
গত বছরের জুনে নিখিল গুপ্ত নিজের মোবাইল ফোন থেকে তাঁর এক পরিচিতজনকে একটি ভিডিও পাঠান। কানাডায় শিখদের প্রার্থনাগৃহ গুরুদুয়ারার বাইরে এক ব্যক্তিকে পরপর ৩৪টি গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি একটি গাড়ির পাশে ঢলে পড়েন। এই ঘটনারই ভিডিও সেটি।
নিহত ওই ব্যক্তি হরদীপ সিং নিজ্জার। কানাডা পুলিশ বলছে, নিখিলের বেশ কয়েকজন টার্গেটের মধ্যে হরদীপ একজন। কারণ নিখিল তাঁর সেই পরিচিতজনকে লিখেছিলেন, ‘আমাদের অনেক টার্গেট রয়েছে।’
মার্কিন কৌঁসুলিদের মতে, নিখিল নিউইয়র্কভিত্তিক আইনজীবী এবং শিখস ফর জাস্টিস সংগঠনের নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে মার্কিন গোয়েন্দাদের তৎপরতায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীরা বিশ্বাস করেন, শিখস ফর জাস্টিসের দুই নেতা পান্নুন এবং নিজ্জার স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সপক্ষে বৈশ্বিক গণভোট আয়োজনে কাজ করছিলেন। এ কারণেই তাঁদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, এই গণভোটের মাধ্যমে পাঞ্জাবকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় চাপ সৃষ্টি করা।
কানাডা এখনো নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে না পারলেও, নিখিলকে গত জুনে চেক প্রজাতন্ত্র থেকে গ্রেপ্তার করে যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্কে দাখিল করা একটি অভিযোগে বলা হয়েছে, নিখিল পান্নুনকে হত্যার জন্য ভাড়াটে খুনি নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু চালচক্রে ভাড়াটে খুনি খুঁজতে গিয়ে মার্কিন পুলিশেরই এক সোর্সকে ১ লাখ ডলার দিয়েছিলেন তিনি।
এই অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে ভারত এমন একটি ক্লাবের সদস্য হয়ে উঠবে যারা আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে গুপ্তহত্যা করে। এর মধ্য দিয়ে ফের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শুরুর ইঙ্গিত মিলছে, যে চর্চাটি দীর্ঘকাল ধরে শুধু বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যেই ছিল।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে বিরোধীদের গুপ্তহত্যার অভিযোগ রয়েছে। বিদেশের মাটিতে ভারত সরকারের গুপ্তহত্যার লক্ষ্য পাকিস্তান অনেক আগে থেকেই ছিল। সম্প্রতি শিখ নেতা নিজ্জার হত্যার ঘটনার পর ভারতের বিরুদ্ধে সেই সন্দেহ আরও গভীর হয়েছে।
বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যার রেকর্ড সবচেয়ে বেশি ইসরায়েলের। হামাসের সিনিয়র নেতাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে দেশটি গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা নতুন করে সাজাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এরই মধ্যেই হামাসের অন্তত তিনজন সিনিয়র নেতাকে গুপ্তহত্যা করেছে ইসরায়েল।
মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকলে, কোনো নিন্দা না হলে, বিচার না হলে এটি বাড়বে। এগুলো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা ও স্থায়ীকরণের উপাদান।’
সৌদি আরবের গুপ্তহত্যার তদন্তকারী কমিটির নেতৃত্বদানকারী ক্যালামার্ড বলেন, ‘বিদেশের মাটিতে লক্ষ্যবস্তু করা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো আমাদের আরও খারাপ দুনিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে; এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
আন্তর্জাতিক আইনে বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা নিঃসন্দেহে বেআইনি। আর কূটনৈতিক কনভেনশন অনুযায়ী এটি আরও বড় অপরাধ, যা যুদ্ধের সমতুল্য।
এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পরিণতি নিয়ে ভয় এবং আন্তর্জাতিক সুযোগ–সুবিধা সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে বিংশ শতকের বেশির ভাগ সময় বেশির ভাগ দেশ গুপ্তহত্যা থেকে বিরত ছিল। এরপরও যেসব দেশ জড়িয়েছে, তারা অভ্যন্তরীণ আইন মেনে কাকে, কখন, কোথায় এবং কীভাবে হত্যা করতে হবে তা নির্ধারণ করেছে।
গুপ্তহত্যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র
স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিশ্বের দুটি পরাশক্তি গুপ্তহত্যায় জড়িয়েছিল, যদিও খুবই ভিন্ন উদ্দেশ্যে। ১৯৬৪ সালের সিআইএ মেমো রিপোর্ট বলছে, সোভিয়েতরা গুপ্তহত্যার টার্গেট করত কেবল সেই ব্যক্তিদের যারা কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার জন্য বিপজ্জনক এবং যাদের কোনোভাবেই অপহরণ করা যায় না।
সাধারণভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তহত্যা নিজ দেশের সেসব নাগরিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যারা বিদেশ থেকে সোভিয়েত শাসনের সমালোচনা করছিল। ১৯৪০ সালে মেক্সিকো সিটির একটি বাড়িতে লিওন ট্রটস্কিকে বরফ ভাঙার সুচ দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এভাবে ক্রেমলিনের শত্রুদের দেশে এবং বিদেশের মাটিতে অপহরণ বা হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতিক্রমও করেছে: জার্মান আইনজীবী ওয়াল্টার লিন্সকে মার্কিন–অধিকৃত বার্লিন থেকে অপহরণ এবং ১৯৫৩ সালে হত্যা করা হয়েছিল।
আমেরিকার বিশ্ব নেতাদের খুনের তালিকায় রাখার প্রবণতা রয়েছে। ২০০৭ সালে সিআইএর কুখ্যাত গুপ্তহত্যার তথ্য ফাঁস হয়, এই নথি ‘ফ্যামিলি জুয়েলস’ নামে বিখ্যাত। সেখানে দেখা যায়, বিদেশি কমিউনিস্ট নেতাদের হত্যার লক্ষ্যবস্তু করেছে সিআইএ। এর মধ্যে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার অসংখ্য পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া সিআইএর হত্যার তালিকায় ছিলেন দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট এনগো দিন দিম এবং কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা। তবে সিআইএ তাঁদের হত্যা করার আগেই মার্কিন সমর্থিত অভ্যুত্থানে তাঁরা নিহত হন। এসব হত্যাকাণ্ডের গোপন নথি প্রকাশ পেলে মার্কিন সিনেটে ‘চার্চ কমিটি’ নামে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়।
তদন্ত শেষে কমিটি জানায়, যুদ্ধের অংশ হিসেবে হলেও ‘গুপ্তহত্যা’ আমেরিকান নীতি, আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা এবং নৈতিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বৈদেশিক নীতির হাতিয়ার এটি হতে পারে না, একে প্রত্যাখ্যান করা উচিত।
এরপর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড ১৯৭৬ সালে একটি নির্বাহী আদেশে বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে সম্মত হন এবং আইন পাস করেন।
গুপ্তহত্যায় ইরান ও উত্তর কোরিয়া
গুপ্তহত্যার বেশির ভাগই করেছে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো। ব্যতিক্রম হিসেবে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে বিদেশের মাটিতে প্রায় দুই ডজন গুপ্তহত্যার পেছনে ইরানকে দায়ী করা হয়। এসবের কিছু ফলও ভোগ করতে হয়েছে তেহরানকে।
১৯৮০ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাপুর বখতিয়ারকে হত্যাচেষ্টার জন্য গ্রেপ্তার হওয়া ইরানের একটি হিট স্কোয়াডকে ক্ষমা করে দেয় ফ্রান্স। ইরান এক দশক পরে প্যারিসে বখতিয়ারকে শেষমেশ হত্যা করেই ছাড়ে।
নিউইয়র্ক সিটিতে নির্বাসিত ইরানি ভিন্নমতাবলম্বী মাসিহ আলিনেজাদ অন্তত দুটি হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন। মার্কিন কর্তৃপক্ষের মতে, ইরানের ভাড়াটে বন্দুকধারীরা ২০২১ সালে তাঁকে আটক করে ইরানে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পুলিশ তা ব্যর্থ করে দেয়। ২০২২ সালে এই লেখককে হত্যার উদ্দেশ্যে আরেকটি দল পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এবারও তারা পুলিশের হাতে আটক হয়।
গত বছরের হ্যালিফ্যাক্স আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ফোরামে আলিনেজাদ বলেন, যে লোকটিকে আসলে ব্রুকলিনে আমার বাড়ির সামনে থেকে একে–৪৭ বন্দুকসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তিনি আগে ইউরোপের একটি অপরাধী চক্রের অংশ ছিলেন। সুতরাং বাস্তবতা হলো—স্বৈরাচারীরা কেবল নিজ দেশের লোকদেরই নয়, সীমানার বাইরের লোকদেরও নিপীড়ন করতে তারা একে অপরকে সাহায্য এবং সমর্থন করছে।
উত্তর কোরিয়া গুপ্তহত্যায় উচ্চাভিলাষী হলেও ততটা চতুর নয়। ১৯৬৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক চুং–হিকে হত্যার উদ্দেশ্যে ‘ব্লু হাউসে’ ব্যর্থ হামলা চালায়। ১৯৯৭ সালে কিম জং ইলের ভাতিজা ই হান–ইয়ংকে হত্যার পেছনেও পিয়ংইয়ংকে দায়ী করা হয়।
২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সৎ ভাই কিম জং নাম কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মারাত্মক স্নায়ুগ্যাসে আক্রান্ত হন। ধারণা করা হয়, পিয়ংইয়ং এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে।
৯/১১ ও যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তহত্যার নতুন যুগ
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একবিংশ শতাব্দীতে সিআইএ এখন আর গুপ্তহত্যার অভিযানকে অগ্রাধিকার দেয় না। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আরও বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এখন গুপ্তহত্যার সংস্কৃতি আর নেই বলেই মনে হচ্ছে।
এখন স্নায়ুযুদ্ধ না থাকলেও অনেক কিছুই বদলেছে। ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা এবং ৯/১১ হামলা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সম্পূর্ণ নতুন যুগের সূচনা করেছে।
নাইন–ইলেভেনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ‘সমস্ত প্রয়োজনীয় এবং উপযুক্ত শক্তি’ ব্যবহারের জন্য মার্কিন কংগ্রেস ২০০১ সালে একটি তালিকা অনুমোদন করে। এরপর ২০১১ সালের অপারেশনে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা এবং ২০২০ সালে ড্রোন হামলায় ইরাকে ইরানের সামরিক কমান্ডার কাসেম সুলেইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র।
গুপ্তহত্যা এখন চলছে আকাশপথে, ফলে খুনিদের ঝুঁকি কমেছে। আইনে এখনো এসব হত্যাকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মার্কিন ড্রোন কর্মসূচির ফাঁস হওয়া নথিতে অনেক কিছু বেরিয়ে এসেছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার বিশ্লেষক ড্যানিয়েল হেল স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ইন্টারসেপ্টকে এসব নথি দেন। নথিতে দেখা যায়, মার্কিন সামরিক বাহিনী ২০১১ থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সোমালিয়া এবং ইয়েমেনে কমপক্ষে নয়জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে টার্গেট করেছে।
সামরিক অভিযানের আওতায় একই ধরনের ড্রোন কর্মসূচি সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়ায় সবচেয়ে বেশি মার্কিন ড্রোন হামলা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার দাবি করে, এসব আক্রমণ হত্যার উদ্দেশ্যে নয়, এগুলো সামরিক শক্তির বৈধ ব্যবহার, যা ২০০১ সালের কংগ্রেসে অনুমোদিত।
সবাইকে ছাড়িয়ে ইসরায়েল
তবে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির অজুহাতে সবচেয়ে বেশি গুপ্তহত্যা করেছে ইসরায়েল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইসরায়েল ফিলিস্তিনি নেতা এবং নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যা করেছে। কিন্তু ইসরায়েল সাধারণত বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের মাটিতে এসব করে না। তবে ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ মিউনিখ গেমসের সময় ইসরায়েলি অলিম্পিক দলের ওপর হামলা চালালে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
এরপরে একটি ইসরায়েলি গোষ্ঠী মিউনিখ হামলার সঙ্গে জড়িত প্রায় দুই ডজন ফিলিস্তিনি নেতাকে হত্যা বা হত্যার চেষ্টা করে বলে মনে করা হয়। ইউরোপের মাটিতে খুন না করার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ইসরায়েল ইতালি, ফ্রান্স, গ্রিস, সাইপ্রাস এবং অন্যান্য দেশে এসব হত্যাকাণ্ড চালায়।
ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন গোয়েন্দা ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট: দ্য সিক্রেট হিস্টরি অব ইসরায়েলস টার্গেটেড অ্যাসাসিনেশন’—এর লেখক রনেন বার্গম্যানকে বলেন, এসব খুনের ঘটনাগুলো ধোঁয়াশাপূর্ণ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। খুব কাছ থেকে গুপ্তহত্যা চালানো আসলেই ভয় উদ্রেককারী। ইসরায়েল এসবের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও, এটি সত্য যে, একজন ইসরায়েলিই সেই বন্দুকের ট্রিগার চেপেছে।
ইসরায়েলের নতুন গুপ্তহত্যা অভিযানের লক্ষ্য হয়েছে হামাস, হিজবুল্লাহ এবং ইরানের নেতারা। ২০০৪ সালে দেশটি হামাস নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে হত্যার জন্য একটি হেলিকপ্টার গানশিপ পাঠায় ইসরায়েল। এই অভিযানে নয়জন পথচারী নিহত হয়। এই হত্যাকাণ্ড জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়। যদিও এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়।
অতি সম্প্রতি, দখলদার দেশটি ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানীদের নির্মূল করার জন্য গুপ্তহত্যা পরিকল্পনাকে প্রসারিত করেছে, এমনকি যারা তেহরানের অস্ত্র কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে না তাঁদেরও হত্যা করেছে।
তবে ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট’ বইটিতে বার্গম্যান ইসরায়েলের টার্গেটেড কিলিং প্রোগ্রাম এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্যে একটি ফারাক দেখিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এখন যেসব কমান্ড–অ্যান্ড–কন্ট্রোল সিস্টেম, যুদ্ধকক্ষ, তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি এবং পাইলটবিহীন বিমান বা ড্রোন আমেরিকা এবং মিত্রদের সেবা দেয়; সবই ইসরায়েলে বিকশিত হয়েছে।’
বার্গম্যান অনুমান করেন, ২০০০–এর আগের দশকগুলোতে ইসরায়েল প্রায় ৫০০টি গুপ্তহত্যা করেছে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় নিয়ে বার্গম্যান লিখেছেন, এই সময় সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এরপর ২০১৮ পর্যন্ত কমপক্ষে আরও ৮০০টি অপারেশন হয়েছিল। সেই হাজার হাজার গুপ্তহত্যার অভিযানে টার্গেট ও অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, যুদ্ধোত্তর সময়ে ইসরায়েল আবারও এসব গুপ্তহত্যা কর্মসূচি বাড়াতে চায়। গাজার বাইরে হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে—সম্ভবত কাতার বা অন্য কোথাও।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্যালামার্ড বলেন, ‘আমরা তথাকথিত সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু করে হত্যা করা প্রায় স্বাভাবিক করে ফেলেছি। এটিকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে আংশিক ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছে। তবে কোনোভাবেই বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যাকে সমর্থন করা যায় না।’
গত ২ জানুয়ারি লেবাননের বৈরুত শহরতলিতে একটি হামাসের অফিসে ড্রোন হামলায় গোষ্ঠীটির সিনিয়র নেতা সালেহ আল–আরৌরি নিহত হন। ওই হামলায় হামাসের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।
গুপ্তহত্যার বিশ্বমঞ্চে পুতিন
বিশ্ব রাজনীতিতে আরেক যুগের সূচনা হয় ২০০০ সালে ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষমতায় আরোহণের মধ্যে দিয়ে। তাঁর নেতৃত্বে মস্কো বিদেশে নিজ দেশের নাগরিকদের হত্যার সোভিয়েত রীতি বজায় রেখেছে। তবে মস্কো যেসব অঞ্চলকে জাতিগত এবং ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার অংশ বলে মনে করে, এমন প্রতিবেশী দেশগুলোর নাগরিকদেরও টার্গেট করছে।
ইউক্রেনের ক্ষেত্রে পুতিনের কৌশলগুলো ক্রমশ নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। ২০০৬ সালে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ দিয়ে দলত্যাগী আলেক্সান্ডার লিৎভিনেঙ্কো এবং সাবেক ডবল এজেন্ট সের্গেই স্ক্রিপালের বিষক্রিয়া এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
কিন্তু রাশিয়া এটাও প্রমাণ করেছে যে, খুনের কালিমা থেকে রেহাই পাওয়া কতটা সহজ! স্ক্রিপালকে বিষ প্রয়োগের চেষ্টার ঘটনায় বেশ কিছু নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লেও ২০১৭ সালে বাজফিড নিউজের তদন্তে প্রকাশিত হয়েছে, পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গোপনে বিশ্বাস করেছিল, রাশিয়া অগণিত গুপ্তহত্যার জন্য দায়ী। কিন্তু যেসবের জন্য মস্কোকে সরাসরি অভিযুক্ত ও তিরস্কার করা হয়নি।
উন্নত গোয়েন্দা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে থাকলেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের জন্য গ্রেপ্তার তেমন নেই। সন্দেহ রয়েছে, এই দেশগুলো পশ্চিমা তদন্তকারীদের এড়াতে কৌশল এবং তথ্য বিনিময় করছে।
গুপ্তহত্যায় সৌদি আরব ও পাকিস্তান
এমনকি যে রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক খ্যাতি রক্ষা করতে চায় তাদের বিরুদ্ধেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। সৌদি রাজপরিবারের সমালোচক ব্লগার জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডের পেছনে রিয়াদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সিআইএ ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে খাশোগি হত্যার জন্য সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে ১৫ জনের হিট স্কোয়াডকে দায়ী করেছে। এরপরেও এখনো ট্রাম্প নির্বিকার স্বরে বলেন, ‘হয়তো তিনি করেছেন, হয়তো করেননি।’
বিচারবহির্ভূত বা নির্বিচারে মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে জাতিসংঘের তৎকালীন বিশেষ র্যাপোর্টার ক্যালামার্ড সৌদি আরবকে জবাবদিহি করতে বিশ্বের ব্যর্থতার নিন্দা জানিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর ও রিপোর্টের চার বছর পর ক্যালামার্ড বলেন, সামান্য পরিবর্তন হয়েছে এবং তবে বিচারের পথ সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধই রয়েছে।
পাকিস্তানও এই কাণ্ডে সমানভাবে দায়ী হতে পারে। দরিদ্র পাকিস্তানি প্রদেশ বেলুচিস্তানের একজন মানবাধিকার আইনজীবী কারিমা বালুচকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে টরন্টোতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কানাডার পুলিশ বলেছে, পাকিস্তানের যোগসাজশের কোনো প্রমাণ নেই, তবে তাঁর পরিবার আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের দাবি করেছে। এ ছাড়া আইনজীবীরা কয়েক মাস আগে সুইডেনে নির্বাসিত পাকিস্তানি সাজিদ হোসেনের মৃত্যুর সঙ্গে আগের ঘটনার মিল আছে বলে দাবি করেছেন।
গুপ্তহত্যা ক্লাবের নতুন মুখ ভারত
বিচার প্রক্রিয়ার অভাবে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা রক্ষার হর্তাকর্তারা বৈদেশিক নীতিকে এগিয়ে নিতে গুপ্তহত্যা অব্যাহত রেখেছে। হত্যাকারী দেশগুলোর ক্লাবে নতুন সদস্য যোগ হচ্ছে। সেই ক্লাবে ভারতকে নতুন সদস্য বলে মনে হচ্ছে। কানাডায় নিজ্জার হত্যা এবং নিউইয়র্কে পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা ছাড়াও পাকিস্তানি গোয়েন্দারা বিশ্বাস করেন, ইন্টারসেপ্টের প্রাপ্ত নথি অনুসারে, ভারত অন্তত দুই পাকিস্তানি বাসিন্দাকে টার্গেট করেছে। একটি পৃথক ভারতীয় মেমো বলছে, কথিত রয়েছে, পশ্চিমে ভারতীয় কনস্যুলেটগুলো এই ‘অত্যাধুনিক ক্র্যাকডাউন স্কিম’ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে।
এদিকে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে এমন প্রাণঘাতী দমন-পীড়নের কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশে দেশটির সমালোচকদের ওপর নজরদারি ও চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বাড়িয়েছে।
সমাধান মিলবে কি?
ক্যালামার্ড বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা এমন একটি আন্তর্জাতিক সন্ধিক্ষণে রয়েছি; যেখানে কোনো দেশ বা সরকারের ভাবমূর্তি ও প্রচারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই সরকারগুলো তার প্রতি একেবারেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে।’
ক্যালামার্ড নিজের প্রতিবেদনে জাতিসংঘকে ‘টার্গেটেড কিলিংয়ের’ সমীক্ষা করার জন্য একটি বিশেষ তদন্ত দল করার আহ্বান জানিয়েছেন, যারা রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের খুঁটিনাটি তদন্ত করবে। তিনি জোর দিয়েছিলেন যে, ‘আমরা এখনো এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত নই এবং কারা এসব করে তার সম্পূর্ণ সন্দেহভাজন তালিকাও আমাদের কাছে নেই।’
ক্যালামার্ড মার্কিন সাময়িকী ফরেন পলিসিকে বলেন, ‘আমি মনে করি, একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বা কমিটি থাকা উচিত, যারা এসব মামলার তদন্ত করবে। এটি গঠিত হলে খুব শক্তিশালী বার্তা যাবে যে, এসব আর সহ্য করা হবে না।’
ক্যালামার্ড ফরেন পলিসিকে আরও বলেন, ‘আমি তখন যে পয়েন্টটি তৈরি করছিলাম এবং এখনো চালিয়ে যাচ্ছি তা হলো—নির্দিষ্ট ঘটনা তদন্তের জন্য আমাদের ক্ষমতার প্রয়োগ পুঙ্খানুপুঙ্খ করা। যা এসব ঘটনা রোধ করবে এবং আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।’
তবে এসব সুপারিশ এখনো উপেক্ষিত। আশ্চর্যের কিছু নেই, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্তত দুটি রাষ্ট্র তাঁদের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে নিয়মিত গুপ্তহত্যা করে যাচ্ছে। বিশ্ব এখনো দায়সারাভাবেই গুপ্তহত্যা মোকাবিলার চেষ্টা করে। অনেক সময় ঘাতকদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা হলেও মূল হোতা দেশ বা সংস্থা দায় এড়ায়।
ক্যালামার্ড বলেন, দেশগুলো দ্বিপক্ষীয় বা কূটনৈতিক স্তরে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু এটি আন্তর্জাতিক আইন পরিচালনার কোনো উপায় নয়। বিশ্ব গুপ্তহত্যা ঠেকানো থেকে আরও দূরে চলে গেছে এবং বিশ্বজুড়ে সীমাহীন যুদ্ধের এক স্বাভাবিকতা এনে দিয়েছে।
হিট স্কোয়াড, বিষযুক্ত টুথপেস্ট বা সশস্ত্র ড্রোন যাই হোক না কেন, বিদেশের মাটিতে হত্যাকাণ্ড নিরাপত্তা নীতি, ভূ–রাজনীতি এবং অভ্যন্তরীণ ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ভিন্নমতাবলম্বী, সাংবাদিক এবং উদ্বাস্তুরা এই বাস্তবতার শিকার সবচেয়ে বেশি—সম্ভবত জঙ্গি ও রাজনৈতিক নেতাদের চেয়েও।
ক্যালামার্ড যুক্তি দেন, এই ধরনের হত্যা বিশ্বকে নিরাপদ করা তো দূরের কথা, বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তাহীনতা তৈরি ছাড়া আর কিছুই করে না। আর এমন পরিস্থিতি তৈরিতে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের মতো দেশগুলো।
ক্যালামার্ড বলেন, ‘গত ২০ বছরে সন্ত্রাসবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে অসংখ্য আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ঘটনা যে “ন্যায্যতা” এনেছে তা সত্যিই নিন্দনীয়। শুধু তাই নয়, দৃঢ় কণ্ঠে এসব ঘটনার নিন্দা করার ক্ষমতাকেও ব্যাপকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে।’
ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ করেছেন আবদুল বাছেদ

গত বছরের জুনে নিখিল গুপ্ত নিজের মোবাইল ফোন থেকে তাঁর এক পরিচিতজনকে একটি ভিডিও পাঠান। কানাডায় শিখদের প্রার্থনাগৃহ গুরুদুয়ারার বাইরে এক ব্যক্তিকে পরপর ৩৪টি গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি একটি গাড়ির পাশে ঢলে পড়েন। এই ঘটনারই ভিডিও সেটি।
নিহত ওই ব্যক্তি হরদীপ সিং নিজ্জার। কানাডা পুলিশ বলছে, নিখিলের বেশ কয়েকজন টার্গেটের মধ্যে হরদীপ একজন। কারণ নিখিল তাঁর সেই পরিচিতজনকে লিখেছিলেন, ‘আমাদের অনেক টার্গেট রয়েছে।’
মার্কিন কৌঁসুলিদের মতে, নিখিল নিউইয়র্কভিত্তিক আইনজীবী এবং শিখস ফর জাস্টিস সংগঠনের নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে মার্কিন গোয়েন্দাদের তৎপরতায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীরা বিশ্বাস করেন, শিখস ফর জাস্টিসের দুই নেতা পান্নুন এবং নিজ্জার স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সপক্ষে বৈশ্বিক গণভোট আয়োজনে কাজ করছিলেন। এ কারণেই তাঁদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, এই গণভোটের মাধ্যমে পাঞ্জাবকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় চাপ সৃষ্টি করা।
কানাডা এখনো নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে না পারলেও, নিখিলকে গত জুনে চেক প্রজাতন্ত্র থেকে গ্রেপ্তার করে যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্কে দাখিল করা একটি অভিযোগে বলা হয়েছে, নিখিল পান্নুনকে হত্যার জন্য ভাড়াটে খুনি নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু চালচক্রে ভাড়াটে খুনি খুঁজতে গিয়ে মার্কিন পুলিশেরই এক সোর্সকে ১ লাখ ডলার দিয়েছিলেন তিনি।
এই অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে ভারত এমন একটি ক্লাবের সদস্য হয়ে উঠবে যারা আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে গুপ্তহত্যা করে। এর মধ্য দিয়ে ফের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শুরুর ইঙ্গিত মিলছে, যে চর্চাটি দীর্ঘকাল ধরে শুধু বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যেই ছিল।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে বিরোধীদের গুপ্তহত্যার অভিযোগ রয়েছে। বিদেশের মাটিতে ভারত সরকারের গুপ্তহত্যার লক্ষ্য পাকিস্তান অনেক আগে থেকেই ছিল। সম্প্রতি শিখ নেতা নিজ্জার হত্যার ঘটনার পর ভারতের বিরুদ্ধে সেই সন্দেহ আরও গভীর হয়েছে।
বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যার রেকর্ড সবচেয়ে বেশি ইসরায়েলের। হামাসের সিনিয়র নেতাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে দেশটি গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা নতুন করে সাজাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এরই মধ্যেই হামাসের অন্তত তিনজন সিনিয়র নেতাকে গুপ্তহত্যা করেছে ইসরায়েল।
মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকলে, কোনো নিন্দা না হলে, বিচার না হলে এটি বাড়বে। এগুলো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা ও স্থায়ীকরণের উপাদান।’
সৌদি আরবের গুপ্তহত্যার তদন্তকারী কমিটির নেতৃত্বদানকারী ক্যালামার্ড বলেন, ‘বিদেশের মাটিতে লক্ষ্যবস্তু করা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো আমাদের আরও খারাপ দুনিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে; এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
আন্তর্জাতিক আইনে বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা নিঃসন্দেহে বেআইনি। আর কূটনৈতিক কনভেনশন অনুযায়ী এটি আরও বড় অপরাধ, যা যুদ্ধের সমতুল্য।
এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পরিণতি নিয়ে ভয় এবং আন্তর্জাতিক সুযোগ–সুবিধা সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে বিংশ শতকের বেশির ভাগ সময় বেশির ভাগ দেশ গুপ্তহত্যা থেকে বিরত ছিল। এরপরও যেসব দেশ জড়িয়েছে, তারা অভ্যন্তরীণ আইন মেনে কাকে, কখন, কোথায় এবং কীভাবে হত্যা করতে হবে তা নির্ধারণ করেছে।
গুপ্তহত্যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র
স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিশ্বের দুটি পরাশক্তি গুপ্তহত্যায় জড়িয়েছিল, যদিও খুবই ভিন্ন উদ্দেশ্যে। ১৯৬৪ সালের সিআইএ মেমো রিপোর্ট বলছে, সোভিয়েতরা গুপ্তহত্যার টার্গেট করত কেবল সেই ব্যক্তিদের যারা কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার জন্য বিপজ্জনক এবং যাদের কোনোভাবেই অপহরণ করা যায় না।
সাধারণভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তহত্যা নিজ দেশের সেসব নাগরিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যারা বিদেশ থেকে সোভিয়েত শাসনের সমালোচনা করছিল। ১৯৪০ সালে মেক্সিকো সিটির একটি বাড়িতে লিওন ট্রটস্কিকে বরফ ভাঙার সুচ দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এভাবে ক্রেমলিনের শত্রুদের দেশে এবং বিদেশের মাটিতে অপহরণ বা হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতিক্রমও করেছে: জার্মান আইনজীবী ওয়াল্টার লিন্সকে মার্কিন–অধিকৃত বার্লিন থেকে অপহরণ এবং ১৯৫৩ সালে হত্যা করা হয়েছিল।
আমেরিকার বিশ্ব নেতাদের খুনের তালিকায় রাখার প্রবণতা রয়েছে। ২০০৭ সালে সিআইএর কুখ্যাত গুপ্তহত্যার তথ্য ফাঁস হয়, এই নথি ‘ফ্যামিলি জুয়েলস’ নামে বিখ্যাত। সেখানে দেখা যায়, বিদেশি কমিউনিস্ট নেতাদের হত্যার লক্ষ্যবস্তু করেছে সিআইএ। এর মধ্যে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার অসংখ্য পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া সিআইএর হত্যার তালিকায় ছিলেন দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট এনগো দিন দিম এবং কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা। তবে সিআইএ তাঁদের হত্যা করার আগেই মার্কিন সমর্থিত অভ্যুত্থানে তাঁরা নিহত হন। এসব হত্যাকাণ্ডের গোপন নথি প্রকাশ পেলে মার্কিন সিনেটে ‘চার্চ কমিটি’ নামে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়।
তদন্ত শেষে কমিটি জানায়, যুদ্ধের অংশ হিসেবে হলেও ‘গুপ্তহত্যা’ আমেরিকান নীতি, আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা এবং নৈতিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বৈদেশিক নীতির হাতিয়ার এটি হতে পারে না, একে প্রত্যাখ্যান করা উচিত।
এরপর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড ১৯৭৬ সালে একটি নির্বাহী আদেশে বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে সম্মত হন এবং আইন পাস করেন।
গুপ্তহত্যায় ইরান ও উত্তর কোরিয়া
গুপ্তহত্যার বেশির ভাগই করেছে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো। ব্যতিক্রম হিসেবে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে বিদেশের মাটিতে প্রায় দুই ডজন গুপ্তহত্যার পেছনে ইরানকে দায়ী করা হয়। এসবের কিছু ফলও ভোগ করতে হয়েছে তেহরানকে।
১৯৮০ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাপুর বখতিয়ারকে হত্যাচেষ্টার জন্য গ্রেপ্তার হওয়া ইরানের একটি হিট স্কোয়াডকে ক্ষমা করে দেয় ফ্রান্স। ইরান এক দশক পরে প্যারিসে বখতিয়ারকে শেষমেশ হত্যা করেই ছাড়ে।
নিউইয়র্ক সিটিতে নির্বাসিত ইরানি ভিন্নমতাবলম্বী মাসিহ আলিনেজাদ অন্তত দুটি হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন। মার্কিন কর্তৃপক্ষের মতে, ইরানের ভাড়াটে বন্দুকধারীরা ২০২১ সালে তাঁকে আটক করে ইরানে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পুলিশ তা ব্যর্থ করে দেয়। ২০২২ সালে এই লেখককে হত্যার উদ্দেশ্যে আরেকটি দল পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এবারও তারা পুলিশের হাতে আটক হয়।
গত বছরের হ্যালিফ্যাক্স আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ফোরামে আলিনেজাদ বলেন, যে লোকটিকে আসলে ব্রুকলিনে আমার বাড়ির সামনে থেকে একে–৪৭ বন্দুকসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তিনি আগে ইউরোপের একটি অপরাধী চক্রের অংশ ছিলেন। সুতরাং বাস্তবতা হলো—স্বৈরাচারীরা কেবল নিজ দেশের লোকদেরই নয়, সীমানার বাইরের লোকদেরও নিপীড়ন করতে তারা একে অপরকে সাহায্য এবং সমর্থন করছে।
উত্তর কোরিয়া গুপ্তহত্যায় উচ্চাভিলাষী হলেও ততটা চতুর নয়। ১৯৬৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক চুং–হিকে হত্যার উদ্দেশ্যে ‘ব্লু হাউসে’ ব্যর্থ হামলা চালায়। ১৯৯৭ সালে কিম জং ইলের ভাতিজা ই হান–ইয়ংকে হত্যার পেছনেও পিয়ংইয়ংকে দায়ী করা হয়।
২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সৎ ভাই কিম জং নাম কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মারাত্মক স্নায়ুগ্যাসে আক্রান্ত হন। ধারণা করা হয়, পিয়ংইয়ং এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে।
৯/১১ ও যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তহত্যার নতুন যুগ
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একবিংশ শতাব্দীতে সিআইএ এখন আর গুপ্তহত্যার অভিযানকে অগ্রাধিকার দেয় না। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আরও বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এখন গুপ্তহত্যার সংস্কৃতি আর নেই বলেই মনে হচ্ছে।
এখন স্নায়ুযুদ্ধ না থাকলেও অনেক কিছুই বদলেছে। ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা এবং ৯/১১ হামলা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সম্পূর্ণ নতুন যুগের সূচনা করেছে।
নাইন–ইলেভেনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ‘সমস্ত প্রয়োজনীয় এবং উপযুক্ত শক্তি’ ব্যবহারের জন্য মার্কিন কংগ্রেস ২০০১ সালে একটি তালিকা অনুমোদন করে। এরপর ২০১১ সালের অপারেশনে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা এবং ২০২০ সালে ড্রোন হামলায় ইরাকে ইরানের সামরিক কমান্ডার কাসেম সুলেইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র।
গুপ্তহত্যা এখন চলছে আকাশপথে, ফলে খুনিদের ঝুঁকি কমেছে। আইনে এখনো এসব হত্যাকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মার্কিন ড্রোন কর্মসূচির ফাঁস হওয়া নথিতে অনেক কিছু বেরিয়ে এসেছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার বিশ্লেষক ড্যানিয়েল হেল স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ইন্টারসেপ্টকে এসব নথি দেন। নথিতে দেখা যায়, মার্কিন সামরিক বাহিনী ২০১১ থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সোমালিয়া এবং ইয়েমেনে কমপক্ষে নয়জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে টার্গেট করেছে।
সামরিক অভিযানের আওতায় একই ধরনের ড্রোন কর্মসূচি সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়ায় সবচেয়ে বেশি মার্কিন ড্রোন হামলা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার দাবি করে, এসব আক্রমণ হত্যার উদ্দেশ্যে নয়, এগুলো সামরিক শক্তির বৈধ ব্যবহার, যা ২০০১ সালের কংগ্রেসে অনুমোদিত।
সবাইকে ছাড়িয়ে ইসরায়েল
তবে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির অজুহাতে সবচেয়ে বেশি গুপ্তহত্যা করেছে ইসরায়েল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইসরায়েল ফিলিস্তিনি নেতা এবং নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যা করেছে। কিন্তু ইসরায়েল সাধারণত বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের মাটিতে এসব করে না। তবে ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ মিউনিখ গেমসের সময় ইসরায়েলি অলিম্পিক দলের ওপর হামলা চালালে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
এরপরে একটি ইসরায়েলি গোষ্ঠী মিউনিখ হামলার সঙ্গে জড়িত প্রায় দুই ডজন ফিলিস্তিনি নেতাকে হত্যা বা হত্যার চেষ্টা করে বলে মনে করা হয়। ইউরোপের মাটিতে খুন না করার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ইসরায়েল ইতালি, ফ্রান্স, গ্রিস, সাইপ্রাস এবং অন্যান্য দেশে এসব হত্যাকাণ্ড চালায়।
ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন গোয়েন্দা ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট: দ্য সিক্রেট হিস্টরি অব ইসরায়েলস টার্গেটেড অ্যাসাসিনেশন’—এর লেখক রনেন বার্গম্যানকে বলেন, এসব খুনের ঘটনাগুলো ধোঁয়াশাপূর্ণ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। খুব কাছ থেকে গুপ্তহত্যা চালানো আসলেই ভয় উদ্রেককারী। ইসরায়েল এসবের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও, এটি সত্য যে, একজন ইসরায়েলিই সেই বন্দুকের ট্রিগার চেপেছে।
ইসরায়েলের নতুন গুপ্তহত্যা অভিযানের লক্ষ্য হয়েছে হামাস, হিজবুল্লাহ এবং ইরানের নেতারা। ২০০৪ সালে দেশটি হামাস নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে হত্যার জন্য একটি হেলিকপ্টার গানশিপ পাঠায় ইসরায়েল। এই অভিযানে নয়জন পথচারী নিহত হয়। এই হত্যাকাণ্ড জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়। যদিও এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়।
অতি সম্প্রতি, দখলদার দেশটি ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানীদের নির্মূল করার জন্য গুপ্তহত্যা পরিকল্পনাকে প্রসারিত করেছে, এমনকি যারা তেহরানের অস্ত্র কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে না তাঁদেরও হত্যা করেছে।
তবে ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট’ বইটিতে বার্গম্যান ইসরায়েলের টার্গেটেড কিলিং প্রোগ্রাম এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্যে একটি ফারাক দেখিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এখন যেসব কমান্ড–অ্যান্ড–কন্ট্রোল সিস্টেম, যুদ্ধকক্ষ, তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি এবং পাইলটবিহীন বিমান বা ড্রোন আমেরিকা এবং মিত্রদের সেবা দেয়; সবই ইসরায়েলে বিকশিত হয়েছে।’
বার্গম্যান অনুমান করেন, ২০০০–এর আগের দশকগুলোতে ইসরায়েল প্রায় ৫০০টি গুপ্তহত্যা করেছে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় নিয়ে বার্গম্যান লিখেছেন, এই সময় সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এরপর ২০১৮ পর্যন্ত কমপক্ষে আরও ৮০০টি অপারেশন হয়েছিল। সেই হাজার হাজার গুপ্তহত্যার অভিযানে টার্গেট ও অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, যুদ্ধোত্তর সময়ে ইসরায়েল আবারও এসব গুপ্তহত্যা কর্মসূচি বাড়াতে চায়। গাজার বাইরে হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে—সম্ভবত কাতার বা অন্য কোথাও।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্যালামার্ড বলেন, ‘আমরা তথাকথিত সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু করে হত্যা করা প্রায় স্বাভাবিক করে ফেলেছি। এটিকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে আংশিক ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছে। তবে কোনোভাবেই বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যাকে সমর্থন করা যায় না।’
গত ২ জানুয়ারি লেবাননের বৈরুত শহরতলিতে একটি হামাসের অফিসে ড্রোন হামলায় গোষ্ঠীটির সিনিয়র নেতা সালেহ আল–আরৌরি নিহত হন। ওই হামলায় হামাসের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।
গুপ্তহত্যার বিশ্বমঞ্চে পুতিন
বিশ্ব রাজনীতিতে আরেক যুগের সূচনা হয় ২০০০ সালে ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষমতায় আরোহণের মধ্যে দিয়ে। তাঁর নেতৃত্বে মস্কো বিদেশে নিজ দেশের নাগরিকদের হত্যার সোভিয়েত রীতি বজায় রেখেছে। তবে মস্কো যেসব অঞ্চলকে জাতিগত এবং ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার অংশ বলে মনে করে, এমন প্রতিবেশী দেশগুলোর নাগরিকদেরও টার্গেট করছে।
ইউক্রেনের ক্ষেত্রে পুতিনের কৌশলগুলো ক্রমশ নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। ২০০৬ সালে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ দিয়ে দলত্যাগী আলেক্সান্ডার লিৎভিনেঙ্কো এবং সাবেক ডবল এজেন্ট সের্গেই স্ক্রিপালের বিষক্রিয়া এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
কিন্তু রাশিয়া এটাও প্রমাণ করেছে যে, খুনের কালিমা থেকে রেহাই পাওয়া কতটা সহজ! স্ক্রিপালকে বিষ প্রয়োগের চেষ্টার ঘটনায় বেশ কিছু নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লেও ২০১৭ সালে বাজফিড নিউজের তদন্তে প্রকাশিত হয়েছে, পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গোপনে বিশ্বাস করেছিল, রাশিয়া অগণিত গুপ্তহত্যার জন্য দায়ী। কিন্তু যেসবের জন্য মস্কোকে সরাসরি অভিযুক্ত ও তিরস্কার করা হয়নি।
উন্নত গোয়েন্দা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে থাকলেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের জন্য গ্রেপ্তার তেমন নেই। সন্দেহ রয়েছে, এই দেশগুলো পশ্চিমা তদন্তকারীদের এড়াতে কৌশল এবং তথ্য বিনিময় করছে।
গুপ্তহত্যায় সৌদি আরব ও পাকিস্তান
এমনকি যে রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক খ্যাতি রক্ষা করতে চায় তাদের বিরুদ্ধেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। সৌদি রাজপরিবারের সমালোচক ব্লগার জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডের পেছনে রিয়াদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সিআইএ ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে খাশোগি হত্যার জন্য সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে ১৫ জনের হিট স্কোয়াডকে দায়ী করেছে। এরপরেও এখনো ট্রাম্প নির্বিকার স্বরে বলেন, ‘হয়তো তিনি করেছেন, হয়তো করেননি।’
বিচারবহির্ভূত বা নির্বিচারে মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে জাতিসংঘের তৎকালীন বিশেষ র্যাপোর্টার ক্যালামার্ড সৌদি আরবকে জবাবদিহি করতে বিশ্বের ব্যর্থতার নিন্দা জানিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর ও রিপোর্টের চার বছর পর ক্যালামার্ড বলেন, সামান্য পরিবর্তন হয়েছে এবং তবে বিচারের পথ সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধই রয়েছে।
পাকিস্তানও এই কাণ্ডে সমানভাবে দায়ী হতে পারে। দরিদ্র পাকিস্তানি প্রদেশ বেলুচিস্তানের একজন মানবাধিকার আইনজীবী কারিমা বালুচকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে টরন্টোতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কানাডার পুলিশ বলেছে, পাকিস্তানের যোগসাজশের কোনো প্রমাণ নেই, তবে তাঁর পরিবার আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের দাবি করেছে। এ ছাড়া আইনজীবীরা কয়েক মাস আগে সুইডেনে নির্বাসিত পাকিস্তানি সাজিদ হোসেনের মৃত্যুর সঙ্গে আগের ঘটনার মিল আছে বলে দাবি করেছেন।
গুপ্তহত্যা ক্লাবের নতুন মুখ ভারত
বিচার প্রক্রিয়ার অভাবে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা রক্ষার হর্তাকর্তারা বৈদেশিক নীতিকে এগিয়ে নিতে গুপ্তহত্যা অব্যাহত রেখেছে। হত্যাকারী দেশগুলোর ক্লাবে নতুন সদস্য যোগ হচ্ছে। সেই ক্লাবে ভারতকে নতুন সদস্য বলে মনে হচ্ছে। কানাডায় নিজ্জার হত্যা এবং নিউইয়র্কে পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা ছাড়াও পাকিস্তানি গোয়েন্দারা বিশ্বাস করেন, ইন্টারসেপ্টের প্রাপ্ত নথি অনুসারে, ভারত অন্তত দুই পাকিস্তানি বাসিন্দাকে টার্গেট করেছে। একটি পৃথক ভারতীয় মেমো বলছে, কথিত রয়েছে, পশ্চিমে ভারতীয় কনস্যুলেটগুলো এই ‘অত্যাধুনিক ক্র্যাকডাউন স্কিম’ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে।
এদিকে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে এমন প্রাণঘাতী দমন-পীড়নের কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশে দেশটির সমালোচকদের ওপর নজরদারি ও চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বাড়িয়েছে।
সমাধান মিলবে কি?
ক্যালামার্ড বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা এমন একটি আন্তর্জাতিক সন্ধিক্ষণে রয়েছি; যেখানে কোনো দেশ বা সরকারের ভাবমূর্তি ও প্রচারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই সরকারগুলো তার প্রতি একেবারেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে।’
ক্যালামার্ড নিজের প্রতিবেদনে জাতিসংঘকে ‘টার্গেটেড কিলিংয়ের’ সমীক্ষা করার জন্য একটি বিশেষ তদন্ত দল করার আহ্বান জানিয়েছেন, যারা রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের খুঁটিনাটি তদন্ত করবে। তিনি জোর দিয়েছিলেন যে, ‘আমরা এখনো এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত নই এবং কারা এসব করে তার সম্পূর্ণ সন্দেহভাজন তালিকাও আমাদের কাছে নেই।’
ক্যালামার্ড মার্কিন সাময়িকী ফরেন পলিসিকে বলেন, ‘আমি মনে করি, একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বা কমিটি থাকা উচিত, যারা এসব মামলার তদন্ত করবে। এটি গঠিত হলে খুব শক্তিশালী বার্তা যাবে যে, এসব আর সহ্য করা হবে না।’
ক্যালামার্ড ফরেন পলিসিকে আরও বলেন, ‘আমি তখন যে পয়েন্টটি তৈরি করছিলাম এবং এখনো চালিয়ে যাচ্ছি তা হলো—নির্দিষ্ট ঘটনা তদন্তের জন্য আমাদের ক্ষমতার প্রয়োগ পুঙ্খানুপুঙ্খ করা। যা এসব ঘটনা রোধ করবে এবং আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।’
তবে এসব সুপারিশ এখনো উপেক্ষিত। আশ্চর্যের কিছু নেই, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্তত দুটি রাষ্ট্র তাঁদের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে নিয়মিত গুপ্তহত্যা করে যাচ্ছে। বিশ্ব এখনো দায়সারাভাবেই গুপ্তহত্যা মোকাবিলার চেষ্টা করে। অনেক সময় ঘাতকদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা হলেও মূল হোতা দেশ বা সংস্থা দায় এড়ায়।
ক্যালামার্ড বলেন, দেশগুলো দ্বিপক্ষীয় বা কূটনৈতিক স্তরে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু এটি আন্তর্জাতিক আইন পরিচালনার কোনো উপায় নয়। বিশ্ব গুপ্তহত্যা ঠেকানো থেকে আরও দূরে চলে গেছে এবং বিশ্বজুড়ে সীমাহীন যুদ্ধের এক স্বাভাবিকতা এনে দিয়েছে।
হিট স্কোয়াড, বিষযুক্ত টুথপেস্ট বা সশস্ত্র ড্রোন যাই হোক না কেন, বিদেশের মাটিতে হত্যাকাণ্ড নিরাপত্তা নীতি, ভূ–রাজনীতি এবং অভ্যন্তরীণ ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ভিন্নমতাবলম্বী, সাংবাদিক এবং উদ্বাস্তুরা এই বাস্তবতার শিকার সবচেয়ে বেশি—সম্ভবত জঙ্গি ও রাজনৈতিক নেতাদের চেয়েও।
ক্যালামার্ড যুক্তি দেন, এই ধরনের হত্যা বিশ্বকে নিরাপদ করা তো দূরের কথা, বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তাহীনতা তৈরি ছাড়া আর কিছুই করে না। আর এমন পরিস্থিতি তৈরিতে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের মতো দেশগুলো।
ক্যালামার্ড বলেন, ‘গত ২০ বছরে সন্ত্রাসবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে অসংখ্য আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ঘটনা যে “ন্যায্যতা” এনেছে তা সত্যিই নিন্দনীয়। শুধু তাই নয়, দৃঢ় কণ্ঠে এসব ঘটনার নিন্দা করার ক্ষমতাকেও ব্যাপকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে।’
ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ করেছেন আবদুল বাছেদ

গত বছরের জুনে নিখিল গুপ্ত নিজের মোবাইল ফোন থেকে তাঁর এক পরিচিতজনকে একটি ভিডিও পাঠান। কানাডায় শিখদের প্রার্থনাগৃহ গুরুদুয়ারার বাইরে এক ব্যক্তিকে পরপর ৩৪টি গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি একটি গাড়ির পাশে ঢলে পড়েন। এই ঘটনারই ভিডিও সেটি।
নিহত ওই ব্যক্তি হরদীপ সিং নিজ্জার। কানাডা পুলিশ বলছে, নিখিলের বেশ কয়েকজন টার্গেটের মধ্যে হরদীপ একজন। কারণ নিখিল তাঁর সেই পরিচিতজনকে লিখেছিলেন, ‘আমাদের অনেক টার্গেট রয়েছে।’
মার্কিন কৌঁসুলিদের মতে, নিখিল নিউইয়র্কভিত্তিক আইনজীবী এবং শিখস ফর জাস্টিস সংগঠনের নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে মার্কিন গোয়েন্দাদের তৎপরতায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীরা বিশ্বাস করেন, শিখস ফর জাস্টিসের দুই নেতা পান্নুন এবং নিজ্জার স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সপক্ষে বৈশ্বিক গণভোট আয়োজনে কাজ করছিলেন। এ কারণেই তাঁদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, এই গণভোটের মাধ্যমে পাঞ্জাবকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় চাপ সৃষ্টি করা।
কানাডা এখনো নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে না পারলেও, নিখিলকে গত জুনে চেক প্রজাতন্ত্র থেকে গ্রেপ্তার করে যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্কে দাখিল করা একটি অভিযোগে বলা হয়েছে, নিখিল পান্নুনকে হত্যার জন্য ভাড়াটে খুনি নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু চালচক্রে ভাড়াটে খুনি খুঁজতে গিয়ে মার্কিন পুলিশেরই এক সোর্সকে ১ লাখ ডলার দিয়েছিলেন তিনি।
এই অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে ভারত এমন একটি ক্লাবের সদস্য হয়ে উঠবে যারা আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে গুপ্তহত্যা করে। এর মধ্য দিয়ে ফের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শুরুর ইঙ্গিত মিলছে, যে চর্চাটি দীর্ঘকাল ধরে শুধু বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যেই ছিল।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে বিরোধীদের গুপ্তহত্যার অভিযোগ রয়েছে। বিদেশের মাটিতে ভারত সরকারের গুপ্তহত্যার লক্ষ্য পাকিস্তান অনেক আগে থেকেই ছিল। সম্প্রতি শিখ নেতা নিজ্জার হত্যার ঘটনার পর ভারতের বিরুদ্ধে সেই সন্দেহ আরও গভীর হয়েছে।
বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যার রেকর্ড সবচেয়ে বেশি ইসরায়েলের। হামাসের সিনিয়র নেতাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে দেশটি গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা নতুন করে সাজাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এরই মধ্যেই হামাসের অন্তত তিনজন সিনিয়র নেতাকে গুপ্তহত্যা করেছে ইসরায়েল।
মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকলে, কোনো নিন্দা না হলে, বিচার না হলে এটি বাড়বে। এগুলো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা ও স্থায়ীকরণের উপাদান।’
সৌদি আরবের গুপ্তহত্যার তদন্তকারী কমিটির নেতৃত্বদানকারী ক্যালামার্ড বলেন, ‘বিদেশের মাটিতে লক্ষ্যবস্তু করা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো আমাদের আরও খারাপ দুনিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে; এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
আন্তর্জাতিক আইনে বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা নিঃসন্দেহে বেআইনি। আর কূটনৈতিক কনভেনশন অনুযায়ী এটি আরও বড় অপরাধ, যা যুদ্ধের সমতুল্য।
এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পরিণতি নিয়ে ভয় এবং আন্তর্জাতিক সুযোগ–সুবিধা সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে বিংশ শতকের বেশির ভাগ সময় বেশির ভাগ দেশ গুপ্তহত্যা থেকে বিরত ছিল। এরপরও যেসব দেশ জড়িয়েছে, তারা অভ্যন্তরীণ আইন মেনে কাকে, কখন, কোথায় এবং কীভাবে হত্যা করতে হবে তা নির্ধারণ করেছে।
গুপ্তহত্যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র
স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিশ্বের দুটি পরাশক্তি গুপ্তহত্যায় জড়িয়েছিল, যদিও খুবই ভিন্ন উদ্দেশ্যে। ১৯৬৪ সালের সিআইএ মেমো রিপোর্ট বলছে, সোভিয়েতরা গুপ্তহত্যার টার্গেট করত কেবল সেই ব্যক্তিদের যারা কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার জন্য বিপজ্জনক এবং যাদের কোনোভাবেই অপহরণ করা যায় না।
সাধারণভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তহত্যা নিজ দেশের সেসব নাগরিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যারা বিদেশ থেকে সোভিয়েত শাসনের সমালোচনা করছিল। ১৯৪০ সালে মেক্সিকো সিটির একটি বাড়িতে লিওন ট্রটস্কিকে বরফ ভাঙার সুচ দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এভাবে ক্রেমলিনের শত্রুদের দেশে এবং বিদেশের মাটিতে অপহরণ বা হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতিক্রমও করেছে: জার্মান আইনজীবী ওয়াল্টার লিন্সকে মার্কিন–অধিকৃত বার্লিন থেকে অপহরণ এবং ১৯৫৩ সালে হত্যা করা হয়েছিল।
আমেরিকার বিশ্ব নেতাদের খুনের তালিকায় রাখার প্রবণতা রয়েছে। ২০০৭ সালে সিআইএর কুখ্যাত গুপ্তহত্যার তথ্য ফাঁস হয়, এই নথি ‘ফ্যামিলি জুয়েলস’ নামে বিখ্যাত। সেখানে দেখা যায়, বিদেশি কমিউনিস্ট নেতাদের হত্যার লক্ষ্যবস্তু করেছে সিআইএ। এর মধ্যে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার অসংখ্য পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া সিআইএর হত্যার তালিকায় ছিলেন দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট এনগো দিন দিম এবং কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা। তবে সিআইএ তাঁদের হত্যা করার আগেই মার্কিন সমর্থিত অভ্যুত্থানে তাঁরা নিহত হন। এসব হত্যাকাণ্ডের গোপন নথি প্রকাশ পেলে মার্কিন সিনেটে ‘চার্চ কমিটি’ নামে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়।
তদন্ত শেষে কমিটি জানায়, যুদ্ধের অংশ হিসেবে হলেও ‘গুপ্তহত্যা’ আমেরিকান নীতি, আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা এবং নৈতিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বৈদেশিক নীতির হাতিয়ার এটি হতে পারে না, একে প্রত্যাখ্যান করা উচিত।
এরপর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড ১৯৭৬ সালে একটি নির্বাহী আদেশে বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে সম্মত হন এবং আইন পাস করেন।
গুপ্তহত্যায় ইরান ও উত্তর কোরিয়া
গুপ্তহত্যার বেশির ভাগই করেছে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো। ব্যতিক্রম হিসেবে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে বিদেশের মাটিতে প্রায় দুই ডজন গুপ্তহত্যার পেছনে ইরানকে দায়ী করা হয়। এসবের কিছু ফলও ভোগ করতে হয়েছে তেহরানকে।
১৯৮০ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাপুর বখতিয়ারকে হত্যাচেষ্টার জন্য গ্রেপ্তার হওয়া ইরানের একটি হিট স্কোয়াডকে ক্ষমা করে দেয় ফ্রান্স। ইরান এক দশক পরে প্যারিসে বখতিয়ারকে শেষমেশ হত্যা করেই ছাড়ে।
নিউইয়র্ক সিটিতে নির্বাসিত ইরানি ভিন্নমতাবলম্বী মাসিহ আলিনেজাদ অন্তত দুটি হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন। মার্কিন কর্তৃপক্ষের মতে, ইরানের ভাড়াটে বন্দুকধারীরা ২০২১ সালে তাঁকে আটক করে ইরানে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পুলিশ তা ব্যর্থ করে দেয়। ২০২২ সালে এই লেখককে হত্যার উদ্দেশ্যে আরেকটি দল পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এবারও তারা পুলিশের হাতে আটক হয়।
গত বছরের হ্যালিফ্যাক্স আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ফোরামে আলিনেজাদ বলেন, যে লোকটিকে আসলে ব্রুকলিনে আমার বাড়ির সামনে থেকে একে–৪৭ বন্দুকসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তিনি আগে ইউরোপের একটি অপরাধী চক্রের অংশ ছিলেন। সুতরাং বাস্তবতা হলো—স্বৈরাচারীরা কেবল নিজ দেশের লোকদেরই নয়, সীমানার বাইরের লোকদেরও নিপীড়ন করতে তারা একে অপরকে সাহায্য এবং সমর্থন করছে।
উত্তর কোরিয়া গুপ্তহত্যায় উচ্চাভিলাষী হলেও ততটা চতুর নয়। ১৯৬৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক চুং–হিকে হত্যার উদ্দেশ্যে ‘ব্লু হাউসে’ ব্যর্থ হামলা চালায়। ১৯৯৭ সালে কিম জং ইলের ভাতিজা ই হান–ইয়ংকে হত্যার পেছনেও পিয়ংইয়ংকে দায়ী করা হয়।
২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সৎ ভাই কিম জং নাম কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মারাত্মক স্নায়ুগ্যাসে আক্রান্ত হন। ধারণা করা হয়, পিয়ংইয়ং এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে।
৯/১১ ও যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তহত্যার নতুন যুগ
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একবিংশ শতাব্দীতে সিআইএ এখন আর গুপ্তহত্যার অভিযানকে অগ্রাধিকার দেয় না। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আরও বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এখন গুপ্তহত্যার সংস্কৃতি আর নেই বলেই মনে হচ্ছে।
এখন স্নায়ুযুদ্ধ না থাকলেও অনেক কিছুই বদলেছে। ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা এবং ৯/১১ হামলা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সম্পূর্ণ নতুন যুগের সূচনা করেছে।
নাইন–ইলেভেনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ‘সমস্ত প্রয়োজনীয় এবং উপযুক্ত শক্তি’ ব্যবহারের জন্য মার্কিন কংগ্রেস ২০০১ সালে একটি তালিকা অনুমোদন করে। এরপর ২০১১ সালের অপারেশনে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা এবং ২০২০ সালে ড্রোন হামলায় ইরাকে ইরানের সামরিক কমান্ডার কাসেম সুলেইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র।
গুপ্তহত্যা এখন চলছে আকাশপথে, ফলে খুনিদের ঝুঁকি কমেছে। আইনে এখনো এসব হত্যাকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মার্কিন ড্রোন কর্মসূচির ফাঁস হওয়া নথিতে অনেক কিছু বেরিয়ে এসেছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার বিশ্লেষক ড্যানিয়েল হেল স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ইন্টারসেপ্টকে এসব নথি দেন। নথিতে দেখা যায়, মার্কিন সামরিক বাহিনী ২০১১ থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সোমালিয়া এবং ইয়েমেনে কমপক্ষে নয়জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে টার্গেট করেছে।
সামরিক অভিযানের আওতায় একই ধরনের ড্রোন কর্মসূচি সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়ায় সবচেয়ে বেশি মার্কিন ড্রোন হামলা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার দাবি করে, এসব আক্রমণ হত্যার উদ্দেশ্যে নয়, এগুলো সামরিক শক্তির বৈধ ব্যবহার, যা ২০০১ সালের কংগ্রেসে অনুমোদিত।
সবাইকে ছাড়িয়ে ইসরায়েল
তবে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির অজুহাতে সবচেয়ে বেশি গুপ্তহত্যা করেছে ইসরায়েল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইসরায়েল ফিলিস্তিনি নেতা এবং নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যা করেছে। কিন্তু ইসরায়েল সাধারণত বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের মাটিতে এসব করে না। তবে ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ মিউনিখ গেমসের সময় ইসরায়েলি অলিম্পিক দলের ওপর হামলা চালালে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
এরপরে একটি ইসরায়েলি গোষ্ঠী মিউনিখ হামলার সঙ্গে জড়িত প্রায় দুই ডজন ফিলিস্তিনি নেতাকে হত্যা বা হত্যার চেষ্টা করে বলে মনে করা হয়। ইউরোপের মাটিতে খুন না করার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ইসরায়েল ইতালি, ফ্রান্স, গ্রিস, সাইপ্রাস এবং অন্যান্য দেশে এসব হত্যাকাণ্ড চালায়।
ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন গোয়েন্দা ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট: দ্য সিক্রেট হিস্টরি অব ইসরায়েলস টার্গেটেড অ্যাসাসিনেশন’—এর লেখক রনেন বার্গম্যানকে বলেন, এসব খুনের ঘটনাগুলো ধোঁয়াশাপূর্ণ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। খুব কাছ থেকে গুপ্তহত্যা চালানো আসলেই ভয় উদ্রেককারী। ইসরায়েল এসবের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও, এটি সত্য যে, একজন ইসরায়েলিই সেই বন্দুকের ট্রিগার চেপেছে।
ইসরায়েলের নতুন গুপ্তহত্যা অভিযানের লক্ষ্য হয়েছে হামাস, হিজবুল্লাহ এবং ইরানের নেতারা। ২০০৪ সালে দেশটি হামাস নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে হত্যার জন্য একটি হেলিকপ্টার গানশিপ পাঠায় ইসরায়েল। এই অভিযানে নয়জন পথচারী নিহত হয়। এই হত্যাকাণ্ড জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়। যদিও এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়।
অতি সম্প্রতি, দখলদার দেশটি ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানীদের নির্মূল করার জন্য গুপ্তহত্যা পরিকল্পনাকে প্রসারিত করেছে, এমনকি যারা তেহরানের অস্ত্র কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে না তাঁদেরও হত্যা করেছে।
তবে ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট’ বইটিতে বার্গম্যান ইসরায়েলের টার্গেটেড কিলিং প্রোগ্রাম এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্যে একটি ফারাক দেখিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এখন যেসব কমান্ড–অ্যান্ড–কন্ট্রোল সিস্টেম, যুদ্ধকক্ষ, তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি এবং পাইলটবিহীন বিমান বা ড্রোন আমেরিকা এবং মিত্রদের সেবা দেয়; সবই ইসরায়েলে বিকশিত হয়েছে।’
বার্গম্যান অনুমান করেন, ২০০০–এর আগের দশকগুলোতে ইসরায়েল প্রায় ৫০০টি গুপ্তহত্যা করেছে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় নিয়ে বার্গম্যান লিখেছেন, এই সময় সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এরপর ২০১৮ পর্যন্ত কমপক্ষে আরও ৮০০টি অপারেশন হয়েছিল। সেই হাজার হাজার গুপ্তহত্যার অভিযানে টার্গেট ও অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, যুদ্ধোত্তর সময়ে ইসরায়েল আবারও এসব গুপ্তহত্যা কর্মসূচি বাড়াতে চায়। গাজার বাইরে হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে—সম্ভবত কাতার বা অন্য কোথাও।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্যালামার্ড বলেন, ‘আমরা তথাকথিত সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু করে হত্যা করা প্রায় স্বাভাবিক করে ফেলেছি। এটিকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে আংশিক ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছে। তবে কোনোভাবেই বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যাকে সমর্থন করা যায় না।’
গত ২ জানুয়ারি লেবাননের বৈরুত শহরতলিতে একটি হামাসের অফিসে ড্রোন হামলায় গোষ্ঠীটির সিনিয়র নেতা সালেহ আল–আরৌরি নিহত হন। ওই হামলায় হামাসের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।
গুপ্তহত্যার বিশ্বমঞ্চে পুতিন
বিশ্ব রাজনীতিতে আরেক যুগের সূচনা হয় ২০০০ সালে ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষমতায় আরোহণের মধ্যে দিয়ে। তাঁর নেতৃত্বে মস্কো বিদেশে নিজ দেশের নাগরিকদের হত্যার সোভিয়েত রীতি বজায় রেখেছে। তবে মস্কো যেসব অঞ্চলকে জাতিগত এবং ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার অংশ বলে মনে করে, এমন প্রতিবেশী দেশগুলোর নাগরিকদেরও টার্গেট করছে।
ইউক্রেনের ক্ষেত্রে পুতিনের কৌশলগুলো ক্রমশ নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। ২০০৬ সালে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ দিয়ে দলত্যাগী আলেক্সান্ডার লিৎভিনেঙ্কো এবং সাবেক ডবল এজেন্ট সের্গেই স্ক্রিপালের বিষক্রিয়া এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
কিন্তু রাশিয়া এটাও প্রমাণ করেছে যে, খুনের কালিমা থেকে রেহাই পাওয়া কতটা সহজ! স্ক্রিপালকে বিষ প্রয়োগের চেষ্টার ঘটনায় বেশ কিছু নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লেও ২০১৭ সালে বাজফিড নিউজের তদন্তে প্রকাশিত হয়েছে, পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গোপনে বিশ্বাস করেছিল, রাশিয়া অগণিত গুপ্তহত্যার জন্য দায়ী। কিন্তু যেসবের জন্য মস্কোকে সরাসরি অভিযুক্ত ও তিরস্কার করা হয়নি।
উন্নত গোয়েন্দা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে থাকলেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের জন্য গ্রেপ্তার তেমন নেই। সন্দেহ রয়েছে, এই দেশগুলো পশ্চিমা তদন্তকারীদের এড়াতে কৌশল এবং তথ্য বিনিময় করছে।
গুপ্তহত্যায় সৌদি আরব ও পাকিস্তান
এমনকি যে রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক খ্যাতি রক্ষা করতে চায় তাদের বিরুদ্ধেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। সৌদি রাজপরিবারের সমালোচক ব্লগার জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডের পেছনে রিয়াদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সিআইএ ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে খাশোগি হত্যার জন্য সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে ১৫ জনের হিট স্কোয়াডকে দায়ী করেছে। এরপরেও এখনো ট্রাম্প নির্বিকার স্বরে বলেন, ‘হয়তো তিনি করেছেন, হয়তো করেননি।’
বিচারবহির্ভূত বা নির্বিচারে মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে জাতিসংঘের তৎকালীন বিশেষ র্যাপোর্টার ক্যালামার্ড সৌদি আরবকে জবাবদিহি করতে বিশ্বের ব্যর্থতার নিন্দা জানিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর ও রিপোর্টের চার বছর পর ক্যালামার্ড বলেন, সামান্য পরিবর্তন হয়েছে এবং তবে বিচারের পথ সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধই রয়েছে।
পাকিস্তানও এই কাণ্ডে সমানভাবে দায়ী হতে পারে। দরিদ্র পাকিস্তানি প্রদেশ বেলুচিস্তানের একজন মানবাধিকার আইনজীবী কারিমা বালুচকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে টরন্টোতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কানাডার পুলিশ বলেছে, পাকিস্তানের যোগসাজশের কোনো প্রমাণ নেই, তবে তাঁর পরিবার আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের দাবি করেছে। এ ছাড়া আইনজীবীরা কয়েক মাস আগে সুইডেনে নির্বাসিত পাকিস্তানি সাজিদ হোসেনের মৃত্যুর সঙ্গে আগের ঘটনার মিল আছে বলে দাবি করেছেন।
গুপ্তহত্যা ক্লাবের নতুন মুখ ভারত
বিচার প্রক্রিয়ার অভাবে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা রক্ষার হর্তাকর্তারা বৈদেশিক নীতিকে এগিয়ে নিতে গুপ্তহত্যা অব্যাহত রেখেছে। হত্যাকারী দেশগুলোর ক্লাবে নতুন সদস্য যোগ হচ্ছে। সেই ক্লাবে ভারতকে নতুন সদস্য বলে মনে হচ্ছে। কানাডায় নিজ্জার হত্যা এবং নিউইয়র্কে পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা ছাড়াও পাকিস্তানি গোয়েন্দারা বিশ্বাস করেন, ইন্টারসেপ্টের প্রাপ্ত নথি অনুসারে, ভারত অন্তত দুই পাকিস্তানি বাসিন্দাকে টার্গেট করেছে। একটি পৃথক ভারতীয় মেমো বলছে, কথিত রয়েছে, পশ্চিমে ভারতীয় কনস্যুলেটগুলো এই ‘অত্যাধুনিক ক্র্যাকডাউন স্কিম’ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে।
এদিকে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে এমন প্রাণঘাতী দমন-পীড়নের কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশে দেশটির সমালোচকদের ওপর নজরদারি ও চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বাড়িয়েছে।
সমাধান মিলবে কি?
ক্যালামার্ড বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা এমন একটি আন্তর্জাতিক সন্ধিক্ষণে রয়েছি; যেখানে কোনো দেশ বা সরকারের ভাবমূর্তি ও প্রচারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই সরকারগুলো তার প্রতি একেবারেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে।’
ক্যালামার্ড নিজের প্রতিবেদনে জাতিসংঘকে ‘টার্গেটেড কিলিংয়ের’ সমীক্ষা করার জন্য একটি বিশেষ তদন্ত দল করার আহ্বান জানিয়েছেন, যারা রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের খুঁটিনাটি তদন্ত করবে। তিনি জোর দিয়েছিলেন যে, ‘আমরা এখনো এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত নই এবং কারা এসব করে তার সম্পূর্ণ সন্দেহভাজন তালিকাও আমাদের কাছে নেই।’
ক্যালামার্ড মার্কিন সাময়িকী ফরেন পলিসিকে বলেন, ‘আমি মনে করি, একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বা কমিটি থাকা উচিত, যারা এসব মামলার তদন্ত করবে। এটি গঠিত হলে খুব শক্তিশালী বার্তা যাবে যে, এসব আর সহ্য করা হবে না।’
ক্যালামার্ড ফরেন পলিসিকে আরও বলেন, ‘আমি তখন যে পয়েন্টটি তৈরি করছিলাম এবং এখনো চালিয়ে যাচ্ছি তা হলো—নির্দিষ্ট ঘটনা তদন্তের জন্য আমাদের ক্ষমতার প্রয়োগ পুঙ্খানুপুঙ্খ করা। যা এসব ঘটনা রোধ করবে এবং আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।’
তবে এসব সুপারিশ এখনো উপেক্ষিত। আশ্চর্যের কিছু নেই, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্তত দুটি রাষ্ট্র তাঁদের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে নিয়মিত গুপ্তহত্যা করে যাচ্ছে। বিশ্ব এখনো দায়সারাভাবেই গুপ্তহত্যা মোকাবিলার চেষ্টা করে। অনেক সময় ঘাতকদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা হলেও মূল হোতা দেশ বা সংস্থা দায় এড়ায়।
ক্যালামার্ড বলেন, দেশগুলো দ্বিপক্ষীয় বা কূটনৈতিক স্তরে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু এটি আন্তর্জাতিক আইন পরিচালনার কোনো উপায় নয়। বিশ্ব গুপ্তহত্যা ঠেকানো থেকে আরও দূরে চলে গেছে এবং বিশ্বজুড়ে সীমাহীন যুদ্ধের এক স্বাভাবিকতা এনে দিয়েছে।
হিট স্কোয়াড, বিষযুক্ত টুথপেস্ট বা সশস্ত্র ড্রোন যাই হোক না কেন, বিদেশের মাটিতে হত্যাকাণ্ড নিরাপত্তা নীতি, ভূ–রাজনীতি এবং অভ্যন্তরীণ ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ভিন্নমতাবলম্বী, সাংবাদিক এবং উদ্বাস্তুরা এই বাস্তবতার শিকার সবচেয়ে বেশি—সম্ভবত জঙ্গি ও রাজনৈতিক নেতাদের চেয়েও।
ক্যালামার্ড যুক্তি দেন, এই ধরনের হত্যা বিশ্বকে নিরাপদ করা তো দূরের কথা, বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তাহীনতা তৈরি ছাড়া আর কিছুই করে না। আর এমন পরিস্থিতি তৈরিতে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের মতো দেশগুলো।
ক্যালামার্ড বলেন, ‘গত ২০ বছরে সন্ত্রাসবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে অসংখ্য আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ঘটনা যে “ন্যায্যতা” এনেছে তা সত্যিই নিন্দনীয়। শুধু তাই নয়, দৃঢ় কণ্ঠে এসব ঘটনার নিন্দা করার ক্ষমতাকেও ব্যাপকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে।’
ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ করেছেন আবদুল বাছেদ

গত বছরের জুনে নিখিল গুপ্ত নিজের মোবাইল ফোন থেকে তাঁর এক পরিচিতজনকে একটি ভিডিও পাঠান। কানাডায় শিখদের প্রার্থনাগৃহ গুরুদুয়ারার বাইরে এক ব্যক্তিকে পরপর ৩৪টি গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি একটি গাড়ির পাশে ঢলে পড়েন। এই ঘটনারই ভিডিও সেটি।
নিহত ওই ব্যক্তি হরদীপ সিং নিজ্জার। কানাডা পুলিশ বলছে, নিখিলের বেশ কয়েকজন টার্গেটের মধ্যে হরদীপ একজন। কারণ নিখিল তাঁর সেই পরিচিতজনকে লিখেছিলেন, ‘আমাদের অনেক টার্গেট রয়েছে।’
মার্কিন কৌঁসুলিদের মতে, নিখিল নিউইয়র্কভিত্তিক আইনজীবী এবং শিখস ফর জাস্টিস সংগঠনের নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে মার্কিন গোয়েন্দাদের তৎপরতায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীরা বিশ্বাস করেন, শিখস ফর জাস্টিসের দুই নেতা পান্নুন এবং নিজ্জার স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সপক্ষে বৈশ্বিক গণভোট আয়োজনে কাজ করছিলেন। এ কারণেই তাঁদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, এই গণভোটের মাধ্যমে পাঞ্জাবকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় চাপ সৃষ্টি করা।
কানাডা এখনো নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে না পারলেও, নিখিলকে গত জুনে চেক প্রজাতন্ত্র থেকে গ্রেপ্তার করে যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্কে দাখিল করা একটি অভিযোগে বলা হয়েছে, নিখিল পান্নুনকে হত্যার জন্য ভাড়াটে খুনি নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু চালচক্রে ভাড়াটে খুনি খুঁজতে গিয়ে মার্কিন পুলিশেরই এক সোর্সকে ১ লাখ ডলার দিয়েছিলেন তিনি।
এই অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে ভারত এমন একটি ক্লাবের সদস্য হয়ে উঠবে যারা আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে গুপ্তহত্যা করে। এর মধ্য দিয়ে ফের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শুরুর ইঙ্গিত মিলছে, যে চর্চাটি দীর্ঘকাল ধরে শুধু বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যেই ছিল।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে বিরোধীদের গুপ্তহত্যার অভিযোগ রয়েছে। বিদেশের মাটিতে ভারত সরকারের গুপ্তহত্যার লক্ষ্য পাকিস্তান অনেক আগে থেকেই ছিল। সম্প্রতি শিখ নেতা নিজ্জার হত্যার ঘটনার পর ভারতের বিরুদ্ধে সেই সন্দেহ আরও গভীর হয়েছে।
বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যার রেকর্ড সবচেয়ে বেশি ইসরায়েলের। হামাসের সিনিয়র নেতাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে দেশটি গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা নতুন করে সাজাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এরই মধ্যেই হামাসের অন্তত তিনজন সিনিয়র নেতাকে গুপ্তহত্যা করেছে ইসরায়েল।
মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকলে, কোনো নিন্দা না হলে, বিচার না হলে এটি বাড়বে। এগুলো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা ও স্থায়ীকরণের উপাদান।’
সৌদি আরবের গুপ্তহত্যার তদন্তকারী কমিটির নেতৃত্বদানকারী ক্যালামার্ড বলেন, ‘বিদেশের মাটিতে লক্ষ্যবস্তু করা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো আমাদের আরও খারাপ দুনিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে; এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
আন্তর্জাতিক আইনে বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা নিঃসন্দেহে বেআইনি। আর কূটনৈতিক কনভেনশন অনুযায়ী এটি আরও বড় অপরাধ, যা যুদ্ধের সমতুল্য।
এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পরিণতি নিয়ে ভয় এবং আন্তর্জাতিক সুযোগ–সুবিধা সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে বিংশ শতকের বেশির ভাগ সময় বেশির ভাগ দেশ গুপ্তহত্যা থেকে বিরত ছিল। এরপরও যেসব দেশ জড়িয়েছে, তারা অভ্যন্তরীণ আইন মেনে কাকে, কখন, কোথায় এবং কীভাবে হত্যা করতে হবে তা নির্ধারণ করেছে।
গুপ্তহত্যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র
স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিশ্বের দুটি পরাশক্তি গুপ্তহত্যায় জড়িয়েছিল, যদিও খুবই ভিন্ন উদ্দেশ্যে। ১৯৬৪ সালের সিআইএ মেমো রিপোর্ট বলছে, সোভিয়েতরা গুপ্তহত্যার টার্গেট করত কেবল সেই ব্যক্তিদের যারা কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার জন্য বিপজ্জনক এবং যাদের কোনোভাবেই অপহরণ করা যায় না।
সাধারণভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তহত্যা নিজ দেশের সেসব নাগরিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যারা বিদেশ থেকে সোভিয়েত শাসনের সমালোচনা করছিল। ১৯৪০ সালে মেক্সিকো সিটির একটি বাড়িতে লিওন ট্রটস্কিকে বরফ ভাঙার সুচ দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এভাবে ক্রেমলিনের শত্রুদের দেশে এবং বিদেশের মাটিতে অপহরণ বা হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতিক্রমও করেছে: জার্মান আইনজীবী ওয়াল্টার লিন্সকে মার্কিন–অধিকৃত বার্লিন থেকে অপহরণ এবং ১৯৫৩ সালে হত্যা করা হয়েছিল।
আমেরিকার বিশ্ব নেতাদের খুনের তালিকায় রাখার প্রবণতা রয়েছে। ২০০৭ সালে সিআইএর কুখ্যাত গুপ্তহত্যার তথ্য ফাঁস হয়, এই নথি ‘ফ্যামিলি জুয়েলস’ নামে বিখ্যাত। সেখানে দেখা যায়, বিদেশি কমিউনিস্ট নেতাদের হত্যার লক্ষ্যবস্তু করেছে সিআইএ। এর মধ্যে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার অসংখ্য পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া সিআইএর হত্যার তালিকায় ছিলেন দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট এনগো দিন দিম এবং কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা। তবে সিআইএ তাঁদের হত্যা করার আগেই মার্কিন সমর্থিত অভ্যুত্থানে তাঁরা নিহত হন। এসব হত্যাকাণ্ডের গোপন নথি প্রকাশ পেলে মার্কিন সিনেটে ‘চার্চ কমিটি’ নামে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়।
তদন্ত শেষে কমিটি জানায়, যুদ্ধের অংশ হিসেবে হলেও ‘গুপ্তহত্যা’ আমেরিকান নীতি, আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা এবং নৈতিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বৈদেশিক নীতির হাতিয়ার এটি হতে পারে না, একে প্রত্যাখ্যান করা উচিত।
এরপর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড ১৯৭৬ সালে একটি নির্বাহী আদেশে বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে সম্মত হন এবং আইন পাস করেন।
গুপ্তহত্যায় ইরান ও উত্তর কোরিয়া
গুপ্তহত্যার বেশির ভাগই করেছে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো। ব্যতিক্রম হিসেবে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে বিদেশের মাটিতে প্রায় দুই ডজন গুপ্তহত্যার পেছনে ইরানকে দায়ী করা হয়। এসবের কিছু ফলও ভোগ করতে হয়েছে তেহরানকে।
১৯৮০ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাপুর বখতিয়ারকে হত্যাচেষ্টার জন্য গ্রেপ্তার হওয়া ইরানের একটি হিট স্কোয়াডকে ক্ষমা করে দেয় ফ্রান্স। ইরান এক দশক পরে প্যারিসে বখতিয়ারকে শেষমেশ হত্যা করেই ছাড়ে।
নিউইয়র্ক সিটিতে নির্বাসিত ইরানি ভিন্নমতাবলম্বী মাসিহ আলিনেজাদ অন্তত দুটি হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন। মার্কিন কর্তৃপক্ষের মতে, ইরানের ভাড়াটে বন্দুকধারীরা ২০২১ সালে তাঁকে আটক করে ইরানে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পুলিশ তা ব্যর্থ করে দেয়। ২০২২ সালে এই লেখককে হত্যার উদ্দেশ্যে আরেকটি দল পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এবারও তারা পুলিশের হাতে আটক হয়।
গত বছরের হ্যালিফ্যাক্স আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ফোরামে আলিনেজাদ বলেন, যে লোকটিকে আসলে ব্রুকলিনে আমার বাড়ির সামনে থেকে একে–৪৭ বন্দুকসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তিনি আগে ইউরোপের একটি অপরাধী চক্রের অংশ ছিলেন। সুতরাং বাস্তবতা হলো—স্বৈরাচারীরা কেবল নিজ দেশের লোকদেরই নয়, সীমানার বাইরের লোকদেরও নিপীড়ন করতে তারা একে অপরকে সাহায্য এবং সমর্থন করছে।
উত্তর কোরিয়া গুপ্তহত্যায় উচ্চাভিলাষী হলেও ততটা চতুর নয়। ১৯৬৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক চুং–হিকে হত্যার উদ্দেশ্যে ‘ব্লু হাউসে’ ব্যর্থ হামলা চালায়। ১৯৯৭ সালে কিম জং ইলের ভাতিজা ই হান–ইয়ংকে হত্যার পেছনেও পিয়ংইয়ংকে দায়ী করা হয়।
২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সৎ ভাই কিম জং নাম কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মারাত্মক স্নায়ুগ্যাসে আক্রান্ত হন। ধারণা করা হয়, পিয়ংইয়ং এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে।
৯/১১ ও যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তহত্যার নতুন যুগ
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একবিংশ শতাব্দীতে সিআইএ এখন আর গুপ্তহত্যার অভিযানকে অগ্রাধিকার দেয় না। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আরও বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এখন গুপ্তহত্যার সংস্কৃতি আর নেই বলেই মনে হচ্ছে।
এখন স্নায়ুযুদ্ধ না থাকলেও অনেক কিছুই বদলেছে। ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা এবং ৯/১১ হামলা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সম্পূর্ণ নতুন যুগের সূচনা করেছে।
নাইন–ইলেভেনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ‘সমস্ত প্রয়োজনীয় এবং উপযুক্ত শক্তি’ ব্যবহারের জন্য মার্কিন কংগ্রেস ২০০১ সালে একটি তালিকা অনুমোদন করে। এরপর ২০১১ সালের অপারেশনে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা এবং ২০২০ সালে ড্রোন হামলায় ইরাকে ইরানের সামরিক কমান্ডার কাসেম সুলেইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র।
গুপ্তহত্যা এখন চলছে আকাশপথে, ফলে খুনিদের ঝুঁকি কমেছে। আইনে এখনো এসব হত্যাকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মার্কিন ড্রোন কর্মসূচির ফাঁস হওয়া নথিতে অনেক কিছু বেরিয়ে এসেছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার বিশ্লেষক ড্যানিয়েল হেল স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ইন্টারসেপ্টকে এসব নথি দেন। নথিতে দেখা যায়, মার্কিন সামরিক বাহিনী ২০১১ থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সোমালিয়া এবং ইয়েমেনে কমপক্ষে নয়জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে টার্গেট করেছে।
সামরিক অভিযানের আওতায় একই ধরনের ড্রোন কর্মসূচি সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়ায় সবচেয়ে বেশি মার্কিন ড্রোন হামলা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার দাবি করে, এসব আক্রমণ হত্যার উদ্দেশ্যে নয়, এগুলো সামরিক শক্তির বৈধ ব্যবহার, যা ২০০১ সালের কংগ্রেসে অনুমোদিত।
সবাইকে ছাড়িয়ে ইসরায়েল
তবে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির অজুহাতে সবচেয়ে বেশি গুপ্তহত্যা করেছে ইসরায়েল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইসরায়েল ফিলিস্তিনি নেতা এবং নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যা করেছে। কিন্তু ইসরায়েল সাধারণত বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের মাটিতে এসব করে না। তবে ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ মিউনিখ গেমসের সময় ইসরায়েলি অলিম্পিক দলের ওপর হামলা চালালে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
এরপরে একটি ইসরায়েলি গোষ্ঠী মিউনিখ হামলার সঙ্গে জড়িত প্রায় দুই ডজন ফিলিস্তিনি নেতাকে হত্যা বা হত্যার চেষ্টা করে বলে মনে করা হয়। ইউরোপের মাটিতে খুন না করার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ইসরায়েল ইতালি, ফ্রান্স, গ্রিস, সাইপ্রাস এবং অন্যান্য দেশে এসব হত্যাকাণ্ড চালায়।
ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন গোয়েন্দা ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট: দ্য সিক্রেট হিস্টরি অব ইসরায়েলস টার্গেটেড অ্যাসাসিনেশন’—এর লেখক রনেন বার্গম্যানকে বলেন, এসব খুনের ঘটনাগুলো ধোঁয়াশাপূর্ণ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। খুব কাছ থেকে গুপ্তহত্যা চালানো আসলেই ভয় উদ্রেককারী। ইসরায়েল এসবের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও, এটি সত্য যে, একজন ইসরায়েলিই সেই বন্দুকের ট্রিগার চেপেছে।
ইসরায়েলের নতুন গুপ্তহত্যা অভিযানের লক্ষ্য হয়েছে হামাস, হিজবুল্লাহ এবং ইরানের নেতারা। ২০০৪ সালে দেশটি হামাস নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে হত্যার জন্য একটি হেলিকপ্টার গানশিপ পাঠায় ইসরায়েল। এই অভিযানে নয়জন পথচারী নিহত হয়। এই হত্যাকাণ্ড জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়। যদিও এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়।
অতি সম্প্রতি, দখলদার দেশটি ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানীদের নির্মূল করার জন্য গুপ্তহত্যা পরিকল্পনাকে প্রসারিত করেছে, এমনকি যারা তেহরানের অস্ত্র কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে না তাঁদেরও হত্যা করেছে।
তবে ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট’ বইটিতে বার্গম্যান ইসরায়েলের টার্গেটেড কিলিং প্রোগ্রাম এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্যে একটি ফারাক দেখিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এখন যেসব কমান্ড–অ্যান্ড–কন্ট্রোল সিস্টেম, যুদ্ধকক্ষ, তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি এবং পাইলটবিহীন বিমান বা ড্রোন আমেরিকা এবং মিত্রদের সেবা দেয়; সবই ইসরায়েলে বিকশিত হয়েছে।’
বার্গম্যান অনুমান করেন, ২০০০–এর আগের দশকগুলোতে ইসরায়েল প্রায় ৫০০টি গুপ্তহত্যা করেছে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় নিয়ে বার্গম্যান লিখেছেন, এই সময় সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এরপর ২০১৮ পর্যন্ত কমপক্ষে আরও ৮০০টি অপারেশন হয়েছিল। সেই হাজার হাজার গুপ্তহত্যার অভিযানে টার্গেট ও অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, যুদ্ধোত্তর সময়ে ইসরায়েল আবারও এসব গুপ্তহত্যা কর্মসূচি বাড়াতে চায়। গাজার বাইরে হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে—সম্ভবত কাতার বা অন্য কোথাও।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্যালামার্ড বলেন, ‘আমরা তথাকথিত সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু করে হত্যা করা প্রায় স্বাভাবিক করে ফেলেছি। এটিকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে আংশিক ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছে। তবে কোনোভাবেই বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যাকে সমর্থন করা যায় না।’
গত ২ জানুয়ারি লেবাননের বৈরুত শহরতলিতে একটি হামাসের অফিসে ড্রোন হামলায় গোষ্ঠীটির সিনিয়র নেতা সালেহ আল–আরৌরি নিহত হন। ওই হামলায় হামাসের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।
গুপ্তহত্যার বিশ্বমঞ্চে পুতিন
বিশ্ব রাজনীতিতে আরেক যুগের সূচনা হয় ২০০০ সালে ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষমতায় আরোহণের মধ্যে দিয়ে। তাঁর নেতৃত্বে মস্কো বিদেশে নিজ দেশের নাগরিকদের হত্যার সোভিয়েত রীতি বজায় রেখেছে। তবে মস্কো যেসব অঞ্চলকে জাতিগত এবং ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার অংশ বলে মনে করে, এমন প্রতিবেশী দেশগুলোর নাগরিকদেরও টার্গেট করছে।
ইউক্রেনের ক্ষেত্রে পুতিনের কৌশলগুলো ক্রমশ নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। ২০০৬ সালে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ দিয়ে দলত্যাগী আলেক্সান্ডার লিৎভিনেঙ্কো এবং সাবেক ডবল এজেন্ট সের্গেই স্ক্রিপালের বিষক্রিয়া এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
কিন্তু রাশিয়া এটাও প্রমাণ করেছে যে, খুনের কালিমা থেকে রেহাই পাওয়া কতটা সহজ! স্ক্রিপালকে বিষ প্রয়োগের চেষ্টার ঘটনায় বেশ কিছু নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লেও ২০১৭ সালে বাজফিড নিউজের তদন্তে প্রকাশিত হয়েছে, পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গোপনে বিশ্বাস করেছিল, রাশিয়া অগণিত গুপ্তহত্যার জন্য দায়ী। কিন্তু যেসবের জন্য মস্কোকে সরাসরি অভিযুক্ত ও তিরস্কার করা হয়নি।
উন্নত গোয়েন্দা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে থাকলেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের জন্য গ্রেপ্তার তেমন নেই। সন্দেহ রয়েছে, এই দেশগুলো পশ্চিমা তদন্তকারীদের এড়াতে কৌশল এবং তথ্য বিনিময় করছে।
গুপ্তহত্যায় সৌদি আরব ও পাকিস্তান
এমনকি যে রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক খ্যাতি রক্ষা করতে চায় তাদের বিরুদ্ধেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। সৌদি রাজপরিবারের সমালোচক ব্লগার জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডের পেছনে রিয়াদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সিআইএ ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে খাশোগি হত্যার জন্য সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে ১৫ জনের হিট স্কোয়াডকে দায়ী করেছে। এরপরেও এখনো ট্রাম্প নির্বিকার স্বরে বলেন, ‘হয়তো তিনি করেছেন, হয়তো করেননি।’
বিচারবহির্ভূত বা নির্বিচারে মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে জাতিসংঘের তৎকালীন বিশেষ র্যাপোর্টার ক্যালামার্ড সৌদি আরবকে জবাবদিহি করতে বিশ্বের ব্যর্থতার নিন্দা জানিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর ও রিপোর্টের চার বছর পর ক্যালামার্ড বলেন, সামান্য পরিবর্তন হয়েছে এবং তবে বিচারের পথ সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধই রয়েছে।
পাকিস্তানও এই কাণ্ডে সমানভাবে দায়ী হতে পারে। দরিদ্র পাকিস্তানি প্রদেশ বেলুচিস্তানের একজন মানবাধিকার আইনজীবী কারিমা বালুচকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে টরন্টোতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কানাডার পুলিশ বলেছে, পাকিস্তানের যোগসাজশের কোনো প্রমাণ নেই, তবে তাঁর পরিবার আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের দাবি করেছে। এ ছাড়া আইনজীবীরা কয়েক মাস আগে সুইডেনে নির্বাসিত পাকিস্তানি সাজিদ হোসেনের মৃত্যুর সঙ্গে আগের ঘটনার মিল আছে বলে দাবি করেছেন।
গুপ্তহত্যা ক্লাবের নতুন মুখ ভারত
বিচার প্রক্রিয়ার অভাবে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা রক্ষার হর্তাকর্তারা বৈদেশিক নীতিকে এগিয়ে নিতে গুপ্তহত্যা অব্যাহত রেখেছে। হত্যাকারী দেশগুলোর ক্লাবে নতুন সদস্য যোগ হচ্ছে। সেই ক্লাবে ভারতকে নতুন সদস্য বলে মনে হচ্ছে। কানাডায় নিজ্জার হত্যা এবং নিউইয়র্কে পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা ছাড়াও পাকিস্তানি গোয়েন্দারা বিশ্বাস করেন, ইন্টারসেপ্টের প্রাপ্ত নথি অনুসারে, ভারত অন্তত দুই পাকিস্তানি বাসিন্দাকে টার্গেট করেছে। একটি পৃথক ভারতীয় মেমো বলছে, কথিত রয়েছে, পশ্চিমে ভারতীয় কনস্যুলেটগুলো এই ‘অত্যাধুনিক ক্র্যাকডাউন স্কিম’ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে।
এদিকে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে এমন প্রাণঘাতী দমন-পীড়নের কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশে দেশটির সমালোচকদের ওপর নজরদারি ও চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বাড়িয়েছে।
সমাধান মিলবে কি?
ক্যালামার্ড বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা এমন একটি আন্তর্জাতিক সন্ধিক্ষণে রয়েছি; যেখানে কোনো দেশ বা সরকারের ভাবমূর্তি ও প্রচারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই সরকারগুলো তার প্রতি একেবারেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে।’
ক্যালামার্ড নিজের প্রতিবেদনে জাতিসংঘকে ‘টার্গেটেড কিলিংয়ের’ সমীক্ষা করার জন্য একটি বিশেষ তদন্ত দল করার আহ্বান জানিয়েছেন, যারা রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের খুঁটিনাটি তদন্ত করবে। তিনি জোর দিয়েছিলেন যে, ‘আমরা এখনো এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত নই এবং কারা এসব করে তার সম্পূর্ণ সন্দেহভাজন তালিকাও আমাদের কাছে নেই।’
ক্যালামার্ড মার্কিন সাময়িকী ফরেন পলিসিকে বলেন, ‘আমি মনে করি, একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বা কমিটি থাকা উচিত, যারা এসব মামলার তদন্ত করবে। এটি গঠিত হলে খুব শক্তিশালী বার্তা যাবে যে, এসব আর সহ্য করা হবে না।’
ক্যালামার্ড ফরেন পলিসিকে আরও বলেন, ‘আমি তখন যে পয়েন্টটি তৈরি করছিলাম এবং এখনো চালিয়ে যাচ্ছি তা হলো—নির্দিষ্ট ঘটনা তদন্তের জন্য আমাদের ক্ষমতার প্রয়োগ পুঙ্খানুপুঙ্খ করা। যা এসব ঘটনা রোধ করবে এবং আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।’
তবে এসব সুপারিশ এখনো উপেক্ষিত। আশ্চর্যের কিছু নেই, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্তত দুটি রাষ্ট্র তাঁদের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে নিয়মিত গুপ্তহত্যা করে যাচ্ছে। বিশ্ব এখনো দায়সারাভাবেই গুপ্তহত্যা মোকাবিলার চেষ্টা করে। অনেক সময় ঘাতকদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা হলেও মূল হোতা দেশ বা সংস্থা দায় এড়ায়।
ক্যালামার্ড বলেন, দেশগুলো দ্বিপক্ষীয় বা কূটনৈতিক স্তরে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু এটি আন্তর্জাতিক আইন পরিচালনার কোনো উপায় নয়। বিশ্ব গুপ্তহত্যা ঠেকানো থেকে আরও দূরে চলে গেছে এবং বিশ্বজুড়ে সীমাহীন যুদ্ধের এক স্বাভাবিকতা এনে দিয়েছে।
হিট স্কোয়াড, বিষযুক্ত টুথপেস্ট বা সশস্ত্র ড্রোন যাই হোক না কেন, বিদেশের মাটিতে হত্যাকাণ্ড নিরাপত্তা নীতি, ভূ–রাজনীতি এবং অভ্যন্তরীণ ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ভিন্নমতাবলম্বী, সাংবাদিক এবং উদ্বাস্তুরা এই বাস্তবতার শিকার সবচেয়ে বেশি—সম্ভবত জঙ্গি ও রাজনৈতিক নেতাদের চেয়েও।
ক্যালামার্ড যুক্তি দেন, এই ধরনের হত্যা বিশ্বকে নিরাপদ করা তো দূরের কথা, বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তাহীনতা তৈরি ছাড়া আর কিছুই করে না। আর এমন পরিস্থিতি তৈরিতে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের মতো দেশগুলো।
ক্যালামার্ড বলেন, ‘গত ২০ বছরে সন্ত্রাসবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে অসংখ্য আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ঘটনা যে “ন্যায্যতা” এনেছে তা সত্যিই নিন্দনীয়। শুধু তাই নয়, দৃঢ় কণ্ঠে এসব ঘটনার নিন্দা করার ক্ষমতাকেও ব্যাপকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে।’
ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ করেছেন আবদুল বাছেদ
তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে দুই পক্ষের কূটনৈতিক যোগাযোগ ক্রমেই শীতল হচ্ছে। চীন বারবার বলছে, তাইওয়ান আমাদের অংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাইওয়ানের নিরাপত্তা আমাদের কৌশলগত স্বার্থের অঙ্গ।
১ দিন আগে
ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পন
২ দিন আগে
এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে...
২ দিন আগে
জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত...
৩ দিন আগেআবদুল বাছেদ, ঢাকা
তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে দুই পক্ষের কূটনৈতিক যোগাযোগ ক্রমেই শীতল হচ্ছে। চীন বারবার বলছে, তাইওয়ান আমাদের অংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাইওয়ানের নিরাপত্তা আমাদের কৌশলগত স্বার্থের অঙ্গ। এই অবস্থায় দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নৌবহর ও মার্কিন যুদ্ধজাহাজ প্রায় প্রতিদিন মুখোমুখি অবস্থায় থাকে। গত মাসে একবার দুটি চীনা যুদ্ধজাহাজ মাত্র ১৫০ মিটারের দূরত্বে চলে এসেছিল।
গত ২ আগস্ট তাইওয়ানে ‘জিরো ডে অ্যাটাক’ নামে একটি ডিস্টোপিয়ান টেভি সিরিজ মুক্তি পেয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে, কীভাবে চীন তাইওয়ানে আগ্রাসন শুরু করতে পারে। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ষড়যন্ত্র, গণমাধ্যমে অনুপ্রবেশ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক প্রভাব খাটানো—সবকিছুই এতে বিশ্লেষণধর্মীভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এটি একটি কল্পকাহিনি হলেও সাম্প্রতিক বাস্তব ঘটনাগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে।
১০ সিজনের বহুল প্রচারিত ও প্রশংসিত এই সিরিজের নির্মাতা চেং হসিন-মেই। তিনি যুক্তরাজ্যভিত্তিক ম্যাগাজিন টাইমকে বলেন, ‘সীমান্ত এলাকায় গেলে আপনি সত্যিই সেই উত্তেজনা টের পাবেন। চীন কোনো না কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েলিংটন কু মনে করছেন, চীনা সেনাবাহিনী (পিএলএ) যেকোনো সামরিক মহড়াকে সত্যিকারের আগ্রাসনে পরিণত করতে পারে। এমন সম্ভাবনা এখন উড়িয়ে দেওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই হুমকি আর চ্যালেঞ্জই এখন তাইওয়ানের সামনে।
চীন বলছে, এটি চূড়ান্ত প্রস্তুতির সময়, আর তাইওয়ান সরকারের ভাষায়, আসন্ন আগ্রাসনের সংকেত। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২৭ সালের মধ্যেই চীন তাইওয়ানে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। তবে কেউ কেউ মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা বৈদেশিক মনোযোগের বিভ্রান্তি দেখা দিলে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং হয়তো তার আগেই পদক্ষেপ নিতে পারেন। তাইওয়ান ইস্যুতে ট্রাম্প স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, চীন আক্রমণ করলে আমেরিকা তাইওয়ানকে একা ছাড়বে না।
এখন ভাবুন, চীন তাইওয়ানে আক্রমণ চালিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র দ্বীপ দেশটির পক্ষে দাঁড়িয়েছে। পেন্টাগনের প্রচলিত যুদ্ধনীতি মেনে মার্কিন নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী হাজার হাজার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছে চীনের জাহাজ, কমান্ড সেন্টার ও লজিস্টিক ঘাঁটির দিকে। প্রথম দফার হামলাতেই ৩৩ হাজারেরও বেশি নিখুঁত লক্ষ্যভেদী অস্ত্র সাড়ে ৮ হাজারের বেশি টার্গেটে আঘাত হেনেছে। সাইবার হামলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে চীনের সামরিক নেটওয়ার্ক, ভেঙে পড়ছে নেতৃত্ব। ফলে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, যেখানে বেইজিং হয় পিছু হটবে, নয়তো নিরুপায় পরাজয় মেনে নেবে।
কিন্তু যদি মনে করেন, এমনটি হবেই হবে, তাহলে ভুল করছেন। কারণ চীনের ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি, কমান্ড সেন্টার ও যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংসের পর যখন একের পর এক পরাজয়ের মুখে পড়বে বেইজিং, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে নেতাদের মধ্যে যোগাযোগ। তখন দেশটি ভিন্নপথে হাঁটতে পারে। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারে ভার্টিক্যাল এস্কেলেশন বা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের। চীন হয়তো মার্কিন সমুদ্রসীমায় একটি পারমাণবিক পরীক্ষামূলক হামলা চালাবে যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দিতে যে এখানেই থেমে যাও। প্রশ্ন হচ্ছে, ওয়াশিংটন কি এমন পদক্ষেপকে পারমাণবিক হামলার পূর্বঘোষণা বলে ধরে নেবে না?
এই বিপজ্জনক উত্তেজনা তৈরি হতে পারে শুধু চীনের পারমাণবিক নীতির কারণে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব যুদ্ধধারণার ফলেও। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার চীনের নেই। তাই বেইজিং হয়তো এখনো মনে করে যে যুক্তরাষ্ট্র আগে পারমাণবিক হামলা চালালে তারা পাল্টা আঘাত করার মতো সক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ সক্রিয় পারমাণবিক বোমা ছিল, চীনের সেখানে ছিল মাত্র ৬০০। এই পশ্চাৎপদতার কারণে চীনা নেতারা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়েই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন বড় পরাজয় ঠেকাতে।
আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো, চীনের অনেক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা দ্বৈত-ক্ষমতাসম্পন্ন; অর্থাৎ একই লঞ্চার থেকে কখনো প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র, আবার কখনো পারমাণবিক ওয়ারহেড নিক্ষেপ করা যায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যদি এসব লঞ্চারে হামলা চালায়, বেইজিং সেটাকে তাদের পারমাণবিক প্রতিরোধশক্তির ওপর আঘাত হিসেবে দেখতে পারে। এটি পাল্টা পারমাণবিক প্রতিক্রিয়া উসকে দিতে পারে।
বিশেষ করে ডিএফ-২৬ ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিগুলো এই জটিলতা বাড়ায়। একই ঘাঁটিতে প্রচলিত ও পারমাণবিক উভয় ধরনের ওয়ারহেড থাকে এবং প্রশিক্ষণে সৈন্যরা প্রথমে প্রচলিত হামলার মহড়া দেয়, পরে সেটি পারমাণবিক ওয়ারহেডে পরিবর্তন করে। যুক্তরাষ্ট্র এসব ঘাঁটিতে আঘাত হানলে চীন সেটিকে পারমাণবিক হামলার প্রস্তুতি হিসেবে দেখতে পারে। একেই বলে এনট্যাঙ্গলমেন্ট প্রবলেম বা এক হামলার দ্বৈত ব্যাখ্যা, যা পারমাণবিক সংঘাত ডেকে আনতে পারে।
এখানে মার্কিন সামরিক পরিকল্পকেরা পড়ে যান এক দোটানায়। তাঁরা যত দ্রুত ও নিশ্চিত বিজয়ের চিন্তায় যুদ্ধের কৌশল সাজাবেন, তত বেশি পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকিতে পড়ে যান। অথচ বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালানোর মতো সরঞ্জাম মজুত নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পরিকল্পনায় যে ধরনের যুদ্ধনীতি প্রাধান্য পায়, সেখানে চীনের কমান্ড, কন্ট্রোল, কমিউনিকেশন, কম্পিউটার, ইন্টেলিজেন্স, সার্ভেইলেন্স ও রিকনাইসেন্স (সি৪ আইএসআর) ব্যবস্থা লক্ষ্য করে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও সাইবার আক্রমণ চালানোর কথা বলা হয়। বাস্তবে তা হয়তো যুদ্ধকে সংক্ষিপ্ত করার বদলে আরও দীর্ঘ ও ধ্বংসাত্মক করে তুলতে পারে। এসব ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে সামরিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক থেকে শুরু করে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহকারী উপগ্রহ এবং সামরিক অভিযান পরিচালনাকারী কমান্ড সদর দপ্তর পর্যন্ত সবকিছু।
যদি কমান্ডাররা নিহত হন এবং কমান্ড ব্যবস্থা ধ্বংসও হয়ে যায়, তবুও যুদ্ধ পরিকল্পনাবিদদের মনে করা উচিত নয় যে এতে দ্রুত বিজয় আসবে। ইতিহাস দেখিয়েছে, কোনো বাহিনী পুরোপুরি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম বছরেই বিপুলসংখ্যক রুশ জেনারেল নিহত হন, তবুও তাদের বাহিনী আজও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইসলামিক স্টেটের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, নেতৃত্ব ধ্বংস করলেও তাঁরা কার্যকর সামরিক শক্তি হিসেবে টিকে থেকেছে, যতক্ষণ না তাদের বাহিনীকে ধীরে ধীরে, দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর সামরিক অভিযানে পুরোপুরি দমন করা হয়েছে।
মার্কিন যুদ্ধনীতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সামুদ্রিক আঘাত হানার ক্ষেপণাস্ত্র তিন দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে, আর ভূমি থেকে দূরপাল্লার হামলার অস্ত্র মজুত ফুরোবে ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে। এমনকি যদি তাইওয়ান, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে চীনকে ঠেকাতেও পারে, তবু মূল্যটা ভয়াবহ হবে। ডজন-ডজন জাহাজ ডুবে যাবে, শত শত বিমান ধ্বংস হবে, আর হাজার হাজার সেনা নিহত হবে।
পেন্টাগন সম্প্রতি দ্রুতগতিতে ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাতাদের দূরপাল্লার অস্ত্রের উৎপাদন দ্বিগুণ বা এমনকি চারগুণ বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। এসবের মধ্যে রয়েছে দূরপাল্লার জাহাজবিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র ও নির্ভুল আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র। কিন্তু এতে সমস্যা আরও বাড়ছে, কারণ এই ‘দূরপাল্লার আক্রমণনির্ভর’ যুদ্ধের ধারণাই আসলে পারমাণবিক সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে, কমাচ্ছে না।
এ বিপদের ব্যাপ্তি শুধু প্রশান্ত মহাসাগরেই সীমাবদ্ধ নয়। ন্যাটোর অনেক পরিকল্পনাও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল দ্বারা প্রভাবিত। ইউরোপীয় সেনা কর্মকর্তারাও বুঝতে পারছেন না যে এসব ‘অপারেশনাল কনসেপ্ট’-এর মধ্যে কতটা বিপজ্জনক উত্তেজনা লুকিয়ে আছে।
কিছু কৌশলবিদ বলেন, পারমাণবিক উত্তেজনার ভয় পেলে যুদ্ধই করা যাবে না; এমন মনোভাবই এখনকার বাস্তবতা। কিন্তু যদি সত্যিই যুদ্ধের সম্ভাবনা থেকে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্টভাবে জানতে হবে, তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী, কতটা ঝুঁকি নেওয়া যাবে, আর সেই ঝুঁকি কমানোর উপায় কী।
এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কৌশলগত গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাইবার শক্তি ও ভবিষ্যৎ সংঘাতবিষয়ক সহযোগী ফেলো ফ্রান্জ-স্টেফান গ্যাডি প্রস্তাব করেন, ‘স্মার্ট অ্যাট্রিশনাল অ্যাপ্রোচ’ একটি বুদ্ধিদীপ্ত ক্ষয়যুদ্ধনীতি। এতে চীনের কমান্ড সেন্টার বা পারমাণবিক ঘাঁটিতে হামলা না করে তাদের প্রচলিত বাহিনীকে রুখে দেওয়া হবে। এর মানে হলো, যুদ্ধ হবে দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর, কিন্তু পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকি কমবে।
এই কৌশলে জোর দেওয়া হবে স্বল্পপাল্লার অস্ত্র ব্যবহারে। বেশি টর্পেডো, ড্রোন এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায়। প্রযুক্তিনির্ভর দ্রুত বিজয়ের মোহ ত্যাগ করে, বাস্তব ও দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে।
কিন্তু সমস্যাটা রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্মতির অভাব। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ কি সত্যিই হাজারো সেনার প্রাণ এবং অর্ধেক নৌবাহিনী হারানোর বিনিময়ে তাইওয়ানের স্বাধীনতা রক্ষা করতে রাজি?
অবশেষে প্রশ্ন একটাই, যুক্তরাষ্ট্র আসলে কি ত্যাগ করতে প্রস্তুত? সামরিক ইতিহাসবিদ মাইকেল হাওয়ার্ড যেমন বলেছিলেন, পশ্চিম এখনো শান্তির কুয়াশার ভেতর দিয়ে নৌযাত্রা করছে। শেষ মহাযুদ্ধ থেকে সময় যতই দূরে সরে যাচ্ছে, ভয়াবহ ভুলের সম্ভাবনাও ততই বাড়ছে।
তাই যুক্তরাষ্ট্রকে এখনই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। শিল্পক্ষমতা বাড়াতে হবে, পারমাণবিক ঝুঁকি কমানোর কৌশল নিতে হবে এবং জনগণকে জানাতে হবে, এই যুদ্ধের প্রকৃত মূল্য কী হবে। প্রযুক্তি দিয়ে দ্রুত জয়ের ভ্রান্ত বিশ্বাসে ভেসে চললে, আগামীতে ‘বৃহৎ দুই শক্তির যুদ্ধ’ হবে মানবজাতির জন্য এক ভয়াবহ শিক্ষা। যেমনটি বলেছিলেন এথেন্সের কৌশলবিদ থুসিডিডিস, পরবর্তী মহাশক্তির যুদ্ধ হবে এক কঠোর শিক্ষক।
তথ্যসূত্র: টাইম ও ফরেন পলিসি

তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে দুই পক্ষের কূটনৈতিক যোগাযোগ ক্রমেই শীতল হচ্ছে। চীন বারবার বলছে, তাইওয়ান আমাদের অংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাইওয়ানের নিরাপত্তা আমাদের কৌশলগত স্বার্থের অঙ্গ। এই অবস্থায় দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নৌবহর ও মার্কিন যুদ্ধজাহাজ প্রায় প্রতিদিন মুখোমুখি অবস্থায় থাকে। গত মাসে একবার দুটি চীনা যুদ্ধজাহাজ মাত্র ১৫০ মিটারের দূরত্বে চলে এসেছিল।
গত ২ আগস্ট তাইওয়ানে ‘জিরো ডে অ্যাটাক’ নামে একটি ডিস্টোপিয়ান টেভি সিরিজ মুক্তি পেয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে, কীভাবে চীন তাইওয়ানে আগ্রাসন শুরু করতে পারে। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ষড়যন্ত্র, গণমাধ্যমে অনুপ্রবেশ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক প্রভাব খাটানো—সবকিছুই এতে বিশ্লেষণধর্মীভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এটি একটি কল্পকাহিনি হলেও সাম্প্রতিক বাস্তব ঘটনাগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে।
১০ সিজনের বহুল প্রচারিত ও প্রশংসিত এই সিরিজের নির্মাতা চেং হসিন-মেই। তিনি যুক্তরাজ্যভিত্তিক ম্যাগাজিন টাইমকে বলেন, ‘সীমান্ত এলাকায় গেলে আপনি সত্যিই সেই উত্তেজনা টের পাবেন। চীন কোনো না কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েলিংটন কু মনে করছেন, চীনা সেনাবাহিনী (পিএলএ) যেকোনো সামরিক মহড়াকে সত্যিকারের আগ্রাসনে পরিণত করতে পারে। এমন সম্ভাবনা এখন উড়িয়ে দেওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই হুমকি আর চ্যালেঞ্জই এখন তাইওয়ানের সামনে।
চীন বলছে, এটি চূড়ান্ত প্রস্তুতির সময়, আর তাইওয়ান সরকারের ভাষায়, আসন্ন আগ্রাসনের সংকেত। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২৭ সালের মধ্যেই চীন তাইওয়ানে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। তবে কেউ কেউ মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা বৈদেশিক মনোযোগের বিভ্রান্তি দেখা দিলে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং হয়তো তার আগেই পদক্ষেপ নিতে পারেন। তাইওয়ান ইস্যুতে ট্রাম্প স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, চীন আক্রমণ করলে আমেরিকা তাইওয়ানকে একা ছাড়বে না।
এখন ভাবুন, চীন তাইওয়ানে আক্রমণ চালিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র দ্বীপ দেশটির পক্ষে দাঁড়িয়েছে। পেন্টাগনের প্রচলিত যুদ্ধনীতি মেনে মার্কিন নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী হাজার হাজার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছে চীনের জাহাজ, কমান্ড সেন্টার ও লজিস্টিক ঘাঁটির দিকে। প্রথম দফার হামলাতেই ৩৩ হাজারেরও বেশি নিখুঁত লক্ষ্যভেদী অস্ত্র সাড়ে ৮ হাজারের বেশি টার্গেটে আঘাত হেনেছে। সাইবার হামলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে চীনের সামরিক নেটওয়ার্ক, ভেঙে পড়ছে নেতৃত্ব। ফলে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, যেখানে বেইজিং হয় পিছু হটবে, নয়তো নিরুপায় পরাজয় মেনে নেবে।
কিন্তু যদি মনে করেন, এমনটি হবেই হবে, তাহলে ভুল করছেন। কারণ চীনের ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি, কমান্ড সেন্টার ও যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংসের পর যখন একের পর এক পরাজয়ের মুখে পড়বে বেইজিং, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে নেতাদের মধ্যে যোগাযোগ। তখন দেশটি ভিন্নপথে হাঁটতে পারে। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারে ভার্টিক্যাল এস্কেলেশন বা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের। চীন হয়তো মার্কিন সমুদ্রসীমায় একটি পারমাণবিক পরীক্ষামূলক হামলা চালাবে যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দিতে যে এখানেই থেমে যাও। প্রশ্ন হচ্ছে, ওয়াশিংটন কি এমন পদক্ষেপকে পারমাণবিক হামলার পূর্বঘোষণা বলে ধরে নেবে না?
এই বিপজ্জনক উত্তেজনা তৈরি হতে পারে শুধু চীনের পারমাণবিক নীতির কারণে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব যুদ্ধধারণার ফলেও। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার চীনের নেই। তাই বেইজিং হয়তো এখনো মনে করে যে যুক্তরাষ্ট্র আগে পারমাণবিক হামলা চালালে তারা পাল্টা আঘাত করার মতো সক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ সক্রিয় পারমাণবিক বোমা ছিল, চীনের সেখানে ছিল মাত্র ৬০০। এই পশ্চাৎপদতার কারণে চীনা নেতারা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়েই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন বড় পরাজয় ঠেকাতে।
আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো, চীনের অনেক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা দ্বৈত-ক্ষমতাসম্পন্ন; অর্থাৎ একই লঞ্চার থেকে কখনো প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র, আবার কখনো পারমাণবিক ওয়ারহেড নিক্ষেপ করা যায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যদি এসব লঞ্চারে হামলা চালায়, বেইজিং সেটাকে তাদের পারমাণবিক প্রতিরোধশক্তির ওপর আঘাত হিসেবে দেখতে পারে। এটি পাল্টা পারমাণবিক প্রতিক্রিয়া উসকে দিতে পারে।
বিশেষ করে ডিএফ-২৬ ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিগুলো এই জটিলতা বাড়ায়। একই ঘাঁটিতে প্রচলিত ও পারমাণবিক উভয় ধরনের ওয়ারহেড থাকে এবং প্রশিক্ষণে সৈন্যরা প্রথমে প্রচলিত হামলার মহড়া দেয়, পরে সেটি পারমাণবিক ওয়ারহেডে পরিবর্তন করে। যুক্তরাষ্ট্র এসব ঘাঁটিতে আঘাত হানলে চীন সেটিকে পারমাণবিক হামলার প্রস্তুতি হিসেবে দেখতে পারে। একেই বলে এনট্যাঙ্গলমেন্ট প্রবলেম বা এক হামলার দ্বৈত ব্যাখ্যা, যা পারমাণবিক সংঘাত ডেকে আনতে পারে।
এখানে মার্কিন সামরিক পরিকল্পকেরা পড়ে যান এক দোটানায়। তাঁরা যত দ্রুত ও নিশ্চিত বিজয়ের চিন্তায় যুদ্ধের কৌশল সাজাবেন, তত বেশি পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকিতে পড়ে যান। অথচ বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালানোর মতো সরঞ্জাম মজুত নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পরিকল্পনায় যে ধরনের যুদ্ধনীতি প্রাধান্য পায়, সেখানে চীনের কমান্ড, কন্ট্রোল, কমিউনিকেশন, কম্পিউটার, ইন্টেলিজেন্স, সার্ভেইলেন্স ও রিকনাইসেন্স (সি৪ আইএসআর) ব্যবস্থা লক্ষ্য করে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও সাইবার আক্রমণ চালানোর কথা বলা হয়। বাস্তবে তা হয়তো যুদ্ধকে সংক্ষিপ্ত করার বদলে আরও দীর্ঘ ও ধ্বংসাত্মক করে তুলতে পারে। এসব ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে সামরিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক থেকে শুরু করে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহকারী উপগ্রহ এবং সামরিক অভিযান পরিচালনাকারী কমান্ড সদর দপ্তর পর্যন্ত সবকিছু।
যদি কমান্ডাররা নিহত হন এবং কমান্ড ব্যবস্থা ধ্বংসও হয়ে যায়, তবুও যুদ্ধ পরিকল্পনাবিদদের মনে করা উচিত নয় যে এতে দ্রুত বিজয় আসবে। ইতিহাস দেখিয়েছে, কোনো বাহিনী পুরোপুরি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম বছরেই বিপুলসংখ্যক রুশ জেনারেল নিহত হন, তবুও তাদের বাহিনী আজও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইসলামিক স্টেটের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, নেতৃত্ব ধ্বংস করলেও তাঁরা কার্যকর সামরিক শক্তি হিসেবে টিকে থেকেছে, যতক্ষণ না তাদের বাহিনীকে ধীরে ধীরে, দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর সামরিক অভিযানে পুরোপুরি দমন করা হয়েছে।
মার্কিন যুদ্ধনীতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সামুদ্রিক আঘাত হানার ক্ষেপণাস্ত্র তিন দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে, আর ভূমি থেকে দূরপাল্লার হামলার অস্ত্র মজুত ফুরোবে ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে। এমনকি যদি তাইওয়ান, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে চীনকে ঠেকাতেও পারে, তবু মূল্যটা ভয়াবহ হবে। ডজন-ডজন জাহাজ ডুবে যাবে, শত শত বিমান ধ্বংস হবে, আর হাজার হাজার সেনা নিহত হবে।
পেন্টাগন সম্প্রতি দ্রুতগতিতে ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাতাদের দূরপাল্লার অস্ত্রের উৎপাদন দ্বিগুণ বা এমনকি চারগুণ বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। এসবের মধ্যে রয়েছে দূরপাল্লার জাহাজবিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র ও নির্ভুল আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র। কিন্তু এতে সমস্যা আরও বাড়ছে, কারণ এই ‘দূরপাল্লার আক্রমণনির্ভর’ যুদ্ধের ধারণাই আসলে পারমাণবিক সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে, কমাচ্ছে না।
এ বিপদের ব্যাপ্তি শুধু প্রশান্ত মহাসাগরেই সীমাবদ্ধ নয়। ন্যাটোর অনেক পরিকল্পনাও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল দ্বারা প্রভাবিত। ইউরোপীয় সেনা কর্মকর্তারাও বুঝতে পারছেন না যে এসব ‘অপারেশনাল কনসেপ্ট’-এর মধ্যে কতটা বিপজ্জনক উত্তেজনা লুকিয়ে আছে।
কিছু কৌশলবিদ বলেন, পারমাণবিক উত্তেজনার ভয় পেলে যুদ্ধই করা যাবে না; এমন মনোভাবই এখনকার বাস্তবতা। কিন্তু যদি সত্যিই যুদ্ধের সম্ভাবনা থেকে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্টভাবে জানতে হবে, তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী, কতটা ঝুঁকি নেওয়া যাবে, আর সেই ঝুঁকি কমানোর উপায় কী।
এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কৌশলগত গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাইবার শক্তি ও ভবিষ্যৎ সংঘাতবিষয়ক সহযোগী ফেলো ফ্রান্জ-স্টেফান গ্যাডি প্রস্তাব করেন, ‘স্মার্ট অ্যাট্রিশনাল অ্যাপ্রোচ’ একটি বুদ্ধিদীপ্ত ক্ষয়যুদ্ধনীতি। এতে চীনের কমান্ড সেন্টার বা পারমাণবিক ঘাঁটিতে হামলা না করে তাদের প্রচলিত বাহিনীকে রুখে দেওয়া হবে। এর মানে হলো, যুদ্ধ হবে দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর, কিন্তু পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকি কমবে।
এই কৌশলে জোর দেওয়া হবে স্বল্পপাল্লার অস্ত্র ব্যবহারে। বেশি টর্পেডো, ড্রোন এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায়। প্রযুক্তিনির্ভর দ্রুত বিজয়ের মোহ ত্যাগ করে, বাস্তব ও দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে।
কিন্তু সমস্যাটা রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্মতির অভাব। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ কি সত্যিই হাজারো সেনার প্রাণ এবং অর্ধেক নৌবাহিনী হারানোর বিনিময়ে তাইওয়ানের স্বাধীনতা রক্ষা করতে রাজি?
অবশেষে প্রশ্ন একটাই, যুক্তরাষ্ট্র আসলে কি ত্যাগ করতে প্রস্তুত? সামরিক ইতিহাসবিদ মাইকেল হাওয়ার্ড যেমন বলেছিলেন, পশ্চিম এখনো শান্তির কুয়াশার ভেতর দিয়ে নৌযাত্রা করছে। শেষ মহাযুদ্ধ থেকে সময় যতই দূরে সরে যাচ্ছে, ভয়াবহ ভুলের সম্ভাবনাও ততই বাড়ছে।
তাই যুক্তরাষ্ট্রকে এখনই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। শিল্পক্ষমতা বাড়াতে হবে, পারমাণবিক ঝুঁকি কমানোর কৌশল নিতে হবে এবং জনগণকে জানাতে হবে, এই যুদ্ধের প্রকৃত মূল্য কী হবে। প্রযুক্তি দিয়ে দ্রুত জয়ের ভ্রান্ত বিশ্বাসে ভেসে চললে, আগামীতে ‘বৃহৎ দুই শক্তির যুদ্ধ’ হবে মানবজাতির জন্য এক ভয়াবহ শিক্ষা। যেমনটি বলেছিলেন এথেন্সের কৌশলবিদ থুসিডিডিস, পরবর্তী মহাশক্তির যুদ্ধ হবে এক কঠোর শিক্ষক।
তথ্যসূত্র: টাইম ও ফরেন পলিসি

গত বছরের জুনে নিখিল গুপ্ত নিজের মোবাইল ফোন থেকে তাঁর এক পরিচিতজনকে একটি ভিডিও পাঠান। কানাডায় শিখদের প্রার্থনাগৃহ গুরুদুয়ারার বাইরে এক ব্যক্তিকে পরপর ৩৪টি গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি একটি গাড়ির পাশে ঢলে পড়েন। এই ঘটনারই ভিডিও সেটি।
২২ জানুয়ারি ২০২৪
ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পন
২ দিন আগে
এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে...
২ দিন আগে
জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত...
৩ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু তাঁর এই সফরের মূল উদ্দেশ্য বহুপক্ষীয় কূটনীতির সূক্ষ্ম শিল্প নয়, বরং আরেকটি ‘শান্তিচুক্তির’ কৃতিত্ব বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বলে জানিয়েছে পলিটিকো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্মেলনে ‘কুয়ালালামপুর চুক্তি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে, সেটিই সম্ভবত ট্রাম্পের আসিয়ান সম্মেলনে যোগ দেওয়ার একমাত্র কারণ।
ট্রাম্প এরই মধ্যে তাঁর ‘বিশ্বজুড়ে বন্ধ করা’ যুদ্ধের তালিকায় যুক্ত করেছেন থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সংঘাতও, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র জুলাই মাসে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করাতে সহায়তা করেছিল। তাঁর দাবি অনুযায়ী, তিনি এরই মধ্যে ইসরায়েল-হামাস, ইসরায়েল-ইরান, পাকিস্তান-ভারত, রুয়ান্ডা-কঙ্গো, আর্মেনিয়া-আজারবাইজান এবং প্রথম মেয়াদে মিসর-ইথিওপিয়া ও সার্বিয়া-কসোভোর সংঘাতও মিটমাট করেছেন।
তবে এসবের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে শান্তিচুক্তি হলেও অনেক ক্ষেত্রে সংঘাত এখনো চলমান বা পুনরায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, যার মধ্যে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার পরিস্থিতিও রয়েছে। তবু ট্রাম্প এই ঘটনাগুলোর সাফল্য ও অতিরঞ্জিত দাবি মিলিয়ে নিজেকে ‘শান্তির প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য জোর প্রচারও চালান, যদিও চলতি মাসের শুরুতে সেই পুরস্কার ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদো পেয়েছেন।
তবু এখনই নিরাশ হচ্ছেন না ট্রাম্প ও তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা। কম্বোডিয়াসহ কয়েকজন বিশ্বনেতা এরই মধ্যে আগামী বছরের পুরস্কারের জন্য আবার ট্রাম্পকে মনোনয়ন দিয়েছেন। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এসব ‘চাটুকার কূটনীতির’ নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত।
তবে কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ডের মধ্যে এই শান্তিচুক্তি প্রকৃতপক্ষে অর্জিত হবে, নাকি ট্রাম্পের কথিত সাফল্য হয়ে থাকবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল প্রশ্ন হলো, ফটোসেশনের পর ট্রাম্প কতটা অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবেন।
জাপানের ওসাকার কানসাই গাইদাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘাত অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মার্ক এস. কোগান টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘এটিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে রাজনৈতিক চাপ বজায় রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র কি এই ইস্যু থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেবে? ট্রাম্প চুক্তি সম্পাদনের পর কি থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার প্রতি আগ্রহ ধরে রাখবে, নাকি অন্য কিছুতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে?’
মার্ক এস. কোগান আরও বলেন, ‘থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যকার এই অমীমাংসিত তুলনামূলক ছোট সংঘাত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই কতটা মাথা ঘামায়? এটা কি অন্য বড় সংঘাতগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ? না, অবশ্যই না। তবে কি এটা গভীর ও উত্তপ্ত? হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এর প্রকৃত প্রভাব কতটা? খুবই সামান্য।’
কোগানের মতে, ‘চুক্তির সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করবে ‘তৃতীয় পক্ষের পর্যবেক্ষণ’-এর ওপর। উভয় দেশ চুক্তির শর্ত মানলেই এটি সফল হতে পারে। তবে দুই পক্ষই পরস্পরকে যুদ্ধবিরতি ভাঙার অভিযোগে অভিযুক্ত করবে। যুক্তরাষ্ট্র তাত্ত্বিকভাবে এই পর্যবেক্ষণ কার্যকরভাবে পরিচালনা করার সক্ষমতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা রাখে, তবে অনেকে এ বিষয়ে সংশয়ী।’
জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অধ্যয়ন কেন্দ্রের অধ্যাপক ও থাই গবেষক পাভিন চাচাভালপংপুন টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘ট্রাম্পের এই অঞ্চলে শান্তি উদ্যোগের অংশগ্রহণটা পুরোপুরি লেনদেননির্ভর মনে হচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠান শেষ হলে তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় বাহ্যিক চাপ সম্ভবত মিলিয়ে যাবে।’
আসিয়ানের বর্তমান চেয়ারম্যান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বৃহস্পতিবার বলেন, চুক্তির বিস্তারিত বিষয়গুলো এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসা হচ্ছে।
কম্বোডিয়া প্রকাশ্যে ট্রাম্পকে ‘একটি বিজয় উপহার’ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। ১৫ অক্টোবর শাসক দলের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা যেকোনো সময় চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত।’
গবেষক পাভিন আরও বলেন, ‘অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের নতুন সরকার সম্প্রতি সংঘাতের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে আগের প্রশাসনকে অপসারণ করেছে। দেশটি এই প্রক্রিয়ায় সাবধানী ভূমিকা নিচ্ছে, স্থিতিশীলতাকে স্বাগত জানাচ্ছে, তবে আশঙ্কা করছে, ট্রাম্প কম্বোডিয়ার পক্ষে ঝুঁকতে পারেন।’
থাইল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী অনুতিন চার্নভিরাকুল গত রোববার বলেন, ‘আমরা আমাদের দেশকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বা অন্য কোনো জাতির দ্বারা শোষিত হতে দেব না। আমরা জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
পাভিনের মতে, ট্রাম্প এই চুক্তি চূড়ান্ত করতে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক সহায়তা করতে পারেন। তবে তাঁর বিশ্বাস, এই চুক্তি ‘স্বল্পমেয়াদি স্থিতিশীলতা’ আনতে পারে, কিন্তু ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তির ভিত্তি হিসেবে ভঙ্গুর’ হিসেবেই রয়ে যাবে।
কম্বোডিয়া চুক্তিতে আগ্রহী হলেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা কত দূর যেতে রাজি। ১৯ অক্টোবর কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন মানেত লিখেছেন, চুক্তিটি মূলত সংঘাতের অবসান এবং দুই দেশের সম্পর্ক পুনর্গঠনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির শর্ত ও আচরণবিধি নির্ধারণের মাধ্যম হবে।
তবে তিনি একই সঙ্গে পরিষ্কার করে বলেন, ‘না জুলাই মাসের যুদ্ধবিরতি, না আসন্ন চুক্তি—কোনোটিই কোনো পক্ষের সার্বভৌম ভূখণ্ডের ওপর আইনি অধিকার ত্যাগের প্রতিশ্রুতি নয়।’
থাই গবেষক পাভিনের মতে, এই চুক্তির স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়; কারণ, এটি মূল ভূখণ্ড এবং ঐতিহাসিক মানচিত্রসংক্রান্ত সীমান্তবিরোধের সমাধান করছে না, বরং সেই সংঘাতকে সাময়িকভাবে স্থগিত করছে মাত্র।

ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু তাঁর এই সফরের মূল উদ্দেশ্য বহুপক্ষীয় কূটনীতির সূক্ষ্ম শিল্প নয়, বরং আরেকটি ‘শান্তিচুক্তির’ কৃতিত্ব বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বলে জানিয়েছে পলিটিকো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্মেলনে ‘কুয়ালালামপুর চুক্তি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে, সেটিই সম্ভবত ট্রাম্পের আসিয়ান সম্মেলনে যোগ দেওয়ার একমাত্র কারণ।
ট্রাম্প এরই মধ্যে তাঁর ‘বিশ্বজুড়ে বন্ধ করা’ যুদ্ধের তালিকায় যুক্ত করেছেন থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সংঘাতও, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র জুলাই মাসে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করাতে সহায়তা করেছিল। তাঁর দাবি অনুযায়ী, তিনি এরই মধ্যে ইসরায়েল-হামাস, ইসরায়েল-ইরান, পাকিস্তান-ভারত, রুয়ান্ডা-কঙ্গো, আর্মেনিয়া-আজারবাইজান এবং প্রথম মেয়াদে মিসর-ইথিওপিয়া ও সার্বিয়া-কসোভোর সংঘাতও মিটমাট করেছেন।
তবে এসবের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে শান্তিচুক্তি হলেও অনেক ক্ষেত্রে সংঘাত এখনো চলমান বা পুনরায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, যার মধ্যে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার পরিস্থিতিও রয়েছে। তবু ট্রাম্প এই ঘটনাগুলোর সাফল্য ও অতিরঞ্জিত দাবি মিলিয়ে নিজেকে ‘শান্তির প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য জোর প্রচারও চালান, যদিও চলতি মাসের শুরুতে সেই পুরস্কার ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদো পেয়েছেন।
তবু এখনই নিরাশ হচ্ছেন না ট্রাম্প ও তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা। কম্বোডিয়াসহ কয়েকজন বিশ্বনেতা এরই মধ্যে আগামী বছরের পুরস্কারের জন্য আবার ট্রাম্পকে মনোনয়ন দিয়েছেন। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এসব ‘চাটুকার কূটনীতির’ নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত।
তবে কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ডের মধ্যে এই শান্তিচুক্তি প্রকৃতপক্ষে অর্জিত হবে, নাকি ট্রাম্পের কথিত সাফল্য হয়ে থাকবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল প্রশ্ন হলো, ফটোসেশনের পর ট্রাম্প কতটা অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবেন।
জাপানের ওসাকার কানসাই গাইদাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘাত অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মার্ক এস. কোগান টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘এটিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে রাজনৈতিক চাপ বজায় রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র কি এই ইস্যু থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেবে? ট্রাম্প চুক্তি সম্পাদনের পর কি থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার প্রতি আগ্রহ ধরে রাখবে, নাকি অন্য কিছুতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে?’
মার্ক এস. কোগান আরও বলেন, ‘থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যকার এই অমীমাংসিত তুলনামূলক ছোট সংঘাত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই কতটা মাথা ঘামায়? এটা কি অন্য বড় সংঘাতগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ? না, অবশ্যই না। তবে কি এটা গভীর ও উত্তপ্ত? হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এর প্রকৃত প্রভাব কতটা? খুবই সামান্য।’
কোগানের মতে, ‘চুক্তির সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করবে ‘তৃতীয় পক্ষের পর্যবেক্ষণ’-এর ওপর। উভয় দেশ চুক্তির শর্ত মানলেই এটি সফল হতে পারে। তবে দুই পক্ষই পরস্পরকে যুদ্ধবিরতি ভাঙার অভিযোগে অভিযুক্ত করবে। যুক্তরাষ্ট্র তাত্ত্বিকভাবে এই পর্যবেক্ষণ কার্যকরভাবে পরিচালনা করার সক্ষমতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা রাখে, তবে অনেকে এ বিষয়ে সংশয়ী।’
জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অধ্যয়ন কেন্দ্রের অধ্যাপক ও থাই গবেষক পাভিন চাচাভালপংপুন টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘ট্রাম্পের এই অঞ্চলে শান্তি উদ্যোগের অংশগ্রহণটা পুরোপুরি লেনদেননির্ভর মনে হচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠান শেষ হলে তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় বাহ্যিক চাপ সম্ভবত মিলিয়ে যাবে।’
আসিয়ানের বর্তমান চেয়ারম্যান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বৃহস্পতিবার বলেন, চুক্তির বিস্তারিত বিষয়গুলো এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসা হচ্ছে।
কম্বোডিয়া প্রকাশ্যে ট্রাম্পকে ‘একটি বিজয় উপহার’ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। ১৫ অক্টোবর শাসক দলের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা যেকোনো সময় চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত।’
গবেষক পাভিন আরও বলেন, ‘অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের নতুন সরকার সম্প্রতি সংঘাতের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে আগের প্রশাসনকে অপসারণ করেছে। দেশটি এই প্রক্রিয়ায় সাবধানী ভূমিকা নিচ্ছে, স্থিতিশীলতাকে স্বাগত জানাচ্ছে, তবে আশঙ্কা করছে, ট্রাম্প কম্বোডিয়ার পক্ষে ঝুঁকতে পারেন।’
থাইল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী অনুতিন চার্নভিরাকুল গত রোববার বলেন, ‘আমরা আমাদের দেশকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বা অন্য কোনো জাতির দ্বারা শোষিত হতে দেব না। আমরা জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
পাভিনের মতে, ট্রাম্প এই চুক্তি চূড়ান্ত করতে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক সহায়তা করতে পারেন। তবে তাঁর বিশ্বাস, এই চুক্তি ‘স্বল্পমেয়াদি স্থিতিশীলতা’ আনতে পারে, কিন্তু ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তির ভিত্তি হিসেবে ভঙ্গুর’ হিসেবেই রয়ে যাবে।
কম্বোডিয়া চুক্তিতে আগ্রহী হলেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা কত দূর যেতে রাজি। ১৯ অক্টোবর কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন মানেত লিখেছেন, চুক্তিটি মূলত সংঘাতের অবসান এবং দুই দেশের সম্পর্ক পুনর্গঠনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির শর্ত ও আচরণবিধি নির্ধারণের মাধ্যম হবে।
তবে তিনি একই সঙ্গে পরিষ্কার করে বলেন, ‘না জুলাই মাসের যুদ্ধবিরতি, না আসন্ন চুক্তি—কোনোটিই কোনো পক্ষের সার্বভৌম ভূখণ্ডের ওপর আইনি অধিকার ত্যাগের প্রতিশ্রুতি নয়।’
থাই গবেষক পাভিনের মতে, এই চুক্তির স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়; কারণ, এটি মূল ভূখণ্ড এবং ঐতিহাসিক মানচিত্রসংক্রান্ত সীমান্তবিরোধের সমাধান করছে না, বরং সেই সংঘাতকে সাময়িকভাবে স্থগিত করছে মাত্র।

গত বছরের জুনে নিখিল গুপ্ত নিজের মোবাইল ফোন থেকে তাঁর এক পরিচিতজনকে একটি ভিডিও পাঠান। কানাডায় শিখদের প্রার্থনাগৃহ গুরুদুয়ারার বাইরে এক ব্যক্তিকে পরপর ৩৪টি গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি একটি গাড়ির পাশে ঢলে পড়েন। এই ঘটনারই ভিডিও সেটি।
২২ জানুয়ারি ২০২৪তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে দুই পক্ষের কূটনৈতিক যোগাযোগ ক্রমেই শীতল হচ্ছে। চীন বারবার বলছে, তাইওয়ান আমাদের অংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাইওয়ানের নিরাপত্তা আমাদের কৌশলগত স্বার্থের অঙ্গ।
১ দিন আগে
এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে...
২ দিন আগে
জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত...
৩ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর প্রস্তাব দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর ধারণা, যুদ্ধ এখন যে অবস্থায় রয়েছে, সেখান থেকেই ভবিষ্যতের আলোচনা শুরু করা উচিত। অর্থাৎ ‘বর্তমান সীমান্তরেখায়’ তিনি দুই দেশকে নতুন করে শুরুর কথা বলছেন। তবে এই প্রস্তাবে ইউক্রেন ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা সমর্থন জানালেও রাশিয়া প্রত্যাখ্যান করেছে।
মজার বিষয়, এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে ট্রাম্পের কি কোনো ফায়দা আছে।
গত রোববার এয়ারফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই থামানো উচিত। বাকিটা পরে আলোচনা করা যেতে পারে।
এ সময় বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ট্রাম্প বলেন, ‘এখন যে অবস্থা, এটা সেভাবেই রেখে দেওয়া হোক। তুমি এটা নাও, আমরা এটা নিই—এভাবে বললে হবে না। রাশিয়া ইতিমধ্যে ইউক্রেনের প্রায় ৭৮ শতাংশ দখল করে নিয়েছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ থামানোই সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে।’
যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়—তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে পুরো দনবাস অঞ্চল ছেড়ে দিতে বলছেন কি না, ট্রাম্প জবাব দেন, ‘না। শুধু এখন যেভাবে ভাগ হয়ে আছে, সেভাবেই থাকুক।’
এখন যুদ্ধরেখা কোথায় আছে? প্রায় চার বছর ধরে চলা যুদ্ধে ইতিমধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের চারটি পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ—দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝিয়া দখল করে নিয়েছে। এ ছাড়া খারকিভ প্রদেশের একটি অংশও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বর্তমানে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক মিলে যে অঞ্চলটি ‘দনবাস’ নামে পরিচিত, সেখানেই সবচেয়ে তীব্র লড়াই চলছে।
রাশিয়া বর্তমানে লুহানস্কের সম্পূর্ণ অংশ ও দোনেৎস্কের বেশির ভাগ অঞ্চল, বিশেষত স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামাতোর্স্কের আশপাশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ছাড়া খেরসনের প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং জাপোরিঝিয়ার বৃহৎ অংশও রুশ সেনাদের দখলে।
জাপোরিঝিয়া ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল, যেখানে ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও বিমান তৈরির কারখানা রয়েছে। এখানেই ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অবস্থিত।
তবে অবাক করার বিষয়, ইউক্রেন ও ইউরোপীয় নেতারা ট্রাম্পের প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছেন। গত মঙ্গলবার ইউরোপীয় নেতারা ও প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা ট্রাম্পের প্রস্তাবকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছি। বর্তমান যুদ্ধরেখাই ভবিষ্যৎ আলোচনার সূচনাবিন্দু হতে পারে।’
এর আগে ইউক্রেন বারবার বলেছে, তারা সব দখল করা ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে চায়। কিন্তু ট্রাম্প কখনো ইউক্রেনকে জমি ছেড়ে দিতে বলেছেন, আবার কখনো বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ জিততে পারে—তাঁর এই অবস্থান বারবার বদলেছে।
গত আগস্টে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলাস্কায় বৈঠকের আগে ট্রাম্প বলেন, এই যুদ্ধে উভয় পক্ষকেই কিছুটা জমি ছাড় দিতে হবে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তিনি উল্টো মন্তব্য করেন—ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ী হতে পারে এবং এমনকি ২০১৪ সালে হারানো ক্রিমিয়াসহ পুরো দেশ পুনর্দখল করতে সক্ষম।
অন্যদিকে রাশিয়া ট্রাম্পের এই প্রস্তাব পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। গত মঙ্গলবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, রাশিয়া দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই শান্তির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ—তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি কোনো ফল দেবে না।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, রাশিয়ার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মস্কো তার দাবিতে অনড়—যুদ্ধ শেষ করতে হলে, দখল করা সমস্ত ভূমি তাদের দিয়ে দিতে হবে এবং নিজেদের বলে দাবি করা পূর্বাঞ্চল থেকে ইউক্রেনীয় সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি গোপন বার্তা পাঠিয়েছে, যেখানে শুধু দখল করা অংশ নয়, রাশিয়া পুরো দনবাসের নিয়ন্ত্রণ দাবি করেছে।
এদিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলতি সপ্তাহে ট্রাম্প এ বৈঠক বাতিল করেছেন। এরপর গতকাল বুধবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মনে হলো এই বৈঠক এখন ফলপ্রসূ হবে না, তাই বাতিল করেছি। তবে ভবিষ্যতে আবার বসা হবে।’
এখন সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাতে দেখা যায়, যুদ্ধ বন্ধ হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে রাশিয়া। প্রশ্ন হতে পারে, নিজেদের ক্ষতি জেনেও কেন ট্রাম্পের প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে ইউরোপ-ইউক্রেন। কারণ, এ মুহূর্তে তাদের কাছে রাশিয়াকে মোকাবিলা করার মতো কোনো অস্ত্র নেই। সর্বশেষ, হোয়াইট হাউসের বৈঠক থেকে আশা করা হয়েছিল, এবার জেলেনস্কি হয়তো টমাহক নিয়ে ফিরবেন। কিন্তু তিনি ফিরেছেন খালি হাতে। এদিকে ইউরোপে আটকে থাকা রুশ অর্থ থেকে ইউক্রেনকে লোন দেওয়ার যে প্রস্তাব উঠেছে, তাতে সবাই একমত হতে পারেনি। ফলে সেটাও আটকে আছে। অর্থাৎ যুদ্ধ চালানোর অর্থ ও রসদ, দুটোরই সংকট আছে ইউক্রেনের। তাই এ মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ করাই তাদের কাছে সবচেয়ে ভালো সমাধান।
সবশেষে আসে ট্রাম্পের কথা। এই যুদ্ধ বন্ধ হলে ট্রাম্প বলতে পারবেন, ‘আমি আরও একটি যুদ্ধ থামিয়েছি। এবার আমাকে নোবেল না দিয়ে যাবে কোথায়!’ তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাই এ যুদ্ধ বন্ধ হলে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ইউরোপের দূরত্ব ঘুচতে পারে।
এদিকে এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। যদিও নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কেমন হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে ওয়াশিংটনের এমন ঘোষণায় চির ধরেছে ট্রাম্প-পুতিনের বন্ধুত্বে। তাই এ যুদ্ধ বন্ধ হলে টিকে যাবে তাঁদের বন্ধুত্ব।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, আল-জাজিরা

ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর প্রস্তাব দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর ধারণা, যুদ্ধ এখন যে অবস্থায় রয়েছে, সেখান থেকেই ভবিষ্যতের আলোচনা শুরু করা উচিত। অর্থাৎ ‘বর্তমান সীমান্তরেখায়’ তিনি দুই দেশকে নতুন করে শুরুর কথা বলছেন। তবে এই প্রস্তাবে ইউক্রেন ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা সমর্থন জানালেও রাশিয়া প্রত্যাখ্যান করেছে।
মজার বিষয়, এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে ট্রাম্পের কি কোনো ফায়দা আছে।
গত রোববার এয়ারফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই থামানো উচিত। বাকিটা পরে আলোচনা করা যেতে পারে।
এ সময় বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ট্রাম্প বলেন, ‘এখন যে অবস্থা, এটা সেভাবেই রেখে দেওয়া হোক। তুমি এটা নাও, আমরা এটা নিই—এভাবে বললে হবে না। রাশিয়া ইতিমধ্যে ইউক্রেনের প্রায় ৭৮ শতাংশ দখল করে নিয়েছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ থামানোই সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে।’
যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়—তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে পুরো দনবাস অঞ্চল ছেড়ে দিতে বলছেন কি না, ট্রাম্প জবাব দেন, ‘না। শুধু এখন যেভাবে ভাগ হয়ে আছে, সেভাবেই থাকুক।’
এখন যুদ্ধরেখা কোথায় আছে? প্রায় চার বছর ধরে চলা যুদ্ধে ইতিমধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের চারটি পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ—দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝিয়া দখল করে নিয়েছে। এ ছাড়া খারকিভ প্রদেশের একটি অংশও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বর্তমানে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক মিলে যে অঞ্চলটি ‘দনবাস’ নামে পরিচিত, সেখানেই সবচেয়ে তীব্র লড়াই চলছে।
রাশিয়া বর্তমানে লুহানস্কের সম্পূর্ণ অংশ ও দোনেৎস্কের বেশির ভাগ অঞ্চল, বিশেষত স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামাতোর্স্কের আশপাশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ছাড়া খেরসনের প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং জাপোরিঝিয়ার বৃহৎ অংশও রুশ সেনাদের দখলে।
জাপোরিঝিয়া ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল, যেখানে ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও বিমান তৈরির কারখানা রয়েছে। এখানেই ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অবস্থিত।
তবে অবাক করার বিষয়, ইউক্রেন ও ইউরোপীয় নেতারা ট্রাম্পের প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছেন। গত মঙ্গলবার ইউরোপীয় নেতারা ও প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা ট্রাম্পের প্রস্তাবকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছি। বর্তমান যুদ্ধরেখাই ভবিষ্যৎ আলোচনার সূচনাবিন্দু হতে পারে।’
এর আগে ইউক্রেন বারবার বলেছে, তারা সব দখল করা ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে চায়। কিন্তু ট্রাম্প কখনো ইউক্রেনকে জমি ছেড়ে দিতে বলেছেন, আবার কখনো বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ জিততে পারে—তাঁর এই অবস্থান বারবার বদলেছে।
গত আগস্টে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলাস্কায় বৈঠকের আগে ট্রাম্প বলেন, এই যুদ্ধে উভয় পক্ষকেই কিছুটা জমি ছাড় দিতে হবে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তিনি উল্টো মন্তব্য করেন—ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ী হতে পারে এবং এমনকি ২০১৪ সালে হারানো ক্রিমিয়াসহ পুরো দেশ পুনর্দখল করতে সক্ষম।
অন্যদিকে রাশিয়া ট্রাম্পের এই প্রস্তাব পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। গত মঙ্গলবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, রাশিয়া দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই শান্তির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ—তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি কোনো ফল দেবে না।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, রাশিয়ার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মস্কো তার দাবিতে অনড়—যুদ্ধ শেষ করতে হলে, দখল করা সমস্ত ভূমি তাদের দিয়ে দিতে হবে এবং নিজেদের বলে দাবি করা পূর্বাঞ্চল থেকে ইউক্রেনীয় সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি গোপন বার্তা পাঠিয়েছে, যেখানে শুধু দখল করা অংশ নয়, রাশিয়া পুরো দনবাসের নিয়ন্ত্রণ দাবি করেছে।
এদিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলতি সপ্তাহে ট্রাম্প এ বৈঠক বাতিল করেছেন। এরপর গতকাল বুধবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মনে হলো এই বৈঠক এখন ফলপ্রসূ হবে না, তাই বাতিল করেছি। তবে ভবিষ্যতে আবার বসা হবে।’
এখন সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাতে দেখা যায়, যুদ্ধ বন্ধ হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে রাশিয়া। প্রশ্ন হতে পারে, নিজেদের ক্ষতি জেনেও কেন ট্রাম্পের প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে ইউরোপ-ইউক্রেন। কারণ, এ মুহূর্তে তাদের কাছে রাশিয়াকে মোকাবিলা করার মতো কোনো অস্ত্র নেই। সর্বশেষ, হোয়াইট হাউসের বৈঠক থেকে আশা করা হয়েছিল, এবার জেলেনস্কি হয়তো টমাহক নিয়ে ফিরবেন। কিন্তু তিনি ফিরেছেন খালি হাতে। এদিকে ইউরোপে আটকে থাকা রুশ অর্থ থেকে ইউক্রেনকে লোন দেওয়ার যে প্রস্তাব উঠেছে, তাতে সবাই একমত হতে পারেনি। ফলে সেটাও আটকে আছে। অর্থাৎ যুদ্ধ চালানোর অর্থ ও রসদ, দুটোরই সংকট আছে ইউক্রেনের। তাই এ মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ করাই তাদের কাছে সবচেয়ে ভালো সমাধান।
সবশেষে আসে ট্রাম্পের কথা। এই যুদ্ধ বন্ধ হলে ট্রাম্প বলতে পারবেন, ‘আমি আরও একটি যুদ্ধ থামিয়েছি। এবার আমাকে নোবেল না দিয়ে যাবে কোথায়!’ তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাই এ যুদ্ধ বন্ধ হলে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ইউরোপের দূরত্ব ঘুচতে পারে।
এদিকে এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। যদিও নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কেমন হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে ওয়াশিংটনের এমন ঘোষণায় চির ধরেছে ট্রাম্প-পুতিনের বন্ধুত্বে। তাই এ যুদ্ধ বন্ধ হলে টিকে যাবে তাঁদের বন্ধুত্ব।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, আল-জাজিরা

গত বছরের জুনে নিখিল গুপ্ত নিজের মোবাইল ফোন থেকে তাঁর এক পরিচিতজনকে একটি ভিডিও পাঠান। কানাডায় শিখদের প্রার্থনাগৃহ গুরুদুয়ারার বাইরে এক ব্যক্তিকে পরপর ৩৪টি গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি একটি গাড়ির পাশে ঢলে পড়েন। এই ঘটনারই ভিডিও সেটি।
২২ জানুয়ারি ২০২৪তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে দুই পক্ষের কূটনৈতিক যোগাযোগ ক্রমেই শীতল হচ্ছে। চীন বারবার বলছে, তাইওয়ান আমাদের অংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাইওয়ানের নিরাপত্তা আমাদের কৌশলগত স্বার্থের অঙ্গ।
১ দিন আগে
ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পন
২ দিন আগে
জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত...
৩ দিন আগেশশী থারুরের নিবন্ধ
আজকের পত্রিকা ডেস্ক

জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত সভ্যতার প্রতিধ্বনি। কূটনীতির জয়গাথা হিসেবে জন্ম নেওয়া এই প্রতিষ্ঠান আজ অস্তিত্বসংকটে। বিশ্বের অনেক দেশই এখন এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, আর ঠিক তখনই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যুক্তরাষ্ট্র নিজেই পিছিয়ে আসতে চাইছে।
লক্ষণগুলো স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ও ইউনেসকোসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সরে এসেছে। জাতিসংঘের অনেক সংস্থায় অর্থায়নও বন্ধ বা ব্যাপকভাবে কমিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের অনুদান কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত।
যুক্তরাষ্ট্র গাজা প্রসঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে, ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের জাতিসংঘের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার ভিসা বাতিল করেছে। অধিবেশনের প্রথম দিনেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নজিরবিহীন বক্তব্যে মাল্টিল্যাটারালিজম বা বহুপাক্ষিকতার মৌলিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিনিধি সুসান রাইস সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমরা এখন আর সেই জায়গাগুলোতে খেলছি না, যেখানে একসময় বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছি।’
বহুপাক্ষিকতার এই ক্ষয় এমন একসময়ে ঘটছে, যখন পৃথিবীর আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দরকার সম্মিলিত পদক্ষেপের। ইউক্রেন, সুদানসহ নানা সংঘাতের আগুন জ্বলছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। শান্তির কোনো ইঙ্গিত নেই। ট্রাম্প প্রশাসন গাজা শান্তিচুক্তির আয়োজন করেছে, কিন্তু তা জাতিসংঘের কাঠামোর বাইরে।
জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুততর হচ্ছে, বৈষম্য বাড়ছে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের গতি শাসনব্যবস্থার সক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই পরিস্থিতিকে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক সংকট।’ তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ভূরাজনৈতিক বিভাজন আমাদের সেই ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে, যা দিয়ে আমরা কার্যকরভাবে এই সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে পারি।’
তাহলে কি বহুপাক্ষিকতা ভাঙনের পথে? জাতিসংঘ কি টিকে থাকতে পারবে ক্রমবর্ধমান এই ‘অপ্রাসঙ্গিকতার’ অভিযোগের ভেতর? এর উত্তর খুঁজতে হলে আগে বুঝতে হবে, বহুপাক্ষিকতা আসলে কী ছিল—আর এখন তা কী হয়ে উঠেছে। মূলত বহুপাক্ষিকতা মানে, এমন বিশ্বাস যে বৈশ্বিক সমস্যা (যা জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান একসময় বলেছিলেন—সীমানাহীন সমস্যা) সমাধানও হতে হবে বৈশ্বিক পরিসরে, এমন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেখানে ছোট-বড় সব রাষ্ট্রেরই সমান কণ্ঠস্বর থাকবে। এটি সার্বভৌম সমতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আইনের শাসনের ওপর দাঁড়ানো এক ব্যবস্থা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ, যেখানে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রত্যেকেরই এক ভোট, এখনো সেই আদর্শের সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রতীক।
কিন্তু বাস্তবতা সব সময়ই আদর্শকে ছায়ায় ফেলে রেখেছে। জাতিসংঘের কাঠামো, বিশেষ করে—নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতা, বৈষম্যকে স্থায়ী করে রেখেছে। জাতিসংঘের অনেক প্রস্তাব বাধ্যতামূলক নয়, বাস্তবায়নের ব্যবস্থাও দুর্বল। সাধারণ পরিষদ অনেক সময়ই পরিণত হয় বাস্তব সমাধানের বদলে রাজনৈতিক বক্তব্যের মঞ্চে। আর নিরাপত্তা পরিষদ নিজেও এখনো ১৯৪৫ সালের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে বহন করছে, যখন আমরা দাঁড়িয়ে ২০২৫-এর শেষ অংশে।
তবু জাতিসংঘ অনেক কিছু অর্জন করেছে। মানবাধিকার-সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), প্যারিস জলবায়ু চুক্তি—সবই এসেছে বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। জাতিসংঘ মানবিক সহায়তা সমন্বয় করেছে, সফল শান্তিরক্ষা মিশন চালিয়েছে, অসংখ্য আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনে ভূমিকা রেখেছে, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য প্রতিক্রিয়া গড়ে তুলেছে। এটি ছোট দেশগুলোর জন্য দিয়েছে বলার জায়গা, আর বড় দেশগুলোর জন্য শোনার বাধ্যবাধকতা। যদিও অনেক সময় তা কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
কিন্তু আজ সেই ব্যবস্থাও ভাঙনের মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দুর্বল হয়েছে, আঞ্চলিক জোটগুলোর উত্থান ঘটেছে, কূটনৈতিক নীতিমালার ঐক্য ভেঙে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গোটা ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘ কালো ছায়া ফেলেছে। উভয় পক্ষই এখন নিজেদের মতো করে সীমিত গোষ্ঠীগত বা দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় ঝুঁকছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং গাজায় ইসরায়েলের অটল অবস্থান আন্তর্জাতিক নিয়মের প্রতি আস্থা আরও দুর্বল করেছে। এমনকি যে ইউরোপে একসময় বহুপাক্ষিকতার প্রতি গভীর অঙ্গীকার ছিল, সেখানে এখন জাতীয়তাবাদের ঢেউ সেই ঐকমত্যকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপট মহৎ উদ্দেশ্যে, কিন্তু সীমিত প্রভাবের প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ এখন ঝুঁকির মুখে। তবে পতন অনিবার্য নয়। বহুপাক্ষিকতা হয়তো আঘাতপ্রাপ্ত, কিন্তু এখনো মারা যায়নি। বিশ্বনেতারা এখনো নিউইয়র্কে একত্র হন, কথা বলেন, আলোচনা করেন, তর্ক করেন—এই ঘটনাই প্রমাণ করে, বৈশ্বিক সংলাপের প্রয়োজন এখনো গভীরভাবে বিদ্যমান।
চলতি বছর শুরু হওয়া ‘ইউএন-৮০’ উদ্যোগের লক্ষ্য হলো জাতিসংঘের দায়িত্বের ভার কমানো, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং জন-আস্থা পুনরুদ্ধার। প্রতিষ্ঠান সংস্কার এখন বিলাসিতা নয়—অস্তিত্বের শর্ত। তবে বহুপাক্ষিকতার সংকট কেবল প্রাতিষ্ঠানিক নয়, তা দার্শনিকও বটে। এই সংকট এক গভীর টানাপোড়েন উন্মোচন করেছে। আর সেটি হলো—বিশ্বব্যাপী পারস্পরিক নির্ভরতা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের আওতায় থাকা ‘যেকোনো জায়গার মানুষ’ আর ‘কোনো এক বিশেষ জায়গার মানুষ’-এর আত্মপরিচয়ের মধ্যে।
ডেভিড গুডহার্টের বিশ্লেষণ এখানে প্রাসঙ্গিক। ‘কোনো এক বিশেষ জায়গার মানুষেরা’ ধর্ম, সংস্কৃতি ও স্থানীয় পরিচয়ে প্রোথিত, তারা বৈশ্বিক অভিজাত শ্রেণি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্রমশ সন্দিহান। তাদের রাজনৈতিক উত্থান—ব্রেক্সিট থেকে ট্রাম্পবাদ পর্যন্ত—বদলে দিয়েছে সেই প্রেক্ষাপট। আর এ কারণেই বহুপাক্ষিকতা টিকে থাকার লড়াই করছে।
অতএব, বহুপাক্ষিকতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শুধু প্রতিষ্ঠান সংস্কারের ওপর নয়, বৈধতা পুনর্গঠনের ওপরও। এই সংস্কারে কেবল কূটনীতিকদের নয়, সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগের প্রতিফলনও ঘটাতে হবে। প্রমাণ করতে হবে, বৈশ্বিক সহযোগিতা বাস্তব সুফল দিতে পারে—চাকরি, নিরাপত্তা, মর্যাদা সবকিছুর। এগুলো শুধু নীতিগত উচ্চারণ নয়। বহুপাক্ষিকতাকে হতে হবে কম প্রযুক্তিনির্ভর, বেশি মানবিক।
আশ্চর্যের বিষয়, যে দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে অভিবাসন ও বৈশ্বিক সম্পৃক্ততার বিরোধিতা করেছে—যেমন জাপান ও হাঙ্গেরি তারা হয়তো এই প্রতিক্রিয়ার ঝড় থেকে তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত। জাপানের সতর্ক কূটনীতি ও সাংস্কৃতিক সমরূপতা দেশটিকে পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোর মতো জনতুষ্টির চাপে পড়তে দেয়নি। অন্যদিকে ভিক্টর অরবানের নেতৃত্বে হাঙ্গেরি গ্রহণ করেছে এক উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থান, যা বহুপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করে।
এগুলো স্বল্প মেয়াদে স্থিতিশীলতা দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি বহন করে। চ্যালেঞ্জ তাই এক মধ্যপথ খুঁজে পাওয়া। একটি বহুপাক্ষিকতা, যা নীতিনিষ্ঠ কিন্তু বাস্তববাদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক কিন্তু কার্যকর। এর জন্য কেবল যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের নেতৃত্ব নয়, প্রয়োজন উদীয়মান শক্তিগুলোর, আঞ্চলিক জোটগুলোর, এমনকি নাগরিক সমাজের সক্রিয় ভূমিকারও। উদাহরণস্বরূপ, ভারত একটি ন্যায়সংগত বৈশ্বিক শৃঙ্খলার পক্ষে নেতৃত্ব দিতে পারে—যেখানে সার্বভৌমত্ব, সংহতি ও টেকসই উন্নয়ন হবে মূল মূল্যবোধ।
জাতিসংঘের ৮০তম জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন যত সামনে বাড়ছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে ঝুঁকি। বর্তমান পৃথিবী সংকটহীন নয়, সহযোগিতাহীন। জাতিসংঘ নিখুঁত নয়। তবুও দাগ হ্যামারশোল্ড যেমন বলেছিলেন, জাতিসংঘ ‘মানবজাতিকে স্বর্গে পৌঁছাতে নয়, নরক থেকে রক্ষা করতে’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল—সেটাকে আবারও পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।
এ উদ্দেশ্য পূরণে জাতিসংঘ হয়তো কখনো কখনো ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু এখনো এটাই একমাত্র মঞ্চ, যেখানে সব দেশ একত্র হয়ে বিশ্বের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে পারে। এটিকে ত্যাগ করা মানে আমাদের সাধারণ মানবতার ধারণাকেই ত্যাগ করা।
বহুপাক্ষিকতা হয়তো ছিন্নভিন্ন, কিন্তু একই সঙ্গে নবজন্মের পথেও আছে। এর টিকে থাকা নির্ভর করছে স্মৃতিচারণা নয়, পুনর্জাগরণের ওপর। আর সেই পুনর্জাগরণ শুরু হয় এই উপলব্ধি থেকে যে এই বিশ্বে যতক্ষণ না সব দেশ স্বাধীন, ততক্ষণ কোনো দেশই প্রকৃত সার্বভৌম নয়।

জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত সভ্যতার প্রতিধ্বনি। কূটনীতির জয়গাথা হিসেবে জন্ম নেওয়া এই প্রতিষ্ঠান আজ অস্তিত্বসংকটে। বিশ্বের অনেক দেশই এখন এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, আর ঠিক তখনই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যুক্তরাষ্ট্র নিজেই পিছিয়ে আসতে চাইছে।
লক্ষণগুলো স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ও ইউনেসকোসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সরে এসেছে। জাতিসংঘের অনেক সংস্থায় অর্থায়নও বন্ধ বা ব্যাপকভাবে কমিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের অনুদান কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত।
যুক্তরাষ্ট্র গাজা প্রসঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে, ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের জাতিসংঘের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার ভিসা বাতিল করেছে। অধিবেশনের প্রথম দিনেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নজিরবিহীন বক্তব্যে মাল্টিল্যাটারালিজম বা বহুপাক্ষিকতার মৌলিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিনিধি সুসান রাইস সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমরা এখন আর সেই জায়গাগুলোতে খেলছি না, যেখানে একসময় বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছি।’
বহুপাক্ষিকতার এই ক্ষয় এমন একসময়ে ঘটছে, যখন পৃথিবীর আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দরকার সম্মিলিত পদক্ষেপের। ইউক্রেন, সুদানসহ নানা সংঘাতের আগুন জ্বলছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। শান্তির কোনো ইঙ্গিত নেই। ট্রাম্প প্রশাসন গাজা শান্তিচুক্তির আয়োজন করেছে, কিন্তু তা জাতিসংঘের কাঠামোর বাইরে।
জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুততর হচ্ছে, বৈষম্য বাড়ছে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের গতি শাসনব্যবস্থার সক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই পরিস্থিতিকে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক সংকট।’ তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ভূরাজনৈতিক বিভাজন আমাদের সেই ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে, যা দিয়ে আমরা কার্যকরভাবে এই সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে পারি।’
তাহলে কি বহুপাক্ষিকতা ভাঙনের পথে? জাতিসংঘ কি টিকে থাকতে পারবে ক্রমবর্ধমান এই ‘অপ্রাসঙ্গিকতার’ অভিযোগের ভেতর? এর উত্তর খুঁজতে হলে আগে বুঝতে হবে, বহুপাক্ষিকতা আসলে কী ছিল—আর এখন তা কী হয়ে উঠেছে। মূলত বহুপাক্ষিকতা মানে, এমন বিশ্বাস যে বৈশ্বিক সমস্যা (যা জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান একসময় বলেছিলেন—সীমানাহীন সমস্যা) সমাধানও হতে হবে বৈশ্বিক পরিসরে, এমন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেখানে ছোট-বড় সব রাষ্ট্রেরই সমান কণ্ঠস্বর থাকবে। এটি সার্বভৌম সমতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আইনের শাসনের ওপর দাঁড়ানো এক ব্যবস্থা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ, যেখানে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রত্যেকেরই এক ভোট, এখনো সেই আদর্শের সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রতীক।
কিন্তু বাস্তবতা সব সময়ই আদর্শকে ছায়ায় ফেলে রেখেছে। জাতিসংঘের কাঠামো, বিশেষ করে—নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতা, বৈষম্যকে স্থায়ী করে রেখেছে। জাতিসংঘের অনেক প্রস্তাব বাধ্যতামূলক নয়, বাস্তবায়নের ব্যবস্থাও দুর্বল। সাধারণ পরিষদ অনেক সময়ই পরিণত হয় বাস্তব সমাধানের বদলে রাজনৈতিক বক্তব্যের মঞ্চে। আর নিরাপত্তা পরিষদ নিজেও এখনো ১৯৪৫ সালের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে বহন করছে, যখন আমরা দাঁড়িয়ে ২০২৫-এর শেষ অংশে।
তবু জাতিসংঘ অনেক কিছু অর্জন করেছে। মানবাধিকার-সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), প্যারিস জলবায়ু চুক্তি—সবই এসেছে বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। জাতিসংঘ মানবিক সহায়তা সমন্বয় করেছে, সফল শান্তিরক্ষা মিশন চালিয়েছে, অসংখ্য আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনে ভূমিকা রেখেছে, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য প্রতিক্রিয়া গড়ে তুলেছে। এটি ছোট দেশগুলোর জন্য দিয়েছে বলার জায়গা, আর বড় দেশগুলোর জন্য শোনার বাধ্যবাধকতা। যদিও অনেক সময় তা কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
কিন্তু আজ সেই ব্যবস্থাও ভাঙনের মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দুর্বল হয়েছে, আঞ্চলিক জোটগুলোর উত্থান ঘটেছে, কূটনৈতিক নীতিমালার ঐক্য ভেঙে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গোটা ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘ কালো ছায়া ফেলেছে। উভয় পক্ষই এখন নিজেদের মতো করে সীমিত গোষ্ঠীগত বা দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় ঝুঁকছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং গাজায় ইসরায়েলের অটল অবস্থান আন্তর্জাতিক নিয়মের প্রতি আস্থা আরও দুর্বল করেছে। এমনকি যে ইউরোপে একসময় বহুপাক্ষিকতার প্রতি গভীর অঙ্গীকার ছিল, সেখানে এখন জাতীয়তাবাদের ঢেউ সেই ঐকমত্যকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপট মহৎ উদ্দেশ্যে, কিন্তু সীমিত প্রভাবের প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ এখন ঝুঁকির মুখে। তবে পতন অনিবার্য নয়। বহুপাক্ষিকতা হয়তো আঘাতপ্রাপ্ত, কিন্তু এখনো মারা যায়নি। বিশ্বনেতারা এখনো নিউইয়র্কে একত্র হন, কথা বলেন, আলোচনা করেন, তর্ক করেন—এই ঘটনাই প্রমাণ করে, বৈশ্বিক সংলাপের প্রয়োজন এখনো গভীরভাবে বিদ্যমান।
চলতি বছর শুরু হওয়া ‘ইউএন-৮০’ উদ্যোগের লক্ষ্য হলো জাতিসংঘের দায়িত্বের ভার কমানো, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং জন-আস্থা পুনরুদ্ধার। প্রতিষ্ঠান সংস্কার এখন বিলাসিতা নয়—অস্তিত্বের শর্ত। তবে বহুপাক্ষিকতার সংকট কেবল প্রাতিষ্ঠানিক নয়, তা দার্শনিকও বটে। এই সংকট এক গভীর টানাপোড়েন উন্মোচন করেছে। আর সেটি হলো—বিশ্বব্যাপী পারস্পরিক নির্ভরতা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের আওতায় থাকা ‘যেকোনো জায়গার মানুষ’ আর ‘কোনো এক বিশেষ জায়গার মানুষ’-এর আত্মপরিচয়ের মধ্যে।
ডেভিড গুডহার্টের বিশ্লেষণ এখানে প্রাসঙ্গিক। ‘কোনো এক বিশেষ জায়গার মানুষেরা’ ধর্ম, সংস্কৃতি ও স্থানীয় পরিচয়ে প্রোথিত, তারা বৈশ্বিক অভিজাত শ্রেণি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্রমশ সন্দিহান। তাদের রাজনৈতিক উত্থান—ব্রেক্সিট থেকে ট্রাম্পবাদ পর্যন্ত—বদলে দিয়েছে সেই প্রেক্ষাপট। আর এ কারণেই বহুপাক্ষিকতা টিকে থাকার লড়াই করছে।
অতএব, বহুপাক্ষিকতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শুধু প্রতিষ্ঠান সংস্কারের ওপর নয়, বৈধতা পুনর্গঠনের ওপরও। এই সংস্কারে কেবল কূটনীতিকদের নয়, সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগের প্রতিফলনও ঘটাতে হবে। প্রমাণ করতে হবে, বৈশ্বিক সহযোগিতা বাস্তব সুফল দিতে পারে—চাকরি, নিরাপত্তা, মর্যাদা সবকিছুর। এগুলো শুধু নীতিগত উচ্চারণ নয়। বহুপাক্ষিকতাকে হতে হবে কম প্রযুক্তিনির্ভর, বেশি মানবিক।
আশ্চর্যের বিষয়, যে দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে অভিবাসন ও বৈশ্বিক সম্পৃক্ততার বিরোধিতা করেছে—যেমন জাপান ও হাঙ্গেরি তারা হয়তো এই প্রতিক্রিয়ার ঝড় থেকে তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত। জাপানের সতর্ক কূটনীতি ও সাংস্কৃতিক সমরূপতা দেশটিকে পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোর মতো জনতুষ্টির চাপে পড়তে দেয়নি। অন্যদিকে ভিক্টর অরবানের নেতৃত্বে হাঙ্গেরি গ্রহণ করেছে এক উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থান, যা বহুপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করে।
এগুলো স্বল্প মেয়াদে স্থিতিশীলতা দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি বহন করে। চ্যালেঞ্জ তাই এক মধ্যপথ খুঁজে পাওয়া। একটি বহুপাক্ষিকতা, যা নীতিনিষ্ঠ কিন্তু বাস্তববাদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক কিন্তু কার্যকর। এর জন্য কেবল যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের নেতৃত্ব নয়, প্রয়োজন উদীয়মান শক্তিগুলোর, আঞ্চলিক জোটগুলোর, এমনকি নাগরিক সমাজের সক্রিয় ভূমিকারও। উদাহরণস্বরূপ, ভারত একটি ন্যায়সংগত বৈশ্বিক শৃঙ্খলার পক্ষে নেতৃত্ব দিতে পারে—যেখানে সার্বভৌমত্ব, সংহতি ও টেকসই উন্নয়ন হবে মূল মূল্যবোধ।
জাতিসংঘের ৮০তম জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন যত সামনে বাড়ছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে ঝুঁকি। বর্তমান পৃথিবী সংকটহীন নয়, সহযোগিতাহীন। জাতিসংঘ নিখুঁত নয়। তবুও দাগ হ্যামারশোল্ড যেমন বলেছিলেন, জাতিসংঘ ‘মানবজাতিকে স্বর্গে পৌঁছাতে নয়, নরক থেকে রক্ষা করতে’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল—সেটাকে আবারও পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।
এ উদ্দেশ্য পূরণে জাতিসংঘ হয়তো কখনো কখনো ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু এখনো এটাই একমাত্র মঞ্চ, যেখানে সব দেশ একত্র হয়ে বিশ্বের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে পারে। এটিকে ত্যাগ করা মানে আমাদের সাধারণ মানবতার ধারণাকেই ত্যাগ করা।
বহুপাক্ষিকতা হয়তো ছিন্নভিন্ন, কিন্তু একই সঙ্গে নবজন্মের পথেও আছে। এর টিকে থাকা নির্ভর করছে স্মৃতিচারণা নয়, পুনর্জাগরণের ওপর। আর সেই পুনর্জাগরণ শুরু হয় এই উপলব্ধি থেকে যে এই বিশ্বে যতক্ষণ না সব দেশ স্বাধীন, ততক্ষণ কোনো দেশই প্রকৃত সার্বভৌম নয়।

গত বছরের জুনে নিখিল গুপ্ত নিজের মোবাইল ফোন থেকে তাঁর এক পরিচিতজনকে একটি ভিডিও পাঠান। কানাডায় শিখদের প্রার্থনাগৃহ গুরুদুয়ারার বাইরে এক ব্যক্তিকে পরপর ৩৪টি গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি একটি গাড়ির পাশে ঢলে পড়েন। এই ঘটনারই ভিডিও সেটি।
২২ জানুয়ারি ২০২৪তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে দুই পক্ষের কূটনৈতিক যোগাযোগ ক্রমেই শীতল হচ্ছে। চীন বারবার বলছে, তাইওয়ান আমাদের অংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাইওয়ানের নিরাপত্তা আমাদের কৌশলগত স্বার্থের অঙ্গ।
১ দিন আগে
ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পন
২ দিন আগে
এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে...
২ দিন আগে