বন্দী করা হচ্ছে, অথবা দেশদ্রোহী..
২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ভারতে আজকাল দিন শুরু হয় দুই ধরনের সংবাদ দিয়ে: একদিকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়—পাকিস্তানবিরোধী বিতর্ক, হিন্দুদের গৌরবগাথা আর নতুন ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা; অন্যদিকে অন্ধকার এক বাস্তবতা—প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কোনো মুসলমান নিগৃহীত হচ্ছে, পিটিয়ে মারা হচ্ছে, মিথ্যা মামলায় বন্দী করা হচ্ছে, অথবা দেশদ্রোহী তকমা পাচ্ছে। এই দুই বাস্তবতার মাঝখানে একটি বার্তা স্পষ্ট—মুসলমানদের কষ্টক্লিষ্ট মুখ হয় অদৃশ্য করে দেওয়া হয়, নয়তো সেটিকে পরিণত করা হয় এক ধরনের টিভি ‘শো’তে, যা সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে সান্ধ্যকালীন বিনোদন। আজ ভারতে মুসলমানের জন্মই যেন আজন্ম পাপ! তার জন্মই হয় অপরাধী হয়ে। তাদের কণ্ঠস্বর কেউ শোনে না।
গত সেপ্টেম্বরে উত্তর প্রদেশের আজমগড়ে সাত বছরের এক মুসলিম শিশুর লাশ উদ্ধার হয়। লাশ ব্যাগে ভরা ছিল। প্রতিবেশীরাই জড়িত ছিল এ হত্যাকাণ্ডে। খবরটা স্থানীয়ভাবে একদিন দুদিন প্রচারিত হলেও দেশের বড় কোনো সংবাদমাধ্যমে জায়গা পায়নি। সেসময় নিউজরুমে আলোচনায় ছিল ‘লাভ জিহাদ’, সীমান্ত উত্তেজনা ও ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ। ফলে একটি মুসলিম শিশুর মৃত্যু জাতীয় ক্ষোভের গল্প হিসেবে ভাইরাল হয়নি। ধীরে ধীরে তা হারিয়ে গেছে। দ্রুত স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া আর দশটা ঘটনার তালিকায় যোগ হয়েছে এই শিশুহত্যা।
সমাজবিজ্ঞানী স্ট্যানলি কোহেন এটিকে বলেন— ‘স্টেটস অব ডিনায়াল’। রাষ্ট্র এখানে নির্লিপ্ত। এখানে নৃশংসতাগুলো আড়াল করা হয় না, বরং এমনভাবে গ্রহণ করা হয় যেন তা স্বাভাবিক। ভারত আজ সেই অবস্থায়। এখানে মুসলমান হত্যার খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়ার যোগ্য নয়, যেন এটা নিত্যদিনের সাধারণ ব্যাপার।
কানপুরে মুসলমানেরা ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করলে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধেই এফআইআর দায়ের করে। গ্রেপ্তার করে ১ হাজার ৩০০ জনকে। ভালোবাসার প্রকাশও যেন আজ অপরাধ। অথচ মহারাষ্ট্র বা মধ্যপ্রদেশে যখন হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো প্রকাশ্যে গণহত্যার ডাক দেয়, তখন টেলিভিশন হয় তাদের মুখপত্র, নয়তো নীরব দর্শক। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা যেন এক মঞ্চনাটক, যেখানে মুসলমানেরা চিরকাল অপরাধী/ভিলেন চরিত্রে আর হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো সভ্যতার ধারক-বাহক ও রক্ষক হিসেবে অভিনয় করে।
ইন্দোরে ‘জিহাদি-মুক্ত বাজার’ নীতিতে রাতারাতি মুসলিম ব্যবসায়ীদের দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে—এ যেন অর্থনৈতিক লিঞ্চিং বা গণপ্রহার। অনেক পরিবার এতে উপার্জন হারায়, শিশুরা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়, নারীরা খাবারের জন্য প্রতিবেশীর দ্বারে দ্বারে ঘোরে। অথচ দেশের বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলো এটিকে দেখায় ‘আইন-শৃঙ্খলার সমন্বয়’ হিসেবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংখ্যাগুরুরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে, নানা মিম বানায়, বানানো হয় অনেক ভিডিও। এসব দেখে মনে হয়, মুসলমানদের প্রতি নিপীড়ন ও বঞ্চনা যেন বিনোদনের উপকরণ!
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এ সংস্কৃতির জন্মদাতা। তিনি প্রকাশ্যে মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘সন্ত্রাসীদের সহযোগী’ আখ্যা দেন। এমন ভাষা এখন ভারতের মূলধারার রাজনীতিরই অংশ। তথাকথিত বিরোধী দলগুলোও প্রতিবাদ না করে বরং নিজস্ব সংস্করণে নিজেদের হিন্দুত্ববাদী প্রমাণ করতে প্রতিযোগিতা করছে। মুসলমানেরা তাই এখন ভারতের রাজনীতিতে নাগরিক নয়, বরং নাটকের প্রপস মাত্র। (প্রপস বলতে মঞ্চ বা পর্দায় অভিনয়ের জন্য ব্যবহৃত বস্তু যেমন; আসবাব, অস্ত্র, পোশাক ইত্যাদি)
ভারতে আজকের দিনে একজন মুসলিম হিসেবে বাঁচা মানে ‘স্থায়ী সন্দেহভাজন’ আতঙ্কে থাকা। মসজিদে তাঁদের ওপর নজর রাখা হয়, বাজারে আড়চোখে তাকানো হয়, শ্রেণিকক্ষে সন্দেহ করা হয়। প্রতি শুক্রবার জুমার জামাতে যাওয়াই ঝুঁকি বলে মনে হয়। আজানের প্রতিটি ধ্বনি কারও কারও কাছে উসকানি বলে মনে হয়।
গীতিকার ও কবি সাহির লুধিয়ানভি একবার লিখেছিলেন, ‘যিনহে নাজ হ্যায় হিন্দ পার, ওহ কাহাঁ হ্যায়?’ (ভারতের জন্য যারা গর্বিত, তারা এখন কোথায়?)। প্রশ্নটি আজও প্রতিধ্বনিত হয়—যারা ভারত ও ভারতের মহত্ত্ব নিয়ে গর্বিত, তারা আজ কোথায়? তারা কী মুসলিমদের এ দুর্দশা দেখেন না?
উগান্ডায় জন্ম নেওয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম গবেষক মাহমুদ মামদানি তাঁর ‘গুড মুসলিম, ব্যাড মুসলিম’ বইয়ে লিখেছেন—রাষ্ট্র ও সমাজ মুসলমানদের ভাগ করে ‘ভালো’ ও ‘খারাপ’ দুই শ্রেণিতে। ‘ভালো’ মুসলমান সে, যে চুপচাপ থাকে; আর ‘খারাপ’ সে, যে আত্মপরিচয় ও মর্যাদা জানান দিতে চায়। ভারতের বাস্তবতাও তা-ই—যে মুসলমান নিজের ধর্মবিশ্বাস আড়াল করে, সে টিকে থাকে; আর যে ভালোবাসা প্রকাশ করে, সমঅধিকার চায়, তাঁকে বলা হয় ‘মুজরিম’ বা অপরাধী। মামদানি আমাদের মনে করিয়ে দেন, এটি ধর্মতত্ত্বের বিষয় নয়, ক্ষমতার বিষয়। এই ক্ষমতাবানেরাই ঠিক করে দেয়, কোনটি বৈধ আর কোনটি অবৈধ— হোক সেটা ধর্মবিশ্বাস বা অধিকারের প্রশ্ন।
এই কারণেই গণপিটুনির ভিডিওগুলো হোয়াটসঅ্যাপে মিমের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এই কারণেই মুসলমানদের জন্মহার বেশি, তারা দ্রুতই হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাবে— সংবাদ উপস্থাপকেরা এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলেন আর হাসেন। এই কারণেই জনতা মুসলমানদের দোকান জ্বালিয়ে দেওয়ার পরে হাসি-তামাশা করে। ঘৃণা এখন আর শুধু রাজনীতি নয়, এটি এখন সমাজের বিনোদনে পরিণত হয়েছে। আর নিষ্ঠুরতা যখন কমেডি হয়ে ওঠে, যখন কাউকে অপমান করার ভিডিও প্রাইম-টাইম স্ক্রিপ্ট হয়ে যায়, তখন গণতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে কোনো ফারাক থাকে না।
কিন্তু ইতিহাস দেখুন, যে সমাজ সংখ্যালঘুদের কষ্টকে বিনোদনে পরিণত করে, সে সমাজ নিজেও রক্ষা পায় না। নাৎসি জার্মানিতে ইহুদি নিধনে তথাকথিত লিবারেলদের বা উদারপন্থীদের নীরবতা, কৃষ্ণাঙ্গদের গণপিটুনির শিকার হতে দেখেও শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের উদাসীনতা, কিংবা গাজায় বোমা হামলা দেখে ইসরায়েলিদের উল্লাস—সবই মনে করিয়ে দেয়, ঘৃণার বিনোদন একসময় নিজের সমাজকেই গ্রাস করে। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়।
তাহলে প্রশ্নটা রয়ে যায়—আমরা মুসলিম, না মুজরিম? কেন প্রতিদিন আমাদের বিচার হয়, অথচ হত্যাকারীরা মুক্ত থাকে? কেন আমাদের সন্তানদের মৃত্যু চাপা পড়ে রাষ্ট্রীয় উৎসবের আড়ালে?
এর উত্তর তালাশ করতে হবে শুধু মুসলমানদের নয়, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠেরও। তারা কি ঘৃণাকে টেলিভিশন শো হিসেবে দেখবে, নাকি একদিন টেলিভিশন বন্ধ করে দেবে? কারণ ঘৃণা যেদিন দেশের একমাত্র বিনোদন হয়ে উঠবে, সেদিন শুধু মুসলমানের লাশ নয় ভারতের প্রজাতন্ত্রেরও পর্দা নামবে। সেদিন কেউ জিজ্ঞেস করবে না আপনি হিন্দু নাকি মুসলিম, ডানপন্থী নাকি উদারপন্থী। সেদিন ঘৃণার অট্টহাসিই হবে এই প্রজাতন্ত্রের একমাত্র অবশিষ্ট আওয়াজ।
আল-জাজিরায় প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে সংক্ষেপিত
লেখক: ইসমাইল সালাউদ্দিন, ভারতীয় লেখক ও গবেষক, মুসলিম পরিচয়, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে কাজ করেন

ভারতে আজকাল দিন শুরু হয় দুই ধরনের সংবাদ দিয়ে: একদিকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়—পাকিস্তানবিরোধী বিতর্ক, হিন্দুদের গৌরবগাথা আর নতুন ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা; অন্যদিকে অন্ধকার এক বাস্তবতা—প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কোনো মুসলমান নিগৃহীত হচ্ছে, পিটিয়ে মারা হচ্ছে, মিথ্যা মামলায় বন্দী করা হচ্ছে, অথবা দেশদ্রোহী তকমা পাচ্ছে। এই দুই বাস্তবতার মাঝখানে একটি বার্তা স্পষ্ট—মুসলমানদের কষ্টক্লিষ্ট মুখ হয় অদৃশ্য করে দেওয়া হয়, নয়তো সেটিকে পরিণত করা হয় এক ধরনের টিভি ‘শো’তে, যা সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে সান্ধ্যকালীন বিনোদন। আজ ভারতে মুসলমানের জন্মই যেন আজন্ম পাপ! তার জন্মই হয় অপরাধী হয়ে। তাদের কণ্ঠস্বর কেউ শোনে না।
গত সেপ্টেম্বরে উত্তর প্রদেশের আজমগড়ে সাত বছরের এক মুসলিম শিশুর লাশ উদ্ধার হয়। লাশ ব্যাগে ভরা ছিল। প্রতিবেশীরাই জড়িত ছিল এ হত্যাকাণ্ডে। খবরটা স্থানীয়ভাবে একদিন দুদিন প্রচারিত হলেও দেশের বড় কোনো সংবাদমাধ্যমে জায়গা পায়নি। সেসময় নিউজরুমে আলোচনায় ছিল ‘লাভ জিহাদ’, সীমান্ত উত্তেজনা ও ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ। ফলে একটি মুসলিম শিশুর মৃত্যু জাতীয় ক্ষোভের গল্প হিসেবে ভাইরাল হয়নি। ধীরে ধীরে তা হারিয়ে গেছে। দ্রুত স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া আর দশটা ঘটনার তালিকায় যোগ হয়েছে এই শিশুহত্যা।
সমাজবিজ্ঞানী স্ট্যানলি কোহেন এটিকে বলেন— ‘স্টেটস অব ডিনায়াল’। রাষ্ট্র এখানে নির্লিপ্ত। এখানে নৃশংসতাগুলো আড়াল করা হয় না, বরং এমনভাবে গ্রহণ করা হয় যেন তা স্বাভাবিক। ভারত আজ সেই অবস্থায়। এখানে মুসলমান হত্যার খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়ার যোগ্য নয়, যেন এটা নিত্যদিনের সাধারণ ব্যাপার।
কানপুরে মুসলমানেরা ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করলে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধেই এফআইআর দায়ের করে। গ্রেপ্তার করে ১ হাজার ৩০০ জনকে। ভালোবাসার প্রকাশও যেন আজ অপরাধ। অথচ মহারাষ্ট্র বা মধ্যপ্রদেশে যখন হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো প্রকাশ্যে গণহত্যার ডাক দেয়, তখন টেলিভিশন হয় তাদের মুখপত্র, নয়তো নীরব দর্শক। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা যেন এক মঞ্চনাটক, যেখানে মুসলমানেরা চিরকাল অপরাধী/ভিলেন চরিত্রে আর হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো সভ্যতার ধারক-বাহক ও রক্ষক হিসেবে অভিনয় করে।
ইন্দোরে ‘জিহাদি-মুক্ত বাজার’ নীতিতে রাতারাতি মুসলিম ব্যবসায়ীদের দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে—এ যেন অর্থনৈতিক লিঞ্চিং বা গণপ্রহার। অনেক পরিবার এতে উপার্জন হারায়, শিশুরা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়, নারীরা খাবারের জন্য প্রতিবেশীর দ্বারে দ্বারে ঘোরে। অথচ দেশের বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলো এটিকে দেখায় ‘আইন-শৃঙ্খলার সমন্বয়’ হিসেবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংখ্যাগুরুরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে, নানা মিম বানায়, বানানো হয় অনেক ভিডিও। এসব দেখে মনে হয়, মুসলমানদের প্রতি নিপীড়ন ও বঞ্চনা যেন বিনোদনের উপকরণ!
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এ সংস্কৃতির জন্মদাতা। তিনি প্রকাশ্যে মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘সন্ত্রাসীদের সহযোগী’ আখ্যা দেন। এমন ভাষা এখন ভারতের মূলধারার রাজনীতিরই অংশ। তথাকথিত বিরোধী দলগুলোও প্রতিবাদ না করে বরং নিজস্ব সংস্করণে নিজেদের হিন্দুত্ববাদী প্রমাণ করতে প্রতিযোগিতা করছে। মুসলমানেরা তাই এখন ভারতের রাজনীতিতে নাগরিক নয়, বরং নাটকের প্রপস মাত্র। (প্রপস বলতে মঞ্চ বা পর্দায় অভিনয়ের জন্য ব্যবহৃত বস্তু যেমন; আসবাব, অস্ত্র, পোশাক ইত্যাদি)
ভারতে আজকের দিনে একজন মুসলিম হিসেবে বাঁচা মানে ‘স্থায়ী সন্দেহভাজন’ আতঙ্কে থাকা। মসজিদে তাঁদের ওপর নজর রাখা হয়, বাজারে আড়চোখে তাকানো হয়, শ্রেণিকক্ষে সন্দেহ করা হয়। প্রতি শুক্রবার জুমার জামাতে যাওয়াই ঝুঁকি বলে মনে হয়। আজানের প্রতিটি ধ্বনি কারও কারও কাছে উসকানি বলে মনে হয়।
গীতিকার ও কবি সাহির লুধিয়ানভি একবার লিখেছিলেন, ‘যিনহে নাজ হ্যায় হিন্দ পার, ওহ কাহাঁ হ্যায়?’ (ভারতের জন্য যারা গর্বিত, তারা এখন কোথায়?)। প্রশ্নটি আজও প্রতিধ্বনিত হয়—যারা ভারত ও ভারতের মহত্ত্ব নিয়ে গর্বিত, তারা আজ কোথায়? তারা কী মুসলিমদের এ দুর্দশা দেখেন না?
উগান্ডায় জন্ম নেওয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম গবেষক মাহমুদ মামদানি তাঁর ‘গুড মুসলিম, ব্যাড মুসলিম’ বইয়ে লিখেছেন—রাষ্ট্র ও সমাজ মুসলমানদের ভাগ করে ‘ভালো’ ও ‘খারাপ’ দুই শ্রেণিতে। ‘ভালো’ মুসলমান সে, যে চুপচাপ থাকে; আর ‘খারাপ’ সে, যে আত্মপরিচয় ও মর্যাদা জানান দিতে চায়। ভারতের বাস্তবতাও তা-ই—যে মুসলমান নিজের ধর্মবিশ্বাস আড়াল করে, সে টিকে থাকে; আর যে ভালোবাসা প্রকাশ করে, সমঅধিকার চায়, তাঁকে বলা হয় ‘মুজরিম’ বা অপরাধী। মামদানি আমাদের মনে করিয়ে দেন, এটি ধর্মতত্ত্বের বিষয় নয়, ক্ষমতার বিষয়। এই ক্ষমতাবানেরাই ঠিক করে দেয়, কোনটি বৈধ আর কোনটি অবৈধ— হোক সেটা ধর্মবিশ্বাস বা অধিকারের প্রশ্ন।
এই কারণেই গণপিটুনির ভিডিওগুলো হোয়াটসঅ্যাপে মিমের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এই কারণেই মুসলমানদের জন্মহার বেশি, তারা দ্রুতই হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাবে— সংবাদ উপস্থাপকেরা এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলেন আর হাসেন। এই কারণেই জনতা মুসলমানদের দোকান জ্বালিয়ে দেওয়ার পরে হাসি-তামাশা করে। ঘৃণা এখন আর শুধু রাজনীতি নয়, এটি এখন সমাজের বিনোদনে পরিণত হয়েছে। আর নিষ্ঠুরতা যখন কমেডি হয়ে ওঠে, যখন কাউকে অপমান করার ভিডিও প্রাইম-টাইম স্ক্রিপ্ট হয়ে যায়, তখন গণতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে কোনো ফারাক থাকে না।
কিন্তু ইতিহাস দেখুন, যে সমাজ সংখ্যালঘুদের কষ্টকে বিনোদনে পরিণত করে, সে সমাজ নিজেও রক্ষা পায় না। নাৎসি জার্মানিতে ইহুদি নিধনে তথাকথিত লিবারেলদের বা উদারপন্থীদের নীরবতা, কৃষ্ণাঙ্গদের গণপিটুনির শিকার হতে দেখেও শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের উদাসীনতা, কিংবা গাজায় বোমা হামলা দেখে ইসরায়েলিদের উল্লাস—সবই মনে করিয়ে দেয়, ঘৃণার বিনোদন একসময় নিজের সমাজকেই গ্রাস করে। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়।
তাহলে প্রশ্নটা রয়ে যায়—আমরা মুসলিম, না মুজরিম? কেন প্রতিদিন আমাদের বিচার হয়, অথচ হত্যাকারীরা মুক্ত থাকে? কেন আমাদের সন্তানদের মৃত্যু চাপা পড়ে রাষ্ট্রীয় উৎসবের আড়ালে?
এর উত্তর তালাশ করতে হবে শুধু মুসলমানদের নয়, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠেরও। তারা কি ঘৃণাকে টেলিভিশন শো হিসেবে দেখবে, নাকি একদিন টেলিভিশন বন্ধ করে দেবে? কারণ ঘৃণা যেদিন দেশের একমাত্র বিনোদন হয়ে উঠবে, সেদিন শুধু মুসলমানের লাশ নয় ভারতের প্রজাতন্ত্রেরও পর্দা নামবে। সেদিন কেউ জিজ্ঞেস করবে না আপনি হিন্দু নাকি মুসলিম, ডানপন্থী নাকি উদারপন্থী। সেদিন ঘৃণার অট্টহাসিই হবে এই প্রজাতন্ত্রের একমাত্র অবশিষ্ট আওয়াজ।
আল-জাজিরায় প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে সংক্ষেপিত
লেখক: ইসমাইল সালাউদ্দিন, ভারতীয় লেখক ও গবেষক, মুসলিম পরিচয়, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে কাজ করেন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ২০ বছর পূর্ণ হলো আজ। শুরুতে প্ল্যাটফর্মটি যে প্রত্যাশা দেখিয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় তা কেবলই বিবর্ণ হয়েছে। বিতর্ক ছড়ানো ও অর্থ উপার্জনের চুম্বকে পরিণত হয়েছে এটি। কেবল তাই নয়, ব্যবহারকারীর ওপর প্ল্যাটফর্মটির সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
বেইজিংয়ে এ সপ্তাহে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছেন চীনের শীর্ষ নেতারা। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে উত্তাল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশটির ক্ষমতা ধরে রাখা এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু এই বৈঠকের আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচির বাইরে রয়েছে এমন দুটি প্রশ্ন, যা চীনের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করছে...
১১ ঘণ্টা আগে
বিশ্বের তিন মহাদেশে এখন এক জটিল ভূরাজনৈতিক খেলা চলছে। এ খেলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হাতে রেখেছেন সবচেয়ে শক্তিশালী কার্ড। তুলনামূলক দুর্বল অবস্থানে থেকেও খেলার মধ্যে টিকে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং চাইছেন পুরো বাজি জিততে।
২ দিন আগে
গাজায় স্থল অভিযানের শুরু থেকে ইসরায়েল জোর দিয়ে বলেছে, তারা ‘চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’। টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে অবিরাম বিমান হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সময়ও একই অবস্থান ছিল নেতানিয়াহুর সরকারের। এমনকি গত সপ্তাহে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষরের পরও একই কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে।
২ দিন আগে